একা আন্দোলন


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এবং অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে উত্তর প্রদেশের হরদোই, সীতাপুর, বারাইচ, বারাবাকী জেলায় এক ব্যাপক কৃষক আন্দোলন সংঘঠিত হয়। ১৯২১ খ্রিঃ শেষ দিকে সংঘটিত এই কৃষক আন্দোলনের নাম ছিলো "একা আন্দোলন" বা "একতা আন্দোলন"। 

একা আন্দোলন
একা আন্দোলন

(১.) নামকরন :- 

আন্দোলন চলাকালে যে কোন অবস্থায় কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নেন বলে এই আন্দোলনের নাম হয়েছিলো "একা আন্দোলন" বা "একতা আন্দোলন"। 

(২.) কারন :-

একা আন্দোলনের মূল কারণ গুলি ছিলো - 
(১.) জমিদার ও জায়গীরদারদের শোষন, 
(২.) ন্যায্য করের অতিরিক্ত আরও ৫০% কর আদায়, 
(৩.) রাজস্ব আদায়কারী ঠিকাদারদের শোষন ও অত্যাচার
(৪.) বেগার শ্রম ও নানা বেআইনি কর আরোপ, 
(৫.) কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ। 


(৩.) নেতৃত্ব :-

একা আন্দোলনের সূচনা পর্বে কংগ্রেস নেতৃত্ব এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আন্দোলনের রাশ মাদারী পাশীর হাতে চলে যায়। প্রকৃতপক্ষে অনুন্নত সম্প্রদায়ের নেতা  মাদারী পাশিই ছিলেন একা আন্দোলনের প্রান পুরুষ। তার নেতৃত্বে অনুন্নত শ্রেনির কৃষকরা দলে দলে একা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। 

মাদারী পাশি ছাড়াও একা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বাবা গরীবদাস। তিনি কিষান আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে স্বরাজের দাবিও উত্থাপন করেন। 

(৪.) কৃষকদের শপথ ও দাবিসমূহ :-

একা আন্দোলনে কৃষকরা মাটিতে গর্ত করে তাতে জল রাখতো। এই জলকে তারা গঙ্গাজল বলে বিশ্বাস করতো। এই জল হাতে নিয়ে তারা সমবেত ভাবে মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে শপথ নেয় - (১.) জমির স্বত্বের মেয়াদ শেষ হলেও তারা জমি ছাড়বে না। (২.) অতিরিক্ত খাজনা দেবে না। (৩.) রসিদ ছাড়া খাজনা দেবে না। (৪.) বেগার শ্রম দেবে না। (৫.) গ্রামের বিরোধ পঞ্চায়েতে মীমাংসা করবে এবং (৬.) যে কোন অবস্থায় নিজেদের একতা রক্ষা করবে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি মারাত্মক আকার ধারন করলে কৃষকরা পন্যের বদলে টাকায় খাজনা দেওয়ার দাবি তোলে। কারন ফসলের দাম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিলো।ফলে ফসলে খাজনা দিতে গিয়ে কৃষকদের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছিলো। 

(৫.) আন্দোলনে হিংসার প্রবেশ :-

মাদারী পাশির নেতৃত্বে অল্প সময়ের মধ্যে একা আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা কুমায়ুন অঞ্চলের সংরক্ষিত অরন্য জ্বালিয়ে দেয়। জমিদার ও তালুকদারদের বাড়ি আক্রমণ করে। 

(৬.) দমন নীতি :-

আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠলে কংগ্রেস একা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। এর ফলে সরকারের পক্ষে আন্দোলনকে দমন করা অনেক সহজ হয়ে যায়। ১৯২২ খ্রিঃ মার্চ মাসের মধ্যে সরকার চরম দমন নীতি চালিয়ে এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়। ১৯২২ খ্রিঃ জুন মাসে মাদারী পাশিকে গ্রেপ্তার করা হলে একা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে

(৭.) একা আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য :-

একা আন্দোলনের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -

(১.) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অসহযোগ আন্দোলন পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলন ছিলো একা আন্দোলন।
(২.) অসহযোগ পর্বে কংগ্রেস নেতৃত্বের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন মুক্ত হয়েই এই আন্দোলন পরিচালিত হয়।
(৩.) একা আন্দোলন একটি কৃষক আন্দোলন হলেও, তার মধ্যে জাতীয়তাবাদী চরিত্রও লক্ষ্য করা যায়। বিদ্রোহ চলাকালে মাদারি পাশী জেলা শাসককে হত্যা করার ও ব্রিটিশ শাসকদের বিতাড়িত করার আবেদন কৃষকদের মধ্যে রেখেছিলেন। এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা বাবা গরিবদাস স্বরাজের দাবি উত্থাপন করেন। 
(৪.) একা আন্দোলনে "গান্ধী মিথ" বা গান্ধীর প্রভাব কাজ করে নি। আন্দোলনকারীরা অহিংসা নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। ফলে আন্দোলন শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই তা হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠেছিলো। 
(৫.) একা আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী ও জঙ্গী হয়ে উঠলে কংগ্রেস প্রচারপত্র বিলি করে কৃষকদের সংযত থাকতে অনুরোধ করেছিলো। কিন্তু কৃষকরা কংগ্রেসের অনুরোধ গ্রাহ্য করে নি
(৬.) একা আন্দোলনে অতিন্দ্রীয়বাদ ও ধর্মীয় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কৃষকরা গঙ্গা জল ও বিশেষ মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে শপথ নিতো।
(৭.) ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে, কংগ্রেস একা আন্দোলনকে সরকারি ভাবে সমর্থন না করলেও, বেশ কয়েকজন স্থানীয় নেতা এই আন্দোলনের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে যুক্ত ছিলেন। 

(৮.) একা আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা :-

একা আন্দোলনের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও লক্ষ্য করা যায়।. যেমন :- 
(১.) এই আন্দোলনে কৃষকরা বেদখলি ও বেআইনি করের হাত থেকে মুক্তির দাবি তুললেও জমিদারি প্রথা বিলোপ বা উচ্ছেদের দাবি তোলেন নি। 
(২.) তারা জমিদারদের কর বন্ধ করার ঘোষনাও করেন নি। ফলতঃ একা আন্দোলন কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রন মুক্ত হলেও, তার নীতির দ্বারা অনেকাংশে পরিচালিত হয়েছিলো।

(৯.) একা আন্দোলনের গুরুত্ব :-

একা আন্দোলন ব্যর্থ হলেও, এর প্রভাব ও গুরুত্বের দিককে কখনই উপেক্ষা করা যায় না। 

(১.) একা আন্দোলন ছিলো নিন্মবর্গ কৃষিজীবী মানুষদের অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। 

(২.) এই আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে বিরাট ত্রাসের সঞ্চার করে ও উত্তর প্রদেশে অসহযোগ আন্দোলনকে তীব্র করে তোলে। পুলিশি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, একা আন্দোলন অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যুক্ত হয়েছিলো। 
(৩.) এই বিদ্রোহের পর কৃষকদের ক্ষোভের কারন গুলি অনুধাবন করে সরকার তা দূর করতে উদ্যোগী হয়। 


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post