১৯০৫ খ্রিঃ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে তা বিভিন্ন শ্রেণীর পাশাপাশি শ্রমিকদেরও স্পর্শ করে। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছিলো ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের প্রকৃত সূচনাকাল। বিপানচন্দ্রের মতে, "শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে স্বদেশী আন্দোলন ছিলো একটি দিক চিহ্ন"। আধুনিক শ্রমিক আন্দোলনের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও প্রবনতাগুলি এই সময় থেকেই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিলো।
সরকারি রিপোর্টে বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের এই যুগে "পেশাদারি আন্দোলনকারী" এবং "শ্রমিক সংগঠন" গড়ে উঠায় যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন |
(ক.) শ্রমিক আন্দোলনের কারন :-
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে - (১.) স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব ও উদ্মাদনা, (২.) কলকারখানা গুলিতে ইওরোপীয় মালিকদের বৈষম্যমূলক শ্রমনীতি, (৩.) কম মজুরি, (৪.) কারখানায় শ্রমিক সরবরাহকারী সর্দার ও বাবুদের ঘুষ, চাঁদা ও আর্থিক জুলুম (৫.) দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, - প্রভৃতি কারনে শ্রমিক আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেছিলো।
(খ.) পূর্ববর্তী যুগের সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের পার্থক্য :-
ভারতে ১৮৬০ দশক থেকেই শ্রমিক আন্দোলনের উদ্ভব ঘটলেও, পূর্ববর্তী যুগের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের কতকগুলি মৌলিক পার্থক্যের দিক লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
(১.) বঙ্গভঙ্গের আগে শ্রমিক আন্দোলন গুলি ছিলো মূলত বিক্ষিপ্ত, ইতস্তত ও অসংগঠিত।
(২.) সেই সময় শ্রমিক আন্দোলন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবি দাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো।
(৩.) তাছাড়া তখন জাতীয় আন্দোলন বা রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণী যুক্ত হয় নি।
কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলনের ধারায় একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটে।
(i.) এই সময় নিছক অর্থনৈতিক দাবী দাওয়া নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন না করে "জাতীয় আন্দোলনে" শ্রমিকদের সামিল করা হয়।
(ii.) এর ফলে শ্রমিকদের মধ্যে জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটে। এছাড়া, এই সময় -
(iii.) অর্থনৈতিক কারনে অসংগঠিত শ্রমিক ধর্মঘটের বদলে স্বদেশী আন্দোলনকে উপলক্ষ করে জাতীয়তাবাদী নেতাদের নেতৃত্বে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘট আরম্ভ হয়। এর ফলে পূর্ববর্তী যুগ অপেক্ষা বঙ্গভঙ্গ পর্বে শ্রমিক আন্দোলন অনেকবেশি জোরদার হয়ে উঠেছিলো।
(গ.) বঙ্গভঙ্গ পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য :-
বঙ্গভঙ্গ পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
(১.) এই সময় শ্রমিক আন্দোলন মূলত কলকাতা কেন্দ্রিক ছিলো।
(২.) এই সময় বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেনী শ্রমিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দেন।
