বিশ শতকের কৃষক আন্দোলন একটি পর্যালোচনা

ভারতবর্ষ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিকাজই এখানকার মানুষদের প্রধান জীবিকা। ভারতের প্রায় ৮০% মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের অর্থনীতিরও মূল স্তম্ভ ও চালিকা শক্তি ছিলো কৃষিকাজ

ইংরেজরা ভারতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ভারতের অর্থনীতির ওপর শোষন চালালে সেই শোষনের চাপ খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের কৃষক সমাজের ওপর নেমে আসে। এই কারনে দেখা যায়, ভারতে ব্রিটিশ শাসনে ধনী, উচ্চ - মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেনী অপেক্ষা কৃষক সমাজই সবথেকে বেশি শোষিত ও নির্যাতিত হয়। সীমাহীন এই শোষনের কারনেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বহু আগে থেকেই ভারতীয় কৃষক সমাজ বিদ্রোহে সামিল হয়। তাদের বিদ্রোহের সংখ্যা ভদ্রলোক শ্রেনীর ইংরেজ বিদ্রোহের সংখ্যা থেকেও পরিমানে অনেক বেশি ছিলো। ভারতে ইংরেজ শাসনের সূচনার সময়কাল থেকে অবসানের প্রাক্কাল পর্যন্ত, ভারতে কোথাও না কোথাও কৃষক বিদ্রোহ ঘটেই চলেছিলো। 

বিশ শতকের কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেনী, জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী
বিশ শতকের কৃষক আন্দোলন একটি পর্যালোচনা

(১.) কৃষক বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি:- 

ভারতে প্রথম পর্বে সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহ গুলির প্রতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী একেবারেই নির্লিপ্ত ও উদাসীন ভূমিকা নিয়েছিলো। কৃষক বিদ্রোহকে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেনী কৃষক সমাজের একান্ত নিজস্ব আভ্যন্তরীণ বিষয় বলেই মনে করতো। কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেনীর নির্লিপ্ততার একটি বড়ো কারন ছিলো ইংরেজদের ভূমিরাজস্ব নীতি। 

ইংরেজরা ভারতে এসে যে একাধিক ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, সেগুলিতে শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেনীই জমি বন্দোবস্ত লাভ করেছিলো। জমির রাজস্ব আদায় হোক বা জমি জমার মামলা মোকদ্দমার বিষয়, প্রত্যেকটি বিষয়ের সঙ্গেই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেনী জড়িতো ছিলেন। এই ভদ্রলোক শ্রেনী আবার ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে ভারতে ইংরেজ শাসনের বড়ো সমর্থকও ছিলেন। 

এমতাবস্থায়, কৃষক বিদ্রোহ মধ্যবিত্ত ভদ্র শ্রেণীর শ্রেনী স্বার্থের পরিপন্থী ছিলো। সম্ভবত এই কারনেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঘটে চলা অধিকাংশ কৃষক বিদ্রোহ গুলি সম্পর্কে মধ্যবিত্ত পরিচালিত প্রেস ও সংবাদপত্র গুলি অদ্ভুত নিরবতা অবলম্বন করেছিলো। এই নিরবতার অবসান হয় ১৮৫৯ - ৬০ খ্রিঃ নীল বিদ্রোহ। 

মাথায় রাখতে হবে, নীল বিদ্রোহ হয়েছিলো নীল চাষের বিরুদ্ধে। নীল চাষ করতো ইওরোপীয় জমিদাররাইওরোপীয় পুঁজিপতিরা ভারতে জমি কিনে বা জমি ভাড়া নিয়ে নীল চাষ শুরু করলে তা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ভদ্রলোক জমিদার শ্রেনীর সামনে প্রতিদ্বন্দ্বী ও চ্যালেঞ্জ হিসাবে হাজির হয়েছিলো।

এই কারনে দেখা যায় নীল বিদ্রোহের বিষয়টি শুধুমাত্র চাষীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। তা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেনীরও অন্যতম আলোচনা ও উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের অনেকে কৃষকদের বিদ্রোহ সংগঠনে সাহায্য করেন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে নীলকরদের অত্যাচারের বিষয়ে সরব হন।

নীল বিদ্রোহ ছাড়া বিশ শতকের পূর্বে সংগঠিত আর কোন বিদ্রোহকেই শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেনী সমর্থন করে নি। বিরোধীতাও করে নি। বরং তার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে নির্লিপ্ত ও উদাসীন ভূমিকা নিয়েছিলো।

