সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা

ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের গতিপ্রকৃতির দিকটি পর্যালোচনা করলে এর ৩ টি প্রধান ধারা বা পর্ব লক্ষ্য করা যায়। যথা -

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা 

(১.) অংশগ্রহণের প্রথম পর্ব :-

১৯০৫ খ্রিঃ থেকে ১৯২০ খ্রিঃ পর্যন্ত সময়কালকে সশস্ত্র সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণের প্রথম পর্ব বলা যেতে পারে। এই পর্বে নারীদের সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ ছিলো অনেকটাই নিরব ও নিস্প্রভ

১৯০৫ থেকে ১৯২০ খ্রিঃ মধ্যে বাংলার বৈপ্লবিক রাজনীতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ মূলত বিপ্লবীদের সাহায্য কর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো

(২.) অংশগ্রহণের দ্বিতীয় পর্ব :-

১৯২১ খ্রিঃ থেকে ১৯২৯ খ্রিঃ পর্যন্ত সময়কালকে সশস্ত্র সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণের দ্বিতীয় পর্ব হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এই পর্বে বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের সজাগ ও ধীর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। 

এখানে বলা প্রয়োজন, ১৯২২ খ্রিঃ অসহযোগ আন্দোলন হঠাৎ করে প্রত্যাহার করা হলে কংগ্রেসী আন্দোলনের মোহ থেকে বিপ্লবীরা বেরিয়ে আসেন এবং পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রামে ঝুঁকে পড়েন। স্বাভাবিক ভাবেই এই সময় বিপ্লবীরা বেশ কিছু গুপ্ত সমিতি গঠন করতে থাকেন। এই সমস্ত গুপ্ত সমিতি গুলি বিপ্লবী আন্দোলনকে তীব্র করে তোলার জন্য বৈপ্লবিক আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি মেনে নেয়।

এরই ফলস্বরূপ এই সময় বিভিন্ন বিপ্লবী সমিতি গুলির মহিলা শাখা হিসাবে "দীপালি সংঘ", "ছাত্রীসংঘ", "শক্তিবাহিনী", "ত্রিপুরা ছাত্রীসংঘ" প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমস্ত নারী সমিতি গুলির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নারীরা রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হয়ে উঠেন এবং বিপ্লবী কর্মকান্ডের শরিক হয়ে পড়েন।

(৩.) অংশগ্রহণের তৃতীয় পর্ব :-

১৯৩০ খ্রিঃ থেকে ১৯৩৬ খ্রিঃ পর্যন্ত সময়কালকে সশস্ত্র সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণের তৃতীয় পর্ব হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এই পর্বেই নারীরা সক্রিয় ভাবে বিপ্লবী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

মূলত এই সময় থেকেই বিপ্লবী সমিতি গুলিতে নারীদের ব্যাপকহারে অন্তর্ভুক্তি ঘটতে থাকে। শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, বীনা দাস, প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার, কল্পনা দত্ত, লীলা নাগ, শান্তিসুধা ঘোষ প্রমুখ নারীরা এই পর্বেই বিপ্লবী কার্যকলাপে সক্রিয় ভাবে অংশ নেন। 

দীপালি সংঘ, ছাত্রী সংঘ প্রভৃতি মহিলা সমিতি গুলির কার্যকলাপও এই সময় দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই সমস্ত নারী সমিতি গুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অসংখ্য নারী প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে বৈপ্লবিক আন্দোলনে সামিল হয়ে পড়তে থাকেন।

সশস্ত্র বিপ্লবে নারীদের ভূমিকার বহুবিধ দিক

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার বহুবিধ দিকগুলিকে দুটি দিকে ভাগ করে তুলে ধরা যায়। যথা - 

(১.) সশস্ত্র বিপ্লবে নারীদের পরোক্ষ ভূমিকা, এবং 
(২.) সশস্ত্র বিপ্লবে নারীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। 

(১.) সশস্ত্র বিপ্লবে নারীদের পরোক্ষ ভূমিকা 

সশস্ত্র বিপ্লবে নারীদের একটা বড়ো অংশ পরোক্ষভাবে  অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই পর্যায়ে নারীদের ভূমিকার পরিমাপের দিকটি ছিলো মহীরুহের মতো এবং কার্যক্ষেত্রে পুরুষদের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। 

(1.) বিপ্লবের আদর্শ ও বীজ বপনে নারী :-

ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রথম পর্বে বিপ্লবের "বীজ বপন", তাকে "লালন পালন" এবং তাকে "রক্ষা করা" - এই ৩ টি ভূমিকাতেই ভারতীয় নারীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।