(৩.) ৪ জন বাঙালি নেতা এইসময় শ্রমিক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। এরা ছিলেন - অশ্বিনীকুমার বন্দোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার রায়চৌধুরী, এথানাসিয়াস অপূর্বকুমার ঘোষ এবং প্রেমতোষ বসু।
(৪.) এই সময়ে শ্রমিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে অর্থনৈতিক দাবি দাওয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক আশা আকাঙ্খাও যুক্ত হয়।
(৫.) মূলত শ্বেতাঙ্গদের পরিচালিত বা ব্রিটিশ মালিকানাধীন সংস্থা গুলিতেই এই সময় ধর্মঘট ও শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হয়।
(ঘ.) স্বদেশী পর্বে শ্রমিক আন্দোলনের পরিচয় :-
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অন্যতম প্রধান পীঠস্থান ও রাজধানী ছিলো বাংলা। ভারতে ব্রিটিশ পুঁজির অনুপ্রবেশের ফলে ভারতে যে কারখানা ভিত্তিক শিল্প স্থাপন শুরু হয়, তাতে খুব স্বাভাবিক ভাবেই রাজধানী হবার সুবাদে এগিয়ে ছিলো বাংলা। বাংলায় ব্রিটিশ পুঁজির অনুপ্রবেশের ফলে অনেক শিল্প গড়ে উঠেছিলো। ঐ সমস্ত শিল্পে বহু বাঙালি শ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত হয়।
তবে ঊনিশ শতকের শেষ দশকে বাংলা দেশে শিল্পায়নের গতি বিশেষ ভাবে বৃদ্ধি পেলে শ্রমিকের চাহিদা বাড়ে। এই সময় কাজের সন্ধানে বিহার, উত্তর প্রদেশ ও ঊড়িষ্যা থেকে বহু শ্রমিক বাংলায় কাজের সন্ধানে আসে। ফলে স্বদেশী আন্দোলনের প্রাক্কালে বাংলায় শ্রমিক শ্রেণীর সংখ্যা যথেষ্টই ছিলো।
তবে বহিরাগত শ্রমিক থাকায় বাংলার শ্রমিকদের মধ্যে ভাষা, ধর্ম ও আঞ্চলিকতা নিয়ে নানা বিভেদ ও বৈষম্য ছিলো। এমতাবস্থায় স্বদেশী আন্দোলনকে উপলক্ষ করে জাতীয়তাবাদী নেতাদের নেতৃত্বে বাংলায় শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘট আরম্ভ হয়।
(i.) শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকা :-
স্বদেশী আন্দোলনের সময় শ্রমিক সংগঠনে জাতীয়তাবাদী নেতারা বিশেষ আগ্রহ দেখান। ব্রিটিশ পুঁজির অনুপ্রবেশে গড়ে ওঠা বিদেশী কলকারখানা ও সংস্থা গুলিতে শ্রমিক ধর্মঘট ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা স্বদেশী আন্দোলনের "বয়কট" কর্মসূচিকে শক্তিশালী করে তোলার উদ্যোগ নেন।
এই সময় বহু স্বদেশী নেতাই (১.) স্থায়ী ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলা, (২.) ধর্মঘটে শ্রমিকদের আইনি সাহায্য দেওয়া, (৩.) ধর্মঘট তহবিলের জন্য অর্থসংগ্রহ করা, ইত্যাদি কাজে উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এই সময় ধর্মঘটী শ্রমিকদের সমর্থনে ভাষন দিয়েছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ ও লিয়াকত হোসেনের মতো জাতীয়তাবাদী নেতারা।
তবে স্বদেশী আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ৪ জন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এঁরা হলেন - অশ্বিনীকুমার বন্দোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার রায়চৌধুরী, অপূর্ব কুমার ঘোষ এবং প্রেমতোষ বসু। এদের মধ্যে প্রথম তিন জন ছিলেন ব্যারিস্টার এবং শেষের জন ছিলেন উত্তর কলকাতার একটি ছাপাখানার মালিক।
(ii.) স্বদেশী পর্বের প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট :-
