ঔপনিবেশিক আমলে "পাশ্চাত্য শিক্ষা" ও "পাশ্চাত্য সভ্যতার" প্রভাবে "মানব মুক্তি" এবং "অধিকার অর্জনের" যে আন্দোলন গুলির সূচনা হয়েছিলো, তা ভারতের দলিত সমাজকেও বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছিলো। ভারতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে দলিত সমস্যা ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরনের জন্য যে আন্দোলনের সূচনা ঘটে তা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারতীয় জনমানসে ব্যপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং আলোড়ন সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে দলিত সমস্যা ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরনে দুজন ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এদের একজন ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, অপরজন ছিলেন বি আর আম্বেদকর।
দলিত অধিকার বিষয়ে গান্ধী আম্বেদকর বিতর্ক |
(ক.) দলিত নামে কারা পরিচিত ছিলেন?
হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থাকে "বর্নপ্রথা"। সামাজিক পদমর্যাদার সিঁড়িতে কোন জাতি বা জাতের অবস্থান ঠিক কোথায়, বর্ন সেটাই চিহ্নিত করে থাকে। একই সঙ্গে সামাজিক শ্রেনিভেদ ও শ্রেনি বিন্যাসও সূচিত হয় বর্নের মাধ্যমেই।
হিন্দুসমাজে বর্ন ৪ টি। ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিনটি বর্ন হলো উচ্চবর্ন। এই ৩ বর্নই ছিলো - "দ্বিজ", অর্থাৎ জন্মের পর উপনয়ন (পৈতে ধারন) সংস্কারের মাধ্যমে এদের দ্বিতীয়বার জন্ম হতো। এই ৩ টি বর্ন হিন্দু সমাজে সর্বশ্রেষ্ঠ বর্ন বলে বিবেচিত হতো। চতুর্থ বর্নটির নাম ছিলো - শূদ্র। সামাজিক পদমর্যাদায় শূদ্ররা অপর তিন বর্নের ঠিক নীচে অবস্থান করতো।
হিন্দু সমাজে এক একটি বর্নের মধ্যে সমমর্যাদা সম্পন্ন একাধিক জাতি অবস্থান করে। যেমন "শূদ্র" বর্ন কাঠামোর মধ্যে তাঁতি, কুমোর, কামার প্রভৃতি নির্দিষ্ট কারিগরি বা হস্তশিল্প পেশায় যুক্ত জাত গুলি অবস্থান করতো। এইসব পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষ হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্য বা অছুত ছিলো না। হিন্দু সমাজের চতুর্বর্ন কাঠামোর এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো।
কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন অসম জাতি বা বর্নের সংমিশ্রনের ফলে হিন্দু সমাজে কতক গুলি নতুন জাতির সৃষ্টি হয়। যেমন - মুচি, মেথর, চন্ডাল, ডোম ইত্যাদি। এই সকল জাতিকে হিন্দুধর্মের চতুঃবর্ন কাঠামোর বাইরে রাখা হয়। এদের বলা হতো "পঞ্চম"। মড়া পোড়ানো, চামড়ার কাজ, নর্দমা সাফ করা ইত্যাদি নোংরা ও দূষন ছড়ায় এমন সব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারনে পরবর্তীকালে পঞ্চমদের "অস্পৃশ্য" বা "অছুত" বলা হয় এবং তাদের থেকে বাকি চারটি বর্নকে আলাদা থাকার ও দূরত্ব বজায় রাখার সামাজিক বিধান দেওয়া হয়।
এর ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই পঞ্চমদের প্রতি সমাজের বাকি চারটি বর্নের লোকেদের মনে ঘৃনা ও অবজ্ঞার মনোভাব সৃষ্টি হয়। পঞ্চমরা হিন্দু ধর্মের চার বর্নের শোষন, অবজ্ঞা ও ঘৃনার শিকার হয়। হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু সমাজের সমস্ত সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও অপরাপর অধিকার গুলি থেকে পঞ্চমরা বঞ্চিত ছিলেন। হিন্দু বর্ন কাঠামোর বাইরে বা একেবারে অন্তে এই প্রান্তিক শ্রেনীদের অবস্থান ছিলো বলে এদেরকে বলা হতো "অন্ত্যজ"।
উচ্চবর্নের ছোঁয়া যাতে না লাগে সেইজন্য অন্ত্যজদের দলবদ্ধভাবে একসঙ্গে ঘন্টা বাজিয়ে উচ্চবর্নের এলাকায় প্রবেশ করতে হতো। এরা উচ্চবর্নের "দলন" বা নিপীড়নের শিকার ছিলেন। এইসব কারনে মহারাষ্ট্রের অন্যতম সমাজ সংস্কারকই জ্যোতিবা রাও ফুলে অন্ত্যজদের নতুন নামকরন করেন "দলিত"।
(খ.) দলিত সমস্যার সমাধানে "গান্ধী - আম্বেদকর বিতর্ক" কী ও কেন?
