দক্ষিণ ভারতে বর্তমান কেরালা রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য কৃষক বিদ্রোহ ছিলো "মোপলা বিদ্রোহ"। বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার এই বিদ্রোহ সংগঠিত হলেও, অসহযোগ আন্দোলনের সময় এই বিদ্রোহ তীব্র ও ব্যাপক আকার ধারন করেছিলো।
মোপলা বিদ্রোহ |
(১.) মোপলাদের পরিচয়
দক্ষিণ ভারতে কেরালার মালাবার অঞ্চলের আরব বংশদ্ভুত মুসলমান কৃষকদের বলা হতো মোপলা। এদের পূর্ব পুরুষরা আরব দেশ থেকে মালাবারে এসেছিলো। টিপু সুলতানের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধের সময় বহু মোপলা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালায়।
(২.) বিদ্রোহের কারন
(i.) নতুন ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন :-
টিপুর পতনের পর ১৭৯২ খ্রিঃ মালাবার অঞ্চলে ইংরেজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় ইংরেজরা রাজস্ব সংগ্রহের জন্য মালাবারে হিন্দু জমিদারদের নিয়ে নতুন ভূমি বন্দোবস্তের প্রচলন করেন। নায়ার ও ব্রাহ্মন নাম্বুদ্রি সম্প্রদায়কে জমিদারি স্বত্ব দেওয়া হয়।
(ii.) হিন্দু জমিদারদের শোষন :-
জমিদারি স্বত্ব প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু জমিদাররা মালাবার অঞ্চলে নানাবিধ সামন্ততান্ত্রিক শোষন শুরু করে। নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মন ও নায়ার জমিদারদের বিরুদ্ধে মোপলাদের ক্ষোভের প্রধান কারন গুলি ছিলো -
(অ.) অনিশ্চিত ভূমিস্বত্ব :-
মালাবার অঞ্চলে মোপলা কৃষকদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভূমিস্বত্ব প্রদান করা হতো। দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার নবীকরনের জন্য তাদের চড়া টাকা ও নজরানা দিতে হতো।
(আ.) জমি থেকে উচ্ছেদ :-
ইংরেজদের নতুন ভূমি ব্যবস্থায় জমির মালিকানা দেওয়া হয়েছিলো হিন্দু জমিদারদের। এই ভূমি ব্যবস্থায় কৃষকরা জমির মালিকানা পায় নি। কৃষকদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খাজনা প্রদানের শর্তে জমি চাষাবাদ ও ভোগদখলের অধিকার জমিদাররা প্রদান করতেন। ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার নিয়ম অনুযায়ী হিন্দু জমিদাররা রাজস্ব প্রদানে অপারগ বা অবাধ্য কৃষকদের যখন তখন উচ্ছেদ করতে পারতেন। মালাবারে যথেচ্ছ ভাবে কৃষক উচ্ছেদ মোপলাদের বিদ্রোহী করে তুলেছিলো।
(ই.) উচ্চ রাজস্বের হার :-
মালাবার অঞ্চলে রাজস্বের হার ছিলো অত্যন্ত চড়া। উৎপন্ন ফসলের প্রায় ৩৫ - ৪০ শতাংশ মোপলাদের খাজনা হিসাবে দিতে হতো। খাজনা দিতে অপারগ মোপলাদের সহজেই জমি থেকে উচ্ছেদ করা হতো অথবা নানা রকম নিপীড়ন করা হতো।
(৩.) মোপলাদের ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ও অসহযোগ পূর্বে তাদের একাধিক বিদ্রোহ
মুসলমান প্রধান মালাবার অঞ্চলে হিন্দু জমিদারদের ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়ায় মুসলমান মোপলা কৃষকরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দু বিদ্বেষী হয় এবং গোড়া ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত হয়। মালাবারে ১৮৩১ খ্রিঃ মসজিদের সংখ্যা ছিলো ৬৩৭। ১৮৫১ খ্রিঃ তার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০৫৮। মোপলারা স্থানীয় নিন্মবর্নের হিন্দু চেরুমারদেরও ইসলামে দীক্ষিত করে।
ধর্মীয় বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় মোপলাদের মনে বিদ্রোহের ভাব জেগে ওঠে। মালাবারে জমিদারকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় জেনমি। এই জেনমিদের বিরুদ্ধে মোপলারা ১৮৩৬, ১৮৫৪, ১৮৮২ এবং ১৮৯৬ খ্রিঃ বিদ্রোহ করে। এইসময় তারা জেনমি নায়ারদের সম্পত্তি দখল করে ও মন্দির আক্রমণ করে। পুলিশের গুলিতে যেসব মোপলারা নিহত হয় তাদের শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়।
(৪.) প্রাক্ অসহযোগ পরিস্থিতি