১৯০৫ খ্রিঃ ১ লা সেপ্টেম্বর বঙ্গভঙ্গের সরকারি ঘোষনার প্রতিবাদে কলকাতা ও কলকাতা সংলগ্ন অঞ্চলে প্রতিবাদ দিবস পালন করা হয়। ঐ দিনই হাওড়ার বার্ন কোম্পানির জাহাজ তৈরি ও মেরামতের কারখানার ৩০০ জন বাঙালি করনিক কর্তৃপক্ষের হাজিরা রেকর্ড করার অপমানজনক নিয়ম চালু করার প্রতিবাদে কাজ থেকে বেরিয়ে আসেন। এটি ছিলো স্বদেশী যুগে বাংলার প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট।
এইসময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী পত্র পত্রিকা গুলি ধর্মঘটিদের সমর্থনে এগিয়ে আসে। জাতীয়তাবাদী পত্রিকা গুলি ধর্মঘটি শ্রমিকদের "নবযুগের অগ্রদূত" বলে অভিনন্দিত করে। এদের সমর্থনে বিভিন্ন স্থানে সভা সমাবেশের আয়োজন করা হয়। "বেঙ্গলী" ও "সঞ্জীবনী" পত্রিকার উদ্যোগে এদের সমর্থনে তহবিল সংগ্রহ শুরু হলে তাতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়।
শ্রমিক নেতা এ সি ব্যানার্জী এইসময় "ক্লার্কস ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন" গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। যদিও তা শেষপর্যন্ত ফলপ্রসূ হয় নি। কারখানা কর্তৃপক্ষ ধর্মঘটী শ্রমিকদের বরখাস্ত করে নতুন কর্মী নিয়োগ করলে বার্ন কারখানার ধর্মঘট স্তিমিত হয়ে আসে।
বার্ন কারখানার বাঙালি ক্লার্কদের ধর্মঘট ঐ কারখানায় কর্মরত ৪,০০০ অবাঙালি শ্রমিক শ্রেনীকে তেমন ভাবে প্রভাবিত না করলেও, এই ধর্মঘট স্বদেশী যুগের প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট হিসাবে প্রবল উদ্মাদনার সঞ্চার করে। একে অনুসরন করেই ১৯০৫ খ্রিঃ পুরো সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস জুড়ে একের পর এক ধর্মঘট সংগঠিত হতে থাকে।
যদিও এই ধর্মঘট গুলির সবকটিই মূল্যবৃদ্ধির মতো অর্থনৈতিক ক্ষোভের কারনেই সংগঠিত হয়েছিলো। তবে এই ধর্মঘট গুলির পিছুনে বঙ্গভঙ্গের কোন আবেগ বা প্রভাব কাজ না করলেও জাতীয় নেতৃবৃন্দ "বয়কট" কর্মসূচির বিকল্প হিসাবে "ধর্মঘট" গুলিকে ব্যবহার করেন এবং ব্যাপক ভাবে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনে সাহায্য করেন। শ্রমিকরাও অনুকূল পরিস্থিতির ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন। এর ফলে এই সময় শ্রমিক আন্দোলনে এক "নবজোয়ার" আসে।
(iii.) বঙ্গভঙ্গের কার্যকরের দিন শ্রমিক ধর্মঘট :-
১৯০৫ খ্রিঃ ১৬ অক্টোবর, বঙ্গভঙ্গের কার্যকরের দিন অন্যান্য শ্রেনির সাথে শ্রমিকরাও প্রতিবাদী আন্দোলনে অংশ নেয়।
(১.) ঐ দিন সব বেসরকারি অফিস ও কলকারখানা বন্ধ থাকে।
(২.) কলকাতা শহর কার্যত বন্ধের চেহারা নেয়।
(৩.) এক সরকারি প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয় ঐ দিন ১২ টি চটকল, একটি চিনির কল সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রায় ৭০ হাজার কলকারখানা বন্ধ থাকে।
(৪.) বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে গাড়োয়ানরা প্রায় ১১ হাজার গোরু ও মোষের গাড়ি বের করে নি।
(৫.) ঐ দিন কলকাতা পুরসভার প্রায় ২০০০ কুলি ও মেথর ধর্মঘট করেন।
সুমিত সরকার তার "The swadeshi Movement in Bengal" গ্রন্থে দেখিয়েছেন, এইসব শ্রমিক ধর্মঘটের সমর্থনে কলকাতার রাস্তায় বহু মানুষের মিছিল বেরিয়েছিলো। অনেক মানুষ ধর্মঘটীদের মিছিলে এইসময় চাঁদা দিয়েছিলেন এবং খাদ্য সরবরাহ করেছিলেন।
(iv.) শ্রমিক আন্দোলনের রূপ :-
অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী পর্বে সংগঠিত ধর্মঘটের তুলনায় সংগঠিত শ্রমিক ধর্মঘট গুলি ছিলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। স্বদেশী আন্দোলন পর্বের সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন গুলিকে তিনি ৩ টি শ্রেনীতে ভাগ করেছেন। যথা -
