গুজরাটের সুরাট জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ তালুক ছিলো বারদৌলি। ১৯২০ দশকে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে এই বারদৌলি তালুক দুটি কারনে স্মরণীয় ও বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলো। এক, "বারদৌলি প্রস্তাবের" জন্য, দুই "বারদৌলি সত্যাগ্রহের" জন্য।
অসহযোগ আন্দোলনের শেষ দিকে বারদৌলিতে জাতীয় কংগ্রেসের ওয়াকিং কমিটির জরুরী বৈঠক বসেছিল। ১৯২২ খ্রিঃ ১২ ফেব্রুয়ারি, অনুষ্ঠিত ঐ বৈঠকে মহাত্মা গান্ধী "বারদৌলি প্রস্তাব" পেশ করে আকস্মিক ভাবে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।
বারদৌলি তালুকে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ঐতিহাসিক ঘটনাটি ছিলো, বারদৌলি সত্যাগ্রহ। বারদৌলিতে সরকারের ক্রমাগত খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৯২৮ খ্রিঃ বারদৌলি সত্যাগ্রহ সংগঠিত হয়। বারদৌলিতে অনুষ্ঠিত দুই ঘটনাই জাতীয় রাজনীতিতে গভীর রেখাপাত করে এবং সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
প্রথম ঘটনাটি সারা দেশে গান্ধীর মত, পথ ও আদর্শকে নিয়ে অনেকের মনে সংশয় সৃষ্টি করে ও নানা বিরুপ সমালোচনার জন্ম দেয়। আবার দ্বিতীয় ঘটনাটি সেই সব সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে গান্ধীজি এবং জাতীয় কংগ্রেসকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে।
বারদৌলি সত্যাগ্রহ |
(ক.) বারদৌলি তালুকের পরিচয় :-
গুজরাটের সুরাট জেলার বারদৌলি তালুক ছিলো একটি কৃষিপ্রধান অনুন্নত এলাকা। এটি ছিলো একটি রায়তওয়ারি অঞ্চল। অর্থাৎ সরকার এই অঞ্চলের রাজস্ব সরাসরি রায়ত বা কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করতো। এখানে জমিদারদের কোন অস্তিত্ব ছিলো না।
বারদৌলিতে কৃষিজাত পন্যের মধ্যে তুলোর চাষ খুব ভালো হতো। এই তালুকের প্রায় ৬০ শতাংশই ছিলেন নিন্মবর্নের ভূমিহীন ক্ষেতমজুর বা ভাগচাষী। এদেরকে স্থানীয় ভাষায় বলা হতো "কালিপরাজ" (কালো মানুষ)। কালিপরাজরা "হালি প্রথা" (বংশানুক্রমিক বাধ্যতামূলক শ্রমদান) অনুসারে উচ্চবর্নের জমি মালিকদের অধীনে কাজ করতো। উচ্চবর্নের জমি মালিকদের বলা হতো "উজলিপরাজ" (সাদা মানুষ)।
বারদৌলিতে কুনবি - পাতিদাররা ছিলো সম্পন্ন কৃষক। বারদৌলি তালুকে জমির মালিকানা এরাই ভোগ করতো। এদেরকেই বলা হতো" উজলিপরাজ" অর্থাৎ সাদা মানুষ। "উজলিপরাজরা" ঋনদাস বা "হালি প্রথার" মাধ্যমে "কালিপরাজদের" দিয়ে জমি চাষ করাতো। কালিপরাজদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন নিন্মবর্গ "দুবলা জনগোষ্ঠীর" মানুষ। এরা উচ্চবর্নের সীমাহীন শোষন, দারিদ্র্য, অবজ্ঞা ও কুসংস্কারে জর্জরিত ছিলেন।
(খ.) বারদৌলি সত্যাগ্রহের প্রেক্ষাপট ও কারন :-
বারদৌলি সত্যাগ্রহের অনুপ্রেরণা অসহযোগ আন্দোলন থেকেই এসেছিলো। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে ঠিক হয়েছিলো গান্ধীজি বারদৌলি তালুকে কৃষকদের নিয়ে সত্যাগ্রহ করবেন। কিন্তু চৌরীচৌরার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় নি।
তবে বারদৌলি সত্যাগ্রহ আপাতভাবে স্থগিত করা হলেও, ঠিক হয় বারদৌলি তালুকে গান্ধীজির গঠনমূলক গ্রামোন্নয়নের কর্মসূচি গুলি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
(১.) অসহযোগ ও সত্যাগ্রহের আদর্শ প্রচার :-
অসহযোগ আন্দোলন বারদৌলি তালুককে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলো। এই সময় স্থানীয় মেহতা ভ্রাতৃদ্বয় (কল্যানজী মেহতা ও কুনরেরজী মেহতা) কৃষকদের মধ্যে অসহযোগ ও সত্যাগ্রহের আদর্শ প্রচার করেন। এর ফলে বারদৌলি তালুকের কৃষকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
