সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের চরিত্র

১৮৬৭ খ্রিঃ হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলা তথা ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রামের অস্পষ্ট পদধ্বনি শোনা যায়। নবগোপাল মিত্র বাংলা যুবসমাজকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে বলীয়ান করে স্বদেশ প্রেমের ভাবাবেগে দীক্ষিত করার উদ্দেশ্যে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন "হিন্দুমেলা"। 

এরপর বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক গুপ্ত সমিতি। যার মধ্যে অন্যতম ছিলো - অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দল, সুহৃদ সমিতি, আত্মোন্নতি সমিতি, শ্রী সংঘ, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স এবং আরও বহু ছোট বড়ো গুপ্ত সমিতি।

আপাত শরীরচর্চার আড়ালে গেরিলা রননীতির মাধ্যমে মাতৃভূমির শৃঙ্খলা মোচন করাই ছিলো এই বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি গুলির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার এক অদম্য স্বপ্নকে সঙ্গী করে বহু শিক্ষিত তরুন ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়ে ভীড় করেছিলেন এইসব গুপ্ত সমিতি গুলিতে। 

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের চরিত্র
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের চরিত্র 

(১.) নারীদের ভূমিকার বহুবিধ দিক :-

ভারতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুন, যুবকরাই সর্বপ্রথম সশস্ত্র বৈপ্লবিক সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। তাদের সংগ্রাম শুরুর অল্প কিছুকালের মধ্যেই তাদের বৈপ্লবিক কর্মযজ্ঞে পাশে এসে দাঁড়ান একের পর এক নারী। 

(১.) প্রদীপের আলোকবর্তিকা হয়ে কখনও পাশে, কখনওবা অন্তরালে নানা ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এইসব নারীরা ভারতীয় বিপ্লববাদের তমসাছন্ন বিপদশঙ্কুল পথকে করে তোলেন সহজ ও মসৃন। (২.) অনেক সময় এরাই আবার পুলিশের তীক্ষ্ণ শ্যেন দৃষ্টির প্রখরতা থেকে পরম স্নেহের আঁচলে আশ্রয় দিয়ে, খাদ্য ও জীবনের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণার নানাবিধ রসদ জুগিয়ে রক্ষা করেন "বিপ্লবী ও বিপ্লবীদের" শুধু তাই নয়, (৩.) এইসব নারীদের কেউ কেউ আবার প্রবল দেশপ্রেমের অমোঘ আকর্ষনে পতঙ্গের মতো ছুটে এসে আত্মহুতি দিতে শুরু করেছিলেন বিপ্লবের দুঃসাহসিক শত্রুনিধন যজ্ঞের অগ্নিকুন্ডে। বিপ্লবী অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপিয়ে পড়া এইরকম  নারীদের মধ্যে ছিলেন - প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার, বীনা দাশ, শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী, কল্পনা দাশগুপ্ত, উজ্জ্বলা মুখার্জি এবং আরোও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নারী। 

সুতরাং একথা বলা যায়, ভারতের সশস্ত্র বৈপ্লবিক সংগ্রামে নারীদের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। পুরুষ বিপ্লবীদের পাশে থেকে নানা ভূমিকায় নারীরাও ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।

(২.) বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব ও চরিত্র :- 

 এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে পুরুষের পাশে অংশ নিলেও, কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতীয় নারীদের ভূমিকার দিকটি পুরুষদের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। 

উদাহরন হিসাবে বলা যায় - 
(১.) পুরুষ বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয় দানআত্মগোপনে সহায়তা প্রদান, 
(২.) তাদের খাদ্য, অর্থ ইত্যাদির রসদ জোগানে সাহায্য করা, 
(৩.) গোপন সংবাদ ও পরিকল্পনাগুলি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া , 
(৪.) বিপ্লবীদের অস্ত্রগুলি সুরক্ষিত রাখা ও গোপন ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া, 
(৫.) জেলবন্দী বিপ্লবীর সঙ্গে স্ত্রী,বোন ইত্যাদি পরিচয় দিয়ে জেলে সাক্ষাৎ করা ও গোপন বার্তা বহনের মতো দুঃসাহসিক কাজগুলি অখ্যাত,অনামী নারীরাই করেছিলেন। 