(১.) সরকারি ছাপাখানা কর্মীদের ধর্মঘট,
(২.) রেল কর্মীদের ধর্মঘট এবং
(৩.) কিছু সংখ্যক চটকল শ্রমিকদের ধর্মঘট।
(অ.) সরকারি ছাপাখানার ধর্মঘট :-
কলকাতায় ছাপাখানার বাঙালি কর্মীরা সংখ্যায় কম হলেও, অন্যান্য ক্ষেত্রের শ্রমিকদের চেয়ে তারা অনেক বেশি শিক্ষিত ও রাজনীতি সচেতন ছিলেন।
কলকাতার "কেন্দ্রীয় সরকারি প্রেস" ও "বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট প্রেসের" কর্মীরা চাকুরির প্রতিকূল শর্তাবলী ও উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে অনেক দিনই ক্ষুব্ধ ছিলেন। ১৯০৫ খ্রিঃ ২৭ সেপ্টেম্বর কলকাতার কেন্দ্রীয় সরকারি প্রেসের কর্মীরা ধর্মঘট শুরু করে। স্বদেশী আন্দোলনের সময় বিদেশী সংস্থায় এই ধর্মঘট সংগঠিত হওয়ায় জাতীয়তাবাদী ও দেশীয় সংংবিদপত্র গুলি ধর্মঘটীদের সমর্থনে এগিয়ে আসে।
এই সময় বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট প্রেস ও কিছু বেসরকারি ছাপাখানার শ্রমিক সহানুভূতিসূচক এই ধর্মঘটে যোগ দেয়। স্বদেশী যুগের দুই বিশিষ্ট শ্রমিক সংগঠক এ সি ব্যানার্জী ও এ কে ঘোষ ছাড়াও বিপিনচন্দ্র পাল, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, ব্রাহ্ম বান্ধব উপাধ্যায়ের মতো প্রথম সারির জাতীয়তাবাদী নেতারা ছাপাখানার শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান।
ব্রিটিশ সরকার এই ধর্মঘটকে স্বদেশি ভাবধারায় প্রভাবিত একটি রাজনৈতিক আন্দোলন বলে ব্যাখ্যা করে এবং আন্দোলন ভাঙ্গার জন্য বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যায়। ধর্মঘটী শ্রমিকরা নিজেদের ঐক্য সুদৃঢ় করে তোলার জন্য এই সময় "প্রিন্টার্স অ্যান্ড কম্পোজিটার্স লীগ" নামে একটি শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলে। এদের উদ্যোগে ১৯০৫ খ্রিঃ ২৭ অক্টোবর উত্তর কলকাতায় এক বিশাল মিছিল বের হয়।
শেষপর্যন্ত, প্রবল জনমতের চাপে নভেম্বর মাসে সরকার ধর্মঘটী শ্রমিকদের বেশ কিছু দাবি দাওয়া মেনে নিলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অবশ্য ধর্মঘটের অপরাধে যেসব শ্রমিকদের বহিষ্কার করা হয়েছিলো, তাদের আর কাজে ফিরিয়ে নেওয়া হয় নি।
(আ.) রেলকর্মীদের ধর্মঘট :-
স্বদেশী যুগে সবচেয়ে বড়ো শিল্প সংস্থা ছিলো ইন্ডিয়ান রেলওয়ে। ভারতের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শ্রমিক রেলওয়েতেই নিযুক্ত হতেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময়ে রেল শ্রমিকদের মধ্যে (ক.) অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গার্ড ও ড্রাইভার, (খ.) বাঙালি ক্লার্ক এবং (গ.) রেলওয়ে ওয়ার্কশপের শ্রমিক - এই তিন বিভাগের শ্রমিকরা সক্রিয় ভাবে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে।
(ক.) ১৯০৬ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের বাঙালি স্টেশন মাস্টার ও ক্লার্করা আন্দোলন শুরু করলে স্বদেশী নেতৃত্ব আন্দোলনকারীদের পাশে এসে দাঁড়ান। বিপিনচন্দ্র পাল, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী ও লিয়াকত হোসেনের মতো স্বদেশী নেতারা রেলকর্মীদের সভায় ভাষন দেন।