(২.) জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বের অবস্থান :-

ভারতে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেনীর মধ্যে ক্রমাগত ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে থাকে। এই ক্ষোভকে সংগঠিত ভাবে বহিঃপ্রকাশ করার জন্য শিক্ষিত ভদ্রশ্রেনী ১৮৮৫ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা করে।

জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ভারতের উচ্চবিত্ত শ্রেনীর প্রতিনিধিদের সংগঠিত করে। এর সদস্য ও পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ছোট বড়ো জমিদার, রাজা মহারাজা, দেশীয় শিল্পপতি, উকিল, মহাজন ও বুর্জোয়া শ্রেনী। খুব স্বাভাবিক ভাবেই জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বের কার্যকলাপ ও দাবিগুলি বুর্জোয়া শ্রেনী, মহাজন ও জমিদারদের স্বার্থের অনুকূল ছিলো১৮৮৫ থেকে ১৯১৬ খ্রিঃ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেস কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় কোন কর্মসূচি গ্রহণ করে নি।

১৮৮৮ খ্রিঃ এলাহাবাদ অধিবেশন, ১৮৮৯ খ্রিঃ বোম্বাই অধিবেশন এবং ১৮৯০ খ্রিঃ কলকাতা অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এলাকা বাড়ানোর জন্য  ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবিসনদ পেশ করে। কারন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এলাকা বাড়লে তা বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থের অনুকূল হবে। চিরস্থায়ী ব্যবস্থার ফলে মধ্যবিত্ত ভদ্রশ্রেনী জমিদারি লাভ করতে পারবেন। 

জাতীয় কংগ্রেস জমিদারদের স্বার্থে কথা বলায় এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সম্প্রসারণের দাবি করায় জমিদাররা কংগ্রেসকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বে ইংরেজ অনুগত রাজা, মহারাজা, চাকুরিজীবী ও জমিদারদের যোগদান জাতীয় কংগ্রেসকে ইংরেজদের নেক নজরে রাখবার এবং তাকে নিরাপদে বেড়ে উঠবার কাজটিকে অনেক সহজতর করে দিয়েছিলো

(৩.) গান্ধীজি, জাতীয় কংগ্রেস ও কৃষক সমাজ :-

১৯১৫ খ্রিঃ গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে পদার্পণ করেন। তার ভারতে আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক কাঠামো, দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তাধারার মধ্যে একটি মৌলিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় তিন দশক জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে খেটেখাওয়া মানুষের কোন সম্পর্ক ছিলো না। কংগ্রেস ও তার কার্যকলাপ উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।

গান্ধীজি জাতীয় কংগ্রেসে যোগদানের পর কংগ্রেস সংগঠনকে ভারতে সমস্ত শ্রেনীর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি রাজনীতির সামাজিকীকরন করেন। রাজনীতিকে শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার না করে তাকে সমাজ সেবার গুরুত্বপূর্ন মাধ্যম ও হাতিয়ার হিসাবে গড়ে তোলেন। মদ্যপান নিবারন, জাতপাতের বিরোধিতা করা, অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা করা, নারীদের স্বনির্ভর করে তোলা, গ্রামোন্নয়ন, ইত্যাদি সামাজিক কর্মসূচি গুলিকে কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। 

এছাড়া, জাতীয় কংগ্রেসকে গান্ধীজি সমাজের সমস্ত স্তর ও শ্রেনীর মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ছোট ছোট দাবি গুলিকে কংগ্রেসের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে কংগ্রেসকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেনী ও স্তরের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলেন। গান্ধীজি জানতেন সমাজের বিভিন্ন স্তর ও শ্রেনীর ছোট ছোট দাবি গুলির ভিত্তিতে তাদের এক ছত্রছায়ায় সম্মিলিত করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে আন্দোলনের মাধ্যমেই গন বিপ্লবের জন্ম হবে। সেই বিরাট গন বিপ্লবের প্রবল জলোচ্ছাসেই একদিন বিলীন হয়ে পড়বে ভারতের সাম্রাজ্যবাদী শাসন। 