নারীরা পুলিশের চোখে পুরুষদের তুলনায় অনেকটাই সন্দেহের উর্ধ্বে ছিলেন বলে এই সমস্ত দুঃসাহসিক কাজ গুলি তারা অনায়াসে করতে পারতেন। মাথায় রাখতে হবে,অসংখ্য অনামী,অখ্যাত,নিরক্ষর গ্রাম্য নারীরাই এইসব দুঃসাহসিক কাজ গুলি করতেন।

বিপ্লবী আন্দোলনে বীরাঙ্গনা নারীদের পাশাপাশি তাই ইতিহাসের অন্তরালে পড়ে থাকা অখ্যাতা নারীদেরও যথেষ্ট অবদান ছিলো। কেননা তারাই পরম মমতা আর স্নেহের পরশে বিপ্লবী আন্দোলনের গুপ্ত ধারাটিকে পুলিশের শ্যেন দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তাকে বেড়ে উঠবার প্রেরনা যুগিয়েছিলেন এবং বিপ্লবের এগিয়ে চলার পথকে করে তুলেছিলেন মসৃন ও সহজতর। 

তাই নির্দ্ধিধায় একথা বলা যায়, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা "কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা" অথবা "বিপ্লবে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নেওয়া" গুটিকতক নারীর অবদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে তা ছিলো আরোও গভীর, ব্যাপকসুদূরপ্রসারী

(৩.) সহযোগী থেকে সক্রিয়তার ভূমিকায় নারী :-

ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথমদিকে অবশ্য অনেক পুরুষ বিপ্লবী নারীদের সশস্ত্র আন্দোলনে সামিল করার বিরোধী ছিলেন। নারীদের পক্ষে সশস্ত্র সংগ্রামের গোপন, ঝুঁকিপূর্ণ ও দুঃসাহসিক কাজগুলি করা সম্ভব নয় বলেই তারা মনে করতেন। 

যদিও পরবর্তীকালে তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছিলো। আমরা আগেই বলেছি, সরাসরি যুক্ত না হয়েও পরোক্ষে সহযোগী হয়ে নারীদের পক্ষে বিপ্লবীদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ গুলি করে দেওয়া সম্ভব হতো। এমনকি নারীরা পুলিশের চোখে সন্দেহেরও উর্ধ্বে ছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই নারীদের এই বিশেষ ভূমিকার দিকটি প্রত্যক্ষ করে পরবর্তীকালে বহু গুপ্ত সমিতি নারীদের সশস্ত্র সংগ্রামে সামিল করেছিলেন।

প্রথম দিকে বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের চরিত্রটি তাই ছিলো "পরোক্ষ সহযোগীর"। কিন্তু অল্প কিছু কালের মধ্যে নারীরাও যে পিছিয়ে নেই, তারাও যে পুরুষের মতো বন্দুক চালাতে পারে, পুরুষের মতোই দৃঢ়চেতা ও সাহসী হয়ে উঠতে পারে - তা প্রমান করার জন্য বহু শিক্ষিত, আত্মসচেতন নারী প্রত্যক্ষ ভাবে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন।

এইভাবে দেখা যায়, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীরা "পরোক্ষ সহযোগী" র ভূমিকা থেকে কালক্রমে "প্রত্যক্ষ সক্রিয়তা" র ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বলা বাহুল্য, সশস্ত্র সংগ্রামে নারী সমাজের এই ভূমিকা জাতীয় আন্দোলনের সংগ্রামশীল ধারাটিকে শুধু দুর্বার করে তোলে নি, এটি পরোক্ষে"নারী আধিকার", "নারী মর্যাদা", "নারী স্বাধীনতা","নারী সক্ষমতা",ইত্যাদি নারী মুক্তির  গুনাবলীরও বিকাশ ঘটায়।

