যারা সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী, তাদেরকেই সাধারনত বলা হয়ে থাকে "বামপন্থী"। রাজনীতির ক্ষেত্রে বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী চিন্তা ধারার প্রথম উদ্ভব ঘটেছিলো ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে। ফরাসি আইন সভায় সামাজিক স্তরভেদ ও প্রচলিত ব্যবস্থার বিরোধিরা আইন সভার বাম দিকের আসনে বসতো বলে তাদেরকে "বামপন্থী" বলা হতো। অন্যদিকে প্রচলিত ব্যবস্থা ও সরকারের সমর্থক গোষ্ঠীরা আইন সভার ডান দিকের আসনে বসতো বলে তাদের "দক্ষিনপন্থী" বলা হতো। বামপন্থীরা সাম্যবাদ ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন।
১৯১৭ খ্রিঃ সোভিয়েত রাশিয়ায় বিপ্লবের মাধ্যমে "সমাজতন্ত্র" অর্থাৎ সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধ জনিত আর্থিক দুরাবস্থার কারনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, খাদ্যাভাব, শ্রমিক ছাঁটাই, ইত্যাদি দেখা দিলে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ গুলিতে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় প্রসার ঘটতে শুরু করে। ভারতও তার ব্যতিক্রম ছিলো না।
বিশ শতকে ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা |
(১.) মানবেন্দ্রনাথ রায় ও ভারতে বামপন্থী চিন্তাধারার প্রবেশ :-
১৯২০ দশকের প্রথমার্ধ থেকেই মূলত ভারতে বামপন্থী চিন্তাধারার প্রসার ঘটতে শুরু করেছিলো। ভারতে বামপন্থী চিন্তাধারার আমদানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন যুগান্তর দলের একজন অন্যতম বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, যিনি পরবর্তীকালে "মানবেন্দ্রনাথ রায়" বা "এম এন রায়" ছদ্মনামেই বেশি বিখ্যাত হয়েছিলেন।
১৯১৫ খ্রিঃ বাঘাযতীনের নেতৃত্বে ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটানোর এক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই উদ্দেশ্যকে সফল করে তোলার জন্য অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এম এন রায় বিদেশ পাড়ি দেন। এর বেশ কয়েকবছর পর তিনি রাশিয়ায় পৌঁছান এবং কমিউনিস্ট মতবাদে দীক্ষিত হন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া ঠিক করে, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ও সাম্যবাদী বিপ্লবকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী বিপ্লবের চক্রাকার বলয়ের মধ্যেই রাশিয়ার সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকবে। বিশ্বে কমিউনিস্ট মতবাদের প্রসারের জন্য রাশিয়ার উদ্যোগে ১৯১৯ খ্রিঃ কমিন্টার্ন নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করা হয়। ভারতে কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রচারের জন্য কমিন্টার্ন মানবেন্দ্রনাথ রায়কে নিযুক্ত করে।
মানবেন্দ্রনাথ রায় ১৯২০ খ্রিঃ রাশিয়ার তাসখন্দে অবনী মুখার্জি, মহম্মদ আলি প্রমুখ ২৪ জন প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। এই দল ১৯২১ খ্রিঃ লেনিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা কমিন্টার্নের স্বীকৃতি লাভ করে। এই বছরেই মানবেন্দ্রনাথ রায় ভারতে কমিউনিস্ট কার্যকলাপ চালানোর জন্য নলিনী গুপ্ত, শওকত ওসমানি প্রমুখ বেশ কয়েকজন বিপ্লবী যুবককে ভারতে পাঠান। তারা ভারতে এসে সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী বিভিন্ন বিপ্লবী গোষ্ঠী গুলির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এর ফলে ১৯২০ দশকের প্রথমার্ধে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কতক গুলি ছোট ছোট কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে।
(২.) ভারতের বিপ্লবীদের সঙ্গে কমিউনিস্ট মতাদর্শের সংযোগ :-
ভারতে কমিউনিস্ট চিন্তাধারা আমদানির ক্ষেত্রে যেমন সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী বিপ্লবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তেমনই ভারতের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট আদর্শের প্রসারের ক্ষেত্রেও সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী বিপ্লবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের দুটি ধারা ছিলো।
(ক.) একটি ছিলো সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী সহিংস আন্দোলনের ধারা। (খ.) অপরটি ছিলো গনতান্ত্রিক ধ্যান ধারনায় বিশ্বাসী অহিংস গন আন্দোলনের ধারা।
ভারতীয় শিক্ষিত যুবকদের একটি বড়ো অংশ গোড়া থেকেই সহিংস আন্দোলনের ধারায় বিশ্বাসী ছিলো। কিন্তু তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারায় দুটি প্রধান দুর্বলতার জায়গা ছিলো। এক, তারা তাদের আন্দোলনের সঙ্গে ভারতের জন সাধারনের কোন অংশেরই সংযোগ ঘটাতে পারেন নি। ফলে তাদের আন্দোলনের গন ভিত্তি ছিলো যথেষ্ট দুর্বল। আর গন ভিত্তি না থাকায় তারা বারংবার চেষ্টা করেও, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে কোন গন অভ্যুত্থান ভারতে ঘটাতে পারেন নি। ছোট গোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র পরিসরে ঘটানো তাদের সশস্ত্র কার্যকলাপ গুলি বাকি জনসমাজের চিন্তা ভাবনা ও কার্যকলাপ থেকে ভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন ছিলো বলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রামীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সন্ত্রাসবাদী নামেই আখ্যায়িত হয়ে যান।
সশস্ত্র সংগ্রামীরা সহিংস হত্যাকাণ্ড ও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ঠিক কি করতে চান তাও যেমন দেশবাসীকে বোঝাতে পারেন নি। ঠিক তেমনই স্বাধীন হওয়া ভারতবর্ষের রূপ কেমন হবে, সে সম্পর্কেও সশস্ত্র সংগ্রামীদের মধ্যে কোন স্পষ্ট চিন্তাধারা ছিলো না। তাদের চিন্তাধারার ধোঁয়াশা ও অস্পষ্টতাকে দূর করেছিলো কমিউনিস্ট মতবাদ ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা। এজন্য দেখা যায়, ভারতে কমিউনিস্ট মতবাদ আমদানি ও দেশবাসীর মধ্যে তা রপ্তানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী যুবকরা। প্রগতিশীল মতবাদে রঞ্জিত হবার পর অবশ্য তারা আর সন্ত্রাসবাদী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিধায় সীমাবদ্ধ থাকেন নি। তারা "বিপ্লবী" নামেই আখ্যায়িত হন এবং তাদের আন্দোলনের মত ও পথ "বিপ্লবী আন্দোলনের ধারা" নামেই পরিচিতি লাভ করে।
