ভারতে শিল্প শ্রমিকের উদ্ভব ও শ্রমিক আন্দোলন

ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ভারত ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিলো  "শিল্প শ্রমিকের উদ্ভব" ও "শ্রমিক আন্দোলন"। একথা ঠিক ইংরেজরা ভারতে আসার আগে ভারতবর্ষে শ্রমদানকারী শ্রেনীর অস্তিত্ব থাকলেও, তথাকথিত ইওরোপীয় ধাঁচের বৃহৎ শিল্প বা কারখানা ভিত্তিক "শিল্প শ্রমিকের" অস্তিত্ব ছিলো না।

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূত্র ধরে "মধ্যবিত্ত শ্রেনী" নামক যেমন একটি নতুন শ্রেনীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো। ঠিক তেমনই ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে কারখানা ভিত্তিক "শিল্প শ্রমিক" নামেও একটি নতুন শ্রেনীর উদ্ভব ঘটে। ইংরেজ পরিমন্ডলে উদ্ভুত" মধ্যবিত্ত শ্রেনী" ও "শিল্প শ্রমিক শ্রেনী" এক অর্থে ছিলো সহদর। পরবর্তীকালে এই দুই শ্রেনীর পারস্পরিক সম্পর্কে ভারতে তীব্র হয়ে উঠেছিলো "শ্রমিক আন্দোলন"।

ভারতে শিল্প শ্রমিকের উদ্ভব ও শ্রমিক আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
ভারতে শিল্প শ্রমিকের উদ্ভব ও শ্রমিক আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় 

(ক.) ভারতে কিভাবে শিল্প শ্রমিকের উদ্ভব ঘটে? 

ইংরেজ আমলে একাধিক কারনে ভারতে শিল্প শ্রমিকের উদ্ভব ঘটে। যেমন - 

(১.) অবশিল্পায়নের প্রভাব :- 

ইংরেজ বনিকরা ভারতে পদার্পণের আগে ভারতের শিল্প ছিলো মূলত কুটির শিল্প। "কুটির" অর্থাৎ বাড়ির মধ্য থেকেই সেই শিল্প পরিচালিত হতো। শিল্পকর্ম বৃহৎ যন্ত্রনির্ভর ছিলো না। ছিলো হস্তচালিত। সাধারনত বাড়ির ছোট বড়ো সকল সদস্যরাই হস্তচালিত কুটির শিল্পে শ্রমদান করতো। কিন্তু ইংরেজদের অবাধ বানিজ্য নীতি, বৈষম্যমূলক শুল্ক নীতি ইত্যাদির কারনে ভারতে অবশিল্পায়ন ঘটে। 

অবশিল্পায়নে ভারতীয় শিল্পের অবনমন ঘটে। ইংরেজদের অবাধ ও সস্তা পন্যের চাপে ভারতীয় কুটির শিল্প ভেঙ্গে পড়তে থাকে। এর ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। এই বেকারদের একটা অংশ কৃষি জমিতে গিয়ে জীবিকা অন্বেষনের চেষ্টা করে। অন্য অংশটি পরবর্তীকালে শিল্প শ্রমিকে পরিনত হয়।

(২.) ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের শিল্প বিকাশ :-

১৮১৩ ও ১৮৩৩ খ্রিঃ চার্টার আইনে ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বানিজ্যের অবসান ঘটিয়ে অন্যান্য ইওরোপীয় পুঁজিপতিদের ভারতে পুঁজি ইনভেস্ট করার পথ প্রশস্ত করা হয়।

এর ফলে ইওরোপীয় ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা ভারতে প্রবেশ করে বৃহৎ শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করেন। পরে এদের সঙ্গে কিছু ভারতীয় উদ্যোগপতিও শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসেন। এইভাবে প্রথমদিকে ব্রিটিশ পুঁজিপতি এবং পরবর্তীকালে দেশীয় উদ্যোগপতিদের প্রচেষ্টায় ভারতে বৃহৎ যন্ত্রনির্ভর শিল্প ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। 

এই সময় লৌহ ইস্পাত শিল্প, কাগজ শিল্প, পাট শিল্প ,কয়লা শিল্প , সিমেন্ট ও রাসায়নিক শিল্প ও কারখানা এবং রেল শিল্পের বিকাশ ঘটলে ভারতে শিল্প শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে।