গান্ধীজি জানতেন ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশ। ভারতের প্রায় ৮০% মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত এবং তারা গ্রামেই থাকেন। ঐ বিরাট সংখ্যক মানুষকে বাদ দিয়ে ভারতের কোন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই সফল হতে পারে না। কারন কৃষকরা এমনই একটি শক্তিশালী মাধ্যম যারা মাটিতে মিশে থাকেন এবং তাদের সত্ত্বার শিকড়ও মাটিতে গ্রথিত থাকে। একমাত্র কৃষকদের মধ্য দিয়েই জাতীয় আন্দোলনের শিকড় ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই জাতীয় আন্দোলনকে শক্তিশালী ও সফল করে তুলতে গেলে জাতীয় আন্দোলনে কৃষকদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। 

মাথায় রাখতে হবে, ভারতে গান্ধীজির আবির্ভাব ও পরিচিতি কিন্তু কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ঘটেছিলো। ১৯১৭ খ্রিঃ গান্ধীজি বিহারের চম্পারনে নীলচাষের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন সংগঠিত করেন। এরপরের বছর ১৯১৮ খ্রিঃ গুজরাটে খেদা সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেন। এই সব সফলতা গান্ধীজির উত্থানের এবং জাতীয় কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব গ্রহনের পথকে সুগম করে। 

কৃষক আন্দোলন পরিচালনার সময়েই গান্ধীজি উপলব্ধি করেন কৃষকদের মধ্যে সংগ্রাম করার এক বিরাট ক্ষমতা রয়েছে। বস্তুতপক্ষে কায়িক শ্রমদানকারী যে কোন শ্রেণীর মধ্যেই এই ক্ষমতা থাকে। একেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন গান্ধীজি। কৃষক সমাজের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে তোলার জন্য গান্ধীজি তথাকথিত ভদ্রলোক শ্রেনীর পোশাক বর্জন করেন এবং কৃষকদের মতোই ল্যাঙ্গোটে আচ্ছাদিত, অর্ধ অনাবৃত ও লাঠি পরিবৃত হয়ে থাকেন।

 গান্ধীজির এই রূপ ভারতের কৃষক স্কুলকে এতটাই প্রভাবিত করে যে বিশ শতকে গান্ধীকে নিয়ে কৃষক সমাজের মধ্যে নানা মিথ ও গুজব তৈরি হয়। বিশ শতকে কৃষক আন্দোলনের সময় অনেক জায়গায় কৃষকদের মধ্যে এমন গুজব ছড়িয়ে যায় যে, গান্ধীর নাম নিলে ব্রিটিশ পুলিশের গুলি জল হয়ে যায়। সাঁওতালদের মধ্যে প্রচারিত হয় গান্ধী টুপি পড়ে থাকলে ব্রিটিশ পুলিশের গুলি তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এই সব গান্ধী মিথ বিশ শতকে কৃষকদের মধ্যে কংগ্রেসের প্রভাব ও অবস্থানকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করেছিলো। 

(৪.) কৃষক আন্দোলন সংগঠনে গান্ধীজি ও কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভূমিকা :- 

গান্ধীজি কংগ্রেসের যোগ দেওয়ার পরেই কৃষকদের প্রতি জাতীয় কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গীর মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। গান্ধীজির নির্দেশে ও আহ্বানে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কৃষকদের জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। এই জন্য বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের উদ্যোগে ছোট ছোট কৃষক সভা গড়ে উঠতে থাকে। উত্তর প্রদেশ, বিহার, বাংলা, ঊড়িষ্যায় এরকম অনেক আঞ্চলিক কিষান সভা গড়ে ওঠে। এই সব কৃষক সভার মধ্য দিয়ে কৃষকরা সংঘবদ্ধ ও সংগঠিত হতে শুরু করেন। 

১৯২১ খ্রিঃ গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন, ১৯৩০ খ্রিঃ আইন অমান্য আন্দোলন ও ১৯৪২ খ্রিঃ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলে কৃষক সভা গুলিও ঐ সমস্ত আন্দোলনে সামিল হয়। বলা বাহুল্য, আঞ্চলিক স্তরে বিভিন্ন ক্ষোভ বিক্ষোভকে ব্যবহার করে বিভিন্ন কৃষক সভা গুলি এবং স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব কৃষক আন্দোলনকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। তাদের এই উদ্যোগের ফলে বিশ শতকে ভারতে কৃষক আন্দোলন এক অভূতপূর্ব গতি ও বৈশিষ্ট্য লাভ করে। 