আমরা আগেই বলেছি, ভারতে কমিউনিস্ট মতবাদের আমদানির ক্ষেত্রে মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জি প্রমুখ সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী বিপ্লবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরা ভারতে এসে সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী যুবকদের মধ্যেই প্রথম কমিউনিস্ট আদর্শের প্রচার করেন। এর ফলে ভারতে বিভিন্ন প্রান্তে কতক গুলি ছোট ছোট কমিউনিস্ট গোষ্ঠী তৈরি হয়।
ভারতের সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী বিপ্লবীদের একটি বড়ো অংশ কারাবাসের আগে এবং কারাবাসের পরে কমিউনিস্ট মতবাদে দীক্ষিত হন। আন্দামানে সেলুলার জেলে বন্দীদের সিংহভাগই পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট মতবাদে দীক্ষিত হন। ভারতীয় বিপ্লবীদের কমিউনিস্ট মতবাদে দীক্ষিত হবার কতক গুলি বিশেষ কারন ছিলো। যেমন -
(১.) কমিউনিস্ট মতবাদেই একমাত্র সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত কারন এবং তার সুস্পষ্ট বিরোধিতার কথা বলা ছিলো।
(২.) এই মতবাদে স্বাধীনতার ধারনাও ছিলো অনেক স্পষ্ট। রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সাম্যের কথা কমিউনিস্ট মতাদর্শে বলা হয়েছিলো।
মনে রাখতে হবে, ব্রিটিশ শোষনে জর্জরিত পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এমন এক ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে কোন সামাজিক বৈষম্য ও জাতপাতের লড়াই থাকবে না। দারিদ্রতা থাকবে না। শোষন ও বঞ্চনা থাকবে না। সকলের সম অধিকার ও সম সুযোগ থাকবে। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এই স্বপ্ন কমিউনিস্ট মতবাদের সমাজতন্ত্রের রূপের সঙ্গে কোথাও যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। পরাধীন ভারতে সমাজতান্ত্রিক ও বামপন্থী মতবাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তার পিছুনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারন ছিলো।
(৩.) ভারতের রাজনীতিতে বামপন্থী গোষ্ঠীর রূপ ও প্রকৃতি :-
১৯২০ দশক থেকে ভারতে বামপন্থী চিন্তাধারার প্রসারের ফলে ৩ টি বামপন্থী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিলো।
(১.) একটি গোষ্ঠী ছিলো - "ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি"। ভারতের রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে এদের গতিপ্রকৃতি ও ভূমিকা সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন কমিন্টার্নের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিলো।
(২.) দ্বিতীয়টি ছিলো - "কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল"। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে গঠিত এই বামপন্থী দল ভারতের নিজস্ব পথ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই সমাজতন্ত্রকে প্রয়োগের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন।
(৩.) তৃতীয় আরেকটি বামপন্থী গোষ্ঠী ছিলো, যারা পূর্বের দুই বামপন্থীদের মতো সংগঠিত ছিলেন না এবং ভিন্ন পথ ও মতাদর্শে ভারতে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের প্রয়োগের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তৃতীয় ধারার বামপন্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও জওহরলাল নেহেরু।
১৯৩০ দশক থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে পরস্পর বিরোধী এই তিন বামপন্থী গোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিলো ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিপথকে ভিন্ন ধারায় পরিচালিত করেছিলো। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন - "ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে সজোরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিলো মৌলিক সামাজিক পরিবর্তনের দিকে"। বামপন্থী চিন্তাধারার প্রভাব ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন মত, পথ ও অভিঘাত রচনা করেছিলো।
(৪.) ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ ও বামপন্থীদের ভূমিকা :-
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণ ও ভূমিকার দিকটিকে আমরা ৩ টি পর্বে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি। যথা -
(ক.) ১৯২০ দশকে ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ ও বামপন্থীদের ভূমিকা,
(খ.) ১৯৩০ দশকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ ও বামপন্থীদের ভূমিকা, এবং
(গ.) ১৯৪০ দশকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ ও বামপন্থীদের ভূমিকা।
(ক.) ১৯২০ দশকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা :-
১৯২০ খ্রিঃ লেনিনের নেতৃত্বে কমিন্টার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, উপনিবেশ গুলির বুর্জোয়া শ্রেনীর নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা আন্দোলন গুলি যদি তাদের বিপ্লবী চরিত্র বজায় রাখে, তাহলে কমিউনিস্টরা অবশ্যই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু পরিস্থিতি যদি ভিন্ন হয় তাহলে কমিউনিস্টরা বুর্জোয়া শ্রেনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, ভারতের কমিউনিস্টরা কমিন্টার্নের নির্দেশ মেনে চলতো। ১৯২১ খ্রিঃ শেষদিকে ভারতের কয়েকটি প্রধান শহরে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিলো। এই ছোট ছোট কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গুলি কমিন্টার্নের নির্দেশ মেনে নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। এই কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর অন্যতম দুই নেতৃত্ব কলকাতার মুজাফ্ফর আহমদ ও বোম্বাইয়ের এস এ ডাঙ্গের সঙ্গে কমিন্টার্নের যোগাযোগ ছিলো।
(i.) অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও পূর্ন স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন :-