সশস্ত্র সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণ তাই দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে যেমন ত্বরান্বিত করেছিলো, ঠিক তেমনি পিছিয়ে থাকা নারী সমাজের অভ্যন্তরে প্রগতিশীল চিন্তনের বীজ বপনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। 

এপ্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে বহু নারীর শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হয়েছিলো। অনেকে মাঝপথে পড়াশোনাও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে বিচ্ছেদ নারী সমাজের কোন ক্ষতি করে নি।

কেননা শিক্ষা "নারী স্বাধীনতা, নারী সক্ষমতানারী মুক্তি" ইত্যাদি নারী চেতনার যে দিক গুলির বিকাশ ঘটিয়েছিলো, বিপ্লবী আন্দোলন প্রকারান্তরে ঐ সমস্ত অপূর্ণ কাঙ্খিত চেতনা ও গুনাবলীর বিকাশ ঘটিয়ে নারী প্রগতির ধারাটিকে অব্যাহত রেখেছিলো। 

আমরা তাই জোর দিয়ে একথা বলতে পারি, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ কখনোই নারী মুক্তি ও অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বরং তা সহায়কই হয়েছিলো।

(৪.) বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণের সংখ্যা ও যোগদানের বৌদ্ধিক প্রেক্ষাপট :-

আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি,সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, দুটি দিক থেকেই নারী সমাজ অংশ নিয়ে ছিলো। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে শিক্ষিত নারীর পাশাপাশি বহু অশিক্ষিত, নিরক্ষর গ্রাম্য রমনীরাও পরোক্ষে নানা ভাবে বিপ্লবীদের গোপনে সাহায্য করেছিলেন। বৃদ্ধা থেকে কিশোরী,যুবতী বিভিন্ন বয়সের নারীরা বিপ্লবীদের এই সাহায্যকর্মে এগিয়ে এসেছিলেন। 

 নারী সমাজের বিপ্লবী আন্দোলনে এই ব্যাপক অংশগ্রহণের একটি অন্যতম কারণ ছিলো উনিশ - বিশ শতকের নব্য জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতে যে প্রবল জাতীয়তাবাদের সঞ্চার হয়েছিলো, তার আবেদন নারী সমাজের কাছেও পৌঁছেছিলো। প্রবল জাতীয়তাবাদ শিক্ষিত সচেতন নারীর পাশাপাশি অশিক্ষিত নারীমনকেও আন্দোলিত করেছিলো। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রগাঢ় দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের অমোঘ আকর্ষনেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই সমস্ত নারীরা বিপ্লবীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলো। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সঙ্গীত গুলিতে দেশকে "মা" হিসাবে তুলে ধরা হয়। সুতরাং এই সময় থেকে "মায়ের" পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের কর্তব্য কর্মের বিষয়টি একদিকে যেমন দেশের তরুনদের প্রভাবিত করেছিলো, ঠিক তেমনি তা নারীদেরও সমান ভাবে প্রভাবিত করেছিলো। স্বামী বিবেকানন্দের অমোঘ বানী "আমরা মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত" - পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত করেছিলো। 

এছাড়া, বন্দেমাতারম মন্ত্র ও সঙ্গীত, আনন্দমঠের শান্তির চরিত্র, দেবী চৌধুরানী উপন্যাসের প্রফুল্লের চরিত্র, শরৎচন্দ্রের "পথের দাবী"তে চিত্রিত বিপ্লবী আদর্শ এবং বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের গোপন সমর্থন ইত্যাদি বিষয় গুলি বারে বারে শিক্ষিত নারী সমাজকে মাতৃমুক্তির কর্মযজ্ঞে অংশ নেওয়ার জন্য অস্থির ও ব্যাকুল করে তুলেছিলো। 

এই বিষয় গুলি ছাড়াও, ভাগবত গীতায় পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের ধর্মযুদ্ধের আদর্শ, বিশেষত তার "দুষ্টের দমন এবং সৃষ্টের পালন" ইত্যাদি ধর্মীয় কর্তব্য কর্মের বিষয় গুলিও ধর্মভীরু নারীমনকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছিলো। এর অনেক ঐতিহাসিক প্রমান ইতিহাসে পাওয়া যায়।