(২.) গঠনমূলক গ্রামোন্নয়ন কর্মসূচির প্রচার :-
এই সময় বারদৌলি তালুকে গান্ধীবাদী নানা গঠনমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। দয়ালজী দেশাই ও মেহতা ভ্রাতৃদ্বয় বারদৌলি তালুকে স্কুলের ছাত্রদের দেশপ্রেমের আদর্শে দীক্ষিত করেন। তারা পনপ্রথা বয়কট, বিদেশী পন্য বয়কট ও মদ্যপানের বিরোধিতার প্রচার করেন। এই সময় কৃষকদের মধ্যেকার বিরোধ দূর করার জন্য "ভজন মন্ডলের" মাধ্যমে কালিপরাজদের সঙ্গে উজলিপরাজদের একত্রে ভজন ও প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হয়।
স্থানীয় গান্ধীপন্থী সত্যাগ্রহীরা কালিপরাজদের জাগরন ও মুক্তির জন্য একাধিক গঠনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। হালি প্রথার বিরুদ্ধে কালিপরাজদের জাগিয়ে তোলা হয়। তাদের আর্থ - সামাজিক উন্নয়নের জন্য ছয়টি আশ্রম ও স্কুল খোলা হয়। কালিপরাজদের নিরক্ষরতা দূর করার জন্য নৈশ বিদ্যালয় খোলা হয়। কালিপরাজদের ভাষায় সাহিত্য রচনা করা হয়। কালিপরাজরা সম্প্রদায়ের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে স্বয়ং গান্ধীজি অংশগ্রহণ করেন। তিনি কালিপরাজদের নতুন নাম দেন "রানিপরাজ" বা অরন্যবাসী।
গ্রামোন্নয়ন ও গান্ধীবাদী আদর্শের প্রচার "বারদৌলি সত্যাগ্রহের" প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলো। কারন এই কর্মসূচি গুলির ফলে বারদৌলি তালুকে (১.) কৃষকদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। (২.) কৃষকরা অনেকবেশি সংগঠিত হতে পেরেছিলো। এমনকি (৩.) রাজনৈতিক দিক থেকেও কৃষকরা অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠেছিলো। এসবই বারদৌলি সত্যাগ্রহের প্রেক্ষাপট রচনা ও সফলতার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।
(৩.) রাজস্বের হার বৃদ্ধি ও ক্ষোভ :-
১৯২৫ খ্রিঃ ভয়াবহ বন্যায় বারদৌলি তালুকে ফসলের প্রভূত ক্ষতি হয় এবং দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। এতদসত্তেও ১৯২৬ খ্রিঃ বোম্বাই সরকারের রাজস্ব দপ্তর বারদৌলি তালুকে ৩০% রাজস্ব বৃদ্ধির নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিবাদ জানায় এবং একটি "তথ্য অনুসন্ধান কমিটি" নিয়োগ করে। এই কমিটির রিপোর্টে বলা হয় এই রাজস্ব বৃদ্ধি অনুচিত। ইয়ং ইন্ডিয়া ও নবজীবন পত্রিকাতে এই রিপোর্ট প্রকাশিত হলে, সরকার সিদ্ধান্ত বদল করে ঘোষনা করে ২১.৯৭ শতাংশ হারে রাজস্ব বাড়ানো হবে। কিন্তু এতেও কৃষকরা সন্তুষ্ট হয় নি। কারন এই সময় বাজারে তুলোর দাম পড়ে যাওয়ায় কৃষকদের প্রভূত অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছিলো।
(গ.) সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্ব গ্রহন :-
সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে বারদৌলিতে গান্ধীবাদী আশ্রমিক গোষ্ঠী (গ্রামোন্নয়নের জন্য যে ছয়টি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো) খাজনা বন্ধ বা সত্যাগ্রহ পরিচালনার জন্য গান্ধীপন্থী আইনজীবী বল্লভভাই প্যাটেলের দ্বারস্থ হন। প্যাটেল বারদৌলিতে আসার পর কৃষকদের বোঝান, খাজনা বন্ধ করা হলে সরকারের তীব্র দমন নীতির শিকার হতে হবে। এ বিষয়ে তাদের সম্মতি পেলে তবেই তিনি আন্দোলন শুরু করবেন।