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজে দলিত সমস্যা নিয়ে অনেক সমাজ সংস্কারকই সংস্কারমূলক কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু এদের কেউই দলিত সমস্যাটিকে জাতীয় স্তরে নিয়ে আসতে সক্ষম হননি, যেটা পেরেছিলেন গান্ধী ও আম্বেদকর। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, গান্ধী এবং আম্বেদকর দুজনেই দলিত সমস্যার সমাধানে অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। দুজনেই দলিত ও অস্পৃশ্য সমস্যার সমাধান করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কিন্তু দলিত ও অস্পৃশ্য সমস্যার সমাধানে দুজনের (১.) চিন্তা ভাবনা, (২.) দৃষ্টিভঙ্গি এবং (৩.) দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আন্দোলনের মত ও পথ ভিন্ন ভিন্ন ছিলো। এই নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আম্বেদকরের যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিলো, তাই ইতিহাসে "গান্ধী - আম্বেদকর বিতর্ক" নামে পরিচিত।
ভারতে সাংবিধানিক আলোচনা ও বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৩০,১৯৩১ এবং ১৯৩২ খ্রিঃ লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। গোলটেবিল বৈঠকে আম্বেদকর ও রায় বাহাদূর শ্রীনিবাস অবদমিত শ্রেনির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধী ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করেন।
গান্ধীজি প্রথম গোলটেবিল বৈঠক বয়কট করায় গান্ধী ও আম্বেদকরের মধ্যে কোন মুখোমুখি বিতর্ক হয় নি। কিন্তু ১৯৩১ খ্রিঃ গান্ধী - আরউইন চুক্তির পর মহাত্মা গান্ধী দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিলে দলিতদের আধিকার রক্ষার প্রশ্নে গান্ধীজির সঙ্গে আম্বেদকরের তীব্র মতপার্থক্য দেখা যায়। এই বৈঠকে গান্ধি ও আম্বেদকর - দুজনেই নিজেকে অবদমিত শ্রেনির প্রতিনিধি রূপে দাবি করেন।
(১.) দলিতদের স্বার্থ রক্ষা, (২.) তাদের আর্থ - সামাজিক তথা রাজনৈতিক আধিকার প্রতিষ্ঠা এবং (৩.) দলিতদের সামাজিক মুক্তি ও আত্মসম্মান প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে গোলটেবিল বৈঠকে আম্বেদকরের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর যে বিতর্ক হয় তাই ইতিহাসে দলিত অধিকার বিষয়ে "গান্ধী - আম্বেদকর বিতর্ক" নামে খ্যাত হয়ে আছে। ১৯৩২ খ্রিঃ পুনা চুক্তির মধ্য দিয়ে এই বিতর্কের মীমাংসা করার চেষ্টা করা হলেও, বাস্তবে তা হয় নি। এইসময় "বিরোধ ও বিভাজনের" আপাত সমাধান হলেও, দলিত স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে পরস্পর বিরোধী বিতর্ক রয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপিকা দেবী চ্যাটার্জী বলেছেন, দলিত সমস্যার বিষয়ে গান্ধীর মতামত ছিলো আম্বেদকরের সম্পূর্ন বিপরীত। তিনি অস্পৃশ্যতা ও দলিত সমস্যাকে হিন্দুবাদের ভেতরকার সমস্যা রূপে দেখতেন। ত্রিশের দশকের গোড়ার দিকে এই দুই নেতার মধ্যে নিস্ফল আলোচনায় তাঁদের মত পার্থক্যকের দিক গুলিকে সামনে আনে এবং পরবর্তীকালে বারবার এই পার্থক্য তীব্রতর হয়ে উঠে আসে।
(গ.) গান্ধী - আম্বেদকর বিতর্কের বিষয়বস্তু :-
দলিতদের স্বার্থরক্ষা, সামাজিক সম্মান লাভ এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার যে দিক গুলিকে নিয়ে গান্ধীজির সাথে আম্বেদকরের বিতর্ক চলেছিলো, সেই মূল দিক গুলিকে আমরা খুব সংক্ষেপে নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) বর্নপ্রথাকে সমর্থনের প্রশ্নে বিতর্ক :-
গান্ধীজি হিন্দু সমাজে দলিত সমস্যার নিরসনে ও অস্পৃশ্যতা দূর করতে কখনোই বর্নব্যবস্থার বিলোপ করতে চান নি। বর্নব্যবস্থার সঙ্গে অস্পৃশ্যতা বা দলিত সমস্যার কোন অনিবার্য সম্পর্ক আছে, একথা গান্ধীজি মানতেন না। তাঁর মতে, বর্নব্যবস্থা যদি বৃক্ষ হয়, অস্পৃশ্যতা তবে পরগাছার মতো। পরগাছাকে কাটকে গিয়ে আমরা যেন ভুল করে বৃক্ষকেই না কেটে দিই।
