আইন অমান্য পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

ভারতে গান্ধীজির ডাকে ১৯৩০ খ্রিঃ আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। মোট দুটি পর্বে আইন অমান্য আন্দোলন সংগঠিত হয়। ১৯৩০ খ্রিঃ থেকে ১৯৩১ খ্রিঃ ৫ ই মার্চ পর্যন্ত ছিলো আইন অমান্য আন্দোলনের প্রথম পর্ব১৯৩১ খ্রিঃ ৫ ই মার্চ গান্ধী আরউইন চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে আইন অমান্য আন্দোলন সাময়িক ভাবে স্থগিত থাকে। গান্ধীজি দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগাদানের জন্য লন্ডন যান।

 কিন্তু গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে আইন অমান্য আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।১৯৩২ খ্রিঃ থেকে ১৯৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত চলেছিলো আইন অমান্য আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব

১৯৩০ খ্রিঃ থেকে ১৯৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত সমগ্র সময়কালটিকেই এককথায় বলা হয়ে থাকে "আইন অমান্য পর্ব"। আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা ছিলো অনেক কম

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন
আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন 


(ক.) বৈশিষ্ট্য :-

এই পর্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি ছিলো -

(i.) ১৯৩০ খ্রিঃ প্রথম দিক এবং ১৯৩৪ খ্রিঃ ছাড়া এই পর্বে তেমন উল্লেখযোগ্য শ্রমিক আন্দোলন সংঘটিত হয় নি
(ii.) ১৯৩০ খ্রিঃ আইন অমান্য আন্দোলনের প্রথম পর্বে শ্রমিক শ্রেণী অংশগ্রহণ করলেও, ১৯৩২ - ৩৪ সালের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণী সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করে নি
(iii.) অসহযোগ আন্দোলনের তুলনায় আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর উপস্থিতি ও সক্রিয়তা দুই - ই কম ছিলো। 
(iv.) তাছাড়া, এই পর্বের শ্রমিক আন্দোলন গুলির তীব্রতা ছিলো অনেক কম। ধর্মঘটের সংখ্যাও ছিলো যথেষ্ট কম।
(v.) আইন অমান্য আন্দোলনের প্রথম পর্বে সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়নে ভাঙ্গন ও নেতৃত্বের মধ্যে মতাদর্শগত বিরোধ এবং শেষ পর্বে সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনে শ্রমিক নেতৃত্বের পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া - এই পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্যনীয় বৈশিষ্ট্য ছিলো। 
(vi.) কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে বিরোধ ও মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব এই পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন করেছিলো।

(খ.) আন্দোলন বিমুখতার কারন :-

আইন অমান্য পর্বে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন বিমুখতার পিছুনে একাধিক কারন ছিলো। 

(১.)  আইন অমান্যে শ্রমিক স্বার্থযুক্ত কর্মসূচির অনুপস্থিতি :- 

১৯৩০ খ্রিঃ গান্ধীজির আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচিতে কৃষকদের ভূমিরাজস্বের পরিমান ৫০% হ্রাস করার কথা বলা থাকলেও, শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য কোন কর্মসূচি বা দাবি আইন অমান্য আন্দোলনে ছিলো না। গান্ধীজি সব সময়ে রাজনৈতিক স্বার্থে শ্রমিকদের ব্যবহার করার বিরোধী ছিলেন। শ্রমিক স্বার্থের কোন দাবি বা কর্মসূচি না থাকায় আইন অমান্য আন্দোলনের প্রতি শ্রমিক শ্রেণীর কোন আত্মিক টান বা সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি। 

(২.) মহামন্দার প্রভাব :- 

১৯৩০ খ্রিঃ বিশ্বব্যাপী মহামন্দা শ্রমিক শ্রেণীর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। মন্দার ফলে বিশ্ববাজারে শিল্প জাত পন্য ও কৃষিজাত পন্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় মালিকরা কলকারখানায় উৎপাদন কমিয়ে দেন। এর ফলে শ্রমিক ছাঁটাই, শ্রমিকদের ভাতা ও বেতন হ্রাস এবং শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক বসিয়ে রাখার মতো ঘটনা ঘটে।

