শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি গান্ধীজি ও জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিলো?

ভারতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো কংগ্রেস কোন বিশেষ শ্রেনী বা সম্প্রদায়ের জন্য লড়াই করবে নাভারতের জাতি,ধর্ম, বর্ন ও অঞ্চলে বিভক্ত মানুষদের সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করার কাজ কংগ্রেস করে যাবে। ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি ও কাজকর্মের মধ্যে এই চিন্তাভাবনারই বাস্তব প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।

শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি গান্ধীজি ও জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিলো?
শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি গান্ধীজি ও জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিলো? 



ভারতে যন্ত্রশিল্পের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে " শিল্প শ্রমিক" নামে একটি নতুন শ্রেনীর আত্মপ্রকাশ করেছিলো। আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী ১৯১১ খ্রিঃ ৩০৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে সংগঠিত শিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা ছিলো ২.১ মিলিয়ন। ১৯১১ থেকে ১৯২১ খ্রিঃ মধ্যে এদের সঙ্গে যুক্ত হয় আরোও ৫,৭৫০০০ জন। এই পরিসংখ্যানের বাইরে অবশ্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের বহু শ্রমিকরাও ছিলো। এদের একটা বড়ো অংশ বিভিন্ন বন্দরে, বাজারে, দোকানে, বাড়িতে ভৃত্য বা ঝাড়ুদারের কাজ করতো। অত্যন্ত কম বেতনে, অমানুষিক পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে ভারতীয় শ্রমিকদের কাজ করতে হতো। তাদের কাজের নিরাপত্তা বলেও কিছু ছিলো না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত কংগ্রেস "দলীর" ভাবে শ্রমিক শ্রেণীকে নিয়ে কোন চিন্তা ভাবনা করে নি। তবে কংগ্রেসের অনেক নেতাই বিভিন্ন সময়ে শ্রমিক সংগঠনে ব্যক্তিগত ভাবে যুক্ত থেকেছিলেন। এক্ষেত্রে সবার আগে যার নাম করতে হয়, তিনি হলেন মহাত্মা গান্ধী। মনে রাখতে হবে, শ্রমিকদের প্রতি জাতীয় কংগ্রেসের দলীয় অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি গান্ধীর চিন্তা ভাবনা দ্বারাই প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছিলো

১৯১৮ খ্রিঃ আমেদাবাদের কাপড়ের কলে মিল মালিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের মজুরি সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেছিলো। এইসময় শ্রমিকরা বোনাস, ছাঁটাই বন্ধ এবং ৫০% মজুরি বৃদ্ধির দাবি করে। ১৯১৮ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি - মার্চ মাসে গান্ধীজি শ্রমিকদের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং ৩৫% মজুরি বৃদ্ধির জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। শেষপর্যন্ত সুতাকলের মালিকরা গান্ধীজির প্রস্তাব মেনে নেন।

গান্ধীজির আমেদাবাদ সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়েই কংগ্রেস দলীয় ভাবে শ্রমিক সমস্যার বিষয়টি উপলব্ধি করে। কংগ্রেসের পরবর্তী অধিবেশন গুলিতে এই চিন্তা ভাবনার বাস্তব প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ১৯১৮ খ্রিঃ আমেদাবাদ সত্যাগ্রহের ঠিক পরের বছরটিতেই জাতীয় কংগ্রেস শ্রমিক সমস্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছিলো ১৯১৯ খ্রিঃ অমৃতসর অধিবেশনে। জাতীয় কংগ্রেসের এই অধিবেশনে প্রতিটি প্রাদেশিক সংগঠনকে শ্রমিক সংগঠন ইউনিয়ন গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। ১৯২০ সালে নাগপুর ও গয়া অধিবেশনে কংগ্রেসে ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালনার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠিত হয়।

গয়া অধিবেশনে সভাপতির ভাষনে চিত্তরঞ্জন দাশ বলেন - "শ্রমিক ও কৃষকদের কংগ্রেসের পক্ষে আনতেই হবে এবং তাদের বিশেষ স্বার্থের দৃষ্টিকোন ও উচ্চতর আদর্শের দৃষ্টিকোন উভয় দিক থেকে সংগঠিত করতে হবে"। শ্রমিক সংগঠনের তত্ত্বে গান্ধীজি নিজেও বিশ্বাসী ছিলেন। মাথায় রাখতে হবে, গান্ধিজী নিজে আমেদাবাদের বস্ত্রশিল্প শ্রমিকদের নিয়ে" আমেদাবাদ টেক্সটাইল লেবার অ্যাসোসিয়েশন" (১৯২০) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি জানতেন, শ্রমিকদের কিছু সমস্যা আছে। সেই সব সমস্যা সংগঠিত ভাবে মালিক পক্ষের মাধ্যমে আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই মিটিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আমেদাবাদ সত্যাগ্রহে তিনি সেটি করে দেখিয়েছিলেন।