গান্ধীজির এই আভিমতকে আম্বেদকর মেনে নিতে পারেন নি। তিনি দলিত ও অস্পৃশ্যদের হিন্দু বর্নব্যবস্থার অপরিহার্য ফল বলে মনে করতেন। কারন বর্ন ব্যবস্থার মাধ্যমেই সামাজিক পার্থক্য, বর্ন - অবর্নের ধারনা এবং অস্পৃশ্যদের জন্ম হয়েছে। সামাজিক ভেদ সৃষ্টিকারী বর্নপ্রথার অবসান ঘটলে জাতিতে জাতিতে আর উচ্চ নীচ পার্থক্য থাকবে না। আম্বেদকরের মতে, সামাজিক পার্থক্য থাকার কারনে হিন্দুদের মধ্যে কোন জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটতে পারে না। সংকীর্ণ বর্ন সচেতনতা তাদের মানসিক জগৎকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
সুতরাং ভারতে দলিত সমস্যা এবং দলিতদের প্রকৃত সামাজিক সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সবার প্রথমে বর্নব্যবস্থার বিলোপ ঘটাতে হবে। আম্বেদকরের মতে, একই ধর্মের মধ্যে যদি বর্নভেদ থাকে তাহলে এক বর্ন অপর বর্নের প্রতি ঘৃনার মনোভাব জ্ঞাপন করবেই।
(২.) বংশানুক্রমিক কর্মবাদকে সমর্থনের প্রশ্নে দুজনের মধ্যে বিতর্ক :-
গান্ধীজির মতে, কর্ম হলো মনুষ্য সম্প্রদায়ের জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। গান্ধীজি জানতেন, পেশা বা কর্মের ওপর ভিত্তি করেই হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্যতার ধারনা এসেছে। তিনি তাই অস্পৃশ্যতার ধারনার ঘোরতর বিরোধিতা করেন। তিনি স্পষ্টতই বলেছেন, মানব জীবনে সকল কর্মই গুরুত্বপূর্ণ এবং সমান মর্যাদার অধিকারী। এক্ষেত্রে তিনি পুরোহিতের পেশার সঙ্গে মেথরের পেশার কোন পার্থক্য নেই বলে মনে করতেন। পুরোহিত পুজোপার্বন করে যে দক্ষিনা পারিশ্রমিক হিসাবে পায়, তা দিয়ে সে জীবন নির্বাহ করে। অনুরূপ ভাবে একজন মেথর নোংরা পরিষ্কার করে যে পারিশ্রমিক পায় তা দিয়েই সে জীবন যাপন করে।
গান্ধীজি বলেছেন, হিন্দু সমাজের প্রত্যেক বর্নের পূর্বপুরুষের পেশাকে ঈশ্বরের দান হিসাবেই গ্রহন করতে হবে। প্রত্যেককেই তার পূর্বপুরুষের পেশাকে উন্নত ও যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। সমাজের সকল ব্যক্তিই যদি একই পেশা অবলম্বন করে জীবন যাপন করতে চায়, তাহলে সমাজ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। তাই শূদ্রকে দৈহিক শ্রম করতেই হবে। ব্রাহ্মনদেরও যা কাজ তাকে তা করে যেতেই হবে। এই প্রথাকে মেনে নিতে হবে ঈশ্বরের দান হিসাবে। কোন মানুষ ইচ্ছা করলে শূদ্র বা ব্রাহ্মন হতে পারে না বা তার ঘরে জন্মগ্রহণ করতে পারে না।
বলা বাহুল্য, গান্ধীজির এই বংশানুক্রমিক কর্মবাদকে আম্বেদকর মেনে নিতে পারেন নি। তিনি এটাকে দলিত সমস্যা সমাধানের এবং অধিকার অর্জনের পরিপন্থী বলে মনে করতেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, সমাজের প্রগতি বজায় রাখার জন্য কর্মগুনকে প্রাধান্য দিতে হবে। বংশগত কারনে এক বর্নের মানুষ কখনই অপর বর্নের ওপর জোরপূর্বক কর্ম চাপিয়ে দিতে পারবে না। বাস্তবে উচ্চবর্নের চাপে একপ্রকার বাধ্য হয়েই দলিত শ্রেনিকে যুগ যুগ ধরে সামাজিক স্বীকৃতি লাভের পক্ষে অন্তরায় নানা অমর্যাকর কাজ করে যেতে হয়। আম্বেদকর তাই দলিত অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বংশানুক্রমিক কর্মবাদের বিরোধিতা করেন।
তিনি তাই বলেন, পুরোহিত পুজোপার্বন করবে নিজের গুনের দ্বারা, বংশের দ্বারা নয়। একই ভাবে শূদ্র বা দলিতরা পুজোপার্বন করতে পারবে নিজের গুনের দ্বারা। বংশগত কারনের যুক্তি দিয়ে তাদের এই অধিকার থেকে কখনই বঞ্চিত করা যাবে না। আম্বেদকরের মতে, বংশগত কর্মবাদের অবসানের মধ্য দিয়েই দলিত সমস্যা নিরসন ও অস্পৃশ্যতা দূর করা সম্ভব।
(৩.) সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বিতর্ক :-
আম্বেদকর দলিত সমস্যার সমাধানে বর্নব্যবস্থার পাশাপাশি জাতিভেদ প্রথারও ঘোরতর বিরোধিতা করেন। তাঁর মতে, যতদিন হিন্দু সমাজে জাতিভেদ প্রথা থাকবে, ততদিন সমাজে জাতিচ্যুতের সংখ্যা বাড়বে। এই জাতিচ্যুতরাই সমাজে দলিত ও অস্পৃশ্য বলে পরিগনিত হন। সুতরাং দলিত সমস্যার সমাধানের অন্যতম পথ হলো হিন্দু সমাজে জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করা ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত করা।