১৯২১ খ্রিঃ কমিন্টার্নের ভারতীয় সদস্য এম এন রায় তাঁর দূত হিসাবে ভারতে পাঠান বিপ্লবী নলিনী গুপ্ত ও শওকত আসমানীকে। উদ্দেশ্য ছিলো ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও রনকৌশল সম্পর্কে কমিন্টার্নের নির্দেশ ভারতীয় কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গুলির কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই ইস্তেহারে বলা হয় ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রধান ও প্রাথমিক লক্ষ্য হলো ভারতের স্বাধীনতা অর্জন।
১৯২১ খ্রিঃ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে দুজন কমিউনিস্ট সদস্য মৌলানা হাসরত মোহানি ও স্বামী কুমারানন্দ ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের পূর্ন স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কংগ্রেস প্রস্তাবটি খারিজ করলেও, কংগ্রেস অধিবেশনে এই প্রস্তাব উঠে আসা এবং তাকে কেন্দ্র করে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা এটাই প্রমান করে যে সে সময়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম কমিউনিস্ট ভাবধারা দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করেছিলো।
১৯২১ খ্রিঃ গান্ধীজির ডাকে ভারতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে কমিউনিস্টরা কমিন্টার্নের নির্দেশ মেনে নিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ১৯২২ খ্রিঃ চৌরিচৌরা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ করে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে বামপন্থীরা হতাশ হয়ে পড়েন এবং গান্ধিবাদী আন্দোলনের বিকল্প কর্মপন্থার অনুসন্ধান করতে থাকেন।
১৯২২ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে গয়া কংগ্রেসে বামপন্থী শ্রমিক নেতা সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার "বারদৌলী প্রস্তাব" দ্বারা অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের নিন্দা করেন এবং জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনকে যুক্ত করার কথা বলেন। এই অধিবেশনে পূর্ন স্বাধীনতার সংশোধনী এনে তিনি প্রকাশ্যে ঘোষনা করেন, "আমরা এখনই ভারতের পূর্ন স্বাধীনতা চাই,তারপর সমাজতন্ত্র"।
(ii.) বিকল্প রনকৌশল ও দল গঠন :-
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে কমিউনিস্টদের প্রস্তাব খুব বেশি গুরুত্ব না পাওয়ায় এবং অসহযোগ আন্দোলন হঠাৎ করে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের কমিউনিস্টরা বুঝতে পারেন কংগ্রেস সম্পূর্ন ভাবে বুর্জোয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
ইতিমধ্যে কমিন্টার্নের চতুর্থ ও পঞ্চম অধিবেশনে নির্দেশ দেওয়া হয়, ভারতের কমিউনিস্টরা যেন ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে এবং সমাজবাদী চরিত্র বজায় রেখে স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশীদার হয়।
এমতাবস্থায়, এম এন রায় ও ভারতীয় কমিউনিস্টরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য বিকল্প পথের চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। এই চিন্তা ভাবনার প্রধান ৩ টি দিক ছিলো। এগুলি হলো -
(i.) দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করা, এবং তাদের সাহায্যে পূর্ন স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করা,
(ii.) কংগ্রেসের ভিতরে ও বাইরে দল গঠন করে ষাঁড়াশি চাপ দিয়ে কংগ্রেসকে বুর্জোয়া নিয়ন্ত্রন থেকে মুক্ত করা এবং
(iii.) জাতীয় কংগ্রেসকে বামপন্থী চিন্তাধারায় নিয়ন্ত্রন করা।
এই রনকৌশলের অঙ্গ হিসাবে ১৯২৫ খ্রিঃ উত্তরপ্রদেশের কানপুরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গুলি একটি প্রকাশ্য সম্মেলনে মিলিত হন এবং এই সম্মেলনেই প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯২০ খ্রিঃ মানবেন্দ্রনাথ রায়ের হাত ধরে ভারতের বাইরে রাশিয়ার তাসখন্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ভারতের প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯২৫ খ্রিঃ ভারতে অভ্যন্তরে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের পার্টি। দুবার প্রতিষ্ঠিত হবার কারনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে "দ্বিজ" বলা হয়ে থাকে।
তবে ১৯২৫ খ্রিঃ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলেও, সেই কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে সেই সময় খোলাখুলি ভাবে কাজ করা সম্ভব হয় নি। এর দুটি কারন ছিলো -
এক, কমিউনিস্টদের প্রতি সরকারি তীব্র দমন নীতি এবং
দুই, কমিউনিস্টদের দুর্বল জনভিত্তি। এই দুটির মোকাবিলায় কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে থেকে কাজ করার এবং নিজেদের জনভিত্তি শক্তিশালী করার চেষ্টা করে।
অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পরেই কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গুলি এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। এই সময় বোম্বাইয়ে - "সোসালিষ্ট" ও "ক্রান্তি", বাংলায় - "লাঙল", "গনবানী" ও "ধূমকেতু", লাহোরে - "কীর্তি কিষান" ও "ইনকিলাব", যুক্তপ্রদেশ - "অসন্তিকারী" এবং মাদ্রাজে - "ওয়ার্কাশ" পত্রিকার মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী সাম্যবাদী চিন্তাধারাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সাম্যবাদী চিন্তা ধারার প্রভাবে সর্দার ভগৎ সিংয়ের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা নিজেদের দলের নাম বদল করে রাখেন "হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি"।
যাইহোক, পত্র পত্রিকায় সাম্যবাদী চিন্তাধারার প্রসারের পাশাপাশি এই সময় বামপন্থীরা জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও নিজেদের জনভিত্তি শক্তিশালী করে তোলার জন্য বেশ কয়েকটি শ্রমিক - কৃষক দল গঠন করেন। এই দল গুলি প্রায় সব কটিই জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই তার শাখা হিসাবে গড়ে উঠেছিলো।
(i.) ১৯২৩ খ্রিঃ সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার ও আরও বেশ কিছু কমিউনিস্ট মাদ্রাজে "Labour kisan party of Hindustan" গঠন করেন। এই দল কংগ্রেসের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে কংগ্রেসের শ্রমিক - কৃষক শাখা হিসাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
(ii.) পাঞ্জাবেও "কীর্তি কিষান পার্টি" নামে একই ধরনের একটি প্রাদেশিক কৃষক - শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়।
