পৃথিবীর যাবতীয় খনিজ পদার্থের কাঠিন্য মাপার জন্য বিজ্ঞানী ফ্রিডরিখ মোজ একটি স্কেল তৈরি করেছিলেন। এই স্কেলকে বলা হয় "Mohs scale"। এই স্কেল অনুযায়ী পৃথিবীতে হিরেই হলো সবচেয়ে কঠিন পদার্থ। আর হিরের কথা উঠে আসলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে "কোহিনুরের" নাম।
কোহিনুর কথা |
কোহিনুরকে নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি,কিংবদন্তি, ইতিহাস, লোককাহিনী, তার থেকেও বড়ো আছে বিস্ময়। বলা হয়, পৃথিবীর অন্যতম অভিশপ্ত হিরে গুলির মধ্যে অন্যতম হলো কোহিনুর। এই হিরে যে যে পুরুষদের হস্তগত হয়েছে অল্পদিনের মধ্যেই তাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছে। সম্ভবত এই কারনে আজও কোহিনুর হিরে ইংল্যান্ডের কোন রাজা পরেন না। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হিরের কু প্রভাব নেই বলে ইংল্যান্ডের রানীর রাজমুকুটে শোভা পায় কোহিনুর।
কোহিনুরকে একশ্রেনীর জ্যোতিষী "অভিশপ্ত হিরে" বলে প্রচার করেছিলেন। বলা হয়, এই হিরে যেসব রাজ পুরুষদের মাথায় উঠেছিলো, খুব অল্প সময়ে তারা প্রচুর ধনসম্পত্তি ও ঐশ্বর্যের অধিশ্বর হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু পরমুহুর্তেই আবার তাদের চূড়ান্ত ভাগ্যবিপর্যয় ঘটেছিলো। জ্যোতিষ সংক্রান্ত এই প্রচার খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে কোহিনুরের হাতবদলের ইতিহাসের সঙ্গে মিলে গিয়েছিলো।
কোহিনুরের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে বেশ কিছু কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলে থাকেন পাঁচ হাজার বছর আগে গোদাবরী নদীর ধারে মুসলিপট্টমে হিরেটি খুঁজে পেয়েছিলেন অঙ্গদেশের রাজা কর্ন। আবার কেউ বলেন, খ্রিঃ পূর্ব ৫৬ সালে এই হিরেটি ছিলো বিক্রমাদিত্যের কাছে। তবে জনশ্রুতিকে বাদ দিয়ে ঐতিহাসিকদের অনেকেই একমত অন্ধ্রপ্রদেশের গোলকুন্ডার কাছে কিলুর বা কোল্লুর খনিতে সর্বপ্রথম কোহিনুর হিরেটি আবিষ্কৃত হয়।
ফরাসি হিরে ব্যবসায়ী তাভার্নিয়ের তথ্য অনুযায়ী ১৬৫৬ - ৫৭ খ্রিঃ নাগাদ দাক্ষিনাত্যের কোল্লুর খনিগর্ভ থেকে উঠে এসেছিলো কোহিনুর। প্রথম অবস্থায় হিরেটির ওজন ছিলো ৭৯৩ ক্যারেট। গোলকুন্ডার মুঘল সেনাপতি মির জুমলার হাত ধরে এই হিরে পৌঁছায় শাহজাহানের হাতে। আবার বাবরের আত্মজীবনী পড়লে দেখা যায়, কোহেনুর গোয়ালিয়রের রাজার কাছ থেকে আসে আলাউদ্দিন খলজির হাতে। তারপর তুঘলক, সৈয়দ ও লোদিদের হাত ঘুরে তা পৌঁছায় বাবরের হাতে।
১৭৩৯ খ্রিঃ নাদির শাহ তখন দিল্লি আক্রমণ করেছেন। কয়েকশো বছর ধরে সাজিয়ে তোলা মুঘলদের সাধের শহর দিল্লি মাত্র ৫৮ দিনের মাথায় ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়। ঠিক এই সময় মুঘল হারেমের এক রমনীর বিশ্বাসঘাতকতায় নাদির শাহ খবর পেলেন বাদশাহ মহম্মদ শাহের পাগড়িতে লুকিয়ে রাখা আছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি হিরে। সেদিন রাতেই বাদশাহকে নৈশভোজে ডাকলেন নাদির শাহ। ভোজ চলাকালীন সময়ে বিজিতকে পাগড়ি বিনিময়ের প্রস্তাব দেন নাদির শাহ। ভোজসভা শেষ করে নিজের ঘরে গিয়ে পাগড়ি খুলে নাদির শাহ কোহেনুর দেখে চিৎকার করে ওঠেন "কোহ - ই-নুর" অর্থাৎ "আলোর পাহাড়"। সেই থেকেই এই হিরের নাম হয় কোহিনুর।
কোহিনুর হিরে হস্তগত হবার আট বছরের মধ্যেই নাদির শাহ নিজেরই প্রধান প্রহরীর হাতে খুন হন। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কোহিনুর সহ সমস্ত সম্পত্তির দখল নেন আহম্মদ শাহ আবদালি। কোহিনুর হস্তগত হবার অল্প কয়েক বছরের মাথায় আবদালি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৭৭২ খ্রিঃ মারা যান। এর কয়েক বছরের মধ্যেই ভেঙে পড়ে তার দুরানি সাম্রাজ্য।