জাতিভেদ প্রথার অবসান নিয়ে ১৯৩০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে আম্বেদকরের সঙ্গে গান্ধীজির মতপার্থক্য দেখা যায়। এই সময় আম্বেদকরের জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতার উত্তরে গান্ধীজি লেখেন - অস্পৃশ্যতা জাতিভেদ প্রথা থেকে সৃষ্টি হয় নি। হিন্দু সমাজে যে উচ্চ নীচ ভেদ সৃষ্টি হয়েছে, যা হিন্দু সমাজকে ক্ষয় করে দিচ্ছে তার থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আঘাতের অর্থ হচ্ছে সমাজের উচ্চ নীচ ভেদের বিরুদ্ধেই আঘাত।
আসলে গান্ধীজি হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন না, তিনি শুধু অস্পৃশ্যতা দূর করতে চেয়েছিলেন। ফলে ১৯৩০ দশকে দলিত সমস্যা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আম্বেদকর ও গান্ধীজির সমাধান সূত্রের মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। গান্ধীজির সমাধান সূত্র ছিলো কেবলই অস্পৃশ্যতা বিরোধী। কিন্তু আম্বেদকরের সমাধানের লক্ষ্য ছিলো - হিন্দু সমাজের জাত পাত, জাতিভেদ ও চতুঃবর্ন প্রথার বিলোপ। কারন ঐ গুলিই ছিলো দলিত সমস্যা ও অস্পৃশ্যতার উৎপত্তির প্রধানতম উৎস।
(৪.) বিভিন্ন জাতের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রশ্নে বিতর্ক :-
আম্বেদকর হিন্দু সমাজের অস্পৃশ্যতা দূরীকরন ও দলিতদের যোগ্য সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য এক জাতির সঙ্গে অপর জাতির বিবাহ বন্ধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তার মতে, একমাত্র রক্তের মিশ্রনই আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে এবং বিভিন্ন জাতের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করতে পারে। হিন্দু সমাজের জাত পাত প্রথাকে ভাঙবার একমাত্র উপায় হলো বিভিন্ন জাতের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করা।
আম্বেদকর যখন বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে দলিত ও অস্পৃশ্যতা দূর করার সমাধান সূত্র পেশ করেন, তখন গান্ধীজি তার বিরোধিতা করেন। তিনি বিবাহের মাধ্যমে অস্পৃশ্যতা দূরীকরন বা দলিত অধিকার প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন।
(৫.) মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত আন্দোলনের প্রশ্নে পার্থক্য :-
দলিতরা হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও মন্দিরে প্রবেশ করার কোন অধিকার তাদের ছিলো না। গান্ধীজি এর তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, উচ্চবর্নের মানুষের বাধায় দলিতরা দেবালয়ে প্রবেশ করতে পারে না। তিনি এটিকে দলিতদের সামাজিক অধিকার লঙ্ঘনের বিষয় হিসাবেই দেখেন। এর সমাধান সূত্র হিসাবে তিনি উচ্চবর্নের মানুষের কাছে উদারতা প্রদর্শনের আবেদন রাখেন। তিনি বলেন ঈশ্বরের সাধন ভজন করার প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে। কোন মানুষই অপরকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।
মাথায় রাখতে হবে, দলিতদের সামাজিক সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে গান্ধীজি ও আম্বেদকর দুজনেই মন্দিরে প্রবেশাধিকার নিয়ে বহুবার আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে দুজনের আন্দোলনের ধারার মধ্যে পার্থক্য ছিলো। গান্ধীজি মনে করতেন, উচ্চশ্রেনির উদারতার দ্বারাই ভারতে দলিতদের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব এবং তাদের কাঙ্খিত অধিকার গুলিও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কিন্তু আম্বেদকর জানতেন সামাজিক উদারতা নয়, একমাত্র আইনী পথের মধ্য দিয়েই অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। যদিও গান্ধী আইনের মাধ্যমে হিন্দু সমাজ থেকে অস্পৃশ্যতা দূরীকরনের পক্ষপাতী ছিলেন না।
দলিতদের মন্দিরে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে তাই গান্ধীর আন্দোলনের ধারা যেখানে উচ্চবর্নের কাছে অনুরোধ উপরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো, সেখানে আম্বেদকর আইনি পথের সাহায্য নিয়ে দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব আরোপ করেন।
