গান্ধী, জিন্না ও ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা |
১
১৮৯২ খ্রিঃ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট থেকে ১৯৩৫ খ্রিঃ ভারত শাসন আইন পর্যন্ত একের পর এক শাসনতান্ত্রিক আইন প্রণয়ন করে যে ইংরেজরা ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার ব্যাপারে এত কৃপনতা দেখিয়েছিলো, সেই ইংরেজরা ১৯৪৮ খ্রিঃ ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলে ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্ট ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে সত্যই ব্রিটিশ জাতির মহানুভবতার এবং উদারতার স্মারক রচনা করেছিলো, না এর পিছনে অন্য অভিসন্ধি ছিলো তা অবশ্যই এক বিতর্কের বিষয়।
১৯৪৮ সালটি নিঃসন্দেহে ভারতীয় উপমহাদেশের এক অপ্রাপ্তির বছর। ১৯৪৮ সালে ভারত হারায় তার জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে। অন্যদিকে পাকিস্তানও এই বছরটিতেই হারায় তাদের তথাকথিত জাতির পিতা মহম্মদ আলি জিন্নাহকে। একজনের মৃত্যু হয়েছিলো হত্যার ফলে, অপরজনের মৃত্যু হয় দুরারোগ্য ফুসফুসের ক্যান্সারে।
গান্ধীর চাইতে মহম্মদ আলি জিন্নাহ বয়সে প্রায় ৭ বছরের ছোটো হলেও, অনেকগুলি ক্ষেত্রে দুজনের মিল ছিলো। গান্ধী এবং জিন্নাহ দুজনেরই পৈতৃক জন্মভিটা ছিলো গুজরাটের কাথিয়াবাড় অঞ্চল। গান্ধীর মতো জিন্নাহও বাল্যবিবাহ করেছিলেন এবং দুজনেই ছিলেন ব্যারিস্টার। আশ্চর্যজনক ভাবে দুজনের মৃত্যুও হয়েছিলো একই বছর ১৯৪৮ সালে। আর এখান থেকেই ইতিহাসের ট্র্যাজেডির শুরু।
জিন্নাহ যখন মুখে চুরুট ধরিয়ে ভারতের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও পাকিস্তানের ধুঁয়া তুলছিলেন, তখন তার অজান্তেই ফুসফুসে বাসা বেঁধেছিলো দুরারোগ্য ক্যান্সার। জিন্নার এই মারন রোগের খবরটি জানতেন একমাত্র তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডঃ জাল প্যাটেল। ভারতীয় রাজনেতারা যদি আরেকটু অপেক্ষা করতেন অথবা ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখতেন, তাহলে হয়তো স্বাধীনতা লাভের পাশাপাশি ভারত বিভাজনকেও রোধ করে দেওয়া যেতো। কেননা ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের পর থেকে জিন্নার শরীর মারাত্মক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেছিলো।
জিন্নার মৃত্যুর পরে পাকিস্তান আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেবার মতো যোগ্য নেতা ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে ছিলো না এমন নয়। তবে তারা কেউই জিন্নার মতো অনমনীয় ও একগুঁয়ে ছিলেন না। জিন্নার মৃত্যুর পর হয়তো সেইসব নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে কোন একটা রফা বা মীমাংসা করে নেওয়া যেতো। এর ফলে হয়তো ভারত বিভাজনকে রুখে দেওয়া যেতে পারতো।
মনে রাখতে হবে, ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে জিন্না ছাড়া আরোও অনেক মুসলিম নেতা ছিলেন। অনেক জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতাও ছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার অঙ্কেই সেইসব নেতাদের সরিয়ে মহম্মদ আলি জিন্নাকেই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জিন্নাকে তারা ভারতীয় উপমহাদেশে ক্ষমতার টিকে থাকার স্বার্থে দাবার গুটির মতোই ব্যবহার করেন। এখানে বলে রাখা ভালো,জিন্নার অসুস্থতার খবরটি সম্ভবত লর্ড মাউন্টব্যাটনও জানতেন। সেই কারনেই হয়তো তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়টি কিছুটা এগিয়ে এনেছিলেন।
এশিয়া মহাদেশে শক্তিশালী ভারতীয় উপমহাদেশ কখনই পশ্চিমা বিশ্বের কাছে কাম্য ছিলো না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বে ভৌমিক জবরদখলের দিন শেষ হয়ে এসেছিলো। সাম্রাজ্যবাদ তার আপন বিবর্তনের নিয়মেই রূপ পরিবর্তন করে "পা" রাখবার সুযোগ খুঁজছিলো। শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশে তা কখনই সম্ভব ছিলো না। চিনে তো নয়ই। এমতাবস্থায় জিন্না ও তার পাকিস্তানই পশ্চিমা বিশ্ব তথা আমেরিকার কাছে সে সুযোগ এনে দিতে পারে। বাস্তবে সেটিই ঘটেছিলো এবং আজও তা ঘটে চলেছে।