গান্ধীজি শ্রমিক সংগঠনে কখনই শ্রেনী সংগ্রাম তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। শ্রম ও পুঁজির সংঘাতের বদলে তিনি শ্রমিক - মালিক সুসম্পর্কের তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শ্রমিক ও মালিক শ্রেনীর সম্পর্ক পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। একটিকে উৎঘাত বা উচ্ছেদ করে কখনোই অপরটি টিকে থাকতে পারে না। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তার সমগ্র সময়কাল গান্ধীর এই তত্ত্বের দ্বারাই আচ্ছাদিত হয়েছিলো

শ্রমিক সংগঠনের ব্যাপারে গান্ধীজির আরেকটি মতো ছিলো, তিনি কখনোই শ্রমিকদের রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিলেন না। এর সবথেকে বড়ো প্রমান হলো তার গন আন্দোলন গুলিতে (যেমন অসহযোগ, আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলন) শ্রমিক শ্রেণীর দাবি দাওয়া বা অভাব অভিযোগের কোন কিছুই কখনো আন্দোলনের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয় নি।

মাথায় রাখতে হবে, জাতীয় কংগ্রেসের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকদের একটা বড়ো অংশই ছিলো বড়ো বড়ো দেশীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীগন। বিভিন্ন সময়ে এই শিল্পপতিগন কংগ্রেসকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতেন। ঐ টাকাতেই কংগ্রেস দলীয় সাংগঠনিক কাজকর্ম পরিচালনা করতো। তাই জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব শ্রমিকদের যেকোন ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন বা শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে শ্রেনী সংগ্রামের তত্ত্বের সব সময়েই বিরোধী ছিলেন।

তারা বিশ্বাস করতেন, শ্রমিক মালিক সংঘাত তীব্রতর হলে জাতীয়তাবাদী ঐক্যে ফাটল দেখা দেবে। তাই তারা ভারতীয় মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলনকে কখনই সমর্থন করতো না। কখনো কখনো ভারতীয় মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা আন্দোলন করলেও, নেতারা শ্রমিকদের পক্ষ অবলম্বনের নামে কার্যত মালিক পক্ষের সঙ্গেই আপোষ মীমাংসা করে নিতেন। দেশীয় শিল্পপতিদের কলকারখায় দীর্ঘদিন ধর্মঘট করে কখনই দেশীয় উদ্যোগপতিদের কংগ্রেস নেতৃত্ব চটাতে চাইতেন না। এর অনেক প্রমান পাওয়া যায়।

উদাহরন হিসাবে বলা যায়, জামসেদপুরে টাটাদের কারখানায় অনেকবার শ্রমিকরা ধর্মঘট করেও নেতৃত্বের অপোষকামী মনোভাবের জন্য তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারে নি। ১৯২৮ খ্রিঃ জামসেদপুরে ধর্মঘটের পরে জে এল এ নেতা সুভাষচন্দ্র বসু কে গুর্খা পুলিশের সহায়তায় বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হয়েছিলো। কারন শ্রমিক ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে তিনি টিসকোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বোঝাপড়া করে শ্রমিকদের বিষয়টি মীমাংসা করে নেন। নেতৃত্বের এই আপোষমুখী মনোভাবের কারনে শ্রমিকদের একটি বড়ো অংশ তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলো।


১৯২০ খ্রিঃ ভারতে বৃহত্তম শ্রমিক সংগঠন "অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস" প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কিন্তু কংগ্রেস কোন দিনই AITUC কে স্বীকৃতি জানায় নি। সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠন AITUC র গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে গান্ধী নিজেকে কখনোই যুক্ত করেন নি। 

তার আমেদাবাদের শ্রমিক সংগঠন "আমেদাবাদ টেক্সটাইল লেবার অ্যাসোসিয়েশনকেও" তিনি কখনো  AITUC  অন্তর্ভুক্ত করতে দেন নি। তিনি সর্বদাই মনে করতেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শ্রমিক ধর্মঘটকে ব্যবহার করা মারাত্মক ভুল হবে। ১৯১৯ খ্রিঃ থেকেই তিনি দার্শনিকের মতো পুঁজির সঙ্গে শ্রমের পারিবারিক বন্ধনের কথা বলে আসছিলেন