বিশ শতকের আগের কৃষক আন্দোলন গুলি আঞ্চলিক স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকতো। সেগুলির নেতৃত্ব ও প্রভাব কৃষক সমাজের মধ্যেও আবদ্ধ থাকতো। কিন্তু বিশ শতকে কংগ্রেসের উদ্যোগের ফলে কৃষক আন্দোলন গুলি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই সময় অধিকাংশ কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন কৃষক সমাজের বাইরে থাকা লোকজন, যারা ছিলেন মূলত গান্ধীর অনুগামী বা কংগ্রেসের সদস্য। এতদিনকার কৃষক সমাজের হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনের বদলে কৃষক সমাজ সর্বপ্রথম অহিংস সত্যাগ্রহের মাধ্যমে এই পর্বে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করে। 

অবশ্য সব সময় কৃষক আন্দোলন অহিংস ছিলো এমন নয়। প্রথম পর্বে অহিংস ভাবে আন্দোলন শুরু হলেও, সরকার দমন নীতি নিলে শীঘ্রই আন্দোলন গুলি হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। অসহযোগ পর্বে চলা প্রায় সব কৃষক আন্দোলন গুলিতেই এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এই সময়কার সমস্ত কৃষক আন্দোলন গুলিরই মূল সুর ছিলো কর বয়কট করা। সব আন্দোলন গুলিই স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা বা উস্কানিতেই সংগঠিত হয়েছিলো। লক্ষ্য ছিলো অসহযোগ আন্দোলনকে কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আরোও শক্তিশালী জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। 

কিন্তু লক্ষ্য করবার মতো বিষয় হলো, আন্দোলন যখনই হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠেছিলো এবং জমিদার বিরোধী হয়ে উঠেছিলো, তখনই কংগ্রেস আন্দোলন থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলো অথবা পিছিয়ে এসেছিলো। কৃষক আন্দোলনের প্রতি কংগ্রেসের এই দ্বিচারিতার পিছুনে গান্ধীর দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির ভূমিকা বিশেষভাবে দায়ী ছিলো। 

গান্ধীজির মতাদর্শে শ্রেনী সংগ্রামের কোন স্থান ছিলো না। তিনি শ্রেনী সংগ্রামের ভিত্তিতে কখনই কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করার পক্ষপাতী ছিলেন না। মনে রাখতে হবে, গোড়া থেকেই জাতীয় কংগ্রেস বড়ো বড়ো জমিদারদের দানে চলতো। ভারতে কৃষক শোষন করতেন বড়ো বড়ো জমিদার বা জোতদার শ্রেনী। তাই কৃষকদের স্বাভাবিক শ্রেনী শত্রু ছিলো জমিদাররা। কিন্তু জমিদাররা আবার কংগ্রেসের বড়ো সমর্থক ও আর্থিক সহায়তার রসদদার ছিলেন। এমতাবস্থায়, কৃষক আন্দোলনকে শ্রেনী সংগ্রামের দিকে অর্থাৎ জমিদারদের বিরুদ্ধে চালিয়ে দিলে তা কংগ্রেসের কাছে আত্মঘাতীর সমতুল্য হয়ে দাঁড়াতো। জমিদাররা কংগ্রেস ত্যাগ করলে অথবা ব্রিটিশ অনুগত জমিদার শ্রেনী কৃষক বিদ্রোহে চটে গেলে সাংগঠনিক স্তরে কংগ্রেস যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়তে পারতো। 

তাই কংগ্রেস প্রকৃত কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করার বদলে কৃষক ক্ষোভকে জাতীয় আন্দোলনে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো। রনজিৎ গুহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, কৃষকরা নিজেরাই নিজেদের সংগঠিত করার ক্ষমতা রাখতো। নিজেদের অভাব অভিযোগকে ঠিকমতো সাজিয়ে গুছিয়ে প্রকাশ করতেও পারতো। এর বহু প্রমান বিশ শতকের আগের কৃষক আন্দোলন গুলিতে  পাওয়া যায়। বিশ শতকে উচ্চকোটির নেতাদের কৃষক আন্দোলনে হস্তক্ষেপের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের তাগিদে কৃষক আন্দোলন গুলিকে ঠিকমতো ব্যবহার করা। 