(ক.) সরলাদেবী চৌধুরানীর ভূমিকা :-

ভারতীয় যুবসমাজে বিপ্লবী আদর্শ এবং বিপ্লবের বীজ বপনে প্রথম অগ্রনী ভূমিকা নেন স্বর্নকুমারী দেবীর কন্যা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্নী সরলাদেবী চৌধুরানী। 

জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির উদার স্বদেশী পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিক্ষিতা সরলাদেবীই প্রথম বাঙালিকে "মৃত্যুচর্চার" আহ্বান জানান। তিনি শরীরচর্চা, কুস্তি, লাঠিখেলা ইত্যাদির মাধ্যমে বঙ্গীয় যুবাদের শারীরিক দুর্বলতাকে দূর করে বলিষ্ঠ হওয়ার আদর্শ প্রচার করেন। শুধু তাই নয়, মানসিক ভীরুতাকে দূর করে ইংরেজ বিরোধী ক্ষোভ উগরে দেওয়ার পন্থা হিসাবে তিনি "প্রতাপাদিত্য উৎসব"," উদয়াদিত্য উৎসব", "বীরাষ্টমী ব্রত" পালনের আয়োজন করেন। 

বাংলার প্রতাপাদিত্য, উদয়াদিত্যের মতো জমিদাররা যেভাবে মুঘল বাদশাহের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ করেছিলেন, ঠিক সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলার বীর সন্তানরাও যাতে বিদেশী ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে - এই ছিলো এই উৎসব গুলির মূল উদ্দেশ্য। দুর্গাষ্টমীর দিন বাংলার ঘরে ঘরে নারীরা তাদের বীর সন্তানের কপালে জয়টিকা পরিয়ে অস্ত্রবিদ্যার প্রতিযোগীতায় পাঠান এবং নিজ পুত্রের বিজয়ের জন্য পালন করেন "বীরাষ্টমী ব্রত"। 

শুধু শারীরিক দিকে বঙ্গ যুবাদের শক্তিশালী করে তোলাই নয়, তাদের মানসিক দিক থেকে শক্তি জোগানোর উদ্দেশ্যে সরলাদেবী প্রকাশ করেন "ভারতী পত্রিকা"। এখানে ক্ষুরধার লেখনিতে বঙ্গযুবাদের তিনি বলেন - "মৃত্যুকে যেচে বর্ন করতে শেখো"। এই পত্রিকায় "বিলিতি ঘুষি বনাম দেশি কিল" ইত্যাদি বিভিন্ন প্রবন্ধ গুলি ভারতীয় যুবকদের আত্মাভিমান এবং আত্মবিশ্বাস বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। 

সরলাদেবী ২৬ নং বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে স্বাস্থ্য একাডেমী নামে একটি শরীরচর্চার কেন্দ্র খোলেন। অল্প দিনের মধ্যে তার অনুকরনে পাড়ায় পাড়ায় শরীরচর্চার আখড়া গড়ে ওঠে। এই আখড়া গুলির মধ্য দিয়েই প্রজ্বলিত হয়েছিলো বিপ্লবের সলতে।

 ১৯০২ খ্রিঃ গড়ে ওঠে বাংলার প্রথম বিপ্লবী সংঘ "অনুশীলন সমিতি"। এই বিপ্লবী সমিতি গুলি প্রতিষ্ঠার সময় সদস্য জোগাড় করে দেওয়া, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সরলাদেবী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। 

(খ.) ভগিনী নিবেদিতার ভূমিকা :- 

সরলাদেবীর পাশাপাশি বিপ্লবী ভাবাদর্শ এবং বিপ্লবী আন্দোলনের বীজ বপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন আইরিশ কন্যা ভগিনী নিবেদিতা। 

 ভগিনী নিবেদিতা ইওরোপের সশস্ত্র সংগ্রামের অনেক গুলি বই অনুশীলন সমিতিকে দান করেছিলেনআয়ারল্যান্ডের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ধাঁচে ভারতে বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনার বীজ তিনি বিপ্লবীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। অসংখ্য বক্তৃতায় তিনি স্বামীজির দেশাত্মবোধের বানী গুলিকে প্রচার করে বিপ্লবী আন্দোলনের সলতেটি প্রস্তুত করে দেন।