১৯২০ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের অসহযোগ প্রস্তাবে বিদেশী শিল্প প্রতিনিধিদের দ্বারা শ্রমিক নিপীড়নের কথা বলা হলেও, ঐ একই নিপীড়ন যে দেশীয় শিল্পপতিরাও করে তা বেমালুম চেপে দেওয়া হয়। ১৯২১ খ্রিঃ অসহযোগ আন্দোলনের সময় আসামের ধর্মঘটি চা বাগিচার শ্রমিকদের একটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিলো - "গান্ধী মহারাজ কি জয়"। অথচ এই ধর্মঘট প্রসঙ্গেই গান্ধী বলেছিলেন - "ভারতে আমরা কোনরকম রাজনৈতিক ধর্মঘট চাই না"।

শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে গান্ধীর মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের মধ্যেও ছিলো। ১৯০৮ খ্রিঃ বাল গঙ্গাধর তিলককে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে যখন বোম্বের শ্রমিকরা বিরাট ধর্মঘট অনুষ্ঠিত করেন তখন তিলক বোম্বের শ্রমিকদের মিল মালিকদের সঙ্গে যাবতীয় বিরোধ ও দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন "পশ্চিমের বলশেভিকবাদ ভারতে সফল হতে পারে না। আমাদের বেদান্তকে ধরে থাকতে হবে এবং তবেই আমাদের যাবতীয় আকাঙ্খার পূরন হবে।" 

১৯৩০ দশকে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল কংগ্রেসের মধ্য থেকে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করলে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এই প্রয়াসকে "মস্তিষ্ক বিকারগ্রস্ত একদল তরুনের বালসুলভ আচরন" বলে নিন্দা করেন। এমনকি কংগ্রেস কার্যনির্বাহী কমিটি প্রস্তাব নেয়, যে সমস্ত কংগ্রেসি "শ্রেনী সংগ্রামের" কথা প্রচার করবে তাদের কার্যকরী কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হবে।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে ভারতে যে প্রাদেশিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয় তাতে AITUC ও শ্রমিক শ্রেণী বিপুল ভাবে কংগ্রেস প্রার্থীদের স্বপক্ষে প্রচার ও সভা সমাবেশ করে। নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল ভোটে জয়লাভের পর শ্রমিক শ্রেণী অনেক বেশি উৎসাহিত হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু তাদের সব উৎসাহে জল ঢেলে দিয়েছিলো কংগ্রেস। 

জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত মন্ত্রীসভা গুলি প্রথম দিকে শ্রমিকপন্থী অবস্থান গ্রহণ করলেও, শেষপর্যন্ত তা বজায় রাখে নি। অধ্যাপক সুমিত সরকার দেখিয়েছেন, কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গুলির শ্রমিক দরদি নীতি খুব শীঘ্রই পুঁজিপতি শ্রেনীর প্রবল চাপের মুখে পড়েবিড়লা কংগ্রেস শাসিত প্রদেশ গুলির চূড়ান্ত অব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ করেন। এমনকি কংগ্রেস শাসিত বোম্বাই ও উত্তর প্রদেশ থেকে পুঁজি সরিয়ে দেশীয় রাজ্য গুলিতে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখান। কারন দেশীয় রাজ্য গুলিতে শ্রমিক আইনের অস্তিত্ব বলে কিছু ছিলো না। 

এর ফলে কংগ্রেস শ্রমিক আন্দোলনে লাগাম টানতে সচেষ্ট হয়। ১৯৩৮ খ্রিঃ "Bombay Trades Dispute Act" প্রনয়ন করে বে আইনী ধর্মঘটের জন্য ৬ মাস জেলের ব্যবস্থা করা হয়ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন বিধিকেও অনেক বেশি কঠোর করে দেওয়া হয়। 

আসলে কংগ্রেসের গোড়া থেকেই বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে আসছিলো। জাতীয় আন্দোলনের প্রয়োজনে কংগ্রেস দলীয় ভাবে কখনোই শ্রমিকদের ক্ষোভকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলো না। কিন্তু তা সত্ত্বেও, শ্রমিক শ্রেণী দলে দলে কংগ্রেস পরিচালিত জাতীয় আন্দোলন গুলিতে অংশগ্রহণ করতো। অনেক কংগ্রেস নেতা শ্রমিক সংগঠনে বা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত থাকতেন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে শ্রমিক সংগঠনের বিষয়ে কংগ্রেসের দলীয় অবস্থান এবং কংগ্রেস নেতৃত্বের অবস্থান এরকম পৃথক ছিলো কেন? শ্রমিকরাই বা কেন কংগ্রেস পরিচালিত আন্দোলন গুলিতে অংশগ্রহণ করতো? 