 প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার যখন পাহাড়তলী ইওরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করার পর আত্মহত্যা করেন, তখন তার মৃতদেহের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের একটি ছবি পাওয়া গিয়েছিলো। কুমিল্লার জেলা শাসক স্টিভেন্সকে হত্যার পর (১৯৩১ খ্রিঃ) সুনীতি চৌধুরী ও শান্তি ঘোষ পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর বলেছিলেন, "এটি আমাদের কাছে ধর্মযুদ্ধ। স্বাধীনতার অধিকারের জন্য লড়াই করা প্রত্যেকের কাছেই এক ধর্মযুদ্ধ"। 

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বিংশ শতকে বাংলা তথা ভারতের বৈপ্লবিক ঘটনাপ্রবাহ বাংলার লোকসংস্কৃতিকেও গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিলো। ক্ষুদিরামের ফাঁসির পর পীতাম্বর দাসের "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি" র করুন সুর গ্রামবাংলার অন্তপুরবাসীনীদের অন্তরকে প্রবল জাতীয়তাবাদের ফল্গুধারায় সিঞ্চিত করেছিলো। শুধু তাই নয়, মহিলাদের কাপড়ের পাড়ে এই গানের অংশ বুনে দিয়ে বাংলার তাঁতিরা দেশাত্মবোধের চেতনা বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এছাড়া, মুকুন্দরামের দাসের একাধিক গান, বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের শোকযাত্রা ইত্যাদি বিষয় গুলি গ্রামের আপামোর নারী সমাজকে গভীর দেশেপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিলো। 

এখানে আরোও একটি তথ্যের উল্লেখ আমরা করবো। পরাধীন ভারতে বিপ্লবীদের প্রধান আরাধ্যা দেবী ছিলেন দেবী কালী। কালী ছিলেন একাধারে সৃষ্টি ও শক্তির আধার, অন্যদিকে মৃত্যু ও ধ্বংসের প্রতিমূর্তি। কালীর উপাসনাও নারীদের পরোক্ষে বৈপ্লবিক মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলোসূর্য সেনের বিপ্লবী দলে যখন প্রমীলা দাস (চৌধুরী) যোগ দিতে আসেন, তখন তাকে দলে অন্তর্ভুক্তির সময় সূর্যসেন নির্দেশ দিয়েছিলেন, নিয়মিত কালীপুজা করতে, এবং প্রতিদিন বুকের মাঝখান চিরে এক দু ফোটা রক্ত মা কালীকে উৎসর্গ করতে। 

বলা বাহুল্য, এই ধরনের অভ্যাস সহনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মেয়েদের দেশের কাজে আত্মোৎসর্গ করার সংকল্পকে আরোও বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছিলো। দেশমাতৃকাও একজন নারী এবং বিপ্লবীদের শক্তি সাধনার দেবীও একজন নারী। সুতরাং নারীরা দুর্বল, ভীরু এই অভিযোগ ঠিক নয়। আরাধ্যা নারী মূর্তি কে সামনে রেখে যেখানে হাজার হাজার যুবক আত্মত্যাগের শপথ নিচ্ছেন, দেশপ্রেমে উজ্জিবিত হচ্ছেন, সেখানে মেয়েরা কেন শুধু দুর্বলতার অজুহাতে অন্তপুরবাসীনী হয়ে বসে থাকবে? বলা বাহুল্য, এই ভাবনা ও প্রশ্ন গুলিই নারীদের মনে গভীর দেশেপ্রেমের আগুন জ্বালিয়েছিলো। ফলস্বরূপ, বহু নারী সশস্ত্র সংগ্রামে এগিয়ে এসেছিলেন।

(৫.) নারীদের অংশগ্রহণের প্রশ্নে গান্ধীর ভূমিকা :-

বিংশ শতাব্দীতে নারীদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সামিল করার ক্ষেত্রে গান্ধীজির ভূমিকা ছিলো অবিসংবাদিত। 