(iii.) বোম্বেতে ১৯২৬ সালে "কংগ্রেস লেবার পার্টি" গঠিত হয়।
(iv.) ১৯২৫ খ্রিঃ নভেম্বর মাসে বাংলায় মুজফ্ফর আহমেদ ও হেমন্তকুমার সরকারের নেতৃত্বে "লেবার স্বরাজ পার্টি অব দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস" নামে একটি দল গঠিত হয়।১৯২৬ খ্রিঃ কৃষ্ণনগরে আয়োজিত এক সম্মেলনে এই দলের নতুন নামকরন করেন "ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি অব বেঙ্গল"। এই পার্টিকেই ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির পূর্বসূরী বলে অনেকে অভিহিত করে থাকেন।
(v.) ১৯২৮ খ্রিঃ এই দল গুলির একটি সর্বভারতীয় সম্মেলন বসে কলকাতায়। এখানে "সর্বভারতীয় ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির" প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই দল শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রকৃতপক্ষে ভারতে - (১.) শ্রমিক আন্দোলন, (২.) কমিউনিস্ট আন্দোলন ও (৩.) স্বাধীনতা আন্দোলন, এই ৩ টি ক্ষেত্রেই ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।
(i.) ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির নেতৃত্বে ১৯২৭ খ্রিঃ থেকে ভারতে শ্রমিক আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ব্যপক আকার ধারন করেছিলো।
(ii.) জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, শ্রমিকদের কাজের সময় হ্রাস, নুন্যতম মজুরি প্রভৃতি দাবি দাওয়া উত্থাপন করে ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি শ্রমিক ও কৃষকদের অধিকারবোধ ও শ্রেনী সচেতনতা সৃষ্টি করতে যথেষ্ট সক্ষম হয়।
(iii.) ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক - কৃষকদের সংযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিকরা ১৯২৮ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসে প্রথম পূর্ন স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে এবং ভারতে সাইমন কমিশনের আগমনের প্রতিবাদে তীব্র প্রতিবাদ ও ধর্মঘট সংগঠিত করে।
(iv.) ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির মূল উদ্দেশ্য ছিলো জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের অপসারিত করে সেখানে বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রন স্থাপন। এই কাজে ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি যে ব্যর্থ হয়েছিলো, তা কখনই বলা যায় না।
ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টির নেতৃত্বে ধীরে ধীরে জাতীয় কংগ্রেসে বামপন্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই বামপন্থীরাই পরবর্তীকালে ১৯৩৪ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠা করে কংগ্রেসকে পুনরায় নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করে। এছাড়া, AITUC র ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট সফল হন।
এককথায়, ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রথম পর্বে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্য দিয়ে ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টি কমিউনিস্টদের জনভিত্তি প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।
(iii.) সরকারি দমন নীতি :-
১৯২৬ খ্রিঃ থেকেই ভারতের রাজনীতি ও শ্রমিক আন্দোলনে বামপন্থীদের প্রভাব তীব্র হয়ে উঠলে ব্রিটিশ সরকার শঙ্কিত হয়ে ওঠে। ইতিপূর্বে ভারতে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানকে অঙ্কুরেই বিনাষ করার জন্য সরকার ১৯২৪ খ্রিঃ চারজন কমিউনিস্ট নেতা মুজাফ্ফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গের, শউকৎ উসমানি ও নলিনী গুপ্তকে গ্রেপ্তার করে "কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা" দায়ের করে।
কিন্তু ১৯২৫ খ্রিঃ পর থেকেই ভারতের রাজনীতি ও শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ব্যাপক প্রভাব বৃদ্ধি পেলে সরকার ১৯২৯ খ্রিঃ পুনরায় ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেপ্তার করে "মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা" দায়ের করে। ঐ একই বছর ওয়ার্কাশ অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ পার্টিকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর ফলে ভারতের রাজনীতিতে কমিউনিস্টদের প্রভাব ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসে।
মোটকথা, ১৯২৮ খ্রিঃ পর্যন্ত সপ্তম কমিন্টার্নের অধিবেশন পর্যন্ত ভারতীয় কমিউনিস্টরা জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এই সময় ভারতীয় মার্কসবাদী ও কমিউনিস্টদের বৃহৎ অংশ কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনকে পরিপুষ্ট করেন। তারা জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।
১৯২৮ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের সম্মিলিত নেতৃত্বে প্রায় পঞ্চাশ হাজার শ্রমিক কংগ্রেসের প্যান্ডেল অধিকার করে পূর্ন স্বাধীনতার দাবি তোলে। ঐ বছরেই বামপন্থীদের নেতৃত্বে কলকাতা ও বোম্বাইয়ে লক্ষাধিক শ্রমিক ভারতে সাইমন কমিশনের আগমনের বিরুদ্ধে মিছিল ও ধর্মঘট করে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্টদের দমন করার জন্যই ১৯২৯ খ্রিঃ মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়েছিলো।
(খ.) ১৯৩০ দশকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা :-
১৯২৮ খ্রিঃ পর থেকেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত আন্দোলনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমরা আগেই বলেছি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কমিন্টার্নের নির্দেশ মেনে চলতো। এই সময় কমিন্টার্নের নির্দেশ অনুযায়ী ১৯৩০ খ্রিঃ আইন অমান্য আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি কোন অংশগ্রহণ করে নি। ১৯৩০ দশকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবে ভারতের শ্রমিক শ্রেনীও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে।