১৯২১ খ্রিঃ অসহযোগ আন্দোলনের আগে মালাবার অঞ্চলে ৩ টি রাজনৈতিক আন্দোলন মোপলাদের পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। একটি ছিলো জমির অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। অপর দুটি আন্দোলন ছিলো যথাক্রমে খিলাফৎ আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন।
(অ.) জমির জন্য লড়াই :-
দক্ষিণ ভারতে ১৮৬৭ খ্রিঃ ত্রিবাঙ্কুরে এবং ১৯১৪ খ্রিঃ কোচিনে কৃষকদের জমির অধিকার স্বীকৃত হলেও, মালাবারে সেই অধিকার স্বীকৃত না হওয়ায় মোপলা কৃষকরা অসন্তুষ্ট হয়।
১৯১৬ খ্রিঃ জমিতে কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মালাবারে একটি আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯১৬ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয় "Malabar Tenants Association"।
১৯২০ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে মানজেরীতে মালাবার জেলা কংগ্রেসের অধিবেশনে মোপলা কৃষকদের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয় এবং এর জন্য আইন তৈরির সুপারিশ করা হয়। মানজেরী অধিবেশন মোপলা কৃষকদের প্রচন্ডভাবে উৎসাহিত করে তোলে। এর প্রভাবে মালাবার অঞ্চলে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উদ্যোগে অনেক গুলি কৃষক সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কৃষক সভা গুলির মধ্য দিয়ে মোপলা কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন।
(আ.) খিলাফৎ ও অসহযোগ আন্দোলন :-
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় যে দুটি আন্দোলন মোপলাদের নতুন ভাবে উৎসাহিত ও সংগঠিত করে তা হলো, খিলাফৎ আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলন।
মুসলমান মোপলা কৃষকরা ছিলো অশিক্ষিত ও ধর্মান্ধ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই খিলাফৎ আন্দোলন তাদের প্রচন্ড ভাবে উৎসাহিত ও উত্তেজিত করে তোলে। তারা স্বপ্ন দেখে খিলাফৎ প্রতিষ্ঠা হলে সেখানে বিধর্মী হিন্দু জমিদারদের আর শোষন থাকবে না।
গান্ধীজি ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের খিলাফৎ আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ায় মোপলা আন্দোলনে এক নতুন জোয়ার আসে। গান্ধীজি, সৌকত আলি, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খাঁ প্রমুখ জাতীয় স্তরের নেতারা মালাবার পরিভ্রমন করে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন। এর ফলে মালাবারের বিভিন্ন স্থানে কংগ্রেস খিলাফৎ কমিটি গঠিত হয়। এই সময় বিভিন্ন কৃষক সমাবেশে মোপলারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় তাদের সংগ্রামী চেতনা বহুগুন বৃদ্ধি পায়।
(ই.) কল্পরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচার :-
এইসময় আলি মুসালিয়ার নামে একজন স্থানীয় মোপলা নেতা প্রচার করেন, মোপলা সন্ত মামপ্রত্তি থাঙ্গল তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছেন খিলাফৎ প্রতিষ্ঠার সময় এসে গেছে। এক নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে কোন ব্যক্তি সম্পত্তি থাকবে না। শোষন থাকবে না। এই ঘটনা অশিক্ষিত মোপলাদের ধর্মীয় উদ্মাদনা ও উৎসাহ বহুগুন বাড়িয়ে দেয়।
১৯২১ খ্রিঃ ২১ ফেব্রুয়ারি, সরকার খিলাফৎ সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ঐ মাসেই মোপলাদের মধ্যে প্রচার করার অভিযোগে মাধবন নায়ার, ইয়াকুব হাসান, গোপাল মেনন, পি মৌদিন কোয়ারের মতো প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেস ও খিলাফতি নেতারা গ্রেপ্তার হন।
এই গ্রেপ্তারের পর মোপলা বিদ্রোহের নেতৃত্ব স্থানীয় মৌলবী ও হাজিদের হাতে চলে যায়। ধর্মান্ধ ঐ সব ব্যক্তিরা প্রচার সমাবেশে মোপলাদের উত্তেজিত করে তুলতে থাকেন।
(৫.) প্রত্যক্ষ কারন ও বিদ্রোহ