(৩.) অনুকূল সামাজিক পরিবেশ:-

ভারতে শিল্প শ্রমিকের উৎপত্তির ক্ষেত্রে তৎকালীন ভারতীয় সমাজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। সেই সময় ভারতের সমাজ ছিলো যৌথ পরিবার ভিত্তিক। ফলে পরিবারের কর্মহীন ব্যক্তি অন্য জায়গায় শ্রমিক হিসাবে কাজে চলে গেলে বিশেষ কোন সমস্যা হতো না। কারন ঐ ব্যক্তির অনুপস্থিততে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাই গ্রামের সম্পত্তি ও পরিবারকে দেখভাল করতেন।

বিহার, ঊড়িষ্যা, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ থেকে বহু চাষি এই ভাবেই শ্রমিকে পরিনত হয়। তাদের শ্রমিক হওয়ার পিছুনে বড়ো কারনটি অবশ্য ছিলো ধীরে ধীরে লোকসংখ্যার চাপে কৃষিতে মাথাপিছু আয় যথেষ্ট কমে যাচ্ছিলোবাড়তি রোজগারের আশাতেই তারা শ্রমিক হয়েছিলো।


(৪.) বিংশ শতাব্দীর অনুকূল পরিবেশ :-

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতে শিল্প শ্রমিকের সংখ্যা বহুগুন বৃদ্ধি পায়। স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেশীয় কারখানার প্রসার ঘটলে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিলিতি পন্যের সরবরাহ কম হলে ভারতীয়দের উদ্যোগে শিল্প প্রসারের পথ প্রশস্ত হয়। এই সময় শিল্প শ্রমিকের সংখ্যাও স্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায়।


(খ.) শ্রমিকদের সংখ্যা ও পরিমান :- 

আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী ১৯১১ খ্রিঃ ৩০৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে সংগঠিত শিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা ছিলো ২.১ মিলিয়ন১৯১১ থেকে ১৯২১ খ্রিঃ মধ্যে এদের সঙ্গে যুক্ত হয় আরোও ৫৭৫০০০ জন। এই তথ্যের বাইরে অসংগঠিত ক্ষেত্রের অনেক শ্রমিক ছিলো। এদের একটা বড়ো অংশ বন্দর বা বাজার গুলিতে ঠিকা শ্রমিক হিসাবে কাজ করতো অথবা লোকের বাড়িতে ভৃত্যের কাজ করতোতথ্যের অপ্রতুলতার জন্য এদের পরিসংখ্যান সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।

মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক রজনীপাম দত্তের মতে, স্যার জর্জ পেইনের তথ্য অনুযায়ী ১৯১১ খ্রিঃ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ও ভারতবর্ষে ব্রিটিশ পুঁজির লগ্নীর পরিমান ছিলো ৬৫০ লক্ষ পাউন্ড। এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, ভারতের বিভিন্ন শহরে শিল্পের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের সংখ্যাও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিলো। 

(গ.) ভারতীয় শ্রমিকদের প্রকৃতি :-

ভারতীয় শ্রমিকদের ছাঁচ ও ধরন ইওরোপীয় ধরনের মতো ছিলো না। দুই জায়গাতেই শ্রমিকরা গ্রাম থেকে উঠে এলেও, এক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য ছিলো।

(ক.) ইওরোপের শ্রমিকরা গ্রাম ছেড়ে একেবারে পাকাপাকি ভাবে শহরে এসে শ্রমিক হিসাবে থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতীয় শ্রমিকরা শহরে কাজ করতে এলেও, গ্রামের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিলো। ফলে তারা একাধারে ছিলো শ্রমিক, অন্যদিকে কৃষক। ইংল্যান্ডে বা ইওরোপের অন্য দেশের ক্ষেত্রে এটি ছিলো না। তারা গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেই শহরে এসেছিলো।

(খ.) ভারতীয় শ্রমিকদের মধ্যে কোন শ্রেনী সচেতনতা ছিলো না। তারা ধর্মগত ও জাতিগত নানা আনুগত্যের বন্ধনে বিভক্ত ছিলো। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ছোটো বড়ো নানা সংঘাতও মাঝে মধ্যে লেগে থাকতো। যেমন কলকাতায় বকরি ঈদ ও রথযাত্রার ছুটি দেওয়া নিয়ে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের শ্রমিকরা মাঝে মধ্যেই লড়াই ও দাঙ্গা বাঁধাতো। আবার অনেক সময় হিন্দু দারোয়ান মুসলিম শ্রমিকদের লেট করে এলে কাজে ঢুকতে দিতো না। এ নিয়েও দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই বিবাদ অনেক সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ নিতো।

(ঘ.) কিভাবে শ্রমিকদের নিয়োগ করা হতো? 