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেসে কমিউনিস্টরা জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে একে বুর্জোয়া শ্রেনির পার্টি বলে ঘোষনা করে। এমনকি জওহরলাল নেহেরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর মতো "কংগ্রেস - বামপন্থীদেরও" তারা বুর্জোয়াদের দালাল বলে অভিহিত করে। তাদের মতে, ১৯৩১ খ্রিঃ গান্ধি আরউইন চুক্তির মাধ্যমে কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আপোষ করেছিলো। তাই এই চুক্তিকে তারা জাতীয়তাবাদের প্রতি কংগ্রেসের বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবেই দেখেছিলো ও আখ্যায়িত করে।
১৯৩০ খ্রিঃ শুরু হয়ে আইন অমান্য আন্দোলন ১৯৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত মোট দুটি পর্বে চলেছিলো। আইন অমান্য আন্দোলনের শেষদিকে অর্থাৎ ১৯৩৪ খ্রিঃ থেকেই ভারতের বামপন্থী আন্দোলনে কতক গুলি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটতে থাকে।
১৯৩৪ খ্রিঃ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি ও তার সকল শাখা সংগঠনকে ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। অন্যদিকে এই বছরেই জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী গোষ্ঠি গুলি নিজেদের সংঘবদ্ধ করার জন্য "কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল" গঠন করে।
আচার্য নরেন্দ্রদেব, জয়প্রকাশ নারায়ন, অচ্যুত পট্টবর্ধন, অশোক মেহতা প্রমুখের উদ্যোগে ১৯৩৪ খ্রিঃ "কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল" প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এই দলের মূল লক্ষ্য ছিলো কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী শক্তিকে সুসংহত করা, ভারতের পূর্ন স্বাধীনতা অর্জন এবং কৃষক শ্রমিকদের সংগঠিত করা। কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের প্রভাবে জাতীয় কংগ্রেস কৃষক ও শ্রমিকদের সমস্যার প্রতি দৃষ্টি দিতে বাধ্য হয়।
ইতিমধ্যে ১৯৩৫ খ্রিঃ মস্কোতে কমিন্টার্নের সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার কথা বলা হয়। এই প্রস্তাবের সূত্র ধরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ইতিপূর্বে ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ায় বামপন্থীদের পক্ষে প্রকাশ্যে দলীয় ভাবে কাজ করতে নানা অসুবিধা ছিলো। এমতাবস্থায়, কমিন্টার্নের নির্দেশ ও দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির জন্য কমিউনিস্টরা পুনরায় কংগ্রেসের কাছাকাছি আসতে শুরু করে। তারা কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলে অন্তভূক্ত হয়ে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
১৯৩০ দশকে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলে বামপন্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ১৯২৯ খ্রিঃ লাহোর কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে জওহরলাল নেহেরু নিজেকে "একজন সমাজতন্ত্রী" বলে ঘোষনা করেন। এই সময় অর্থাৎ ১৯৩০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে জওহরলাল নেহেরু কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের তিন নেতা আচার্য নরেন্দ্রদেব, জয়প্রকাশ নারায়ণ ও অচ্যুত পট্টবর্ধনকে কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটিতে নিযুক্ত করলে দক্ষিণপন্থীরা তার প্রবল বিরোধিতা করে।
তবে ১৯৩৭ খ্রিঃ নির্বাচনে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের প্রভাবে জাতীয় কংগ্রেস নির্বাচনে বিপুল সাফল্য লাভ করে। ১৯৩৫ খ্রিঃ ভারত শাসন আইন অনুসারে ১৯৩৭ খ্রিঃ ভারতে প্রাদেশিক আইন সভা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৬ খ্রিঃ লক্ষৌ অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেস ১৯৩৭ খ্রিঃ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বামপন্থীরা নির্বাচন ইস্তেহার রচনার দায়িত্ব পান। এই ইস্তেহারকে যথার্থ জনমুখী করে তোলার জন্য কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থে ভূমি ও ভূমিরাজস্ব সংস্কার এবং কারখানায় কাজের সময় ও শর্ত নির্ধারনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর ফলে কংগ্রেস যেমন নির্বাচনী সাফল্য পেয়েছিলো, তেমনি বাংলা ও পাঞ্জাবে একাধিক বামপন্থী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন।
তবে ১৯৩৭ খ্রিঃ নির্বাচনে জয়লাভের পর কংগ্রেস ব্রিটিশ ভারতে প্রাদেশিক সরকার গঠনে ইচ্ছা প্রকাশ করলে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল তার তীব্র বিরোধিতা করে। কারন এই সময় কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের মনে হয়েছিলো সরকারে এখুনি যোগ দিলে কংগ্রেসের মধ্যে সংগ্রামী চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে। সরকার সম্পর্কে বহুবিধ ক্ষোভ কংগ্রেসের জনপ্রিয়তাও নষ্ট করে দিতে পারে। যদিও শেষপর্যন্ত কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের সমস্ত যুক্তি ও আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে জাতীয় কংগ্রেস জয়লাভ করা প্রদেশ গুলিতে "প্রাদেশিক সরকার" গঠন করে।
১৯৩৯ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের ত্রিপুরি অধিবেশন সুভাষ চন্দ্র বসু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল সুভাষচন্দ্র বসুকে সমর্থন করে। তবে সভাপতি নির্বাচিত হবার পর সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে গান্ধীজি ও তাঁর অনুগামীদের বিরোধ দেখা দিলে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল গান্ধীজিকেই সমর্থন করেন। কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের এই বিশ্বাসঘাতক অবস্থানের জন্য সুভাষচন্দ্র বসুর পক্ষে জাতীয় কংগ্রেসে সভাপতির কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায়, গান্ধিপন্থী ও সমাজতন্ত্রীদের অসহযোগীতায় সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করেন এবং ১৯৩৯ খ্রিঃ তার বামপন্থী অনুগামীদের নিয়ে "ফরওয়ার্ড ব্লক" নামে এক নতুন দল গঠন করেন। সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন করে বামপন্থী দল গুলিকে জোটবদ্ধ করার চেষ্টা করেও সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। বামপন্থী গোষ্ঠী গুলি এই সময় সুভাষচন্দ্রের ডাকে কোন সাড়া দেন নি।