মন্দার ব্যাপক প্রভাব বাংলার পাটকল গুলিতে দেখা গিয়েছিলো। দেশের অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রেও এর প্রভাব দেখা যায়। এর ফলে শ্রমিক শ্রেণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। কাজের অনিশ্চয়তা ও ব্যাপক ছাঁটাইয়ের ফলে শ্রমিকদের শক্তিহীনতা এই পর্বের আন্দোলন বিমুখতার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কারন ছিলো।

(৩.) শ্রমিক সংগঠনে ভাঙ্গন :- 

শ্রমিক সংগঠনে (ক.) নেতাদের মধ্যে দলাদলি  এবং (খ.) কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের মধ্যে বিরোধ আইন অমান্য পর্বের শ্রমিক আন্দোলনকে দুর্বল করেছিলো।

১৯২৯ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে AITUC র নাগপুর সম্মেলনে বামপন্থী শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে সংস্কারপন্থী শ্রমিক নেতাদের বিরোধ দেখা যায়। এই সময় এন এম যোশী, ভি ভি গিরির মতো সংস্কারপন্থী ও সরকারের সঙ্গে আপোস নীতিতে বিশ্বাসী শ্রমিক নেতারা AITUC থেকে বেরিয়ে এসে "All India Trade Union Federation" নামে আলাদা একটি শ্রমিক সংগঠন গঠন করেন। এই শ্রমিক সংগঠনটি শ্রমিকদের রাজনৈতিক আন্দোলনের বিরোধী ছিলো।

অন্যদিকে কমিউনিস্টরা আবার জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে একসঙ্গে থেকে আন্দোলন করতে অস্বীকার করে। কংগ্রেসের পুঁজি ও শ্রমের সুসম্পর্কের তত্ত্ব এবং কমিউনিস্টদের শ্রেনী সংগ্রামের তত্ত্ব একে অপরের পরিপন্থী ছিলো। এমতাবস্থায় AITUC থেকে বেরিয়ে এসে কমিউনিস্টরা ১৯৩১ খ্রিঃ "Red Trade Union Congress" নামে পৃথক একটি শ্রমিক সংগঠন গঠন করে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন AITUC র ভাঙ্গন শ্রমিক আন্দোলনকে দুর্বল করেছিলো।

পর পর দুবার সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠনে ভাঙ্গনের ফলে রেল শ্রমিক কর্মচারীদের অনেক সংগঠনই নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যায়। বাংলার চটকলবোম্বাইয়ের নাগপুরের বস্ত্রশিল্পেও একই অবস্থা ঘটেছিলো। 

(৪.) শ্রমিক নেতৃত্বের আপোষমুখী নীতি :-

১৯৩০ দশকে মহামন্দার প্রভাবে কাজের অনিশ্চিত পরিবেশ, কর্মের নিশ্চয়তা না থাকা শ্রমিক শ্রেনীকে সর্বদাই শঙ্কিত করে রেখেছিলো। ব্যাপক ছাঁটাইয়ের ফলে শ্রমিক শ্রেণীও সংখ্যার দিক থেকে ছিলো যথেষ্ট দুর্বল। এমতাবস্থায় মালিকদের একের পর এক শ্রমিক বিরোধী নীতি শ্রমিক আন্দোলনকে আরোও দুর্বল করে দেয়। মন্দার কারন দেখিয়ে মালিক শ্রেনী শ্রমিকদের বেতন হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিলে বেশ কিছু ইউনিয়ন শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।

শ্রমিক নেতৃত্বের এই আপোষমুখীনতার কারনেই আইন অমান্য পর্বে কোন শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হতে পারে নি। 

(৫.) কমিউনিস্ট নেতৃত্বের নিস্ক্রিয়তা :-

১৯২৭ খ্রিঃ থেকে শ্রমিক সংগঠনে কমিউনিস্টরা ব্যাপক সক্রিয়তা দেখান। এই সময় অধিকাংশ শ্রমিক সংগঠনই বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রনে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু ১৯২৮ খ্রিঃ পর থেকেই কমিউনিস্ট নেতৃত্ব জাতীয় আন্দোলন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করেন

কমিউনিস্টরা ষষ্ঠ কমিন্টার্নের নির্দেশ অনুসারে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকায় শ্রমিক আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠতে পারে নি। 