(খ.) ১৯০৬ খ্রিঃ ২৭ জুলাই ইস্ট ইন্ডিয়া রেলের কেরানি ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে রেলকর্মীদের ইউনিয়ন "রেলওয়েমেনস ইউনিয়ন"। হাওড়া থেকে আসানসোল, রানিগঞ্জ পর্যন্ত এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
(গ.) ১৯০৬ খ্রিঃ ২৭ আগস্ট সাহেবগঞ্জ ও জামালপুরের রেলওয়ে ওয়ার্কশপের কর্মীরা অর্থনৈতিক কারনে ধর্মঘট শুরু করে। এই দুই জায়গায় অবাঙালি কুলিরা ধর্মঘটীদের সমর্থনে এগিয়ে এলে আন্দোলন জঙ্গীরূপ ধারন করে। এইসময় পুলিশ গুলি চালালে এবং নেতৃত্বের মধ্যে দলাদলি দেখা গেলে সাহেবগঞ্জ ও জামালপুর ওয়ার্কশপের ধর্মঘট ভেঙ্গে যায়।
যদিও এই ওয়ার্কশপ কর্মীদের সমর্থনে ততদিনে অন্যান্য রেল ওয়ার্কশপেও খুব শীঘ্রই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিলো। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে খড়্গপুর ওয়ার্কশপ ধর্মঘট। এটি ১৯০৬ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে সংগঠিত হয়। কিন্তু ততদিনে স্বদেশী নেতৃত্ব আন্দোলন থেকে হাত গুটিয়ে নিতে আগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের প্রাথমিক উদ্মাদনাও স্তিমিত হতে শুরু করেছিলো। ফলে নেতৃত্বের দোলাচলে শ্রমিক আন্দোলন সুসংবদ্ধ রূপ লাভ করতে ব্যর্থ হয়।
এর প্রায় এক বছর পর ১৯০৮ খ্রিঃ নভেম্বর মাসে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলের ইউরোপীয় ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গার্ড ও ড্রাইভাররা আন্দোলন শুরু করলে জাতীয়তাবাদী পত্র পত্রিকা ও নেতৃত্ব অনেকটা উদাসীন ভূমিকা পালন করে।
(ই.) চটকল শ্রমিকদের ধর্মঘট :-
স্বদেশী যুগে ছাপাখানা ও রেলকর্মীদের আন্দোলন মূলত কেরানি ও কিছু সংখ্যক দক্ষ শ্রমিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তবে এযুগে একেবারে সাধারণ শ্রমিকদের আন্দোলন একমাত্র চটকল গুলিতেই দেখা যায়।
বিভিন্ন পর্বে ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ খ্রিঃ মধ্যে বাংলার ৩৭ টি চটকলের মধ্যে ১৮ টি চটকলে ধর্মঘট সংগঠিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলো হাওড়ার ফোর্ট গ্লস্টার জুটমিল ও অক্টোবর জুটমিলের ধর্মঘট। এখানে ১৯০৫ থেকে ১৯০৬ মধ্যে ৩ টি ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। কাজের সময় সংক্রান্ত ইওরোপীয় ম্যানেজারদের অত্যাচার ও কয়েকজন করনিক ও সর্দারকে বরখাস্ত করার প্রতিবাদে এই ধর্মঘট গুলি হয়েছিলো।
এছাড়া এই পর্বের চটকল ধর্মঘট গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো -
(১.) ১৯০৫ খ্রিঃ গার্ডেনরিচের হুগলি জুটমিল ও রিষড়ার ওয়েলিংটন জুটমিলের ধর্মঘট।
(২.) ১৯০৬ খ্রিঃ দমদমের আরাটুন মিল, গার্ডেনরিচের ক্লাইভ মিল এবং শ্রীরামপুরে ইন্ডিয়া মিলের ধর্মঘট।
(৩.) ১৯০৭ খ্রিঃ রিষড়ার হেস্টিংস মিল, গার্ডেনরিচের ক্লাইভ মিল, দমদমের আরাটুন মিল, বেলেঘাটার সুরা মিল, হাওড়ার ডেল্টা মিল ও কাঁকিনারা জুটমিলের ধর্মঘট।
এই পর্বের অধিকাংশ ধর্মঘটই ছিলো অসংগঠিত ও স্বতঃস্ফূর্ত। সমকালীন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের উদ্মাদনা শ্রমিকদের পরোক্ষ ভাবে ধর্মঘটে উৎসাহিত করেছিলো। তবে এইসব ধর্মঘটের পিছুনে মূল কারন ছিলো অর্থনৈতিক। বজবজের ২৮ জন মিল শ্রমিকের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি থেকে জানা যায় "বাবু"ও "সর্দাররা" (শ্রমিক সরবরাহের ঠিকাদার) শ্রমিকদের নানা ভাবে হেনস্তা করতেন।তারা প্রায়ই ঘুষ ও পুজোর চাঁদা শ্রমিকদের কাছ থেকে আদায় করতেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো মিল মালিকদের নানা অত্যাচার ও কম মজুরিতে অধিক পরিমানে খাটানো।