তাছাড়া, আম্বেদকর মনে করতেন, শুধু মন্দিরে প্রবেশের অধিকার লাভের মধ্য দিয়েই দলিত সমস্যার নিরসন হবে না। এজন্য চাই দলিতদের সমস্ত অধিকার, প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা।
(৬.) নামকরন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বিতর্ক :-
গান্ধীজি দলিতদের অস্পৃশ্যতার সমস্যাকে ধর্মীয় দিক থেকে দেখেছিলেন। তাই দলিতদের জীবনধারা থেকে অস্পৃশ্যতার অভিশাপকে দূর করার জন্য তাদের নতুন নামকরন করেছিলেন "হরিজন"। হরিজনের অর্থ ছিলো হরি অর্থাৎ ঈশ্বরের মানুষ। হরিজন নামকরনের মধ্য দিয়ে গান্ধীজি নিজেকে অস্পৃশ্যদের বন্ধু হিসাবে প্রমান করতে চান।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, হরিজন শব্দটি অস্পৃশ্যদের ক্ষেত্রে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন সন্ত নরসিনহা মেহতা নামে একজন নগর ব্রাহ্মন। ইনি নিজ সম্প্রদায়কে অগ্রাহ্য করে অস্পৃশ্যদের আপনজন হিসাবে গ্রহন করেছিলেন। অর্থাৎ দলিতদের হরিজন নামকরনটি গান্ধী প্রথম করেন নি। কিন্তু যেহেতু তিনি জাতীয় স্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, তাই তার ব্যবহৃত হরিজন নামটি নিয়ে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং তা স্বীকৃতি লাভ করে।
বলা বাহুল্য, প্রথম দিকে সমাজের উচ্চবর্নের লোকেরা অস্পৃশ্যদের হরিজন হিসাবে সমাজে স্বীকৃতি দিতে রাজি হননি। এই সময় গান্ধীজি অস্পৃশ্যদের নতুন নামকরনের জন্য বোম্বাই লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে "হরিজন" শব্দটিকে আইনি স্বীকৃতি দেবার জন্য একটি বিল পেশ করেছিলেন।
আম্বেদকর দলিত সমস্যাকে ধর্মীয় দিক থেকে দেখেন নি। তিনি এটিকে আর্থ - সামাজিক সমস্যা রূপে দেখেছিলেন। তাই ধর্মীয় ভাবাবেগ সর্বস্ব "হরিজন" নামকরনের মধ্য দিয়ে দলিত ও অস্পৃশ্যতার নিরসন ঘটবে না বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তাঁর মতে, "অস্পৃশ্য" শব্দটির মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে দলিতদের আর্থ - সামাজিক শোষন ও বঞ্চনার ইতিহাস লুকিয়ে আছে। অস্পৃশ্য শব্দটিই তাদের দুঃখ দুর্দশার পরিচায়ক। অস্পৃশ্য নামের বদলে শুধুমাত্র হরিজন নামকরনের মধ্য দিয়ে কখনই দলিতরা সকল অধিকার গুলি লাভ করতে পারবে না। এমনকি পৃথক নামকরনের মধ্য দিয়ে কখনোই বঞ্চনার ইতিহাসকে বদলে ফেলা যায় না ।
(৭.) শিক্ষা ক্ষেত্রে দলিত অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বিরোধ ও মতপার্থক্য :-
দলিতদের জীবন থেকে অস্পৃশ্যতার অভিশাপ দূর করার সমাধান সূত্র হিসাবে গান্ধীজি অস্পৃশ্যদের শিক্ষা গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি অস্পৃশ্যদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবাধ ভাবে প্রবেশের কথা বলেন। তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্পৃশ্যরা যাতে অন্য তিনটি বর্নের ঘৃনার শিকার না হয় তা শিক্ষক মহাশয় অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে দেখবেন। শিক্ষার মধ্য দিয়ে হিন্দু সমাজ থেকে অস্পৃশ্যতা দূর করা যাবে বলে গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন। এজন্য তিনি ছাত্রদের নৈতিক শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। নৈতিকতা থেকেই জন্ম নেবে ঘৃনাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা।
আম্বেদকর নিজে দলিত সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে উঠে এসেছিলেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি নানা ভাবে উচ্চবর্নের শোষনের শিকার হয়েছিলেন। আম্বেদকর খুব ভালো করেই জানতেন, উচ্চবর্ন দলিতদের শিক্ষা ও অধিকার অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায়। আম্বেদকর ১৯৪০ খ্রিঃ ২৭ আগস্ট "হরিজন সেবক সংঘের" একটি মাসিক পত্রে, "দি বম্বে ক্রনিকলের" সংখ্যায় গান্ধীজির বক্তব্যের সমালোচনা করে যুক্তি দেন - গান্ধীজি তাঁর নিজ জেলায় অস্পৃশ্যদের শিক্ষা অর্জনের জন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন নি।