(৬.) সরকারি দমন নীতির প্রভাব :-

আইন অমান্য পর্বে শ্রমিক আন্দোলনে মন্দা দেখা যাওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারন ছিলো সরকারি দমন নীতি। ১৯২৯ খ্রিঃ শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার দ্বিমুখী রনকৌশল অবলম্বন করে। ১৯২৯ খ্রিঃ সরকার "ট্রেড ডিসপিউট অ্যাক্টপ্রনয়ন করে। এই আইনে
শ্রমিকদের ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষনা করা হয় এবং মালিকদের সঙ্গেও শ্রমিকদের বিরোধকে ট্রাইবুনালের দ্বারা নিস্পত্তি করার কথা বলা হয়।

এছাড়া, ১৯২৯ খ্রিঃ মার্চ মাসে ৩১ জন প্রথম সারির কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তার করে "মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা" দায়ের করে। এর ফলে কমিউনিস্ট পরিচালিত শ্রমিক আন্দোলনে বিরাট নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা যায়। কমিউনিস্টদের দমন করে সরকার একদিকে শ্রমিক আন্দোলনের কন্ঠোরোধ করার চেষ্টা করেছিলো, অন্যদিকে ভারতে সোভিয়েত রাশিয়ার সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলো। ১৯২৯ খ্রিঃ শীর্ষ স্থানীয় কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতারা জেলে বন্দি থাকায় শ্রমিক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এসেছিলো। ১৯৩০ খ্রিঃ শ্রমিক আন্দোলন সংঘবদ্ধ হয়ে উঠতে না পারার এটি একটি বড়ো কারন ছিলো।

(৭.)  Royal Commission গঠন :-

১৯৩০ দশকে শ্রমিক আন্দোলনের মন্দার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারন ছিলো শ্রম সংক্রান্ত রাজকীয় কমিশন গঠন। ১৯২৯ খ্রিঃ "Royal Commission on Labour" গঠন করে শ্রমিকদের কিছুটা আশ্বস্ত করা হয়।

মোটকথা, একদিকে রাষ্ট্রীয় দমন নীতি অন্যদিকে শ্রমিক ঐক্যে ভাঙ্গন - এই দুয়ের ফলে ১৯৩১ সালের পর শ্রমিক আন্দোলনে ভাটার টান দেখা যায়।

(গ.) আইন অমান্য পর্বে শ্রমিক আন্দোলনের পরিচয় :- 

আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকরা সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও, শ্রমিক আন্দোলনের ধারাটি একেবারেই লুপ্ত হয়ে যায় নি। জাতীয়তাবাদী ঘটনাবলীর প্রভাবে ১৯৩০ খ্রিঃ প্রথম দিকে বেশ কয়েকটি শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত হয়।

(i.) স্বাধীনতা দিবসের সমর্থনে আন্দোলন :-

১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় কংগ্রেস প্রতীকি স্বাধীনতা দিবস পালন করলে তা শ্রমিক শ্রেনীকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। এই ঘটনার অল্প কয়েকদিন পরে ১৯৩০ খ্রিঃ ৪ ফেব্রুয়ারি বোম্বাইয়ের প্রায় কুড়ি হাজার শ্রমিক পূর্ন স্বরাজের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এদের অধিকাংশই ছিলেন রেল শ্রমিক

(ii.) লবন সত্যাগ্রহের সমর্থনে শ্রমিক আন্দোলন :-

১৯৩০ খ্রিঃ ৬ ই এপ্রিল লবন সত্যাগ্রহের মাধ্যমে গান্ধীজি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে তা শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যেও গভীর উদ্মাদনার সঞ্চার করে। ঐ দিনই বোম্বাইয়ের "গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে মেনস্ ইউনিয়নের" শ্রমিকরা এক অভিনব কায়দায় সত্যাগ্রহ শুরু করেন। 

উত্তর বোম্বাইয়ের শহরতলীর রেল স্টেশন গুলিতে তারা দলে দলে লাল ঝান্ডা নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন। লাইন পরিস্কার করার জন্য এইসময় পুলিশ প্রতিবাদী শ্রমিকদের ওপর গুলি চালালে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই সময় পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় ও গ্রেপ্তার শুরু করলে জাতীয় কংগ্রেস এর প্রতিবাদে ৬ ই জুলাই "গান্ধী দিবস" পালন করে। সেদিন প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে এবং ৪৯ টি কারখানার শ্রমিকরা কর্মস্থলে হাজির হলেও কর্মবিরতি পালন করে। 