প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আন্দোলন শুরু করার পরে ধর্মঘটী শ্রমিকরা জাতীয়তাবাদী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বহিরাগত নেতাদের কাজ ছিলো শ্রমিকদের সমর্থনে সভা সমাবেশের আয়োজন করা এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে বৃহত্তর জনসাধারণকে ধর্মঘটীদের বিষয়ে সচেতন করে তোলা।
চটকল শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্য দিয়েও এই সময় শ্রমিক সংগঠনের উদ্ভব হয়। ১৯০৬ খ্রিঃ আগস্ট মাসে বজবজ অঞ্চলের চটকল শ্রমিকদের সংগঠন হিসাবে গড়ে ওঠে "Indian mill Hands union"। এটিকে অনেকেই চটকল শ্রমিকদের প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন বলে অনেকে দাবি করে থাকেন। ১৯০৭ খ্রিঃ শেষের দিকে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়" Indian Labour union"। ১৯০৮ খ্রিঃ পর এই প্রতিষ্ঠানটি সম্ভবত ভেঙ্গে যায়। কেননা এর আর কোন তথ্য পরবর্তীকালে আর পাওয়া যায় না।
(v.) সীমাবদ্ধতা :-
বঙ্গভঙ্গ পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার দিক লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
(১.) এই পর্বের শ্রমিক আন্দোলন কেবলমাত্র কলকাতা শিল্পাঞ্চল ও রেলওয়ে শ্রমিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
(২.) কলকাতা শিল্পাঞ্চলের মধ্যে আবার নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রেই শ্রমিক আন্দোলন আবদ্ধ ছিলো।
(৩.) এই সময়ের শ্রমিক আন্দোলনে প্রধানত বাঙালি শ্রমিকরাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। অবাঙালি শ্রমিকরা খুব কম ক্ষেত্রেই বাঙালি নেতৃত্ব ও স্বদেশী আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলো।
(৪.) খনি ও বাগিচা (চা, কফি) শিল্পে শ্রমিক আন্দোলনের কোন প্রভাব পড়ে নি।
(৫.) এই পর্বের যে চারজন নেতা শ্রমিক আন্দোলনে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত হয়েছিলো, তারা কেউই প্রথম সারির নেতা ছিলেন না। ফলে শ্রমিক আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠতে পারে নি।
(৬.) বাংলায় অবাঙালি শ্রমিকদের ওপর বাঙালি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত রাজনৈতিক নেতাদের তেমন প্রভাব ছিলো না। ভাষা ও সংস্কৃতিগত কারনে বাংলার স্বদেশী নেতৃত্ব শ্রমিক শ্রেনীকে রাজনীতি সচেতন করতে ব্যর্থ হয়েছিলো। অন্যদিকে তাদের অর্থনৈতিক লড়াইয়ের সঙ্গেও নিজেদের যুক্ত করতে সফল হয় নি।
(৭.) স্বদেশী যুগে বাংলাদেশে এমন কোন স্থায়ী শ্রমিক সংগঠনও তৈরি হয় নি, যা পরবর্তীকালে টিকে ছিলো বা স্থায়ী রূপ পেয়েছিলো। এইজন্য স্বদেশী যুগের শ্রমিক আন্দোলন একটি বিচ্ছিন্ন ও সীমাবদ্ধ ঘটনা হিসাবেই ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছিলো। পরবর্তীকালের আন্দোলনে এই পর্বের আন্দোলনের কোন সূত্র স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে নি।
(ঙ.) স্বদেশী পর্বে বাংলার বাইরে শ্রমিক আন্দোলনের পরিচয় :-
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে শুধুমাত্র বাংলা নয়, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, মাদ্রাজ, বোম্বাই প্রভৃতি অঞ্চলেও শ্রমিক আন্দোলনের ঢেউ স্পর্শ করেছিলো।