প্যাটেল বোম্বাইয়ের গভর্নর উইলিংডনকে অনুরোধ করেও সরকারের মত পাল্টাতে পারেন নি। এমতাবস্থায়, ১৯২৭ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে পাতিদার সম্মেলনে গান্ধীজি ও বল্লভভাই প্যাটেল মিলিত হয়ে সরকারকে রাজস্ব না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বারদৌলিতে সত্যাগ্রহ পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্ব বল্লভভাই প্যাটেলের হাতে দেওয়া হয়।
(ঘ.) বারদৌলিতে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পরিচয় :-
এর ফলে বল্লভভাই প্যাটেল ১৯২৮ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি মাসে বারদৌলিতে আসেন এবং বাড়তি খাজনা বন্ধের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন।
প্যাটেল ১৯২৮ খ্রিঃ বারদৌলির কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে সত্যের পথে থেকে যে অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন, তাই ইতিহাসে "বারদৌলি সত্যাগ্রহ" নামে পরিচিত হয়।
বারদৌলি সত্যাগ্রহকে সফল করে তোলার জন্য প্যাটেল তার অসাধারন সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় দেয়।
(১.) সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য প্যাটেল সম্পূর্ণ বারদৌলি তালুককে ১৩ টি অঞ্চলে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চলে সত্যাগ্রহ পরিচালনার দায়িত্ব একজন করে অভিজ্ঞ নেতাদের হাতে দেন।
(২.) সত্যাগ্রহের শুরুতে হিন্দু - মুসলিম কৃষকদের গীতা ও কোরান ছুঁয়ে শপথ করানো হয় সরকার প্রচলিত হারে খাজনা নিতে রাজী না হলে তারা সরকারকে কোন খাজনা দেবে না।
(৩.) সত্যাগ্রহকে সফল করে তোলার জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের মনবল বাড়ানো হয়। আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ধোপা নাপিত বন্ধ করে সামাজিক বয়কট করা হয়।
(৪.) বারদৌলি সত্যাগ্রহ সম্পর্কে জনমত গঠনের জন্য এই সত্যাগ্রহের সংবাদ বিভিন্ন সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচার করা হয়। তাছাড়া বারদৌলি থেকে "সত্যাগ্রহ পত্রিকা" প্রকাশিত হয়।
(৫.) আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকার কৃষকদের জমি বাজেয়াপ্ত করলে এবং পুলিশ সেনা দিয়ে দমন পীড়ন চালালে ঐ দমন নীতির সংবাদ সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচার করা হয়। বারদৌলি সত্যাগ্রহকে কালিপরাজদের সম্প্রদায়ও দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। সরকার বিভেদ নীতি প্রয়োগ করে কালিপরাজদের জমিদানের প্রলোভন দিয়ে আন্দোলন দুর্বল করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এতেই বোঝা যায়, গান্ধীর সত্যাগ্রহ আদর্শ বারদৌলিতে কতটা শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে পেরেছিলো।
(৬.) সরকারি দমন নীতিতে কৃষকদের মনোবল যাতে ভেঙে না পড়ে, সেইজন্য অবিরাম সভা ও বক্তৃতার মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হতে থাকে।
(৭.) বারদৌলি সত্যাগ্রহে দলে দলে ছাত্র ও নারীরা অংশগ্রহণ করে। কিষান নারীরা গৃহকোন ছেড়ে সত্যাগ্রহে অংশ নেন। তাদের সাথে মিঠুবেন প্যাটেল, ভক্তিবাঈ, বল্লভভাই প্যাটেলের কন্যা মনিবেন প্যাটেল, শারদা মেহতার মতো সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারও অংশগ্রহণ করেন।
(ঙ.) জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব :-
সংবাদপত্রে ব্যাপক প্রচারাভিযান এবং সত্যাগ্রহীদের শক্তিশালী ও দৃঢ় অবস্থানের জন্য অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বারদৌলি সত্যাগ্রহ একটি জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিনত হয়। ভারতের সকল অঞ্চলের দৃষ্টি বারদৌলি সত্যাগ্রহের দিকে পড়ে।
