রাম্পা বিদ্রোহ

অসহযোগ আন্দোলনের সময় অন্ধ্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও ভয়াবহ কৃষক বিদ্রোহ ছিলো গোদাবরী উপত্যকার রাম্পা উপজাতির বিদ্রোহ। 

১৯২২ - ২৪ খ্রিঃ অন্ধ্রপ্রদেশের গোদাবরী উপত্যকায় রাম্পা উপজাতির কৃষকরা আল্লুরি সীতারাম রাজুর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেন। এটিই ইতিহাসে "রাম্পা বিদ্রোহ" নামে পরিচিত। 

রাম্পা বিদ্রোহ
রাম্পা বিদ্রোহ 

(১.) পরিচয় :-

রাম্পারা ছিলো দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র অঞ্চলের একটি উপজাতি গোষ্ঠী। এরা গোদাবরী উপত্যকার অরন্য ও মোহনা অঞ্চলে বসবাস করতো। এই অঞ্চলটি খরাপ্রবন হওয়ায় রাম্পারা কৃষিকাজের পাশাপাশি অরন্যের উপরেও নানা ভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন পর্বে তারা নানা কারনে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলো। 

(২.) বিদ্রোহের কারন :-

রাম্পাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠার পিছনে দুটি প্রধান কারন ছিলো। যেমন - 


(ক.) ঔপনিবেশিক অরন্য আইন 

ব্রিটিশ সরকার ঔপনিবেশিক অরন্য আইনকে গোদাবরী এলাকায় কার্যকর করলে রাম্পারা তাদের চিরাচরিত অধিকার গুলি থেকে বঞ্চিত হন। এর ফলে তারা - 
১. জঙ্গল থেকে কাঠ, মধু ও জ্বালানি সংগ্রহের অধিকার হারান। 
২. অরন্যে গোচারন ও শিকারের অধিকার হারান। 
৩. ঔপনিবেশিক অরন্য আইনে ঝুম চাষ নিষিদ্ধ হওয়ায় রাম্পারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

(খ.) জমিদার ও মহাজনদের শোষন 

রাম্পাবিদ্রোহের একটি অন্যতম প্রধান কারন ছিলো জমিদারমহাজনদের শোষন। মহাজন শ্রেনী ইংরেজদের জটিল আইনের সুযোগ নিয়ে নিরক্ষর রাম্পাদের ঋনভারে জর্জরিত করে এবং তাদের জমি গুলি দখল করে নিতে থাকে। এর ফলে রাম্পাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। 

(গ.) প্রত্যক্ষ কারন 

রাম্পা বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারন ছিলো অরন্য ও পার্বত্য অঞ্চলে জোর করে রাম্পাদের দিয়ে রাস্তা তৈরি করানো। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাম্পা কৃষকদের জোর করে বেগার খাটানো হয়। ব্যাস্টিয়ন নামে গুডেমের এক ইংরেজ তহশিলদার বল প্রয়োগ করে রাম্পা কৃষকদের রাস্তা নির্মানে নিযুক্ত করলে রাম্পারা উত্তেজিত হয়ে বিদ্রোহ ঘোষনা করে। 

(৩.) নেতৃত্ব :-

রাম্পা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন আল্লুরি সীতারাম রাজু নামের জনৈক ভবঘুরে সাধু। আল্লুরী সহজ সরল আদিবাসীদের তার ধর্মীয় মতবাদের দ্বারা সংগঠিত করেন। তিনি নিজেকে কল্কি অবতারমহাত্মা গান্ধীর অনুগামী বলে প্রচার করেন। রাম্পা উপজাতির মানুষ বিশ্বাস করতো সীতারাম রাজু নানা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। আল্লুরী রাজুর অলৌকিক ক্ষমতার প্রচার রাম্পা কৃষকদের মনে সাহসের সঞ্চার করে। 

(৪.) বিদ্রোহ ঘোষনা :-

সীতারাম রাজুর নেতৃত্বে রাম্পা কৃষকরা সরকারি আইন লঙ্ঘন করলে তাদের দমন করার জন্য সরকার পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করে। এই সময় রাজুর নেতৃত্বে রাম্পা কৃষকরা গেরিলা যুদ্ধ চালায়। 

অল্প সময়ের মধ্যেই রাম্পা বিদ্রোহ হিংসাত্মক হয়ে পড়ে। রাম্পা কৃষকরা মহাজন বাড়ি ও পুলিশ থানা গুলিতে আক্রমণ করে। প্রায় ২৫০০ বর্গ মাইল এলাকায় এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ভদ্রাচলম্ থেকে পার্বতীপুরম্ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে এই আন্দোলনের বিস্তার হয়। 

(৫.) দমন নীতি :- 

রাম্পা উপজাতির আন্দোলন শেষদিকে হিংসাত্মক হয়ে উঠলে ব্রিটিশ সরকার মালাবারের স্পেশাল পুলিশ ও আসাম রাইফেলদের সাহায্যে তীব্র দমন নীতি নিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করে। ১৯২৪ খ্রিঃ ৬ ই মে রাজু ধরা পড়লে রাম্পা বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহ দমন করতে মাদ্রাজ সরকারকে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা খরচা করতে হয়। রাম্পা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও, তা ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করেছিলো। 

(৬.) বৈশিষ্ট্য :-

দাক্ষিনাত্যের রাম্পা বিদ্রোহের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের দিক লক্ষ্য করা যায়। যেমন - 

(১.) এটি ছিলো একটি আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহ
(২.) এই বিদ্রোহে কোন স্থানীয় ব্যক্তি বা উপজাতি নেতা নেতৃত্ব দেন নি। নেতৃত্ব দেন আল্লুরি সীতারাম রাজু নামে এক বহিরাগত ব্যক্তি। 
(৩.) অসামান্য জনপ্রিয়তার কারনে আল্লুরি সীতারাম রাজু রাম্পা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের লোকগাথার বীরে পরিনত হন। 
(৪.) রাম্পা বিদ্রোহ প্রথমে শান্তিপূর্ণ ভাবে শুরু হলেও, পরে হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠেছিলো। 
(৫.) অলৌকিকতাবাদ ও অতিন্ত্রিয়বাদের প্রয়োগ যেকোন আদিবাসী বিদ্রোহে দেখা যায়। রাম্পা বিদ্রোহেও এটি দেখা গিয়েছিলো। সতীরাম রাজুর কল্কি অবতার তত্ত্ব ও নানা অলৌকিকত্ববাদ বিদ্রোহীদের প্রভাবিত করেছিলো।
(৬.) আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এই বিদ্রোহ জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলো। বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করলেও, ভারতীয় পুলিশ, সেনা বা কর্মচারীদের হত্যা না করার সংকল্প নিয়েছিলেন। 

(৭.) রাম্পা বিদ্রোহের গুরুত্ব :-

 রাম্পা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও, এর প্রভাব ও গুরুত্বের দিককে কখনই উপেক্ষা করা যায় না। 

(১.) রাম্পা বিদ্রোহ ছিলো নিন্মবর্গ আদিবাসী মানুষদের অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। 
(২.) এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে বিরাট ত্রাসের সঞ্চার করে। 
(৩.) এই বিদ্রোহের পর রাম্পা উপজাতিদের ক্ষোভের কারন গুলি অনুধাবন করে সরকার তা দূর করতে উদ্যোগী হয়। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post