বাস্তবে এটাই ঘটেছিলো। বিশ শতকের কৃষক আন্দোলন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কংগ্রেস কখনই চিরস্থায়ী এলাকায় কৃষক আন্দোলন সংগঠনে আগ্রহ দেখায় নিতার যতো আগ্রহ ছিলো রায়তওয়ারী এলাকায়। কারন চিরস্থায়ী এলাকাটি ছিলো জমিদারদের এলাকা। ওখানে কৃষক আন্দোলন তীব্র হলে জমিদারদের স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারতো। কিন্তু রায়তওয়ারী এলাকায় সরকার সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায় করতেন। তাই ঐ সব এলাকায় কৃষক আন্দোলন তীব্র করে তুললে কংগ্রেসের রাজনৈতিক লাভ বেশি হতো বলে কংগ্রেস রায়তওয়ারী এলাকার কৃষক আন্দোলন নিয়ে অত্যন্ত উৎসাহিত ছিলো। সম্ভবত এইজন্যই অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পর কংগ্রেস ১৯২৮ খ্রিঃ বারদৌলী সত্যাগ্রহ নিয়ে এতটা উৎসাহিত হয়ে পড়েছিলো। বারদৌলী সত্যাগ্রহের মাধ্যমে কংগ্রেস অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের হতাশাকে কিছুটা দূর করার চেষ্টা করে। 

আরেকটি উদ্দেশ্য ছিলো কৃষকদের মধ্যে গান্ধীর আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসার জায়গাটাকে পাকাপোক্ত করা। কেননা অসহযোগ আন্দোলনের সময় কৃষক আন্দোলন গুলি যখনই জমিদার বিরোধী হয়ে উঠেছিলো অথবা হিংসাত্মক হয়ে উঠেছিলো, তখনই কংগ্রেস আন্দোলন থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলো। কংগ্রেসের এই ভূমিকায় কংগ্রেসেরই অনেক কৃষক নেতা বিরক্ত হয়ে কংগ্রেস ত্যাগ করেন এবং নিজেদের মতো করে কৃষকদের সংগঠিত করার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। 

প্রকৃতপক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কৃষক আন্দোলন সংগঠনে কংগ্রেস সম্পূর্ন ভাবে গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারাই পরিচালিত হয়। গান্ধীজির অনুপ্রেরণায় সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহেরু, মদনমোহন মালব্য, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা নিজেদের কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেন। কিন্তু কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হলেও, এরা গান্ধীজির নির্দেশ ছাড়া এক পা এগোতে পারতেন না। আবার অনেক সময় পিছিয়েও আসতেন। উত্তর প্রদেশের কৃষকদের কর বয়কট আন্দোলনকে গান্ধীজি সমর্থন না করলে কংগ্রেস নেতৃত্ব আন্দোলন থেকে পিছিয়ে আসেন। 

প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস কখনই জমিদারদের চটাতে চাইতো না। এইজন্য কর বয়কট বা জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদের মতো কৃষক আন্দোলনের মূল কর্মসূচি গুলিকে কংগ্রেস কখনই সমর্থন করে নি। এর ফলে কংগ্রেসের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন তার গতি হারায়

(৫.) কৃষক আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা :- 

১৯২০ দশক থেকেই ভারতে বামপন্থী চিন্তাধারার আগমন ঘটতে শুরু করে। ১৯২০ খ্রিঃ ভারতের বাইরে (তাসখন্দে) এবং  ১৯২৫ খ্রিঃ ভারতের অভ্যন্তরে (কানপুরে) ভারতের প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হবার পরেই ভারতে বামপন্থী চিন্তাধারার দ্রুত প্রসার ঘটে। 

বামপন্থীরা কংগ্রেসের তুলনায় সাংগঠনিক ভাবে অনেক দুর্বল হলেও, কৃষক আন্দোলন সংগঠনে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। বামপন্থীরা কৃষক আন্দোলনকে শ্রেনী সংগ্রামের লক্ষ্যে পরিচালিত করতে চান। 