(১.) তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে বিদেশী মালিকানাধীন একটি বস্ত্র কারখানায় ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচার করেন সুব্রক্ষন্যম শিব ও চিদাম্বরম পিল্লাই। এই দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলে তুতিকোরিন ও তিরুনেলভেলিতে ব্যাপক ধর্মঘট ও সংঘর্ষ হয়।
(২.) ১৯০৭ খ্রিঃ পাঞ্জাবে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসাবে রাওয়ালপিন্ডির অস্ত্র কারখানা ও রেলওয়ে কর্মশালার শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। ধর্মঘটে ইন্ধন দেওয়ার অপরাধে পাঞ্জাব থেকে অজিত সিং (ভগৎ সিং এর কাকা) ও লালা লাজপত রায় বহিষ্কৃত হন।
(৩.) ১৯০৮ খ্রিঃ গোড়ার দিকে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেলে সরকার সংবাদপত্রের কন্ঠোরোধের জন্য দমনমূলক আইন প্রণয়ন করে। এই সময় বাল গঙ্গাধর তিলক তার "মারাঠা" ও "কেশরী" পত্রিকায় একের পর এক প্রবন্ধ লিখে ব্রিটিশ সরকারের কঠোর সমালোচনা করলে সরকার ১৯০৮ খ্রিঃ ২৪ জুন বাল গঙ্গাধর তিলককে গ্রেপ্তার করে।
তিলকের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বোম্বাইয়ের সমস্ত বাজার ১০ দিন ধরে বন্ধ থাকে। বোম্বাই বন্দর, বস্ত্র কারখানা ও রেল ওয়ার্কশপের শ্রমিকরা তিলকের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ধর্মঘট করেন। প্রায় ৬ দিন ধরে তাদের ধর্মঘট চলে। সরকার পুলিশ ও সেনা নামিয়ে ধর্মঘট ভাঙ্গার চেষ্টা করলে সেনার গুলিতে ১৬ জন শ্রমিক নিহত হন ও ৫০ জন শ্রমিক আহত হয়। ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে, এই ধর্মঘট ছিলো প্রকৃত অর্থে ছিলো রাজনৈতিক ধর্মঘট।
(চ.) মূল্যায়ন :-
সবশেষে বলা যায়, স্বদেশী যুগের শ্রমিক আন্দোলন গুলি শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবি দাওয়ার ভিত্তিতে সংগঠিত হলেও, সেগুলি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবি দাওয়ার গোন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলি আর্থিক চাহিদার গোন্ডি অতিক্রম করে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো। এই পর্বের শ্রমিক আন্দোলন গুলির এটিই ছিলো সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য ও প্রবনতা। এর ফলে এই পর্বের শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকদের রাজনৈতিক সচেতনতাও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিলো।
গ্রন্থঋন
১. আধুনিক ভারত (পলাশি থেকে নেহরু) - সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়।
২. আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৭০৭ - ১৯৬৪) - সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়।
৩.আধুনিক ভারতের ইতিহাস (ব্রিটিশরাজ থেকে নেহেরু) - রতন কুমার বিশ্বাস।
৪. আধুনিক ভারতের রূপান্তর - রাজ থেকে স্বরাজ - সমর কুমার মল্লিক ।
৫. আধুনিক ভারত ও বিশ্বের ইতিহাস - জীবন মুখোপাধ্যায়।
৬. ভারত ইতিহাস পরিক্রমা - প্রভাতাংশু মাইতি ও অসিত কুমার মন্ডল।
৭. ভারতের ইতিহাস - আধুনিক যুগ ১৭০৭ - ১৯৬৪ - তেসলিম চৌধুরী।
৮. পলাশী থেকে পার্টিশান - শেখর বন্দোপাধ্যায়।
৯. আধুনিক ভারতের ইতিহাস - বিপান চন্দ্র।
১০. স্বদেশী আন্দোলন : বাংলা ও বাঙালি - সম্পাদক অমিতাভ দাশগুপ্ত।