মাউন্টব্যাটন খুব ভালো করেই জানতেন ভৌগলিক দিক থেকে ভিন্ন দুই মেরুতে অবস্থিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের কোন ভবিষ্যত নেই। তিনি অত্যন্ত সচেতন ভাবেই বলেছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র আগামী পঁচিশ বছরের মধ্যেই দু টুকরো হয়ে যাবে। বাস্তবে তাই ঘটেছিলো। ১৯৭১ খ্রিঃ ২৬ শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ খ্রিঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতালাভ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ধর্মকে অবলম্বন করে কখনই পৃথক জাতি নির্মান করা যায় না, যেটা জিন্নাহ এবং তার পূর্বসূরি সৈয়দ আহমেদ খানরা করেছিলেন। মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতিই একটি জাতির আত্মপরিচয়ের মূল খোলস ও বর্ম।
ধর্ম সত্যই যদি জাতি নির্মানের মূল শর্ত ও উপাদান হতো তাহলে পাকিস্তান কখনই পূর্বপাকিস্তানীদের ওপর বিমাতৃসুলভ আচরন করতো না বা বর্বরতা দেখাতো নয়। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙ্গেও যেতো না। কারন এক জাতি সর্বদাই এক রাষ্ট্রে থাকতে চায়। সুতরাং ভারতীয় উপমহাদেশে মহম্মদ আলি জিন্নার "নেশন থিওরির" গোড়াতেই মস্ত গলদ ছিলো। সে গলদ পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হবার চব্বিশ বছরের মধ্যেই ধরা পড়েছিলো। ধরা পড়েছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙ্গনের মধ্যেও।
২
বিশ্বের মধ্যে ভারতবর্ষই একমাত্র দেশ যার মাটিতে আধ্যাত্মবাদের বীজ ছড়ানো আছে। চিরকালই ভারতবর্ষে সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগটা অত্যন্ত নিবিড়। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য শুধু রাজনৈতিক নেতা হলেই চলে না। ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দিতে হয়। প্রাচীনকাল থেকে যারাই এটি করেছেন তারাই শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি লাভ করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতের মৌর্য সম্রাট অশোকের কথা বলা যেতে পারে। অশোক শুধু রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তিনি সামাজিক ও ধর্মীয় নেতাও ছিলেন। মুঘল যুগে আকবরও তাই ছিলেন। ইতিহাসে সম্ভবত এই কারনেই তাদের "মহান" বলা হয়েছে।
ভারতে মহাত্মা গান্ধীর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও মহানত্বের পিছুনেও এই একই কারন ছিলো। মনে রাখতে হবে, পরাধীন ভারতে গান্ধীজি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক ও সামাজিক নেতা। এই কারনেই সমকালীন সময়ে জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে ভারতবর্ষের একটি বড়ো অংশের মানুষ গান্ধির দ্বারা দ্রবিভূত ও আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো।
মাথায় রাখতে হবে, আধ্যাত্মবাদ ও ধর্ম সম্পূর্ণ এক বিষয় নয়। আধ্যাত্মবাদের মধ্যে কোন সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ নেই। কিন্তু "ধর্ম" আচরন সর্বস্ব ও সাম্প্রদায়িক। অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে গান্ধীজি খিলাফৎ আন্দোলনের সংমিশ্রন ঘটাতে গিয়ে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মেরই সংমিশ্রন ঘটান। সেই সংমিশ্রন অতি অল্পকালের মধ্যেই দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িকতার রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এজন্য গান্ধি আজোও সমালোচিত হয়ে থাকেন। আধ্যাত্মবাদ ও ধর্মের প্রভেদকে গান্ধীও কোন কোন সময় উপলব্ধি করতে পারেন নি। পরবর্তীকালে তার এই দেখানো পথেই হেঁটেছিলেন মহঃ আলি জিন্নাহ।