ভারতীয় শ্রমিকদের কলকারখানায় নিয়োগ করতো ঠিকাদাররা। এই ঠিকাদারেরাও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্য থেকেই উঠে আসতো। পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে এইসব ঠিকাদারদের "সরদার" এবং উত্তর ভারতে "মিস্ত্রি" বলা হতো। শ্রমের চাহিদার ওঠা নামা অনুযায়ী ঠিকাদাররা কারখানায় সর্বদা শ্রমিক সরবরাহ নিশ্চিত রাখতো। 

এটি করতে গিয়েই পরবর্তীকালে এই ঠিকাদারেরা অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ন হয়ে উঠেছিলো। তারা অনেক সময়েই শ্রমিকদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তাদের "শ্রমিক" হিসাবে নিযুক্ত করতো।

শ্রমিকরা কাজের জন্য সরদারদের ওপর নির্ভর করলেও, সরদারদের অতিরিক্ত খবরদারি অথবা শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী কোন কাজের জন্য অনেক সময় শ্রমিক শ্রেণী সরদারদের বিরুদ্ধাচরনও করতো। ১৯১৯ - ২০ খ্রিঃ সরদারদের খবরদারির বিরুদ্ধে কলকাতার চটকল গুলিতে অনেক আন্দোলন ও ধর্মঘট হয়েছিলো।

(ঙ.) শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থার চিত্র :- 

(১.) ভারতে শ্রমিক শ্রেণী সহজলভ্য হওয়ায় তাদের কাজের কোন নিরাপত্তা ছিলো না।
(২.) শ্রমিকদের বেতন ছিলো অনেক কম। 
(৩.) অনেক সময় তাদের ঠিকমতো বেতন দেওয়া হতো না। যন্ত্রপাতি নষ্টের অভিযোগে মালিক পক্ষ বেতন কেটে নিতো। 
(৪.) ঊনিশ শতকের শেষদিকে বিভিন্ন শিল্পে শ্রমিকদের দৈনিক ১৫/১৬ ঘন্টা করে কাজ করতে হতো
(৫.) ফ্যাক্টরীতে বিদ্যুতের আলো এসে গেলে কাজের সময় আরোও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। 
(৬.) অধিক লাভের আশায় বিভিন্ন কারখানায় নামমাত্র মজুরিতে ৩০ - ৪০% শিশু শ্রমিককে নিযুক্ত করা হতো। 
(৭.) পশ্চিম ভারতের সুতাকল গুলিতে পুরুষ, নারী ও শিশু শ্রমিকদের বেতন ছিলো যথাক্রমে ১২ টাকা, ৯ টাকা ও ৬ টাকা। অর্থাৎ বেতনে বৈষম্য ছিলো। 
(৮.) শ্রমিকরা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতো। 


ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের উদ্ভব ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় :-

ভারতে শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গেই শ্রমিক আন্দোলনেরও সূত্রপাত হয়। 

শ্রমিক আন্দোলনের বিভিন্ন পর্ব :- 

ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসকে আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগতি প্রকৃতির ধরন অনুযায়ী ৫ টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যথা - 
(১.) ১৮৫০ খ্রিঃ থেকে ১৯০৩ খ্রিঃ পর্যন্ত ছিলো শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম পর্ব
(২.) ১৯০৫ থেকে ১৯১৭ খ্রিঃ পর্যন্ত ছিলো শ্রমিক আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব
(৩.) ১৯১৮ খ্রিঃ থেকে ১৯২২ খ্রিঃ পর্যন্ত ছিলো শ্রমিক আন্দোলনের তৃতীয় পর্ব
(৪.) ১৯২৭ থেকে ১৯৪৬ খ্রিঃ পর্যন্ত ছিলো শ্রমিক আন্দোলনের চতুর্থ পর্ব। 

(১.) প্রথম পর্বের শ্রমিক আন্দোলন :-

(I) প্রথম দিকের শ্রমিক আন্দোলন গুলি ছিলো - বিক্ষিপ্ত ও ইতস্তত (II) কোন শ্রেণী চেতনা, রাজনৈতিক মতাদর্শ বা রাজনৈতিক আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শ্রমিকরা আন্দোলন করে নি। (III) এই সময়ের শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিক সংগঠনের কোন ভূমিকাও ছিলো না