আম্বেদকর লেখেন আমেদাবাদ জেলার গোদাভিতে হরিজনদের ছেলেদের স্থানীয় পর্ষদ বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য এমনভাবে নির্যাতন করা হয়েছিলো যে, ৪২ টি হরিজন পরিবার গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলো। তারা "সানন্দ" মহকুমা তালুকের চলে গিয়েছিলো। সুতরাং একথা অত্যন্ত স্পষ্ট যে গান্ধী মুখে হরিজনদের শিক্ষার কথা বললেও, নিজের জেলাতেই হরিজনদের শিক্ষা অর্জনের অধিকার সুনিশ্চিত করতে পারেন নি।
আম্বেদকর আরোও বলেন - গান্ধীর নিজের নিয়ন্ত্রনে "তিলক স্বরাজ তহবিলের" ১কোটি ২৫ লক্ষ টাকা থাকা সত্ত্বেও তা থেকে এককটাকাও গান্ধী দলিতদের শিক্ষা অথবা তাদের উন্নতির জন্য ব্যয় করেন নি।
(৮.) রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে বিতর্ক :-
দলিতদের অধিকার লাভ এবং দলিতদের জীবন থেকে অস্পৃশ্যতার অভিশাপকে দূর করার জন্য বাবাসাহেব আম্বেদকর দলিতদের বিভিন্ন সামাজিক অধিকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক অধিকারের কথা বলেন। তিনি জানতেন ভারতে দলিত সমস্যার কোন সমাধান ব্রিটিশ সরকার কখনই করবে না। কারন ইংরেজরা সবসময় ভেদ নীতিতে বিশ্বাসী।
তাই আম্বেদকর ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা এবং সেখানে দলিত সম্প্রদায়ের পৃথক প্রতিনিধিত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করে আম্বেদকর উপলব্ধি করেছিলেন প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের শাসনক্ষেত্রে উচ্চবর্নের প্রাধান্য ছিলো। দলিতরা সেখানে উপেক্ষিত ছিলো। এত যুগ ধরে যে দলিতরা পিছিয়ে আছে এটি তার একটি অন্যতম কারন।
গান্ধী যদিও রাজনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে দলিত অধিকার প্রতিষ্ঠা ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরনের পক্ষপাতী ছিলেন না। দলিত সমস্যা ও অস্পৃশ্যতার সমস্যাকে তিনি সম্পূর্ণ সামাজিক সমস্যা হিসাবে দেখেছিলেন এবং সামাজিক বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়েই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।
কিন্তু দলিত সমস্যা দূরীকরনের সমাধান সূত্র হিসাবে আম্বেদকর অস্পৃশ্যদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার গুলি থাকা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করতেন। যেভাবে উচ্চবর্নের হিন্দুরা সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার গুলি ভোগ করে চলেছে, সেগুলি যদি অস্পৃশ্যরা পায়, তবেই সমাজ থেকে অস্পৃশ্যতা দূর হবে।
(৯.) পৃথক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে গোলটেবিল বৈঠকে চরম বিতর্ক :-
আম্বেদকর দলিতদের জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে আসন সংরক্ষণের আশায় ১৯৩০ খ্রিঃ গোড়ায় লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন এবং দলিতদের আসন সংরক্ষণের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন।
আম্বেদকর গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, "এদেশে ব্রিটিশ সরকার ধাপে ধাপে যে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের কাজকর্মের পরিধি বাড়িয়েছে, তাতে দলিত সম্প্রদায়কে নিয়মমাফিক ভাবেই উপেক্ষা করা হয়েছে। তারাও যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দাবি করে, সে ব্যাপারে কোন চিন্তা ভাবনাই করা হয় নি। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং বলছি আমাদের সমস্যার সমাধান করতে হবে দেশের সাধারন রাজনৈতিক সমস্যার একটি অঙ্গ হিসাবে।" অর্থাৎ এই সময় আম্বেদকর তথ্যনিষ্ঠ যুক্তি দিয়ে প্রচার করেন, অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক অধিকার ও ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়েই অস্পৃশ্যতার দূরীকরন সম্ভব।
১৯৩১ খ্রিঃ লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধীজি যোগদান করেন। এই বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিলো ভারতের স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সংবিধান প্রনয়ন করা। এই বৈঠকে আম্বেদকর প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থায় দলিতদের আসন সংরক্ষণের জন্য এক মোক্ষম যুক্তি দেন।