গান্ধীর মতো মহৎ আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য মহঃ আলি জিন্নাহের ছিলো না। কিন্তু তিনি গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের মতোই ধর্মকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। "ধর্ম" নামক অস্ত্রটির প্রয়োগ নিজ নিজ অনুগামীদের সংঘবদ্ধ করার জন্য রাজনেতারা বিভিন্ন সময়েই করে থাকেন। জিন্নাহও করেছিলেন। যদিও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মারাত্মক অধার্মিক ছিলেন।
ইসলামিয় অনুশাসন ও আচার আচরনের ছিঁটেফোঁটাও জিন্নার মধ্যে ছিলো না। জিন্নাহরা মাত্র দুই পুরুষ আগে হিন্দু থেকে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। মুসলমানি আদব কায়দার কোন কিছুই জিন্নার মধ্যে ছিলো না। সে সব আদাব কায়দা অনুকরন করবার কোন তাগিদ তাঁর মধ্যে ছিলো না। এ ক্ষেত্রে কোনরকম ছলনার আশ্রয়ও তিনি কখনো নেন নি। যেটা বর্তমান ভারতে অনেক রাজনৈতিক নেতারাই নিয়ে থাকেন। তারা ইফতারে যান, নামাজ পড়েন, ইসলামীয় ঢঙে ফেজ টুপি পড়েন। এইসকল রাজনৈতিক নেতারা জিন্নার থেকে যে বহুগুন বেশি সাম্প্রদায়িক এবং অকৃত্রিম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মুসলমান ধর্মে মদ্যপান ও শুকরের মাংস ভক্ষনকে হারাম বলে মনে করা হয়। কিন্তু প্রতি সন্ধ্যায় এই দুটি খাদ্য জিন্নার ভয়ঙ্কর প্রিয় ছিলো। তিনি জীবনে কখনো রোজা রাখেন নি। এমনকি নামাজও পড়েন নি। পাঞ্জাবের বিশিষ্ট শিল্পপতি কে এল গৌবার স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, ১৯৩৬ সালে বহু অনুরোধ - উপরোধের পর জিন্নাহকে লাহোরের বাদশাহী মসজিদে নামাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু জিন্নাহ যখন মসজিদে ঢুকলেন, তখন নামাজ পড়ার বদলে হিন্দুদের মতো হাতজোড় করে জোড়াসনে বসে পড়েন। নামাজ পড়ার নুন্যতম আদব কায়দাটুকুও তিনি জানতেন না।
১৯৪৭ খ্রিঃ ১৪ ই আগস্ট, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা দিবসে জিন্নাহ এক বিশাল মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন। তাঁর মনেই ছিলো না তখন রমজান মাসের রোজা চলছে। কোন মুসলমান দুপুরে জলগ্রহন পর্যন্ত করবেন না। এসবই প্রমান করে জিন্নাহ কতখানি অমুসলিম ছিলেন এবং ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। তিনি হিন্দি, উর্দু বা কোন ভারতীয় ভাষায় ঠিক করে কথা পর্যন্ত বলতে পারতেন না। ইসলামের যাবতীয় অনুশাসন ভঙ্গ করেও জিন্নাহ সেকালের মৌলানা - উলেমা অধ্যুষিত মুসলমান সমাজের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
কেন এমনটি ঘটলো, তা বিশ্লেষণ করা যদিও এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে আমরা এটাই বোঝাতে চাইছি, ধর্মকে কিভাবে খুব সহজেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয় এবং বর্তমান ভারতীয় উপমহাদেশে কিভাবে সুকৌশলে অধার্মিক রাজনেতারা ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে চলেন। মাথায় রাখতে হবে, ভারত বিভাজন ধর্মের ভিত্তিতেই হয়েছিলো। এই ধর্মীয় বিভাজনের ক্ষেত্রে জিন্নাহ যতটা দায়ী ছিলেন, গান্ধী তার থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না। ধর্ম, রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সূক্ষতম পার্থক্যের দিক গুলিকে উপলব্ধি করা ও তুলে ধরাও এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য।
৩
ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯৪৮ এর বছরটি যেমন ছিলো ট্র্র্যাজেডির বছর, তেমনি আগস্ট মাসটিও ছিলো একটি স্মরনীয় মাস। আগস্ট মাসটির সঙ্গে ভারত ও ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের অনেক স্মরনীয় ঘটনা জড়িত ছিলো। জোব চার্নক যখন জাহাজে করে কলকাতার ঘাটে প্রথম পদার্পণ করেন, সেই মাসটি ছিলো আগস্ট মাস। ১৭৬৫ খ্রিঃ এই আগস্ট মাসেই দিল্লির বাদশা শাহ আলমের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও ঊড়িষ্যার দেওয়ানির সনদ লাভ করেছিলেন। মহাবিদ্রোহের পর ভারতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে ইংল্যান্ডেশ্বরী ভিক্টোরিয়ার প্রথম ঘোষনাও হয়েছিলো এই আগস্ট মাসে। আশ্চর্যজনক ভাবে ভারতে ইংরেজদের ক্ষমতা হস্তান্তরের মাসটিও ছিলো আগস্ট মাস। ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ই আগস্ট ভারতবর্ষ ইংল্যান্ডের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সম্রাটের যে প্রতিনিধির হাত দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা এসেছিলো, ৩২ বছর পরে সেই মাউন্টব্যাটেনের মৃত্যুও হয় এই আগস্ট মাসে, এক আততায়ীর বোমার আঘাতে। ১৯৭৯ খ্রিঃ ২৬ শে আগস্ট মাছ ধরতে গিয়ে এক আততায়ীর ছোড়া বোমার আঘাতে মাউন্টব্যাটনের ছয় ফুট দীর্ঘ শরীরটি ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো।
ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে আগস্ট মাসের এই অদ্ভুত সম্বন্ধকে আবিষ্কার করেছিলেন ভপ্পালা পাঙ্গুনি মেনন, যিনি ইতিহাসে ভি পি মেনন নামেই অধিক পরিচিত। মেনন ছিলেন ভারতের শেষ ভাইসরয় লুই মাউন্টব্যাটনের রাজনৈতিক উপদেষ্টা। তাঁর অসামান্য তীক্ষ্ণ কূটনৈতিক বুদ্ধির তুলিতেই অঙ্কিত হয়েছিলো স্বাধীন ভারতের নতুন মানচিত্র।
১৯৪৭ খ্রিঃ ৪ জুন, মাউন্টব্যাটন এক বিশাল সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগের প্রস্তাবটি তুলে ধরেন। এই সময় একজন সাংবাদিক মাউন্টব্যাটেনকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার কি মনে হয়না দেশ ভাগের ফলে ভারতের এক বিরাট সংখ্যক মানুষকে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে যেতে হবে? এর উত্তরে মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, আমার তা মনে হয় না। তাছাড়া কিছু সংখ্যক লোক তো স্বাভাবিক ভাবেই এপার ওপার করবে। অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর বৃহত্তম পরিযানকে সরকার উপলব্ধি করতে পারে নি অথবা খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনাও করে নি। সরকারের এই উদাসীনতার ফল ভারতীয় উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রানের বিনিময়ে দিতে হয়েছিলো।
জুনমাসের সাংবাদিক বৈঠকেই জনৈক সাংবাদিক মাউন্টব্যাটেনকে প্রশ্ন করে বসেন, ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন তারিখ কি আপনি ভেবেছেন? সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে মাউন্টব্যাটেন কিছুক্ষন চুপ থাকেন। তারপর শান্তকন্ঠে বলেন, ভারত স্বাধীন হবে ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৪৫ সালের ১৫ ই আগস্ট দিনটিতেই জাপান মিত্র শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। মাউন্টব্যাটেন কর্মসূত্রে একজন সৈনিক ছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ১৫ ই আগস্ট দিনটি তার কাছে একটি স্মরণীয় দিন ছিলো। সম্ভবত এই কারনেই তিনি ১৫ ই আগস্ট দিনটিকে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বেছে নিয়েছিলেন।
১৯৪৭ খ্রিঃ ৪ ই জুলাই ইংল্যান্ডের হাউস অব কমেন্সে ভারতের স্বাধীনতা বিল পাশ করা হয়। ইংল্যান্ডের রাজা ১৮ ই জুলাই বিলে সই করলে বিলটি আইনে পরিণত হয়। এই আইনে ইংরেজ অধিকৃত ভারতকে "ভারত" ও "পাকিস্তান" নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে ভাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা হয়। প্রায় ৬০০ ওপর স্বাধীন ভারতীয় দেশীয় রাজ্য গুলিকেও স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং বলা হয় তারা ইচ্ছে করলে স্বাধীন থাকতে পারে অথবা চাইলে ভারত বা পাকিস্তান যেকোন দেশে যোগ দিতে পারে। মোটকথা যে ভৌগলিক অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার কালে ইংরেজ এদেশে পদার্পণ করেছিলো, তারা এদেশ থেকে বিদায়ের সময়েও ভারতীয় উপমহাদেশকে ঐ অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো।