প্রধানত মালিকের জুলুম, আর্থিক দুর্গতি, স্বপ্ল মজুরি, অমানুষিক পরিশ্রমের তাড়নায় শ্রমিকেরা মাঝে মধ্যে এইসময়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলো। এই পর্বে - 

(ক.) ১৮৬০ খ্রিঃ দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর প্রেরনায় আসামের চা বাগানের শ্রমিকরা প্রথম ধর্মঘট করে। 

(খ.) তবে ১৮৬২ খ্রিঃ ভারতের প্রথম শিল্প শ্রমিকদের ধর্মঘট হয় কলকাতায়। হাওড়া রেল স্টেশনের ১২০০ শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘট করে। 

(গ.) এই পর্বে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের অনেক ব্যক্তি শ্রমিক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এরা প্রত্যেকেই ব্রাহ্মসমাজের ব্যক্তি ছিলেন। ১৮৭০ খ্রিঃ ব্রাহ্ম নেতা শশীপদ ব্যানার্জি বরানগরে চটকল শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে এক পয়সার "ভারত শ্রমজীবী" পত্রিকা ও "শ্রমজীবী সমিতি" (১৮৭১) প্রতিষ্ঠা করেন। 

(ঘ.) একই ধরনের প্রচেষ্টা এইসময় পশ্চিম ভারতেও লক্ষ্য করা যায়। ১৮৭২ খ্রিঃ ব্রাহ্মসমাজের আরেক সভ্য পি সি মজুমদার বোম্বাই নগরে শ্রমিকদের শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে ৮ টি নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ১৮৯০ খ্রিঃ নারায়ন মেঘাজী লোখুন্ডে নামে এক সমাজসেবী বোম্বে মিল হ্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে এই প্রতিষ্ঠানকে ভারতের প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন বলে অভিহিত করেন। 

(ঙ.) ১৮৮২ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে মাদ্রাজ ও বোম্বেতে ২৫ টি এবং ১৮৯২-৯৩ সালে বোম্বেতে আরোও কয়েকটি শ্রমিক ধর্মঘটের উল্লেখ সরকারি নথিপত্র থেকে জানা যায়। 

প্রথম পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য :- 

প্রথম পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন - 
(১.) শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা পর্বে ব্রিটিশ মালিকানাধীন সংস্থা গুলিতেই প্রথম সংগঠিত আন্দোলন শুরু হয়। 
(২.) অনেক ক্ষেত্রে এই পর্বে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে মধ্যবিত্ত শ্রেনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
(৩.) প্রথম পর্যায়ে মূলত কাজের সময় বেঁধে দেওয়ার জন্যই আন্দোলন হয়েছিলো। এইজন্য ১৮৮১ খ্রিঃ এবং ১৮৯১ খ্রিঃ পর পর দুটি ফ্যাক্টরি আইন পাশ করে শিশুদের কাজের সময় ৯ ঘন্টা এবং নারীদের কাজের সময় কমিয়ে ১১ ঘন্টায় বেঁধে দেওয়া হয়। 
(৪.) এই পর্বের শ্রমিক আন্দোলন ছিলো ইতস্তত ও বিক্ষিপ্ত
(৫.) কোন সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠনের উদ্ভব এই পর্বে ঘটে নি। এই পর্বের শ্রমিক সংগঠন গুলির আয়ুও ছিলো ক্ষনস্থায়ী।
(৬.) শ্রমিক শ্রেণী কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ বা আন্দোলন দ্বারা সংগঠিত হয় নি। 

(২.) দ্বিতীয় পর্বের শ্রমিক আন্দোলন :- 

১৯০৫ থেকে ১৯১৭ খ্রিঃ পর্যন্ত সময়কালকে শ্রমিক আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় বলে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। 

(ক.) দ্বিতীয় পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য :- 

দ্বিতীয় পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য বা প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন - 
(১.) দ্বিতীয় পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধি ও জাতিগত বৈষম্যের প্রতিবাদে আন্দোলন সংগঠিত হয়। 
(২.) এই সময় চা, কফি, রবার, তুলা প্রভৃতি বাগিচা গুলিতে শ্রমিক চালান দেওয়া এবং শ্রমিকদের ওপর জাতিগত বৈষম্যমূলক ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হয়। 
(৩.) এই পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের রাজনৈতিক চেতনার জাগরন ঘটে। ১৯০৫ - ১৯০৮ সময়কালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনতিলকের গ্রেপ্তারের প্রভাবে এই সময় শ্রমিক আন্দোলনে গতি আসে। 
(৪.) ১৯০৯ থেকে ১৯১৩ খ্রিঃ পর্যন্ত ভারতের শ্রমিক আন্দোলন সমাজ সেবামূলক মনোভাব নিয়েই চলে। 
(৫.) ১৯১৪ খ্রিঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় শ্রমিক আন্দোলনে সাময়িক ভাঁটা পড়ে। 