ডি এন ধানাগারে তার "peasant movement in India" গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ১৯২৯ খ্রিঃ পর্যন্ত কমিউনিস্টরা সত্যিকারের কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার কাজ সামান্যই করেছিলো। বামপন্থী আন্দোলনের শুরুতে শ্রমিক সংগঠনে এবং কলকারখানায় ধর্মঘট সংগঠনে বামপন্থীরা তাদের শক্তিক্ষয় করেছিলো। কিন্তু ভারতের মতো কৃষিপ্রধান একটি দেশে সংখ্যা গরিষ্ঠ কৃষক সংগঠনে বামপন্থীরা যদি শুরুতেই অধিক যত্নবান হতো, তাহলে হয়তো ভারতের ইতিহাসের গতিপথটাই পাল্টে যেতে পারতো। কিন্তু বিশ শতকের বিশের দশকে কলকারানায় বামপন্থীদের ক্রমাগত ধর্মঘট, শ্রমিক আন্দোলন ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের স্বার্থে আঘাত করলে ব্রিটিশ সরকার ১৯২৯ খ্রিঃ মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে বামপন্থীদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করে। 

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলাতে প্রথম শ্রেণীর নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ায় ভারতে বামপন্থী আন্দোলনে কিছুটা মন্দা ও ভাঁটা দেখা যায়। তবে সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হলেও কৃষক আন্দোলন সংগঠনে বামপন্থী মতাদর্শ স্থানীয় স্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। 

১৯৩০ দশকে বাংলাদেশে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় কিষান সভা, শ্রমিক - কৃষক দল ও কৃষক দল। এই সময়ে কমিউনিস্টরা ও কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীরা একত্রে কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য এগিয়ে আসে। 

১৯৩৪ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে গঠিত হয় কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল। এই দল ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৭ খ্রিঃ পর্যন্ত কৃষকদেরকে সংগঠিত করার চেষ্টা চালায়। ১৯৩০ দশক থেকেই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে কিষান সভা গড়ে উঠতে থাকে। এক্ষেত্রে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্টরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন

বামপন্থী মতাদর্শের প্রভাবে কিষান সভা সর্বপ্রথম জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদের দাবি উত্থাপন করেবাংলা, বিহার, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, ঊড়িষ্যাতে কিষান সভার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। বাংলাতে ভূমিহীন বর্গা চাষীদের জমির অধিকারের জন্য এবং বিহারে বখস্ত জমি (রাজস্ব দিতে না পারায় যে জমি কেড়ে নেওয়া হয়) পুনরুদ্ধারের জন্য কিষান সভা আন্দোলন চালিয়ে যায়। 

ক্রমে কৃষক স্বার্থ রক্ষায় বামপন্থী নেতারা একটি সর্বভারতীয় সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই উপলব্ধি থেকেই ১৯৩৬ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে কংগ্রেসের বামপন্থী অংশ "কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল" প্রতিষ্ঠা করে এবং কমিউনিস্টরা "সারা ভারত কিষান কংগ্রেস" (All India kishan Congress) প্রতিষ্ঠা করে। বিহার কিষান সভার প্রতিষ্ঠাতা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী এর সভাপতি হন এবং অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষক আন্দোলনের পথিকৃৎ অধ্যাপক এন জি রঙ্গ এর সম্পাদক নিযুক্ত হন। 

১৯৩৬ খ্রিঃ কিষান কংগ্রেস একটি ইস্তাহার প্রকাশ করে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, কৃষি ঋন মুকুব, বেগার প্রথার উচ্ছেদ, খাজনার হার ৫০% হ্রাস, কৃষকদের বনজ সম্পদ আহরনের অধিকার প্রভৃতি দাবি তুলে। 

১৯৩৫ খ্রিঃ ভারত শাসন অনুযায়ী ১৯৩৭ খ্রিঃ প্রাদেশিক নির্বাচনে কংগ্রেস জয়লাভ করে বিভিন্ন প্রদেশে মন্ত্রীসভা গঠন করে। ঐ মন্ত্রীসভা কৃষকদের কল্যানে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করলেও, ১৯৪০ খ্রিঃ "কংগ্রেস মন্ত্রীসভা" গুলি পদত্যাগ করলে কৃষকদের আশা আকাঙ্খা গুলি অপূর্নই রয়ে যায়। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মহাত্মা গান্ধী ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলে ভারতীয় কৃষক সমাজ তাতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া মিত্র পক্ষে যোগ দিলে ভারতীয় কমিউনিস্টরা ব্রিটিশ বিরোধী ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে। এর ফলে কমিউনিস্টদের জনপ্রিয়তা ও কৃষকদের ওপর তাদের প্রভাব অনেকখানি হ্রাস পায়। প্রবল জাতীয়তাবাদের দ্বারা প্রভাবিত করে কৃষক সমাজ এই পর্বে বিহার, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, বাংলা ও মহারাষ্ট্র - কর্নাটক অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করে। শ্রেনী সংগ্রাম ছাড়াই এই পর্বের কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়। এই কৃষক আন্দোলন সংগঠনে কংগ্রেসের নীচু তলার কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরবর্তীকালে পুনরায় কৃষক আন্দোলন সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন কমিউনিস্টরা। ১৯৩০ দশকে কৃষক আন্দোলনে তাদের যে দোদুল্যমানতা ছিলো, এই পর্বে তা লক্ষ করা যায় নি। ১৯৪৬ - ৪৭ খ্রিঃ তেভাগা আন্দোলন, পুন্নাপ্রা ভায়ালারের গন সংগ্রাম (১৯৪৭, অক্টোবর)  এবং ১৯৪৬ - ৫১ তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলন কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত আন্দোলন ছিলো।