১৫ ই আগস্ট ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সারা দেশ থেকে বড়ো বড়ো জ্যোতিষিরা সরকারকে চিঠি লিখতে শুরু করেন, ১৫ ই আগস্ট দিনটি ভয়ঙ্কর অশুভ। ঐ দিন যে দেশ জন্মাবে তার ভবিষ্যত একেবারেই অন্ধকার। নেহরু যদিও এসব মানেন না, তবু তার অন্যান্য সহকর্মীরা জেদ ধরলেন ঐ অশুভ দিনে ভারত স্বাধীন হবে না। এই ঘটনায় মাউন্টব্যাটেন ঘোর সমস্যায় পড়লেন। কারন ইতিমধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিল পাশ হয়ে গেছে। তাই দিন বদল করা সম্ভব নয়।
এইসময় জ্যোতিষিরা একটা উপায় বাতলে দিলেন। ভারতীয় ক্যালেন্ডার মতে ১৪ তারিখ, বৃহস্পতিবার রাত ১২ টায় অভিজিত যোগ পড়বে। ঐ সময় স্বাধীন ভারত জন্ম নেবে। অভিজিত যোগ অত্যন্ত শুভ লগ্ন। সত্য, মিথ্যা জানি না। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে অনায়াসে উপলব্ধি করা যায়, স্বাধীন ভারতের জন্মটা অত্যন্ত শুভ যোগে হয়েছিলো বলেই হয়তো এত সমস্যা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভারত আজোও টিকে আছে। পাকিস্তানের মতো ভারতের কোন অঙ্গহানি হয় নি, অথবা ভারত ব্যর্থ রাষ্ট্রে পর্যবসিতও হয়ে যায় নি।
ঠিক হয়েছিলো, লুই মাউন্টব্যাটেন ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেই গর্ভনর জেনারেল হিসাবে প্রতিনিধিত্ব করবেন। কিন্তু মহম্মদ আলি জিন্নাহ পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পদটি কিছুতেই অন্য কাউকে ছেড়ে দিতে রাজি হলেন না। সবদিক বিবেচনা করে ঠিক হলো, ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করবে। ভারত দেশবিভাগকে সমর্থন করে না। ভারত কারো থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার নীতিতেও বিশ্বাসী নয়। তাই ঠিক হলো ১৪ ই আগস্ট বৃহস্পতিবার পাকিস্তান ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পরেই ১৫ ই আগস্ট শুক্রবার ভারত "স্বাধীনতা দিবস" পালন করবে।
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হবার অনেক আগেই অবশ্য জিন্নাহ ভারত ত্যাগ করেন। ৭ ই আগস্ট তিনি বড়োলাটের বিমানে ভারত ছেড়ে করাচিতে চলে আসেন। এতদিন ধরে মুসলমানদের মনে হিন্দুদের বিরুদ্ধে একরাশ ঘৃনা আর অবিশ্বাসের বীজ রোপন করার পর বিলায় লগ্নে তার বানী ছিলো - " যারা সংখ্যালঘু হয়ে ভারতে থেকে যাচ্ছে, তারা যেন যে দেশে থাকছে তার প্রতি অনুগত থাকে।"
১১ ই আগস্ট পাকিস্তানের গনপরিষদে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষনে জিন্না বলেন -
"অতীত ভুলে গিয়ে, আমরা নিজেদের জাতি, বর্ন সব ভুলে গিয়ে যদি এই রাজ্যের নাগরিক হিসাবে একজোট হয়ে কাজ করি, তাহলে আমরা অকল্পনীয় উন্নতি করতে পারবো। এখানে সব সম্প্রদায়ের, তারা সংখ্যাগুরু হোক কি লঘু হোক, হিন্দু হোক কি মুসলমান, সকলের সমান অধিকার, কেননা আমরা এক দেশের নাগরিক... ।"
কার্যোদ্ধারের পর জিন্নার এই ভয়ঙ্কর রকম অসাম্প্রদায়িক চেতনা সত্যিই বিস্ময়ের উদ্রেগ করে। জিন্না তাঁর প্রথম মন্ত্রীপরিষদে আইনমন্ত্রী করলেন একজন হিন্দুকে। এই ব্যক্তিটি ছিলেন বাংলাদেশের বরিশালের একজন তপশীলী নেতা যোগেন মন্ডল।
৭ ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিঃ জিন্না যখন বড়োলাটের বিমানে করে করাচিতে আসেন তখন তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। তিনি এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে বিমানের আসন ছেড়ে উঠে আসতেও তাঁর কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু অসাধারণ মনের জোরে তিনি একাই কারো সাহায্য ছাড়াই বিমানের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসেন। অপেক্ষামান বিশাল জনতার দিকে তাকিয়ে তিনি তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তরুন এ ডি সিকে বলেছিলেন - "জানো, আমি কোনদিন কল্পনা করিনি যে সত্য সত্যই একদিন পাকিস্তানের মাটিতে পা দিতে পারবো।"