ইতিমধ্যে ১৯৩৯ খ্রিঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলির যুদ্ধ প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে। ১৯৩৯ খ্রিঃ ২ রা অক্টোবর, বোম্বাইয়ে বামপন্থীদের উদ্যোগে শ্রমিক শ্রেণী যুদ্ধ বিরোধী মিছিল ও ধর্মঘট করে। প্রায় ৯০,০০০ শ্রমিক এই রাজনৈতিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। রজনীপাম দত্তের মতে, এটি ছিলো বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ বিরোধী শ্রমিক ধর্মঘট।
(গ.) ১৯৪০ দশকে স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা :-
১৯৪০ দশকে ভারতে ৩ টি নতুন বামপন্থী দলের উদ্ভব ঘটে। যথা - ফরওয়ার্ড ব্লক, ভারতের বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল ও রেডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি।
কমিন্টার্নের তৃতীয় কংগ্রেসেই উপনিবেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন নিয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে লেনিনের বিতর্ক দেখা যায়। এই সময় লেনিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে জাতীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সহযোগিতার কথা বলেছিলেন। কিন্তু মানবেন্দ্রনাথ রায় মনে করতেন, ভারতের বুর্জোয়া নেতৃত্ব সম্পর্কে জনগনের মোহভঙ্গ হয়েছে। এখুনিই ভারতে বিপ্লবের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের এই ধরনের অবাস্তব মতবাদ ও কমিন্টার্নের বিরোধিতার জন্য তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল থেকে বিতাড়িত হন। এর পর তিনি ভারতে ফিরে এসে কংগ্রেসে কিছুদিন কাজ করার পর উপলব্ধি করেন, কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কোন বিপ্লবী সংগঠন তৈরি করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় ১৯৪০ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে, মানবেন্দ্রনাথ রায় "রেডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি" গঠন করেন। ১৯৩৯ খ্রিঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই দল সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে এমনকি রেডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি একমাত্র দল ছিলো, যা ১৯৪২ খ্রিঃ ভারতে ক্রিপশ মিশনের প্রস্তাব গুলিকে সমর্থন করেছিলো।
১৯৪০ খ্রিঃ বাংলার অনুশীলন দলের একাংশ জেল থেকে বেরিয়ে এসে রামগড়ে গঠন করেন "ভারতের বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল" বা আর এস পি। এই দলের সঙ্গে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের একাংশ যোগদান করেছিলো।
অন্যদিকে ১৯৩৯ খ্রিঃ ৩ রা মে সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই "ফরওয়ার্ড ব্লক" নামে আরেকটি নতুন বামপন্থী দল গঠন করেন। অর্থাৎ ১৯৪০ দশকে পরস্পর বিরোধী দল গঠন ও রাজনৈতিক অবস্থান বামপন্থী রাজনীতির অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিলো।
১৯৪০ দশকে ভারতের জাতীয় রাজনীতির উল্লেখযোগ্য ঘটনা গুলি ছিলো - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম, নৌ বিদ্রোহ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগ। ১৯৩০ দশকের মতো ১৯৪০ দশকেও ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে ও জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থীরা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এই সময় ভারতের বামপন্থী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারার পরস্পর বিরোধী চরিত্র, অবস্থান ও ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়।
১৯৩৯ খ্রিঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধ বিরোধী অবস্থান নিয়ে এই যুদ্ধকে "সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ" বলে অভিহিত করেছিলো। কিন্তু পরে যুদ্ধজনিত আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল বদল ঘটে।
১৯৪১ খ্রিঃ "রুশ জার্মান অনাক্রমন চুক্তি" ভঙ্গ করে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলে, রাশিয়া বিশ্বযুদ্ধে মিত্র পক্ষে যোগ দেয়। এই সময়" ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি" বিশ্বযুদ্ধে আর "সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ" না বলে "জনযুদ্ধ" বলে অভিহিত করেন। তারা একনায়ক জার্মানির সঙ্গে রাশিয়া সহ পশ্চিমী গনতান্ত্রিক দেশ গুলির যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে "জনগনের লড়াই" বা "জনযুদ্ধ" বলে অভিহিত করে। ১৯৪১ খ্রিঃ থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধে ইংল্যান্ডে সরাসরি সমর্থন করে। মানবেন্দ্রনাথ রায় ও তার অনুগামীরা প্রায় বিনা শর্তে সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৪২ খ্রিঃ গান্ধীজির ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টি এই গন আন্দোলন থেকে সরে থাকে। এমনকি কমিউনিস্ট প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠন গুলিকেও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা থেকে কমিউনিস্টরা বিরত রাখার চেষ্টা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডকে এই অভূতপূর্ব সাহায্য করার প্রতিদান স্বরূপ ভারতে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ খ্রিঃ কমিউনিস্ট পার্টির ওপর যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।
অন্যদিকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরুর আগেই ব্রিটিশ সরকার জাতীয় কংগ্রেসের সমস্ত প্রথম শ্রেণীর নেতাদের গ্রেপ্তার করে নেওয়ায়, ভারতের অপর দুই বামপন্থী দল "কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল" ও "ফরওয়ার্ড ব্লক" ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সমর্থন করে। কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল গোপনে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সংগঠিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৪৩ খ্রিঃ মে জুন মাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে যে রাজনৈতিক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলো তাতে কংগ্রেসকে ভারত ছাড়ো প্রস্তাব গ্রহণের জন্য নিন্দা করা হয়। এমনকি ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সমর্থন করার জন্য কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ও ফরওয়ার্ড ব্লকের ভূমিকারও তীব্র সমালোচনা ও নিন্দা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাতীয়তাবাদী বিরোধী অবস্থান গ্রহণের জন্য এই সময় কমিউনিস্ট পার্টির জনপ্রিয়তা যথেষ্ট কমে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের সশস্ত্র অভিযান সংগঠিত হলে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে তাদের কমিউনিস্ট পত্রিকায় নানা কুরুচিকর কার্টুন এঁকে নেতাজিকে তোজোর কুকুর, গাঁধা এবং সাম্রাজ্যবাদের দালাল নামে অভিহিত করে। অন্যদিকে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ও ফরওয়ার্ড ব্লক আজাদ হিন্দ ফৌজের সশস্ত্র সংগ্রামকে সমর্থন করে।