(খ.) দ্বিতীয় পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের পরিচয় :- 

১৯০৫ খ্রিঃ শ্রমিক শ্রেণী সর্বপ্রথম রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। এই সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে বাংলায় শ্রমিক আন্দোলনে জোয়ার আসে। শ্রমিকরা রাজনৈতিক চেতনা ও আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই সময় বাংলায় সরকারি ছাপাখানা কর্মীরা, রেল কর্মীরা ও চলকলের কর্মীরা ধর্মঘট করেন। 

শ্রমিকরা এই সময়  অর্থনৈতিক কারনে বিশেষত মজুরি বৃদ্ধির কারনে ধর্মঘট করলে স্বদেশী আন্দোলনের অনেক নেতা ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনী শ্রমিকদের ধর্মঘট ও আন্দোলন গুলিকে সমর্থন করেন। এই সময় অনেক মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। তবে বঙ্গভঙ্গ পর্বে তাদের এই উদ্যোগ কোন সর্বভারতীয় রূপ লাভ করে নি। ফলতঃ বঙ্গভঙ্গ পর্বের শ্রমিক আন্দোলনকে একটি বিচ্ছিন্ন বা ইতস্তত ঘটনা বলেই মনে করা হয়। 

১৯০৮ খ্রিঃ ২৪ জুন ইংরেজ সরকার বাল গঙ্গাধর তিলককে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামলা দায়ের করে। তিলকের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে মহারাষ্ট্রে প্রবল বিক্ষোভ দেখা যায়। বোম্বাইয়ের বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিকরা এই সময় ধর্মঘট করে। বন্দরের এক হাজার কর্মী ধর্মঘটে যোগ দেয়। এই ধর্মঘটের বৈশিষ্ট্য ছিলো এই যে, এটি ছিলো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। এর সঙ্গে শ্রমিকদের কোন আর্থিক দাবি দাওয়ার সম্পর্ক ছিলো না।

১৯০৯ খ্রিঃ থেকে ১৯১৩ খ্রিঃ পর্যন্ত ভারতের শ্রমিক আন্দোলন সমাজসেবামূলক মনোভাব নিয়েই পরিচালিত হয়। এই পর্বে বোম্বাইয়ের কামগড় হিতবর্ধন সভা, সোসাল সার্ভিস লীগ, সারভেন্ট অব ইন্ডিয়া সোসাইটি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান গুলি শ্রমিকদের মধ্যে নানা সমাজ সেবামূলক কাজ করতে থাকে।

১৯১১ খ্রিঃ ইংরেজ সরকার "ভারতীয় কারখানা আইন" প্রণয়ন করেন। এই আইনে কাজের সময় বেঁধে দেওয়া হয় এবং শিশু ও নারী শ্রমিকদের জন্য কিছু সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯১৪ খ্রিঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় শ্রমিক আন্দোলনে সাময়িক ভাবে ভাঁটা পড়ে

(৩.) তৃতীয় পর্বের শ্রমিক আন্দোলন

ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৯১৮ খ্রিঃ থেকে।

(ক.) তৃতীয় পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য :-

এই পর্বের শ্রমিক আন্দোলনের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা - 

১. এই সময় থেকে শ্রমিক আন্দোলন আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করে। 
২. সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বেশ কিছু শ্রমিক সংগঠনের উদ্ভব ঘটতে শুরু করে। 
৩. এই পর্বে শ্রমিক সংগঠনে জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের সক্রিয় ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। 
৪. এই পর্বেও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনী শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 
৫. এই পর্বেই শ্রমিক আন্দোলন শ্রেনী সংগ্রামের চেতনার দ্বারা প্রভাবিত হয়। 
৬. আধুনিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সূচনা এই পর্ব থেকেই শুরু হয়। 

(খ.) তৃতীয় পর্বে শ্রমিক আন্দোলনের কারন :-

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিক আন্দোলনে প্রবল গতিবেগ দেখা যায়। এর পিছুনে অনেক গুলি কারন ছিলো। যথা - 