তিনি বলেন, ভারত যদি স্ব শাসিত দেশ হতে চায় তবে এর সরকারকে জনগনের সরকার, জনগনের দ্বারা গঠিত সরকার এবং জনগনের জন্যই সরকার হতে হবে। কিন্তু ভারতের জনগন যখন বিভিন্ন জাত ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত তখন এটি কিভাবে রূপায়িত হতে পারে? এর একটাই উপায় আছে, তা হলো আইনসভা ও শাসনবিভাগে জনসংখ্যার অনুপাতে সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা।
আম্বেদকরের প্রখর যুক্তিতে গোলটেবিল বৈঠকে দলিত ও অস্পৃশ্যতার সমস্যাটি নতুন ভাব ও গুরুত্ব লাভ করে। এই সময় কংগ্রেস উপলব্ধি করতে পারে, ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করতে হলে অস্পৃশ্যদের দাবি পূরন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা থেকে এটিও উঠে আসে স্বাধীন ভারতে দলিতদের কি হিন্দুদের দয়ার ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে, নাকি সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের নীতি অনুসারে তাদের নিজেদের সুরক্ষার উপায় তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে? এই সময় গোলটেবিল বৈঠকে দলিতদের পৃথক প্রতিনিধিত্বের বিষয়টির গুরুত্বকে সকলে অনুধাবন করলেও গান্ধীজি এর তীব্র বিরোধিতা করেন।
(ঘ.) সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ও পুনা চুক্তি :-
তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের শেষে ব্রিটিশ সরকার দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি মেনে নেয়। ১৯৩২ খ্রিঃ ১৬ অক্টোবর, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার রেমসে ম্যাকডোনাল্ড সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষনা করেন। এই ঘোষনার মাধ্যমে ভারতের মুসলমান, শিখ, ভারতীয় খ্রিষ্টান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং হিন্দুদের নিন্মহিন্দু ও সাধারন হিন্দু এই দুভাগে বিভক্ত করে আইনসভায় পৃথক প্রতিনিধিত্ব ও পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা ঘোষনা করেন।
এইসময় মহাত্মা গান্ধী দলিতদের পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করেন। অস্পৃশ্যদের পৃথক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গান্ধী ও আম্বেদকরের মধ্যে চরম মতপার্থক্যের সৃষ্টি হলে এর দরুন তাদের অস্পৃশ্যতা দূরীকরনের আন্দোলনের ধারা প্রকাশ্যে জনগনের সামনে চলে আসে।
ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক অস্পৃশ্যদের পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর ঘোষনাকে মহাত্মা গান্ধী হিন্দু সমাজের বিভাজন হিসাবে আখ্যায়িত করেন এবং এর প্রতিবাদে গুজরাটের যারবেদা জেলে অনশন শুরু করেন। গান্ধীজির এই অনশনকে আম্বেদকর দলিতদের চাপে রাখার কৌশল হিসাবে আখ্যায়িত করেন।
শেষপর্যন্ত গান্ধিজির বিরোধিতা ও অনশনের চাপে আম্বেদকর অবদমিত শ্রেনীর জন্য পৃথক নির্বাচনমন্ডলীর দাবি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। এইসময় অনশনে গান্ধীজির শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে জাতীয় কংগ্রেসের অনেক নেতা আম্বেদকর কে পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর দাবি থেকে সরে আসার জন্য অনুরোধ করেন। ১৯৩২ খ্রিঃ ২৪ শে সেপ্টেম্বর গান্ধী ভক্ত রাজেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে আম্বেদকরের পুনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঠিক হয়, দলিতদের পৃথক আসন সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে হিন্দুরা একত্রিত ভাবে যৌথ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করবে।
(ঙ.) গান্ধী - আম্বেদকর বিতর্কের নিস্পত্তিতে আম্বেদকরের ভূমিকা :-
পুনা চুক্তির পর গান্ধীজি দলিত সমস্যা ও দলিতদের অধিকার অর্জনের জন্য পূর্বের তুলনায় আরোও শক্তিশালী আন্দোলন ও দৃঢ়তর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীজির সেইসব আন্দোলন ও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আম্বেদকর নানাবিধ যুক্তির অবতারণা করে গান্ধীজির দলিত বা হরিজন আন্দোলনের অসাড়তা প্রমান করার চেষ্টা করেন। যার বেশ কিছু ইতিপূর্বেই আমরা "গান্ধী আম্বেদকর বিতর্কের বিষয়বস্তু" অংশে পর্যালোচনায় তুলে ধরেছি।