গান্ধীজি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারীদের অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। ১৯১৯ খ্রিঃ রাওলাট সত্যাগ্রহে নারীরা অংশ নিয়েছিলো। পরের বছর অসহযোগ আন্দোলনের গঠনমূলক কর্মসূচি গুলিকে সফল করে তোলার জন্য গান্ধীজি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে নারী সমাজের কাছে আবেদন রাখেন। তিনি বলেন, মেয়েদেরও স্বাধীনতার অধিকার আছে।

আসলে গান্ধী নারীদের জাতীয় আন্দোলনে সামিল করে তাদের অর্থনৈতিক পরাধীনতা এবং সামাজিক বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। গান্ধীজি মনে করতেন, চরকা কাটা, খদ্দর তৈরি, মদ্যপান নিবারন করার মতো কর্মসূচি গুলি নারীরাই প্রকৃতপক্ষে সফল করে তুলতে পারে। নারী সমাজের কাছে গান্ধীজির আহ্বান একটা প্রচন্ড শক্তির মতো কাজ করে। গান্ধীজির প্রচন্ড আকর্ষণ ও গ্রহনযোগ্যতাকে উপেক্ষা করার সাহস পুরুষতান্ত্রিক ভারতের ছিলো না।

 ফলে গান্ধীর আবেদন ভারতের রক্ষনশীল সমাজে প্রচন্ড অভিঘাত সৃষ্টি করে গৃহকোনে আবদ্ধ নারী সমাজের দরজার আগলকে অনেকটাই আলগা করে দেয়। এরই ফলে ধীরে ধীরে নারী সমাজ অন্তপুর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। যদিও গান্ধীজি প্রথমদিকে একেবারেই চান নি পুরুষের মতো নারীরা প্রত্যক্ষ বা সক্রিয় ভাবে আন্দোলনের শরিক হোক। এর বদলে নারীরা "নারীত্বের গোন্ডী" র মধ্যে থেকেই জাতীয় আন্দোলনের গঠনমূলক কর্মসূচি গুলি পালন করুক। 

বলা বাহুল্য, কর্মসূচি পালনের প্রশ্নে গান্ধীজি রক্ষনশীল মনোভাব নিলেও, জাতীয় আন্দোলনে যোগদানের প্রশ্নে নারী সমাজের কাছে তার আবেদনের বিরাট শক্তি ভারতের রক্ষনশীল সমাজের মুখ অনেকটাই আলাগা করে দেয়। গান্ধীজির আহ্বানে জাতীয় আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ নারীদের মনে স্বাধীনতা প্রাপ্তির আকাঙ্খাকে বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। 

পরবর্তীকালে দেখা যায়, স্বাধীনতার প্রতি নারীর এই অদম্য আকাঙ্খা সবসময় "কংগ্রেসের আপোষমুখী" আন্দোলনের ধারাটির প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে পারে নি। ফলস্বরূপ, বহু নারী কংগ্রেসের আপোষমুখী আন্দোলন থেকে সরে এসে সশস্ত্র সংগ্রামের ধারাটির দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। অনেকে আবার কংগ্রেসের ভিতরে থেকেই অতি গোপনে সশস্ত্র সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। 

(৬.) অংশগ্রহণকারী নারীদের সামাজিক ভিত্তি ও চরিত্র :- 

পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেসমস্ত নারীরা প্রত্যক্ষ ভাবে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন, তারা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন সাধারন শিক্ষিতা বা উচ্চশিক্ষিতা। বিপ্লবী কাজকর্মে যুক্ত এদের বেশিরভাগেরই বয়স ছিলো ১৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। বিবাহিত এবং অবিবাহিত দুই ধরনের নারীরাই এর মধ্যে ছিলেন। ননীবালা দেবী, দুকড়িবালা দেবী, সিন্ধুবালা দেবীর মতো বিবাহিত নারীরা মূলত পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিলেন। 