১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মারাত্মক আকার ধারন করলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধে। 
২. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইওরোপীয় পুঁজির ভারতে প্রবেশ করতে নানা বাধার সম্মুখীন হয়। এই সুযোগে ভারতীয় শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। কিন্তু যুদ্ধান্তে শিল্প ও বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিলে ব্যাপকভাবে শ্রমিক ছাটাই চলতে থাকে। 
৩. ১৯১৭ খ্রিঃ সোভিয়েত রাশিয়ায় সাম্যবাদী বিপ্লব হলে তা শ্রমিক শ্রেণীকে রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক বেশি সচেতন করে। 
৪. এই সময়ে রাওলাট সত্যাগ্রহ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, খিলাফৎ অসহযোগ আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে গভীর উদ্দীপনার সঞ্চার করে। 

(গ.) শ্রমিক সংগঠনের বিস্তার :-

এই সময় শ্রমিক শোষন বৃদ্ধি পেলে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে এগিয়ে আসেন শ্রমিক নেতা বি পি ওয়াদিয়া। তিনি ১৯১৮ খ্রিঃ "মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন" গঠন করে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে শ্রমিক আন্দোলনের ডাক দেন। একে ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের আধুনিক পর্যায়ের সূচনা বলা যায়। মাসিক এক আনা চাঁদার ভিত্তিতে এর সদস্য হওয়া যেতো। এই ইউনিয়নে প্রথমে শুধুমাত্র কলকারখানার শ্রমিকদের সদস্য করা হতো। পরে ট্রামকর্মী, রিক্সা চালক ও অন্যান্য শ্রেনীর শ্রমিকদেরও সদস্য করা হয়। 

"মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়নকে" অনেকে ভারতের প্রথম শ্রমিক সংগঠন বলে অভিহিত করেন। 

যাইহোক, ১৯১৮ থেকে ১৯২০ মধ্যে সারা ভারতে অসংখ্য ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় এই সময় দেশে ১২৫ টিরও অধিক ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত হয়েছিলো। এদের সম্মিলিত সদস্য সংখ্যা ছিলো আড়াই লক্ষ। 

(ঘ.) আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংঘের সঙ্গে যোগ :- 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লীগ অব নেশনের অঙ্গ হিসাবে "ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন" (I. L. O) গঠিত হয়। ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ভারতবর্ষ I. L. O র সদস্য হয়। এর ফলে ভারতীয় শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। 

ভারতীয় নেতাদের মধ্যে অনেকেই ইতিপূর্বে ইংল্যান্ডের শ্রমিক সংগঠন গুলির সঙ্গে পরিচিত লাভ করার সুযোগ পান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৭ খ্রিঃ ভারতে প্রথম মে দিবস পালন করা হয়। 

(ঙ.) ভারতের বৃহত্তর শ্রমিক সংগঠন "AITUC" প্রতিষ্ঠা :- 

"মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন" অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর সংগঠন হলেও, তা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম বৃহত্তর শ্রমিক সংগঠনটি ছিলো "All India trade union Congress" বা AITUC১৯২০ খ্রিঃ জুলাই মাসে বোম্বাই শহরে তিলকের নেতৃত্বে এক শ্রমিক সমাবেশে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। লালা লাজপত রায়কে এই সংগঠনের প্রথম সভাপতি নির্বাচন করা হয়। 

গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলনকে সর্বাত্মক রূপ দিতে AITUC গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে ১৯২০ খ্রিঃ AITUC উদ্যোগে মোট ২০০ টি শ্রমিক ধর্মঘট পালিত হয়। অসহযোগ আন্দোলনের সময় ১৯২১ খ্রিঃ ধর্মঘটের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭৬ টিতে। ১৯২২ খ্রিঃ তার সংখ্যা আরোও বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫০ টিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলো বোম্বাইয়ে প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত আগমনের প্রতিবাদের ধর্মঘট। 

১৯২১ খ্রিঃ ইংল্যান্ডের যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলস ভারত ভ্রমণ উপলক্ষে বোম্বাইয়ে এলে বোম্বাই শহরে ১ লক্ষ ৪০ হাজার সুতিকল শ্রমিক ধর্মঘটে নামে। এই সময়ের এক সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯২০ খ্রিঃ বিভিন্ন স্থানের ধর্মঘটে প্রায় ৪ লক্ষ শ্রমিক এবং ১৯২১ খ্রিঃ ৬ লক্ষ শ্রমিক ধর্মঘটে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। 