আমরা আগেই বলেছি, জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা বিভিন্ন সময়ে শ্রমিক ধর্মঘট ও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। ১৯১৮ খ্রিঃ আমেদাবাদের শ্রমিক ধর্মঘটে মহাত্মা গান্ধী অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৩ ও ১৯২৪ সালে AITUC বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। জওহরলাল নেহেরু ও সুভাষ চন্দ্র বসুও AITUC র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৮ - ২৯ খ্রিঃ জামসেদপুর ইস্পাত কারখানার ধর্মঘটে সুভাষচন্দ্র বসু অংশ নিয়েছিলেন। মাদ্রাজে ভি ভি গিরি, আমেদাবাদে গুরজারিলাল নন্দার মতো অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। 

বলা বাহুল্য, দলীয় অবস্থান ভিন্ন থাকা সত্ত্বেও এই সব নেতারা ব্যক্তিগত ভাবে শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন বা ধর্মঘটে অংশ নিতেন শুধুমাত্র জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াবার উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে কংগ্রেসের তরফ থেকে শ্রমিকদের রাজনৈতিক আন্দোলনে তীব্র অনীহা থাকা সত্ত্বেও, শ্রমিক শ্রেণী স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশ নিতো। আসলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মঘটকে যুক্ত করে শ্রমিকরা নিজেদের সংগ্রাম ও ধর্মঘটকে বৈধতা দানের চেষ্টা করতো। তবে এক্ষেত্রে গান্ধী প্রভাব ও দেশাত্মবোধক চেতনাও ভারতীয় শ্রমিক শ্রেনীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো।

গান্ধীজিকে নিয়ে ভারতীয় কৃষক সমাজের মধ্যে যেমন নানা বিধ মিথ প্রচলিত ছিলো। ঠিক তেমনটি শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। ১৯২৯ খ্রিঃ গোলমুরি টিনপ্লেট ধর্মঘট পরিচালনায় কংগ্রেসী নেতাদের ব্যর্থতা সত্ত্বেও, ১৯৩০ খ্রিঃ ছোটনাগপুরে শ্রমিকরা গান্ধী টুপি পরতে শুরু করে এবং হাজারে হাজারে জাতীয়তাবাদী সভায় যোগদান করতে থাকে। কৃষকদের মতো শ্রমিক শ্রেনীও বিশ্বাস করতো "গান্ধী ভগবানের" টুপি পরে বা নাম নিয়ে যদি আন্দোলন করা যায়, তাহলে ব্রিটিশ পুলিশের বন্দুক তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। 

শেষ কথা  :- 

সবশেষে বলা যায়, শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনের প্রশ্নে গান্ধীজির মতাদর্শগত অবস্থান (শ্রেনী সংগ্রামের বিরোধিতা) এবং জাতীয় কংগ্রেসের বস্তুগত অবস্থান ( পুঁজিপতিদের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ) কোথাও যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। দলীয় ভাবে কংগ্রেস শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক আন্দোলনের বিরোধী হলেও, অনেক কংগ্রেস নেতাই শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবি দাওয়ার আন্দোলন এবং জাতীয় আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলন পরিচলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এক্ষেত্রে কংগ্রেসের ব্যক্তি অবস্থান ও দলীয় অবস্থান কখনোই এক ছিলো না। কংগ্রেসের দলীয় অবস্থানের বাইরে থেকেই কংগ্রেসের কর্মীরা শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। নেতৃত্বের সেই ভূমিকা ও অবস্থানকে কখনোই দলীয় অবস্থানের সঙ্গে মিশিয়ে এক করে দেখা ঠিক হবে না। 

মাথায় রাখতে হবে, ভারতে গনতান্ত্রিক ধ্যানধারনা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান ছিলো জাতীয় কংগ্রেস। কংগ্রেসের  উদার ও মুক্ত গনতান্ত্রিক ধ্যান ধারনার কারনেই বিভিন্ন মত ও পথের কর্মীরা কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় এসে নির্বিঘ্নে আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। শ্রমিক সংগঠনের ক্ষেত্রেও এই উদার পরিমন্ডলের জন্যই কংগ্রেস কর্মীরা দলীয় অবস্থানের বাইরে থেকে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পেরেছিলেন। আজকের দলতান্ত্রিক ভারতবর্ষে দলীয় কর্মীদের এই কাজকর্ম বিরুদ্ধাচারন ও  শৃঙ্খলা ভঙ্গ বলে বিবেচিত হলেও, আলোচ্য সময়ে উদার নৈতিক গনতান্ত্রিক পরিমন্ডলে তা মনে হয় নি। 

প্রতি রবিবার প্রকাশিত হয় নতুন লেখা। *** প্রতি রবিবার প্রকাশিত হয় নতুন লেখা। *** প্রতি রবিবার প্রকাশিত হয় নতুন লেখা। **** প্রতি রবিবার প্রকাশিত হয় নতুন লেখা।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post