সুতরাং বলা যায়, পুনাচুক্তির দ্বারা গান্ধী আম্বেদকর বিতর্কের অবসান হয় নি। কারন দলিতরা তখনোও তাদের প্রাপ্য অধিকার পায় নি। গান্ধী অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার অর্জনের পক্ষে যেসব যুক্তি ও পদক্ষেপ করেন তা দলিতদের সমস্যা দূরীকরনে তেমন সাহায্য করে নি। ফলে দলিত সমস্যা নিরসনে গান্ধী ও আম্বেদকরের গৃহীত নীতি, পদ্ধতি ও আন্দোলন নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়। এজন্য সংবিধানে খসড়া কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ডঃ বি আর আম্বেদকরকে দলিত স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়।
(চ.) গান্ধী - আম্বেদকর বিতর্কের বৈশিষ্ট্য :-
গান্ধী - আম্বেদকর বিতর্কের বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করার পর এর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
১. গান্ধী ও আম্বেদকর দুজনেই আন্তরিক ভাবে ভারতে দলিত সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন। গান্ধী ও আম্বেদকর দুজনেই গোলটেবিল বৈঠকে ও অন্যান্য সময়ে নিজেদের দলিতদের প্রতিনিধি হিসাবে দাবি করলেও, গান্ধীর দাবিকে অস্পৃশ্যরা গ্রহন করেন নি। তারা আম্বেদকরকেই তাদের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসাবে গ্রহন করেছিলো।
২. দলিত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আম্বেদকরের চাইতে গান্ধীজির ভূমিকা ছিলো অনেক সীমিত। গান্ধী শুধুমাত্র সামিজিক প্রেক্ষিত ও দৃষ্টিভঙ্গিতে দলিত সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আম্বেদকর বৃহত্তর আর্থ - সামাজিক তথা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলিত সমস্যার বিষয়টিকে দেখেছিলেন এবং তার সমাধান করতে চেয়েছিলেন।
৩. গান্ধীজির দলিত আন্দোলনের লক্ষ্য ছিলো শুধুমাত্র অস্পৃশ্যতার অবসান ঘটানো। কিন্তু আম্বেদকর অস্পৃশ্যতার পাশাপাশি হিন্দু সমাজের বর্নপ্রথা ও জাতপাতেরও অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন।
৪. আরেকটি বিষয় হলো, গান্ধীজি অস্পৃশ্য বা দলিতদের কখনো একটি পৃথক শ্রেনী হিসাবে দেখেন নি। এইজন্য তাদের মুক্তির ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি কোন বাস্তবিক পথের সন্ধান দিতে পারেন নি।
৫. কিন্তু আম্বেদকর অস্পৃশ্য ও দলিতদের পৃথক শ্রেনি হিসাবে দেখেছিলেন। তাই তাদের মুক্তি ও অধিকার অর্জনের পক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও সাংবিধানিক এবং আইনি রক্ষাকবচের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। আম্বেদকরের মত ও পথ দলিতদের কাছে গান্ধীর চাইতে অনেক বেশি বিজ্ঞান সম্মত ও গ্রহনযোগ্য হয়েছিলো বলে পরবর্তীকালে আম্বেদকর অস্পৃশ্যদের কাছে মুক্তিযোদ্ধার নায়ক হিসাবে পরিগনিত হন।
৬. গান্ধী ও আম্বেদকর দুজন সমাজ সংস্কারকই আজীবন অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এদের কেউই অস্পৃশ্যতা টিকে থাকবার অন্যতম প্রধান শর্ত ভারতের সামন্তবাদী ভূমি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারন করেন নি। আম্বেদকর এই প্রসঙ্গে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেও নানা ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন।
৭. গান্ধী - আম্বেদকর বিতর্কের আরেকটি বিশেষত্বের দিক হলো তাদের আগে অনেক সংস্কারকই দলিত সমস্যা, অস্পৃশ্যতা দূরীকরন ও দলিত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করলেও, তাদের কেউই গান্ধী বা আম্বেদকরের মতো বিষয় গুলিকে জাতীয় আন্দোলনের সামনের সারিতে নিয়ে আসতে পারেন নি, বা প্রকাশ্যে জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেন নি।
গ্রন্থঋন :-
১. অস্পৃশ্যতা নিবৃত্তিকরনের ক্ষেত্রে গান্ধী ও আম্বেদকরের ধারনার তুলনামূলক পর্যালোচনা - স্বপন সরকার।
২. ভারতের সভ্যতা ও সমাজ বিকাশে ধর্ম শ্রেনী ও জাতিভেদ - সুকোমল সেন।
৩. পতিত - দেবী চ্যাটার্জী