(iii.) গান্ধীজির গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ধর্মঘট :-

১৯৩০ খ্রিঃ ৪ ঠা মে গান্ধিজিকে আইন অমান্যের অপরাধে গ্রেপ্তার করা হলে সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বোম্বাই শহরের কয়েক লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে। এই জনসমুদ্রে বোম্বাইয়ের কাপড়ের মিলের ও রেলের হাজার হাজার শ্রমিক যোগ দেয়। বস্ত্র ব্যবসায়ীরা ছদিন ধরে ধর্মঘট করেন। 

(vi.) মহারাষ্ট্রের শোলাপুরের ধর্মঘট :-

আইন অমান্য পর্বে শ্রমিক আন্দোলনের উজ্জ্বল নজির স্থাপন করেছিলেন মহারাষ্ট্রের শোলাপুরের শ্রমিকরা১৯৩০ খ্রিঃ ৭ ই মে গান্ধীর গ্রেপ্তারের খবর শুনে শোলাপুরের বস্ত্রকল শ্রমিকরা ধর্মঘটে সামিল হন। উত্তেজিত মিল শ্রমিকরা স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মিলে মদের দোকান গুলিতে আগুন লাগিয়ে দেন এবং রেল স্টেশন, আদালত, থানা ও পৌরভবন গুলি আক্রমণ করেন। ব্রিটিশ প্রশাসনকে অকেজো করে তারা শহরের পুরো কর্তৃত্ব দখল করে।

এই সময় পুলিশের গুলিতে বহু শ্রমিকের মৃত্যু হলে উত্তেজিত জনতা ছটি থানা পুড়িয়ে দেয় এবং ২ জন পুলিশকে হত্যা করে। আদালত চত্বরও অগ্নিদগ্ধ হয়। পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলে জেলাশাসক ও পুলিশ কর্তারা শোলাপুর ত্যাগ করেন। এরপরেই শোলাপুরের শ্রমিকরা একটি সমান্তরাল প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেন। ১০ ই মে থেকে ১২ মে পর্যন্ত শোলাপুরে ব্রিটিশ সরকারের কোন অস্তিত্ব ছিলো না। 

শেষপর্যন্ত সামরিক আইন জারি করে শোলাপুরের শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করা হয়। শোলাপুরের শ্রমিক নেতা শ্রীকৃষ্ণ সারদা, কুরবান হোসেন, মালাপ্পা ধনেশেষ্ঠী ও জগন্নাথ সিন্ধেকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।

শোলাপুর অভ্যুত্থানের ৪ জন নেতার মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ বোম্বে ও আমেদাবাদের মিল শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। শোলাপুরের অভ্যুত্থান ছিলো মূলত শ্রমিক শ্রেণীর অভ্যুত্থান।

(v.) কলকাতায় ঠেলাগাড়ি শ্রমিকদের ধর্মঘট :- 

আইন অমান্য আন্দোলনের সময় কলকাতা পুলিশ দুপুর বেলা মোষের গাড়ি চালানো বন্ধ করে এক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর প্রতিবাদে ১৯৩০ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় ও আব্দুল মোমিনের নেতৃত্বে কলকাতায় মোষের গাড়ির গাড়োয়ানরা পথ অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করেন। পুলিশ গুলি চালিয়েও অবরোধকারীদের বাগে আনতে পারে নি। এমতাবস্থায়, আন্দোলনের চাপে পড়ে সরকার শেষ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়। 

(vi.) অন্যান্য স্থানের শ্রমিক ধর্মঘট :-

আইন অমান্য পর্বে আরোও বেশ কিছু ধর্মঘট ও শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হয়।

আইন অমান্যকে কেন্দ্র করে ধর্মঘট করেন - 
(ক.) করাচির ডক শ্রমিকরা 
(খ.) মাদ্রাজের চুলাই মিল শ্রমিকরা। 
(গ.) জাতীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের পর বজবজ মিল শ্রমিকরা এবং
(ঘ.) কলকাতার পরিবহন শিল্প শ্রমিকরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। 

(ঘ.) শ্রমিক আন্দোলনের গতি প্রকৃতি :- 

আইন অমান্য পর্বে শ্রমিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির দিকটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় -