অন্যদিকে অবিবাহিত নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, বিপ্লবের দুই ধরনের কাজের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। অবিবাহিত নারীদের মধ্যে আবার স্কুল কলেজের ছাত্রীদের সংখ্যাই সবথেকে বেশি ছিলো। এইসব ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন - শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, কল্যানী দাশ, বীনা দাস, প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার, কল্পনা যোশী এবং লীলা নাগ প্রমুখ।মাথায় রাখতে হবে, অংশগ্রহণকারী এই সমস্ত মেয়েরা প্রায় প্রত্যেকেই মধ্যবিত্ত শিক্ষিত হিন্দু পরিবার থেকেই উঠে এসেছিলেন। 

তবে এক্ষেত্রে ব্রাহ্ম চেতনায় উদ্বুদ্ধ সরলাদেবী চৌধুরানী, কল্যানী দাস, বীনা দাস এবং মুসলিম মহিলা হালিমা খাতুন, রাজিয়া খাতুনের মতো ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তেরও পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে হিন্দু মহিলারা যতটা এগিয়ে এসেছিলেন, মুসলিম নারীরা ততটা এগিয়ে আসতে পারেন নি। তবে তার অর্থ এই নয় যে তারা দেশকে ভালোবাসতেন না। আসলে শিক্ষার অভাব এবং কঠোর সামাজিক অনুশাসনের জন্য মুসলিম নারীরা হিন্দু নারীদের মতো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে আসতে পারেন নি। 

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসটি গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার সূত্র ধরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম হয়। প্রথমদিকে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী ব্রিটিশ শাসনকে সমর্থন করলেও, পরে নানা কারণে তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই ক্ষোভের কারনেই মধ্যবিত্ত শ্রেণী পরবর্তীকালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। 

দেখা যায়, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতে যে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন চলেছিলো, নারী পুরুষ নির্বিশেষে তার প্রায় সব সদস্যই এসেছিলেন ইংরেজী শিক্ষিত সরকারী চাকুরীজীবী বা উন্নত পেশার সঙ্গে যুক্ত মধ্যবিত্ত পরিবার গুলি থেকে।

 (১.) চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের অন্যতম সদস্য প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার ছিলেন চট্টগ্রাম পুরসভা দপ্তরের একজন কেরানীর কন্যা। 
(২.) কল্পনা দত্তের ঠাকুরদা ছিলেন চট্টগ্রামের একজন প্রভাবশালী ডাক্তার, যার সঙ্গে ইংরেজ সরকারের যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক ছিলো। 
(৩.) ঢাকার লীলাবতী নাগের পিতা ছিলেন রায়বাহাদূর গিরিশ চন্দ্র নাগ, যিনি একাধারে বাংলা ও আসামের সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। 
(৪.) শান্তি ঘোষের পিতা ছিলেন কুমিল্লা কলেজের একজন অধ্যাপক। 
(৫.) কলকাতার বীনা দাস ও কল্যানী দাশের পিতা ছিলেন একজন শিক্ষক। 
(৬.) রানীবালা দত্ত ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জেনের কন্যা। 

বলা বাহুল্য, আর্থিক ভাবে স্বচ্ছ এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এই সমস্ত মধ্যবিত্ত পরিবার গুলির পরিবেশ ছিলো খুবই উদার এবং মুক্ত। এই খোলামেলা পরিমন্ডলের জন্যই দেখা গিয়েছিলো, সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সিংহভাগ নারী মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবার গুলি থেকেই উঠে এসেছিলেন। 

শিক্ষিত, সরকারী চাকুরে এই মধ্যবিত্ত পরিবার গুলির সামাজিক অবস্থানও যথেষ্ট নিরাপদ ছিলো। কেননা পারিবারিক সম্মানজনক পেশার কারনে মধ্যবিত্ত পরিবার এবং ঐ পরিবারের মেয়েরা পুলিশের চোখে সন্দেহের বাইরে ছিলেন। 