পাকিস্তানে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য ১৩ ই আগস্ট থেকেই সেখানে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ১৪ ই আগস্ট লাটদম্পতি করাচিতে পৌঁছাবামাত্র CID অফিসার জানালেন জিন্নাহকে হত্যার চক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে । সুতরাং হুডখোলা গাড়িতে জিন্নার শোভাযাত্রা করা ঠিক হবে না। মাউন্টব্যাটেন অনেক বুঝিয়েও জিন্নাকে রাজি করাতে পারলেন না।
অবশেষে হুডখোলা গাড়িতে জিন্না আর মাউন্টব্যাটেন শোভাযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢুকলেন। পুরো পথটাই দুজনে অজানা এক আশঙ্কায় ভয়ে সিঁটিয়ে রইলেন। এইসময় জিন্না বড়োলাটের সঙ্গে একটি বাক্যালাভ পর্যন্ত করেন নি। অবশেষে গাড়ি রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢোকবার পর বড়োলাটের হাঁটুর ওপর হাত রেখে জিন্না বললেন - "আল্লাহর দোয়াতে আপনাকে জীবিত নিয়ে আসতে পারলুম।" ততক্ষণে বড়োলাটের বুকেও স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়েছে। তিনি রসিকতা করে বললেন - "কি যা তা বলছেন। আমিই তো আপনাকে জীবন্ত ফিরিয়ে আনলাম।"
৪
১৪ ই আগস্টের অনুষ্ঠান শেষ করে সন্ধ্যায় লাটদম্পতি ফিরে এলেন দিল্লিতে। ঐ দিন সন্ধ্যায় গন পরিষদের সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ এবং প্রধানমন্ত্রী নেহেরু আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হবার জন্য মাউন্টব্যাটেনকে নিমন্ত্রণ করেন। নেহেরু একটি সীল করা খাম মাউন্টব্যাটেনের হাতে তুলে দিলেন। ঐ খামে স্বাধীন ভারতের প্রথম মন্ত্রীসভা ১৩ জন সদস্যদের নাম লেখা রয়েছে।
নেহেরু চলে যাবার পর খামটি খুলে মাউন্টব্যাটেন হো হো করে হেসে ফেললেন। খামের ভিতরে শুধু একটি সাদা কাগজ। প্রচন্ড টেনশনে নেহেরু অথবা তাঁর সচিব আসল তালিকাটি খামে ভরতেই ভুলে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য এই ভুল সংশোধন করে নেওয়া হয়েছিলো।
১৪ ই আগস্ট ঠিক রাত ১১ টায় গন পরিষদের বিশেষ অধিবেশন বসলো। ভাগ্যের কি আশ্চর্য পরিনতি। ব্রিটিশ আমলে যে বন্দেমাতারম গান গাইলে বেত্রাঘাত বা কারাবাস বরন করতে হতো, সেই গান দিয়েই অধিবেশন শুরু হলো। গান গাইলেন সুচেতা কৃপালনী। দেশের হয়ে যারা আত্মবলিদান দিয়েছেন, তাদের স্মৃতিতে দুমিনিট নিরবতা পালন করে অনুষ্ঠানের কাজ শুরু হয়। এর পরে শুরু হয় ভাষন অনুষ্ঠান। ১৪ ই আগস্টের রাত্রে গুরুত্বপূর্ণ বক্তা ছিলেন ৩ জন - চৌধুরী খালিকুজ্জামান, ডক্টর সর্বোপল্লী রাধাকৃষ্ণান এবং জওহরলাল নেহেরু।
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষন যখন নেহেরু তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষনটি প্রদান করলেন...
"বহুকাল আগে আমরা ভাগ্যের সঙ্গে এক অভিসারে বেরিয়েছিলাম। আজ সময় এসেছে নতুন করে শপথ নেবার।... আজ মধ্যরাত্রির ঘন্টা যখন বাজবে, সারা বিশ্ব যখন নিদ্রামগন, তখন ভারতবর্ষ জীবন ও স্বাধীনতা নিয়ে জেগে উঠবে। এক একটা মুহুর্ত আসে, ইতিহাসে সেরকম মুহূর্ত অতি বিরল, যখন আমরা পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরন করে নিই, যখন একটা যুগের অবসান হয়, যখন একটা দেশের আত্মা দীর্ঘ অবদমন শেষে আপন বানী খুঁজে পায়। এই সেই সময়, এই ভাবগম্ভীর ক্ষনে আমরা ভারতের প্রতি, ভারতের জনগনের প্রতি এবং সর্বোপরি মানবতার আদর্শের প্রতি সেবায় নিজেদের নিবেদন করার শপথ গ্রহণ করবো...। আজ আমাদের দুর্ভাগ্যের দিন শেষ হলো,আজ ভারত নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলো।"
গন পরিষদের অনুষ্ঠান শেষ হলো নারীদের পক্ষ থেকে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও সমবেত বন্দেমাতারম গান গাওয়ার মধ্যে দিয়ে। পরের দিন সকালে প্রধান বিচারপতি মাউন্টব্যাটেনকে শপথবাক্য পাঠ করালেন। এরপর মাউন্টব্যাটেনের কাছে শপথ নিলেন অন্যান্য মন্ত্রীরা। স্বাধীন ভারতের প্রথম মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়েছিলো সব দল ও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে।