১৯২২ খ্রিঃ অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করার পর পর শ্রমিক আন্দোলনের গতি কিছুটা হ্রাস পায়। "Royal commission of Labour" এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯২১ সালে ভারতে মোট ৩৭৬ টি ধর্মঘট হয়। কিন্তু ১৯২৪ থেকে ১৯২৭ সালের মধ্যে ধর্মঘটের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৩০ টিতে। 

(৪.) চতুর্থ পর্বের শ্রমিক আন্দোলন :- 

১৯২৭ খ্রিঃ থেকে ভারতে চতুর্থ পর্বের শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। এই সময়ে শ্রমিক আন্দোলনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা - 
(১.) এই সময়ে ধর্মঘট গুলি পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র আকার ধারন করে। 
(২.) এই সব ধর্মঘট গুলিতে নবজাত কমিউনিস্ট পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। 

(ক.) চতুর্থ পর্বে ধর্মঘটের পরিচয় :- 

চতুর্থ পর্বে শিল্প ক্ষেত্রে ব্যাপক মন্দা দেখা দেওয়ায় শিল্পপতিরা ব্যাপক ছাঁটাই নীতি গ্রহণ করে। এর ফলে এই সময় ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত হয়। এইসব ধর্মঘট গুলি সংগঠনে কমিউনিস্ট পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। 

(১.) ১৯২৭ খ্রিঃ ১২ ফেব্রুয়ারি খড়্গপুর রেল শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। এই ধর্মঘটে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক যোগ দেয়। মার্চ মাসে এই ধর্মঘট উঠে গেলে সরকার ১৭০০ শ্রমিককে ছাঁটাই করতে চাইলে পুনরায় শ্রমিক শ্রেণী ধর্মঘটে সামিল হয়। 
(২.) ১৯২৮ খ্রিঃ লিলুয়ার ইস্ট ইন্ডিয়ান এবং সাউথ ইন্ডিয়ান রেলে ধর্মঘট হয়। লিলুয়ার ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেন ধরনী গোস্বামী, গোপেন চক্রবর্তী, কিরন মিত্র ও শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। 
(৩.) বস্ত্র শিল্পে শ্রমিক ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে ১৯২৮ ও ১৯২৯ খ্রিঃ বোম্বাইয়ের বস্ত্রশিল্প শ্রমিকরা দুবার ধর্মঘট করে। প্রায় ৬ মাস ধরে এই ধর্মঘট গুলি চলে। এই সময় কমিউনিস্টদের উদ্যোগে বস্ত্রকল শ্রমিকদের জঙ্গি সংগঠন "গিরনি কামগার ইউনিয়ন" (১৯২৮ খ্রিঃ) প্রতিষ্ঠিত হয়।
(৪.) ১৯২৮ ও ১৯২৯ খ্রিঃ বাংলার পাটকল গুলিতে শ্রমিক ছাঁটাই ও কাজের সময় বৃদ্ধির প্রতিবাদে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট সংঘটিত হয়। ১৯২৯ খ্রিঃ জুলাই আগস্ট মাসে ৬০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই ও কাজের সময় বৃদ্ধির প্রতিবাদে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল গুলির ২ লক্ষ শ্রমিক ৩৭ দিন ধরে অনশন চালায়। এই ধর্মঘট পরিচালনা করেছিলো "বেঙ্গল জুট ওয়ার্কাশ ইউনিয়ন"। বহু কমিউনিস্ট নেতা এই শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। 

(খ.) শ্রমিক সংগঠনে বামপন্থীদের ভূমিকা:- 

১৯২৫ খ্রিঃ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতে শ্রমিক আন্দোলনে বামপন্থীদের প্রভাব অনেক বেশি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিলো। ১৯২২ খ্রিঃ থেকেই শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্টদের প্রভাব দেখা যেতে থাকে। ১৯২৫ খ্রিঃ থেকে ১৯২৯ খ্রিঃ শিল্প ধর্মঘট গুলির সংগঠনে বামপন্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। 