এরই ফলস্বরূপ, অনুশীলন সমিতির যুবকরা শুধুমাত্র শরীরচর্চার গোন্ডীর মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখার কৌশলে সন্তুষ্ট থাকতে পারলেন না। ১৯০৬ খ্রিঃ অনুশীলন সমিতি ভেঙ্গে তৈরি হলো "যুগান্তর দল"। এই দলের দুজন প্রধান কান্ডারি ছিলেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং স্বামী বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত

এখানে বলা প্রয়োজন, যুগান্তর দলের মুখপত্র টি নিবেদিতার বাগবাজারের বাড়িতে আলাপ আলোচনা করেই প্রকাশিত হয়েছিলো। শুধু তাই নয়, যুগান্তর দল আইরিশ বিপ্লবের টেকনিক অনুযায়ী যথাক্রমে গুপ্ত হত্যা ও ডাকাতি, গেরিলা যুদ্ধ এবং প্রকাশ্যে বিদ্রোহমূলক যুদ্ধ - এই তিন রননীতির মধ্য দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, যুগান্তর দলের আইরিশ টেকনিকের এই পরিকল্পনাটি নিবেদিতাই দিয়েছিলেন।

পরবর্তীকালে যুগান্তর দলের আদর্শে বা তার শাখা সংগঠন হিসাবে নামে,বেনামে অসংখ্য বিপ্লবী সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। 

যাইহোক, সরলাদেবী চৌধুরানী ও ভগিনী নিবেদিতার মতো নারীরা যদি বিপ্লববাদে এগিয়ে না আসতেন তাহলে হয়তো বঙ্গীয় বিপ্লববাদ সেভাবে দানাই বাঁধতে পারতো না। 

(2.) বিপ্লবীদের খাদ্য সংস্থান ও আশ্রয়দানে নারী :-

শুধু বিপ্লবের বীজ বপন নয়, বিপ্লবীদের আশ্রয় এবং খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা করেও নারীরা বিপ্লবী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। 

যুগান্তর দল জার্মানি থেকে অস্ত্র এনে ভারতে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে। পরবর্তীকালে তা ফাঁস হয়ে যায় এবং ১৯১৫ খ্রিঃ "ভারত - জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা" (১৯১৫ - ১৬) দায়ের হয়। এই মামলায় অভিযুক্ত বিপ্লবীদের আশ্রয়দান করেছিলেন হাওড়া জেলার বাসিন্দা ননীবালা দেবী, কলকাতার তিলজলা এলাকার বাসিন্দা সিন্ধুবালা ঘোষ, নোয়াখালীর সুশীল মিত্র এবং ময়মনসিংহের ক্ষীরোদা সুন্দরী চৌধুরী। 

যুগান্তর দলের প্রথম পরিকল্পনা কিংসফোর্ড হত্যা প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই বিপ্লবী ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর আশ্রয়দাত্রী ছিলেন মেদিনীপুরের চারুশীলা দেবী, বিনোদবালা দেবী এবং ইনাদুবালা দেবীচট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পরে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতে এগিয়ে এসেছিলেন বেশ কয়েকজন নারী। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - বিনোদিনী দেবী, বিরাজ মোহিনী দেবী, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, ধলঘাটের সাবিত্রী দেবী। 

মোটকথা, প্রত্যেকটি বিপ্লবী কার্যকলাপ বা অভ্যুত্থানের পর বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়দানে এগিয়ে এসেছিলেন কোন না কোন নারী। ইতিহাস ঘাটলে যে অসংখ্য আশ্রয়দাত্রী নারীদের নাম উঠে আসে, এক্ষেত্রে আমরা তাদের মাত্র কয়েক জনের নামোল্লেখ করে বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার প্রধান দিকটি বোঝানোর চেষ্টা করলাম মাত্র। 

(3.) বিপ্লবীদের "অস্ত্র" রক্ষায় নারী :- 

তবে বিপ্লবীদের শুধু আশ্রয়দানই নয়, বিভিন্ন সময়ে বিপ্লবীদের অস্ত্র গুলি সুরক্ষিত রাখতেও নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। 

১৯১৪ খ্রিঃ যুগান্তর দলের জার্মানি থেকে আনা অস্ত্র গুলি লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করেন বীরভূমের দুকড়িবালা দেবী এবং সুরধনী মোল্লানি। বহরমপুরের শ্যামাপদ ভট্টাচার্যের কন্যা শোভা ভট্টাচার্য ছিলেন অনুশীলন সমিতির সদস্যা। তার কাছেই বিপ্লবীদের অনেক অস্ত্র শস্ত্র লুকিয়ে রাখা হতো। এছাড়া শ্রীসংঘ, দীপালি সংঘের মেয়েরাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।