আইনসভার সদস্যরা বারদৌলির কৃষকদের দাবি সমর্থন করলে বোম্বাই সরকার কোনঠাসা হয়ে পড়ে। বোম্বাই কাউন্সিলের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন কে এন মুন্সী ও লালজী নারাণজী।
বারদৌলির কৃষকদের সমর্থনে বোম্বাই প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চলে ব্যাপক কৃষক আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হয়। এই সময় বোম্বাইয়ের কাপড়ের কলের ধর্মঘটি শ্রমিকরা সত্যাগ্রহী কৃষকদের সমর্থন করে। আমেদাবাদের শ্রমিকরা সত্যাগ্রহী কৃষকদের সাহায্যের জন্য ১৩০০ টাকা চাঁদা তুলে পাঠান। এই সময় বোম্বাইয়ের বামপন্থীদের প্রভাব মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি পায়। কমিউনিস্ট দল রেল ধর্মঘটের হুমকি দেয়। বোম্বাই ইয়ুথ লীগ, পাঞ্জাব ইয়ুথ লীগ থেকে "জাঠা" বা সংগ্রামী দল বারদৌলির পথে যাত্রা করে। সরকার কিষান - শ্রমিক যৌথ আন্দোলনের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
ইতিমধ্যে ১৯২৮ খ্রিঃ ২ রা আগস্ট, স্বয়ং গান্ধীজি বারদৌলিতে এসে নেতৃত্ব দেওয়ার সঙ্কল্প নেন। তিনি ঘোষনা করেন, সরকার প্যাটেলকে গ্রেপ্তার করলে তিনি নিজে বারদৌলি সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দেবেন। গান্ধীজির আগমন বারদৌলি সত্যাগ্রহীদের মনবল ও উৎসাহ দুই বৃদ্ধি করে।
(চ.) সরকারের নতি স্বীকার ও তদন্ত কমিটি গঠন :-
১৯২৮ খ্রিঃ জুলাই মাসে সরকার বারদৌলি আন্দোলনকে দমন করার জন্য পুলিশ ও সামরিক বাহিনী পাঠানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু বারদৌলি আন্দোলন যেভাবে জাতীয় আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়, এবং এই আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেনী যোগ দিতে প্রস্তুত হয়, তাতে সরকারের রাতের ঘুম ছুটে যায়। আগস্টের গোড়ার দিকে সরকার দমন নীতির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। প্রচন্ড চাপের মুখে বড়োলাট আরউইন বোম্বাইয়ের ছোটলাটকে দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে বলেন।
এমতাবস্থায় সরকার সিদ্ধান্ত নেয় বারদৌলির বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করা হবে এবং কৃষকদের বাজেয়াপ্ত করা জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। অবশেষে বারদৌলি ঘটনার তদন্ত করার জন্য সরকার "ব্রুমফিল্ড ম্যাক্সওয়েল তদন্ত কমিটি" গঠন করে। এই তদন্ত কমিটি বর্ধিত রাজস্বের হার ২২% থেকে কমিয়ে ৬.২৫% করার সুপারিশ করে। রাজস্বের হার কমানোয় বারদৌলি সত্যাগ্রহ চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করে। অবশেষে কৃষকরা সংশোধিত হারে রাজস্ব প্রদান করেন।
(ছ.) বারদৌলী সত্যাগ্রহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব :-
বারদৌলি সত্যাগ্রহ ছিলো একটি সফল সত্যাগ্রহ আন্দোলন। ভৌগলিক দিক থেকে এর ব্যাপ্তি আঞ্চলিক স্তরে সীমাবদ্ধ থাকলেও, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই সত্যাগ্রহের গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম -
প্রথমত, বল্লভভাই প্যাটেল এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে (ক.) তার অসামান্য সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় দেন, (খ.) "সর্দার" উপাধি লাভ করেন এবং (গ.) সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিচিতি পান। এই সাফল্য কংগ্রেসে বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্ব ও গ্রহনযোগ্যতাকে আরোও বলিষ্ঠতার জায়গায় পৌঁছে দেয়। কংগ্রেস কার্যকরী কমিটি সফল সত্যাগ্রহ পরিচালনার জন্য প্যাটেলকে অভিনন্দন জানায়।