পরবর্তীকালে অবশ্য আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারকে কেন্দ্র করে ভারতে গন অভ্যুত্থান সংগঠিত হলে কমিউনিস্ট পার্টি তাতে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করে। আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রশিদ আলীর বিচারকে কেন্দ্র করে ১৯৪৬ খ্রিঃ ১২ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় "রশিদ আলি দিবস" পালন করা হয়। ১৯৪৬ খ্রিঃ নৌ বিদ্রোহ শুরু হলে ভারতের কোন রাজনৈতিক দল নৌ বিদ্রোহকে সমর্থন না করলেও কমিউনিস্ট পার্টি এই বিদ্রোহকে সমর্থন করে।
১৯৪০ দশকে শেষদিকে পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি পৃথক পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাবকে সমর্থন করে। অন্যদিকে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল, ফরওয়ার্ড ব্লক দল ভারত বিভাজনের বিপক্ষে মতপ্রকাশ করে। তখন অবশ্য বৃহত্তর জনসমাজকে প্রভাবিত করার মতো কোন গন সংগঠন তাদের ছিলো না। ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্ট দেশভাগের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ঐ স্বাধীনতার বিরোধিতা করে বলে - "ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়"।
১৯৪৭ খ্রিঃ থেকে আজ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে নি। দলীয় ভাবে স্বাধীনতা দিবস পালন অথবা জাতীয় পতাকা উত্তোলনও করে না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ১৯৪৭ খ্রিঃ ১৫ ই আগস্ট ভারত রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করলেও, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভারতবাসী লাভ করতে পারে নি। কমিউনিস্ট পার্টি আজও বিশ্বাস করে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষন ও মুক্তির একমাত্র পথ ও মত হলো "সমাজতন্ত্র"।
(৫.) বিশ শতকে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র :-
বিশ শতকে ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির ধারার মধ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
(i.) বিশ শতকের প্রথমার্ধে কোনরকম সংগঠন ছাড়াই ভারতে বামপন্থী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটতে শুরু করেছিলো। এই বামপন্থী চিন্তাধারা যেমন কংগ্রেসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলো তেমনি ভারতে সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসীদের মধ্যেও প্রসারিত হয়েছিলো।
(ii.) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে বামপন্থী চিন্তাভাবনাকে সংঘবদ্ধ করার জন্য এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার জন্য নানা বামপন্থী সংগঠনের উদ্ভব ঘটতে শুরু করেছিলো। ১৯২৫ খ্রিঃ ভারতে যেমন কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়, তেমনিই জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ১৯৩৪ খ্রিঃ কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল, ১৯৩৯ খ্রিঃ ফরওয়ার্ড ব্লক দল এবং ১৯৪০ খ্রিঃ ভারতের বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল প্রভৃতি গঠিত হয়।
(iii.) ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যে কোন ঐক্যবদ্ধ ধারা, প্রবনতা বা চরিত্র লক্ষ্য করা যায় না। যেমন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নির্দেশ মেনে ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলো। অন্যদিকে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল, ফরওয়ার্ড ব্লক ও অন্যান্য বামপন্থীরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
(iv.) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কমিন্টার্ন বা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নির্দেশ অনুযায়ী চলতে গিয়ে অনেক সময়েই উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থেকেছিলো। যেমন কমিন্টার্নের নির্দেশ অনুযায়ী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আইন অমান্য আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রভৃতি জাতীয়তাবাদী গন আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখে।
(v.) ভারতের উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী দল গুলির আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিলো, তারা এক্ষেত্রে কংগ্রেসকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলো। কখনো কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করে কখনওবা কংগ্রেসকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে তারা স্বাধীনতা আন্দোলনকে সফল করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।
(vi.) শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী গন সংগঠন বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বদলে তারা জাতীয় কংগ্রেসকেই উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান অভিমুখ ও প্রতিষ্ঠান বলে মেনে নিয়েছিলো। কংগ্রেসকে বিভিন্ন উপায়ে বামপন্থী চিন্তাধারায় প্রভাবিত করার চেষ্টা বামপন্থী দল গুলি করেছিলো।