১৯২৬  - ২৮ খ্রিঃ মধ্যে বামপন্থীদের উদ্যোগে বাংলা, বোম্বাই, পাঞ্জাব ও যুক্ত প্রদেশে "Workers and peasants party" প্রতিষ্ঠার দ্বারা শ্রমিকদের ব্যাপক ভাবে সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন - মুজাফফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, পি সি যোশী। বামেরা গনবানী, শ্রমিক, ক্রান্তি প্রভৃতি পত্র পত্রিকার মাধ্যমে শ্রেনী সংগ্রামের আদর্শ ছড়িয়ে দেন। 

(গ.) জঙ্গী ধর্মঘট ও দমন নীতি :- 

বামপন্থীদের প্রভাবে ১৯২৭ খ্রিঃ থেকে শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘট জঙ্গী রূপ নিলে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। ১৯২৮ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি মাসে সাইমন কমিশন ভারতে এলে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ ভাবে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলনবিক্ষোভে অংশ নেন। 

এই সময় শ্রমিক আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে ১৯২৯ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার শ্রমিক আন্দোলনের গতি রোধের জন্য "জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স" জারি করেন এবং ১৯২৯ খ্রিঃ শ্রমিক আন্দোলনের মতদদাতা কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তার করে "মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা" দায়ের করে। 

এরপর ১৯৩০ খ্রিঃ আইন অমান্য আন্দোলন ও ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন দুটি থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের সরিয়ে রাখে। ফলে ঐ পর্বে  বামপন্থীদের উদ্যোগে কোন কার্যকরী শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হয় নি। 

জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাবে এবং জাতীয় ঘটনাবলীর সঙ্গে সাযুর্জ্য রেখে বেশ কিছু শ্রমিক ধর্মঘট অবশ্য এই পর্বেও চলতে থাকে। এর মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছিলো আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিচারকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের ধর্মঘট। ১৯৪৬ খ্রিঃ ২২ ফেব্রুয়ারি, বোম্বাইয়ের প্রায় ৩ লক্ষ শ্রমিক ধর্মঘট করে। এই ধর্মঘটে পুলিশ গুলি চালালে প্রায় ২৫০ জন শ্রমিক নিহত হয়। 

শেষ কথা 

সবশেষে বলা যায়, ভারতের শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে আমাদের এই আলোচনাটি নিঃসন্দেহে একটি অসম্পূর্ন রচনা। ভারতে ১৮৫০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত, প্রায় একশত বৎসরের শ্রমিক আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাসকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে একটি প্রবন্ধে তুলে ধরা শুধু অসম্ভবই নয়, অসম্পূর্নও বটে। আমরা এই আলোচনায় শ্রমিক আন্দোলনের পট পরিবর্তনের মূল দিক ও সূত্র গুলি তুলে ধরে ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের সামগ্রিক চরিত্র ও রূপটি বোঝবার চেষ্টা করেছি মাত্র। 

একথা ঠিক, ভারতের শ্রমিক শ্রেণী ও শ্রমিক আন্দোলন কখনই ইওরোপীয় ধাঁচ ও ধরনের ছিলো না।জাতি,ধর্ম,বর্ন, ভাষা ও আঞ্চলিক নানা তারতম্যে শ্রমিক শ্রেনী বিভাজিত ছিলো। ভারতীয় শ্রমিকদের একটা বড়ো অংশই একাধারে ছিলো কৃষক। শ্রমিকরা ছিলেন নিরক্ষরঅশিক্ষিত। এইসব প্রতিবন্ধকতা সত্বেও ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ শ্রমিক শ্রেণীকে সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

তবে নেতৃত্বের মধ্যে মতাদর্শগত নানা পার্থক্য থাকায় শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনকে সোভিয়েত রাশিয়ার মতো বিপ্লবের দোরগড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় নি। ভারতের শ্রমিক শ্রেণী "বিপ্লব" সংগঠিত করতে না পারলেও, তাদের আন্দোলন ব্যর্থ ছিলো এমনটা মনে করার কোন কারন নেই। মাথায় রাখতে হবে ভারতের শ্রমিক শ্রেণী শুধু পুঁজিপতি শোষনের বিরোধিতা করে নি। সাম্রাজ্যবাদী শাসনেরও বিরোধিতা করেছিলেন। তারা ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সেরা সৈনিক। 


 
প্রতি রবিবার প্রকাশিত হয় নতুন লেখা। *** প্রতি রবিবার প্রকাশিত হয় নতুন লেখা। *** প্রতি রবিবার প্রকাশিত হয় নতুন লেখা। **** প্রতি রবিবার প্রকাশিত হয় নতুন লেখা।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post