দ্বিতীয়ত, বারদৌলি সত্যাগ্রহের প্রায় ৬ বছর আগে ১৯২২ খ্রিঃ ১২ ফেব্রুয়ারি, বারদৌলিতে কংগ্রেসের ওয়াকিং কমিটিতে গান্ধীজী আকস্মিক ভাবে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় গান্ধীর মত, পথ ও সত্যাগ্রহের আদর্শ নিয়ে দেশে হতাশা, সমালোচনা ও প্রশ্ন দেখা গিয়েছিলো। ১৯২৮ এর "বারদৌলি সত্যাগ্রহ" দেশের সেই সব সংশয়ের অবসান করে। গান্ধীজির মত, পথ ও সত্যাগ্রহের আদর্শের যৌক্তিকতা এবং কার্যকারিতার শক্তিকে দেশবাসী নতুন করে উপলব্ধি করে।
তৃতীয়ত, বারদৌলি সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস অসহযোগ পরবর্তী পর্বের হতাশা ও ব্যর্থতাকে কাটিয়ে উঠে নতুন করে পুনরুজ্জিবিত হয়ে ওঠে। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে একমাত্র জাতীয় কংগ্রেসই প্রকৃত কার্যকর গন আন্দোলন সংগঠিত করতে পারে, এই বিশ্বাস, আস্থা ও ভরসার জায়গা ফিরে আসে।
চতুর্থত, বল্লভভাই প্যাটেল বারদৌলি সত্যাগ্রহের আগে বোম্বাইয়ের গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তা প্রত্যাখ্যান করায় প্যাটেল বারদৌলি সত্যাগ্রহ শুরু করেন। এই ঘটনা প্রমান করে, আলাপ আলোচনা নয়। একমাত্র শক্তিশালী গন আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সরকারের কাছে দাবি আদায় করা সম্ভব। এই শিক্ষা পরবর্তীকালে জাতীয় কংগ্রেসকে বৃহত্তর গন আন্দোলন সংগঠিত করতে উৎসাহিত করেছিলো। সুতরাং বারদৌলী সত্যাগ্রহের শিক্ষা পরবর্তীকালের বৃহত্তর গন আন্দোলন আইন অমান্য আন্দোলনের ভিত্তিভূমি হিসাবে কাজ করেছিলো, এটি বলা যায়।
পঞ্চম, বারদৌলির সত্যাগ্রহের সাফল্য সেখানকার কৃষকদের মনে নতুন চেতনা ও আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার করে। বারদৌলির সাফল্য সারা দেশব্যাপী প্রচারিত হলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যেও এই চেতনা ও আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার হয়।
সর্বোপরি বলা যায়, দেশের কৃষক - শ্রমিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং বামপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বারদৌলি সত্যাগ্রহ যে পরোক্ষ অবদান রেখেছিলো, তার গুরুত্বকেও উপেক্ষা করা যায় না। এইসময় ভারত সচিব বার্কেনহেডকে লেখা বোম্বাইয়ের গভর্নর উইলসনের চিঠি থেকে এই আশঙ্কার কথা জানা যায়।
(জ.) বারদৌলি সত্যাগ্রহের বৈশিষ্ট্য :-
বারদৌলি সত্যাগ্রহের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
(১.) বারদৌলি সত্যাগ্রহের সবথেকে উজ্জ্বল দিক ছিলো হিন্দু মুসলিম ঐক্য। হিন্দু মুসলিম কৃষকরা গীতা ও কোরান ছুঁয়ে সরকারকে খাজনা না দেবার শপথ গ্রহণ করেছিলো।
(২.) বারদৌলি সত্যাগ্রহের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের দিক হলো, এখানকার কৃষকরা দৃঢ়তার সঙ্গে আন্দোলন পরিচালনা করলেও, কখনো হিংসার পথ গ্রহন করেন নি। গান্ধীজির পথেই তারা আস্থাশীল ছিলেন।
(৩.) বারদৌলি সত্যাগ্রহে কৃষকদের যে একতা লক্ষ্য করা যায়, তাও ছিলো যথেষ্ট অভূতপূর্ব। বারদৌলিতে কৃষকদের ঐক্য নষ্ট করার জন্য সরকার ভূমিহীন কালিপরাজদের জমির প্রতিশ্রুতি দিলেও, তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলো।