পরবর্তীকালে আহমদ শাহ আবদালির ছেলে তিমুর শাহের থেকে কোহিনুর আসে নাতি জামান শাহের হাতে। জামান শাহের কাছ থেকে হিরে পান তার ভাই শাহ সুজা। এরপর শাহ সুজাকে পরাজিত করে কোহেনুর লাভ করেন পাঞ্জাবের রনজিৎ সিংহ।
১৮৩৯ খ্রিঃ মাত্র ৫৮ বছর বয়সে মারা যান রনজিৎ সিংহ। তার মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই ইংরেজরা শিখদের পরাজিত করে পুরো পাঞ্জাব দখল করে নেন। এই সময় কোহেনুর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়।
এ পর্যন্ত কোহিনুর ভারতের মধ্যেই ছিলো। কিন্তু ইংরাজ কোম্পানির হস্তগত হবার পর ১৮৫০ খ্রিঃ প্রথম বারের জন্য কোহিনুর ভারতীয় উপমহাদেশ ত্যাগ করে। আর কোনদিনই কোহিনুর ভারতে ফিরে আসে নি।
১৮৫১ খ্রিঃ লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেসে কোহিনুর হিরের প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এই সময় হিরেটির কাটিং পছন্দ না হওয়ায় ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া কোহিনুরকে নতুন করে কাটিংয়ের নির্দেশ দেন। বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার কাটিংয়ের ফলে হিরেটির ওজন ৭৯৩ ক্যারেট থেকে দাড়িয়েছিলো যথাক্রমে ২৭৯ ক্যারেট। সেখান থেকে ১৮৬ ক্যারেট। আবার সেখান থেকে ১০৮ ক্যারেট।
১৯৩৭ খ্রিঃ রানী প্রথম এলিজাবেথের মুকুটে বসানো হয় "ব্রিটিশ আভিজাত্যের প্রতীক" কোহিনুর। এর পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত রাজকীয় অনুষ্ঠানেই রানীরা এই হিরেখচিত মুকুট ব্যবহার করতে থাকেন, আজোও এর ব্যতিক্রম হয় নি। ১৯৯৪ খ্রিঃ থেকে কোহিনুরকে রাখা হয় লন্ডনের নিউ জুয়েল হাউসে।
১৯৪৭ খ্রিঃ ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করার পর স্বাধীন ভারতের সংসদে কোহিনুরকে ফিরিয়ে আনার দাবি ওঠে। তবে সেই সব দাবিকে নসাৎ করে দিয়ে ১৯৫৩ খ্রিঃ ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সংসদে বলেন, কোহিনুর কোন শিল্প সামগ্রী নয়। তা এখন ব্রিটিশ রাজমুকুটের একটি রত্ন। তাই ঐ হিরে ফেরানোর ব্যাপারে সহমত নয় সরকার।
ভারতের মতো পাকিস্তানও কোহিনুরকে ফেরানোর চেষ্টা করেছিলো। এর দু দশক পর ইংল্যান্ডের সঙ্গে কূটনৈতিক বৈঠক চলাকালীন সময়ে পাক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো কোহিনুরকে পাকিস্তানে ফেরানোর আর্জি জানান। তার মতে লাহোর থেকে (রঞ্জিত সিংহের উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে ) কোহিনুর হিরে ইংরেজদের হাতে গিয়েছিলো। তাই কোহিনুরের আসল মালিক পাকিস্তান এবং তা পাকিস্তানের হাতেই ফিরিয়ে দেওয়া উচিৎ। কিন্তু এই অনুরোধ সত্ত্বেও ব্রিটেন কোহিনুরকে ফিরিয়ে দিতে রাজি হয় নি।
তবে কোহিনুর ইংল্যান্ডের আভিজাত্যের জৌলুস ও প্রতীক বহন করলেও, এই জৌলুসের অন্তরালে আছে ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদী শোষন ও লুন্ঠনের এক কালো ছায়ার ইতিহাস। যতদিন এই কোহিনুর ইংল্যান্ডের বুকে থাকবে ততদিন তা ভারতের বুকে ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী শোষন ও লুন্ঠনের প্রতীক হিসাবেই থেকে যাবে। ভারতের ইতিহাস থেকে কোহিনুরকে কোনদিনই বিচ্ছিন্ন করা যাবে না, এটাই ভবিতব্য। কোহিনুরকে পৃথিবীর কোন শাসকই খুব বেশি দিন নিজের কাছে রাখতে পারেন নি। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। কোহিনুর কোনদিনই কারো হয় নি।