(৬.) শেষ কথা 

সবশেষে বলা যায়, বিশ শতকে ভারতে কৃষক আন্দোলন সংগঠনে জাতীয় কংগ্রেস এবং বামপন্থী উভয় দলের অবদান গুরুত্বপূর্ণ থাকলেও, কারো ভূমিকাই যথেষ্ট ছিলো না। দুটি দলই নিজ নিজ আদর্শ ও মতাদর্শ দ্বারা এত বেশি প্রভাবিত ছিলো, যে আদর্শের দোহাই দিয়ে অনেক সময়েই তারা কৃষক আন্দোলন সংগঠনের জায়গা থেকে সরে এসেছিলো। 

উদাহরন হিসাবে বলা যায়, যখনই কোন কৃষক আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী ও জমিদার বিরোধী চরিত্র লাভ করতো তখনই কংগ্রেস কৃষক আন্দোলন থেকে নীতি আদর্শের দোহাই দিয়ে হাত গুটিয়ে নিতো। ফলে ইংরেজদের পক্ষে কৃষক আন্দোলন গুলিকে দমন করার কাজ অনেক সহজ হয়ে যেতো। কংগ্রেসের এই দ্বিচারিতার জন্য বিশ শতকের কৃষক আন্দোলন গুলি তার কাঙ্খিত পূর্নতা লাভ করতে পারে নি। 

কৃষক আন্দোলন সংগঠনে মতাদর্শগত সংকট শুধু যে কংগ্রেসের ছিলো এমনটা নয়। বামপন্থীদেরও ছিলো। ভারতীয় বামপন্থীরা সোভিয়েত রাশিয়ার ঢঙেই ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখতেন। তারা বুঝতেই চান নি, ইংরেজ আমলে ভারতে শ্রমিক শ্রেণী বলে একটি শ্রেনীর উদ্ভব ঘটলেও, ব্যাপক শিল্পায়ন হয় নি। ফলে সোভিয়েত রাশিয়ার মডেল কোন মতেই ভারতে কাজ করবে না। 

ভারতের মতো একটি কৃষিপ্রধান দেশে কৃষকদের সংগঠিত করেই বিপ্লবের পথে যাওয়া যেতে পারতো। কিন্তু বামপন্থীরা তাদের মতাদর্শগত বিভ্রান্তির জন্য কৃষক সংগঠনে পিছিয়ে থাকেন। ১৯৩০ দশকে কৃষক সমাজে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি পেলেও, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সেই আন্তর্জাতিক মতাদর্শের টানাপোড়েনে তারা নিষ্কর্মা হয়েই বসে থাকলেন।

 ভারত ছাড়ো আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম শ্রেণীর নেতারা কারারুদ্ধ ছিলেন। সেই সুযোগের পূর্ন সদ্ব্যবহার করে কমিউনিস্টরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ব্যাপক ভাবে কৃষকদের সংগঠিত করতে পারতেন। ইতিহাস তাদের সে সুযোগ দিয়েছিলো। কিন্তু তারা মতাদর্শের দোহাই দিয়ে তা করেন নি। ফলে পরাধীন ভারতে কংগ্রেস এবং বামপন্থী দুটি দলের মতাদর্শগত দ্বিধা দ্বন্দ্বের জন্য ভারতের কৃষক আন্দোলন গুলি পূর্নতা লাভ করতে পারে নি।


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post