বলা বাহুল্য, এই নিরাপদ অবস্থানের জন্যই স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবার গুলির নারীদের পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে একপ্রকার বিনা বাধায় বিপ্লবীদের নানা ভাবে সাহায্য করা বা সরাসরি বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিলো। এই নিরাপদ সামাজিক অবস্থানের জন্যই বাংলা তথা ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোভাগে মধ্যবিত্ত এবং নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত মেয়েরাই মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছিলেন। 

তাছাড়া, মধ্যবিত্ত পরিবার গুলির ভিতরে দাদা, ভাই, পিতা প্রভৃতি পুরুষ সদস্যরা দেশীয় রাজনীতির সঙ্গে বিশেষত, কংগ্রেসী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। অনেক পরিবার স্বদেশী জিনিস পত্র ছাড়া, বিলিতি জিনিস বাড়িতে ঢুকতে দিতেন না। এর ফলে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা দেশের কাজে এগিয়ে আসবার যথেষ্ট অনুপ্রেরণা ও বৌদ্ধিক রসদ তাদের পরিবার গুলি থেকেই পেয়েছিলেন। 

তবে তার অর্থ এই নয় যে ঐ সমস্ত পরিবারের মেয়েরা পরিবারের সম্মতিতেই সশস্ত্র বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা গোপনে,পরিবারকে কিছু না জানিয়েই বিপ্লবী কাজকর্মে অংশ নিয়েছিলেন। পরিবারকে জানানোর অবশ্য কোন উপায়ও ছিলো না। কেননা সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদানের অন্যতম প্রধান শর্তই ছিলো চূড়ান্ত গোপনীয়তা এবং কঠোর আত্মত্যাগ। 

বলা বাহুল্য, বহু নারী নিরবে, নিভৃতে কাউকে কিছু জানতে না দিয়ে এই আত্মত্যাগ করেছিলেন। দেশসেবার কোনরকম খ্যাতি বা নাম যশের প্রত্যাশা ছাড়াই নিরবে, নিভৃতে, নির্ভয়ে, তারা বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ নিতেন। প্রকাশ্যে অংশ নেওয়া পুরুষ আড়ম্বরপ্রিয় দেশসেবক রাজনীতিবিদদের থেকে খ্যাতির অন্তরালে পড়ে থাকা এইসব নারীদের দেশপ্রেম নিঃসন্দেহে ছিলো অনেক বেশি নির্ভেজাল ও খাঁটি। 

বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে দেখা গেছে, পুরুষ বিপ্লবীদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় পুলিশের অত্যাচারের ভয়ে বা অন্য কোনো প্রলোভনে বিশ্বাসঘাতকতা করে অনেক বিপ্লবীদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নারীরা কিন্তু এমনটি কখনই করেন নি। 

গর্ভনরকে স্ট্যানলি জ্যাকশনকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে গুলি করার পর যখন বীনা দাশকে পুলিশ গ্রেফতার করে জানতে চান যে বীনা বন্দুক কার কাছ থেকে পেয়েছেন? তার নাশকতামূলক কাজের পিছনে কে কে জড়িতো আছে? তখন বীনা একটিই উত্তর দিয়েছিলেন,"তার বাবা তাকে বিশ্বাসঘাতক হতে শেখায় নি" প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার পাহাড়তলী ইওরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পর পটাসিয়াম সায়ানায়েড খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। এমনকি বিপ্লবে পরোক্ষে সাহায্য করা অনেক বৃদ্ধা রমনীদের থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার পর নানা রকম পুলিশি অত্যাচার, নিপীড়ন সত্ত্বেও তারা একটি কথাও ফাঁস করে দেন নি। 



গ্রন্থঋন :- 

১. স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী - কমলা দাশগুপ্ত। 
২. বিংশ শতকের অগ্নিযুগে বাংলার অন্তপুরবাসিনী (১৯০০ - ১৯৩০ দশক) - শর্মিষ্ঠা দাস। 
৩. ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব - উপেন্দ্র কিশোর রক্ষিত রায়।
৪. জাতীয় আন্দোলনে বঙ্গনারী - যোগেশচন্দ্র বাগল।


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post