(4.) বিপ্লবীদের গোপন সংবাদ বহনে নারী :- 

আশ্রয় দান ও অস্ত্র রক্ষা ছাড়াও, বিপ্লবী সমিতি গুলির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন এবং গোপন সংবাদ আদান প্রদানের কাজটির ক্ষেত্রেও নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

এই কাজটির ক্ষেত্রে গৃহবধূদের তুলনায় স্কুল কলেজের ছাত্রীরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। পুলিশের দৃষ্টি ও সন্দেহ এড়িয়ে "বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স" দলের মীরা দত্তগুপ্ত ও উমা সেন, চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের কল্পনা দত্ত, প্রমীলা দাস, আরতি রক্ষিত, অনুশীলন দলের প্রতিভা ভদ্র, পারুল মুখার্জি, যুগান্তর দলের কল্যান দাশ, কল্পনা দাশগুপ্ত প্রমুখ নারীরা আত্মগোপনকারী বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগের সেতু হিসাবে কাজ করতেন। 

এই যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে নারীরা যে কতখানি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা বোঝবার জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ আমরা করবো।

১৯১৫ - ১৬ খ্রিঃ জার্মানির রডা কোম্পানির অস্ত্র লুঠের অপরাধে পুলিশ বিপ্লবী রামচন্দ্র মজুমদারকে গ্রেপ্তার করে। সেই সময় বিধবা রমনী ননীবালা দেবী শাঁখা সিঁদুর পরে জেলারকে রামচন্দ্রের স্ত্রী - র পরিচয় দিয়ে জেলে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। সাক্ষাৎ করার মূল উদ্দেশ্য ছিলো রামচন্দ্রের কাছ থেকে পিস্তলের তথ্য গোপনে জেনে তা দলের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

চিরাচরিত সংস্কার, সামাজিক নিন্দা ইত্যাদি সবকিছুকে উপেক্ষা করে তাদের এই দুঃসাহসিক কাজকর্ম গুলি প্রমান করে কতখানি দেশাত্মবোধের চেতনায় ভারতীয় নারীরা উজ্জিবিত ছিলেন।

(5.) বিপ্লবে আর্থিক সহায়তা প্রদান :- 

বিভিন্ন সময়ে বিপ্লবী কার্যকলাপে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেও, ভারতীয় বীরাঙ্গনা নারীরা বিপ্লবী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের মামলার খরচ চালানোর জন্য প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার, ইন্দুমতি সিংহ অনবদ্য ভূমিকা নেন। প্রীতিলতা প্রায়ই তার বাবার মাসিক বেতন, এমনকি নিজের স্কলারশিপের টাকাও চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলকে দিয়ে দিতেন। 

লীলাবতী মহাজন, বিমল প্রতিভা দেবী, বীনা দাশ, সুলতা কর, মীরা দাশগুপ্ত, বিনোদিনী সেন, সুশীলা মিত্রের মতো অসংখ্য নারী নানাভাবে অর্থ সাহায্য করে বিপ্লবী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। 

বিভিন্ন সময়ে বিপ্লবী সমিতি গুলির আর্থিক সংকটে তারা পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন। কেউ পরিবারের পুরুষ সদস্যদের পুরো মাসের বেতন এনে দিয়ে, কেউবা গোপনে বাড়ির অর্থ চুরি করে এনে অথবা নিজের স্কলারশিপের টাকা প্রদান করে, টিউশন পড়িয়ে, লটারির টিকিট বিক্রি করে (বীনা দাশ) এবং অনেক সময় নিজের বসনের শেষ অলংকারটিও নির্দ্ধিধায় বিক্রি করে নানাভাবে তারা বিপ্লবী আন্দোলনে অর্থ জুগিয়ে গিয়েছিলেন। 

ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার দিকটি বিশ্লেষন করে তাই সবশেষে একথা বলা'ই যায়, সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিলো গভীর, ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। ভারতের বিপ্লবী অভ্যুত্থানে পুরুষদের ভূমিকা যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, তার থেকে নারীদের ভূমিকা কোন অংশে কম ছিলো না, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। 

(২.) সশস্ত্র বিপ্লবে নারীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা  

 সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা সংক্রান্ত আলোচনা একেবারেই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যদি না আমরা বিপ্লবী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নেওয়া নারীদের অসীম বীরত্মপূর্ন অবদানের দিকগুলিকে তুলে না ধরি। 