গান্ধী স্মরন করিয়ে দিয়েছিলেন, "স্বাধীনতা কংগ্রেস পায় নি, পেয়েছে ভারত।" তিনি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, "মন্ত্রীসভা গঠন করতে হবে সবচেয়ে দক্ষ লোকেদের দিয়ে, তারা যে পার্টিরই লোক হোক।" বলা বাহুল্য, মন্ত্রীসভা গঠনের সময় গান্ধীজির এই আপ্তবাক্যটি বিশেষ স্মরনে রেখেছিলেন নেহেরু। স্বাধীন ভারতের প্রথম মন্ত্রীসভায় বি আর আম্বেদকর, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো চরম কংগ্রেস বিরোধী নেতারাও স্থান পেয়েছিলেন। কংগ্রেস বিরোধী নেতাদের মন্ত্রীসভায় যুক্ত করাটা নিঃসন্দেহে নেহেরুর একটি বড়ো কূটনৈতিক সাফল্য ছিলো।
স্বাধীনতার আগেই নেহেরু মাউন্টব্যাটনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,ভারতে ইংরেজরা বিদায় নেবার মুহূর্তে কোন রকম অসম্মান আচরন তাদের প্রতি করা হবে না। ২৭ শে জুলাই গনপরিষদে জাতীয় পতাকা সংক্রান্ত আলোচনার সময়ে মাউন্টব্যাটন আবদার করেছিলেন, ভারত ও পাকিস্তান দুটি পতাকার ছোট্ট এক কোনে যেনো ইউনিয়ন জ্যাককে এঁকে দেওয়া হয়। নেহেরু এবং জিন্না এককথায় মাউন্টব্যাটনের প্রস্তাবকে খারিজ করে দেন। পতাকা সংক্রান্ত মাউন্টব্যাটনের দ্বিতীয় আবদারটি ছিলো কোথাও যেন অনুষ্ঠান করে স্বাধীন ভারতে ব্রিটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাককে না নামানো হয়। মাউন্টব্যাটনের দ্বিতীয় আবদারটি অবশ্য নেহেরু মেনে নিয়েছিলেন। কথামতো ১৪ ই আগস্টে সূর্যাস্তের পর ভারতের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর থেকে ব্রিটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাককে খুলে ফেলা হয়।
১৪ ই আগস্ট গনপরিষদে রাতের অনুষ্ঠান শেষে পরদিন ১৫ ই আগস্ট বিকেলে ইন্ডিয়া গেটের পাশে খোলা ও প্রশস্ত জায়গায় ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠান হয়। নেহেরু জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন। সেই পতাকাকে সশ্রদ্ধ স্যালুট জানালেন মাউন্টব্যাটন। প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের মহাসমারোহে উদযান হয় স্বাধীনতার অনুষ্ঠান। ঐ দিন পুরো দিল্লি শহরকে রঙিন আলোতে সাজিয়ে তোলা হলো। শুধু রাজধানীতেই ৩০০ পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠিত হয়।
৫
১৫ আগস্টের দু সপ্তাহ আগেই গান্ধিজী দিল্লি ত্যাগ করেন। প্রথমে তিনি ছুটে গেলেন কাশ্মীরে। পরে ট্রেনে করে ফিরে এলেন কলকাতায়। একবছর আগে থেকে যে দাঙ্গার আগুন সেখানে লেগেছিলো, তা তখনও দাউ দাউ করে জ্বলছিলো। ১৩ ই আগস্ট গান্ধিজী মুসলিম প্রধান বেলেঘাটা অঞ্চলে একটি ভাঙ্গাচোরা বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। ১৪ তারিখ সন্ধ্যেবেলা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী গান্ধীর কাছে এসে জানতে চাইলেন, "পরের দিন কী ধরনের উৎসব অনুষ্ঠান হওয়া উচিত?" উত্তরে গান্ধী বলেন, "চতুর্দিকে লোকে না খেতে পেয়ে মরছে। এই ভয়াবহ দুর্দশার মাঝখানে আপনি উৎসবের আয়োজন করতে চান?" হিন্দুস্থান টাইমসের একজন রিপোর্টার স্বাধীনতা উপলক্ষে গান্ধীজির কাছে একটি বানী প্রার্থনা করলে গান্ধিজী বলেন - "তাঁর ভান্ডার শূন্য হয়ে গেছে"। গান্ধীজি বিদেশী রিপোর্টারকে তার বদলে নেহেরুর সঙ্গে কথা বলার নির্দেশ দেন।
মাথায় রাখতে হবে, স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার সময়ে চলছিলো ভয়ঙ্কর ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গা। হিন্দু মারছে মুসলমানকে। মুসলমান মারছে হিন্দুকে। চারিদিকে রক্তপাত, ঘৃনা আর মৃত্যু দেখে গান্ধীজি অত্যন্ত মুষড়ে পড়েছিলেন। এই স্বাধীনতা তো তিনি কখনো চান নি। তাই ভারত যখন স্বাধীন হলো স্বাধীনতার কোন আনন্দ গান্ধিজীকে স্পর্শ করতে পারে নি।