(৪.) বারদৌলি সত্যাগ্রহের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের দিক হলো ছাত্র ও মহিলাদের অংশগ্রহণ। স্কুল কলেজের ছাত্ররা সত্যাগ্রহের প্রচারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলো। তবে নারীদের অংশগ্রহণ ছিলো সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। কিষান পরিবারের মেয়েদের পাশাপাশি বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরাও দলে দলে বারদৌলি সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন মিঠুবেন প্যাটেল, ভক্তিবাঈ, বল্লভভাই প্যাটেলের কন্যা মনিবেন প্যাটেল, শারদা মেহতা প্রমুখ। নারীরাই বারদৌলী সত্যাগ্রহে বল্লভভাই প্যাটেলকে "সর্দার" উপাধি দেয়।
(ঝ.) সমালোচনা :-
বারদৌলি সত্যাগ্রহকে অনেক ঐতিহাসিকই নানা দিক থেকে সমালোচনা করে থাকেন। বারদৌলি তালুক ছিলো রায়তওয়ারী ভূমি বন্দোবস্তের অধীনে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই অঞ্চলে জমিদারদের কোন অস্তিত্ব ছিলো না। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি রাজস্ব সংগ্রহ করতো।
মনে রাখতে হবে, কংগ্রেসের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জমিদাররা। কংগ্রেস কখনই জমিদারি এলাকায় কৃষক আন্দোলনে খুব বেশি সক্রিয়তা দেখাতো না। কারন এর ফলে জমিদারদের স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারতো। বারদৌলি তালুক রায়তওয়ারী ভূমি বন্দোবস্তের অধীনে থাকার কারনেই কৃষক আন্দোলন সংগঠনে কংগ্রেস এতটা সক্রিয়তা দেখায়।
যদিও, এতটা সক্রিয়তা দেখানোর কোন দরকার ছিলো না বলে ঐতিহাসিক ডি এন ধনগারে মনে করেন। তার মতে, বারদৌলীতে পাতিদার সম্প্রদায় ছিলো যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও ধনী। রাজস্ব বৃদ্ধি পাতিদারদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করেছিলো ঠিকই, কিন্তু কখনই তা তাদের কাছে বোঝা হয়ে ওঠেনি। তার মতে, বারদৌলি সত্যাগ্রহ অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছিলো।
আসলে বারদৌলি সত্যাগ্রহ "রাজস্ব ধার্য ও রাজস্বের হারের পুনর্বিন্যাসের মধ্যেই" সীমাবদ্ধ ছিলো। জমির পারস্পরিক সম্পর্ক, জমির পুনর্বন্টন, কালিপরাজদের জমির অধিকার, তাদের শোষনের অবসান ইত্যাদি বিষয় গুলি এই সত্যাগ্রহে গুরুত্ব লাভ করে নি। বোম্বের "ওয়ার্কাস অ্যান্ড পিজেন্টস পার্টির" নেতা আর এস নিম্বকার তাই যথার্থই বলেছিলেন, অত্যন্ত সীমিত ও সংকীর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে কংগ্রেস বারদৌলি সত্যাগ্রহ করেছিলো।
ডি এন ধনাগারের মতে, জমির মালিকদের শোষনের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন সংগঠিত হয় নি। এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিলো সম্পন্ন পাতিদার কৃষকদের স্বার্থে। কালিপরাজদের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে উচ্চবর্নের পাতিদাররা রাজস্বের হার কমাতে সফল হয়েছিলো বারদৌলি সত্যাগ্রহে।
গ্রন্থঋন :-
১. আধুনিক ভারতের ইতিহাস - ব্রিটিশরাজ থেকে নেহেরু যুগ - ড. রতন কুমার বিশ্বাস।
২. ভারত ইতিহাস পরিক্রমা - প্রভাতাংশু মাইতি ও অসিত কুমার মন্ডল ।
৩. আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস - সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ।
৪.আধুনিক ভারতের রূপান্তর - রাজ থেকে স্বরাজ - সমর কুমার মল্লিক।
৫. আধুনিক ভারত - পলাশী থেকে নেহেরু - সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়।
৬. আধুনিক ভারত ও বিশ্বের ইতিহাস - জীবন মুখোপাধ্যায়।
৭. পলাশি থেকে পার্টিশান - শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়।
৮. আধুনিক ভারতের ইতিহাস - বিপান চন্দ্র।