 (১.) ১৯৩০ খ্রিঃ প্রথমার্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাবে বেশ কয়েকটি জায়গায় শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘট সংগঠিত হয়। 
(২.) কিন্তু ১৯৩১ সালের পর শ্রমিক আন্দোলনে কিছুটা ভাটার টান দেখা যায়। ১৯৩১ খ্রিঃ নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনকে মিলনের বা ঐক্যবদ্ধ হবার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তাতে বিশেষ সাড়া পাওয়া যায় নি। 
(৩.) ১৯৩২ সালে মোট  ১১৮ টি শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত হয় এবং এতে প্রায় এক লক্ষ আঠাশ হাজার শ্রমিক অংশগ্রহণ করে। 
(৪.) ১৯৩৩ ও ১৯৩৪ খ্রিঃ ধর্মঘটের সংখ্যা ছিলো যথাক্রমে ১৪৬ ও ১৫৯ টি। প্রায় দেড় থেকে আড়াই লক্ষ শ্রমিক এই সব ধর্মঘট গুলিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই সময় বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়ন গুলি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। 
(৫.) এই উপলব্ধি থেকেই ১৯৩৩ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি মাসে রেল শ্রমিক কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন মিলিত হয়ে গঠন করে "ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ লেবার"। অন্যদিকে এই বছরেই এপ্রিল মাসে "ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন" ও নবজাত "ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ লেবার" একত্রিত হয়ে "ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন" গঠন করে। এই সংগঠনের প্রধান নেতৃত্বের মধ্যে ছিলেন - ভি ভি গিরি, গুরুস্বামী, যমুনা দাস মেহতা। 

(ঙ.) কমিউনিস্টদের কর্মতৎপরতা ও প্রভাব :-

আইন অমান্য পর্বে বিদেশী মালিকানাধীন চটকলভারতীয় মালিকানাধীন কাপড়ের কল গুলিতে ব্যাপক শ্রমিক ছাঁটাইবেতন হ্রাসের ফলে শ্রমিকদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ট্রেড ইউনিয়ন গুলির অনৈক্যের কারনে এইসময় শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনের যথেষ্ট উপাদান থাকা সত্ত্বেও, ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করা যায় নি। তবু এক্ষেত্রে বেশ কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্টরা পুনরায় AITUC র কাছাকাছি আসে। এর পরের বছর "রেড ট্রেড ইউনিয়নের কংগ্রেস" সদস্যরা পুনরায় AITUC তে যোগদান করেন। এর ফলে আইন অমান্য আন্দোলন পর্বের শেষে পুনরায় সাংগঠনিক স্তরে শ্রমিক ঐক্য জোরদার হয়ে উঠতে শুরু করে। 

আইন অমান্য আন্দোলনের একেবারে শেষ প্রান্তে ১৯৩৪ খ্রিঃ শোলাপুর, নাগপুর ও বম্বেতে বড়ো ধরনের শ্রমিক ধর্মঘট সংঘটিত হয়। এই ধর্মঘট গুলি সংগঠিত করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। ব্রিটিশ সরকার এজন্য শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্টদের প্রভাব খর্ব করার জন্য ১৯৩৪ খ্রিঃ ২৮ শে জুলাই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। 

১৯৩৪ খ্রিঃ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও, ঐ বছর জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ১৯৩৪ খ্রিঃ আচার্য নরেন্দ্র দেব ও জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে "কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টি" প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দল AITUC র অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল মনে করতো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি দেশের বৃহত্তম অংশ শ্রমিক কৃষকদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষারও প্রয়োজন আছে। 

এইসময় শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গের মতো এক শ্রেনীর কমিউনিস্ট নেতার বোধদয় হয়, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে থেকে শ্রমিকদের মঙ্গল করা যাবে না। এজন্য তারা কংগ্রেস সোসালিস্ট দলের সঙ্গে সহযোগীতা করতে থাকেন। ফলে ১৯৩৪ খ্রিঃ শ্রমিক সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ চেহারা পুনরায় ফিরে আসে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৩৫ সাল থেকে শ্রমিক আন্দোলনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো


প্রতি রবিবার প্রকাশিত হয় নতুন লেখা। *** প্রতি রবিবার প্রকাশিত হয় নতুন লেখা। *** প্রতি রবিবার প্রকাশিত হয় নতুন লেখা। **** প্রতি রবিবার প্রকাশিত হয় নতুন লেখা।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post