১৪ ই আগস্ট মধ্যরাতে যখন গনপরিষদে স্বাধীন ভারতের জন্ম হচ্ছিল, তখন গান্ধিজী সেখান থেকে অনেক দূরে ছিলেন। নোয়াখালির ভয়ঙ্কর দাঙ্গার আগুন ঝলসে দিয়েছিলো ৭৮ বছরের বৃদ্ধের স্বাধীনতার সব আনন্দ আর উচ্ছাসকে । ১৪ ই আগস্ট রাত্রি ৯ টায় খুব সকাল সকাল গান্ধী ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরদিন ১৫ ই আগস্ট তিনি সারাটা দিন অনশন আর প্রার্থনা করে কাটালেন। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা দিবসে অংশ নেন নি গান্ধিজী।
১৫ ই আগস্টে তখনও ভারত ভাগ হয় নি। অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে মান্ধান্তা আমলের মানচিত্র ঘেঁটে স্যার সিরিল রেডক্লিফ ভারত পাকিস্তানের সীমানা মানচিত্র তৈরি করলেন। তারপর ১৩ ই আগস্ট তা তুলে দিলেন মাউন্টব্যাটনের হাতে। মাউন্টব্যাটন জানতেন, এই মানচিত্র এখুনি প্রকাশ করে দিলে কি ভয়ংকর পরিস্থিতি হতে পারে। শুরু হয়ে যাবে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা.. এবং এর দায় সরাসরি ব্রিটিশ প্রশাসনের ঘাড়ে পড়বে। তিনি তাই ১৫ ই আগস্ট ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ১৭ ই আগস্ট নবগঠিত দুই রাষ্ট্রের বিভাজিত মানচিত্র প্রকাশ করেন।
মাউন্টব্যাটনের এই ঘৃন্য কাজকে চার্চিলও সমর্থন করেন নি। মাউন্টব্যাটন ইংল্যান্ডে ফেরার পর যখন স্যার এন্টনী ইডেন মাউন্টব্যাটনের সম্মানে এক সংবর্ধনা দেন, তখন সেখানে উপস্থিত হয়ে খোদ চার্চিল বলেছিলেন, "ডিকি তুমি ভারতে যা করে এসেছো তাতে আমাদের মুখে চাবুক পড়েছে।" চার্চিল ভারতীয়দের ভালোবাসেন একথা কেউ বলবেন না ঠিকই, কিন্তু কয়েক লক্ষ নির্দোষ, নিরীহ মানুষের অপমৃত্যু তাঁরও বিবেকে ঘা মেরেছিলো।
৬
জিন্না ভারতে যে সাম্প্রদায়িক আগুন লাগিয়ে দিয়ে যান, সেই আগুন স্বাধীন ভারতের দুই প্রান্তেই জ্বলছিলো - ভারতেও এবং পাকিস্তানেও। জিন্নার লাগানো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন নেভাতে গিয়েই শেষপর্যন্ত প্রান গিয়েছিলো মহাত্মা গান্ধীর। যে মানুষটি সারা জীবন মানুষকে ঘৃনা না করার শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন। মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েগিয়েছিলেন। ৭৮ বছর বয়সে এসে সেই মানুষটিকেই খুন হতে হয়েছিলো নাথুরাম গডসে নামক এক অমানুষের হাতে।
জিন্না আর গান্ধী ভারতীয় উপমহাদেশের দুই কিংবদন্তি চরিত্র। এদের একজন নতুন দেশের জন্ম দিয়েছিলেন, অপরজন দেশকে ভালোবেসে নিজের জীবন দিয়েছিলেন। গান্ধী মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। তাই ভাগ করতে পারেন নি। নতুন দেশ গড়তেও পারেন নি। অপরজন মানুষকে ঘৃনা করতে শিখিয়েছিলেন। তাই অনায়াসে ভাগ করতে পেরেছিলেন এবং নতুন এক দেশের জন্ম দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইতিহাস কখনো কাউকে ক্ষমা করে না। সে তার আপন নিয়মে ঠিকই প্রতিশোধ নিয়ে নেয়।
"জিন্না" ও "পাকিস্তান আন্দোলন" ভারতের যে অঙ্গহানি ঘটিয়েছিলো তাই বুমেরাং হয়ে চব্বিশ বছর পরে ফিরে এসেছিলো পাকিস্তানের জীবনে। ঠিক যে অধিকারের প্রশ্নে জিন্না মুসলমানদের ভারত থেকে পৃথক করে দেন, ঠিক সেই একই অধিকারের প্রশ্নে শেখ মুজিবর রহমান পূর্ববঙ্গীয়দের পাকিস্তান থেকে আলাদা করে দেন। ইতিহাসের অমোঘ প্রতিশোধ আর নির্মম পরিহাস বোধহয় একেই বলে। ১৯৭১ খ্রিঃ পাকিস্তান দু টুকরো হয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
গ্রন্থঋন :-
১. ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দশক - দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়।
২. ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট - ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক লাপিয়ের।
৩. গান্ধী উত্তর ভারতবর্ষ - রামচন্দ্র গুহ।
৪. জিন্নাহ অব্ পাকিস্তান - স্টেনলি উলপার্ট, অক্সোফোর্ট - ১৯৮৯।