১৯২১ খ্রিঃ আগস্ট মাসে স্থানীয় একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। এই সময় তিরুরঙ্গাভি মসজিদে অস্ত্রের তল্লাশি করার জন্য পুলিশ অভিযান চালালে, মোপলাদের ধূমায়িত ক্ষোভ বিদ্রোহের আকারে প্রসারিত হয়।
বিদ্রোহীরা সরকারি দপ্তর, পুলিশ চৌকি, হিন্দু জমিদার বাড়ি আক্রমণ করে। প্রায় দশ হাজার মোপলা গেরিলা পদ্ধতিতে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালায়।
আন্দোলনের তীব্রতায় দক্ষিণ মালাবারের এরনাড ও বাল্লুবানাড তালুকের বেশ কয়েকমাস ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রন মুক্ত থাকে। মালাবারের বেশ কিছু অঞ্চলে সাময়িক ভাবে খিলাফৎ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
(৬.) সাম্প্রদায়িক চরিত্র লাভ
ক্রমে মোপলা বিদ্রোহ সাম্প্রদায়িক চরিত্রের রূপ নেয়। গোড়ার দিকে উদার হিন্দু জমিদারদের প্রতি সদয় ব্যবহার নেওয়া হলেও, আন্দোলন শেষের দিকে উগ্র ও ধর্মান্ধ হয়ে উঠে। ঐ সময় অবশিষ্ট হিন্দু জমিদার ও সাধারন নিরপরাধ হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। ধর্মান্ধ মোপলা কৃষকরা এই পর্বে প্রায় ৬০০ হিন্দুকে হত্যা করে এবং ২৫০০ হিন্দুকে বলপূর্বক ধর্মান্তকরন করে।
(৭.) সরকারি দমননীতি
অবশেষে নির্মম দমন নীতি প্রয়োগ করে ব্রিটিশ সরকার মোপলা বিদ্রোহ দমন করে। সরকারি মতে ২৩৩৭, এবং বেসরকারি মতে ১০,০০০ মোপলাকে হত্যা করে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়। সামরিক আইন জারি করে ব্রিটিশ সরকার মোপলা বিদ্রোহকে নিয়ন্ত্রনে আনে।
(৮.) মোপলা বিদ্রোহের প্রকৃতি
মোপলা বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মোপলা বিদ্রোহকে একটি "সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা" বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে কমিউনিস্টরা এবং বামপন্থী ঐতিহাসিকদের একটি বড়ো অংশ মোপলা বিদ্রোহকে একটি "কৃষক বিদ্রোহ" রূপে বর্ননা করেছেন।
অযথা বিতর্কে না গিয়ে বলা যায়, দুটি বক্তব্যই ঠিক। কারন মোপলা বিদ্রোহের মধ্যে যেমন কৃষক বিদ্রোহের উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। তেমনই সাম্প্রদায়িক চেতনা ও কার্যকলাপের দিকটিও লক্ষ্য করা যায়। আবার এই বিদ্রোহের সামন্ত বিরোধী অবস্থান ছিলো অত্যন্ত মজবুত। ধর্ম নিঃসন্দেহে বিদ্রোহীদের উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতা দিয়েছিলো। কিন্তু ধর্মই আবার তাদের শ্রেনীগত ভাবে ঐক্যবদ্ধ হতেও সাহায্য করেছিলো।
সবদিক বিচার বিশ্লেষণ করে তাই বলা যায়, মোপলা বিদ্রোহ ছিলো অসহযোগ আন্দোলনের সময় সংগঠিত ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি কৃষক বিদ্রোহ। অসহযোগ পূর্ববর্তী সময়কালের মোপলা বিদ্রোহ গুলি মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যেই বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনের সময় মোপলাদের বিদ্রোহ প্রকৃত অর্থেই একটি গন বিদ্রোহে পরিনত হয়েছিলো। মোপলাদের কল্পরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচার ও ইংরেজ বিরোধিতা এই কৃষক বিদ্রোহকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চরিত্রও দান করেছিলো।
(৯.) মোপলা বিদ্রোহের গুরুত্ব
মোপলা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও, এর গুরুত্ব ও প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।
(১.) মোপলা বিদ্রোহ ছিলো নিন্মবর্গের মানুষদের অস্তিত্ব ও অধিকার রক্ষার লড়াই।
(২.) এটি ছিলো ধর্মীয় ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত একটি কৃষক বিদ্রোহ।
(৩.) এই বিদ্রোহের প্রভাবেই পরবর্তীকালে ১৯২৯ খ্রিঃ টেনান্সি অ্যাক্ট বা প্রজাস্বত্ব আইন পাশ করে মোপলা কৃষকদের অধিকার রক্ষার চেষ্টা করা হয়।
(৪.) মোপলা বিদ্রোহ দক্ষিণ ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশকে নষ্ট করে।