(vii.) ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য লক্ষন ছিলো বামপন্থী দল গুলির মধ্যে নানা মতাদর্শগত পার্থক্য ছিলো। এই জন্য ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামদল গুলি পরস্পর বিরোধী ভূমিকা ও অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে কমিউনিস্ট পার্টি বিরোধিতা করলেও, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল এবং ফরওয়ার্ড ব্লক দল ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলো। আবার ভারতের কমিউনিস্টরা সুভাষ চন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রামের বিরোধিতা করলেও, কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল সুভাষ চন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রামকে সমর্থন করেছিলো।
(viii.) ভারতে উপনিবেশ বিরোধী রাজনীতিতে বামপন্থীদের এই পরস্পর বিরোধী অবস্থান ও ভূমিকা জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থীদের জনভিত্তিকে যথেষ্ট দুর্বল করেছিলো, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
(ix.) বামপন্থীরা ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে পূর্ন স্বাধীনতার কথা তুলে ধরলেও এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে কংগ্রেসের ভূমিকাকে আপোসকামী বলে উল্লেখ করলেও, কমিউনিস্টরাও বাস্তবে ভারতে আপোষহীন ভাবে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে পারে নি। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, আইন অমান্য আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তাদের বিরোধিতায় কমিউনিস্টদের দেশপ্রেম নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন। আজোও অনেকে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং আজোও কমিউনিস্টরা এর কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেন না।
(৬.) ভারতের উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের সীমাবদ্ধতা :-
বিশ শতকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বামপন্থী দল গুলি বিশেষ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হলেও, কখনোই তাদের আন্দোলন জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় আন্দোলনের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে নি বা চূড়ান্ত সফলতাও পায় নি। বামপন্থীদের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা তাদের ব্যর্থতার পিছুনে দায়ী ছিলো। যেমন -
(i.) ভারতে বামপন্থীদের মধ্যে কোন ঐক্য ছিলো না। বামপন্থীরা মতাদর্শগত দিক থেকে নানা ভাগে বিভক্ত ছিলেন। এই মতাদর্শগত বিভেদের জন্য তারা ভিন্ন ভিন্ন বামপন্থী দল গঠন করেছিলো। এই দল গুলি কখনোই ঐক্যবদ্ধ ভাবে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নি বা জোটবদ্ধ হয় নি।
(ii.) ভারতীয় কমিউনিস্টদের আন্দোলনের প্রেরনা, কর্মসূচি ও পদ্ধতি সবই এসেছিলো বিদেশ (রাশিয়া) থেকে। ভারতের মাটিতে তাদের আন্দোলনের মূল শিকড় নিহিত ছিলো না। ফলে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ধারায় স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের চরিত্র লক্ষ্য করা যায় না। তা অনেকটাই ছিলো আরোপিত ও ওপর থেকে নিয়ন্ত্রিত।
(iii.) বামপন্থীদের আন্দোলন অধিকাংশ ক্ষেত্রে শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। গ্রামাঞ্চলের তৃনমূল স্তরের অশিক্ষিত, দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে বামপন্থী আন্দোলনের খুব একটা প্রভাব পড়ে নি।
(iv.) ভারতের উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে কমিউনিস্টদের অংশগ্রহণ কমিন্টার্নের নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত হওয়ায় কমিউনিস্টরা আপোষহীন ভাবে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে পারেন নি। রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষার্থে তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডকে সমর্থন করে এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে। এমনকি ১৯৩০ দশকে কমিন্টার্নের নির্দেশ মেনে তারা আইন অমান্য আন্দোলন থেকেও দূরে থাকে। জাতীয় আন্দোলনে তাদের এই ন্যাক্কারজনক ভূমিকায় কমিউনিস্টদের দেশপ্রেম নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন।
(v.) বামপন্থীদের মধ্যে কমিউনিস্টরা শ্রমিক আন্দোলনে যতটা আগ্রহী ছিলেন, ভারতে কৃষকদের সংগঠিত করতে ততোটাই অনাগ্রহী ছিলেন। বেশ কিছু তাত্ত্বিক কমিউনিস্ট নেতা মনে করতেন, কৃষকরা শ্রমিকদের মতো সর্বহারা শ্রেনী নয়। জমির প্রতি তাদের লোভ আছে। সুতরাং শ্রমিক আন্দোলনের প্রয়োজনেই বা তাগিদেই কৃষক সংগঠনে কমিউনিস্টরা গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ভারতের মতো কৃষিপ্রধান দেশে ৮০% কৃষিজীবী মানুষদের সংগঠিত করে বিপ্লব ঘটানোর কোন পরিকল্পনা কমিউনিস্ট পার্টির ছিলো না।
(৭.) জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অবদান :-
তবে এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা ও অবদানকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না।
(i.) বামপন্থীরাই সর্বপ্রথম জাতীয় কংগ্রেসে পূর্ন স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে এবং কংগ্রেসের আপোসকামী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করে।
(ii.) কংগ্রেস পরিচালিত স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারায় কৃষক ও শ্রমিকরা তেমন গুরুত্ব লাভ করে নি। ভারতীয় জনসমাজের এই বৃহত্তর অংশ স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে ছিলেন। ভারতে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিকদের অংশগ্রহণ করানোর ক্ষেত্রে বামপন্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
(iii.) বামপন্থী মতাদর্শের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ পরাধীন ও ব্রিটিশ শোষনে জর্জরিত শিক্ষিত ভারতবাসী ও তরুন রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে নতুন আশা ও উদ্দীপনার সঞ্চার করে। ভারতের প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতাই সমাজতান্ত্রিক মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হন।
(iv.) ১৯২৮ খ্রিঃ বোম্বাইয়ে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীরা উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ খ্রিঃ নৌ বিদ্রোহকে একমাত্র বামপন্থীরাই সমর্থন করে।
(v.) বামপন্থীরা ভারতের উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করে জাতীয়তাবাদী গন আন্দোলনের ধারাকে আরোও শক্তিশালী করে তোলেন।