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, ১৯৩০ দশক থেকে নারীরা সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এই পর্বে বেশ কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নারী ছিলেন, যারা সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মূল দায়িত্বে ছিলেন। এমনই কয়েকজন অসামান্য নারীর অবদানের কথা আমরা আলোচনার শেষে তুলে ধরবো, যাদের ভূমিকা সশস্ত্র সংগ্রামের ধারাটিকেই শুধু সমৃদ্ধ করে নি, চিরাচরিত সংস্কারে নিমজ্জিত, গৃহকোনে আবদ্ধ, দেশীয় নারী মহলে যোগ করেছিলো এক অন্যমাত্রা এবং দেশপ্রেমের আবহ। 

(ক.) শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী :- 

১৯৩১ খ্রিঃ কুমিল্লার অত্যাচারী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা করে সবচেয়ে কমবয়সী ব্রিটিশ হত্যাকারী বিপ্লবী হিসাবে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেন ১৫ বছরের শান্তি ঘোষ এবং ১৪ বছরের সুনীতি চৌধুরী। স্কুলের ছাত্রী হিসাবে তাদের এই কর্মকান্ড সারা দেশে শিক্ষিত নারীদের মনে বিপ্লবের আগুন জ্বেলে দেয়। শান্তি এবং সুনীতিই ছিলেন ইংরেজ হত্যাকারী প্রথম ভারতীয় মহিলা বিপ্লবী। 

(খ.) বীনা দাস :- 

বিপ্লবী ভূপাল বোসের গুপ্ত সমিতির অন্যতম সদস্য ছিলেন বীনা দাস। ভূপাল বোসের গুপ্ত সমিতির সদস্যরা পরবর্তীকালে প্রায় সকলেই গ্রেপ্তার হলে এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে, দলের হাল ধরেন বীনা দাস। 

১৯৩২ খ্রিঃ ৬ ই ফেব্রুয়ারি তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে বাংলার গর্ভনর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন। যদিও অল্পের জন্য বেঁচে যান জ্যাকসন। কিন্তু বীনা দাসের এই সাহসী পদক্ষেপ ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনকে এক অন্যমাত্রা প্রদান করে ব্রিটিশ আধিকারিকদের মনে এক ভয়াবহ ত্রাসের সঞ্চার করে। 

(গ.) প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার :- 

বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের আরেক বীরাঙ্গনা ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার। মাস্টারদা সূর্যসেনের চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি সক্রিয় ভাবে অংশ নেন। ১৯৩২ খ্রিঃ ৬ ই ফেব্রুয়ারি বীনা দাস জ্যাকসনকে হত্যার চেষ্টা করেন, ঠিক সেই বছরটিতেই ২৪ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইওরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করে শাসকমহলে বিরাট ত্রাসের সঞ্চার করেন। 

এই অভিযানের শেষে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার অসম্মান থেকে বাঁচতে প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানায়েড খেয়ে, প্রমান করে দিয়ে যান, "মেয়েরা দেশের জন্য মরতে ভয় পায় না।" 

বলা বাহুল্য, প্রীতিলতাই ছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামে ভারতের প্রথম মহিলা শহীদ। তাঁর এই আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম ভারতের হাজার হাজার মেয়েদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে দিয়ে যায়। 

(ঘ.) কল্পনা দত্ত :- 

চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের আরোও এক বীরাঙ্গনা ছিলেন কল্পনা দত্ত। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের বিপ্লবীরা যখন জেলে বন্দি, তখন জেলের বাইরে ও ভিতরে ডিনামাইট বসিয়ে বিস্ফোরক ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়। এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন কল্পনা দত্ত। 

বেথুন কলেজের বিজ্ঞানের ছাত্রী কল্পনা কলকাতা থেকে বোমা তৈরির মশলা নিয়ে আসেন তার চট্টগ্রামের বাড়িতে। সেখানেই তিনি ডিনামাইট তৈরি করে সেগুলি পাঠিয়ে দেন চট্টগ্রামের জেলে। যদিও, এই পরিকল্পনাটি শেষপর্যন্ত বাস্তবায়িত করা যায় নি। কিন্তু কল্পনা দত্তের এই সাহসী কাজ বহু নারীকে পরবর্তীকালে বিপ্লববাদে অনুপ্রাণিত করে। 

(ঙ.) উজ্জ্বলা মজুমদার :- 

বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ নেওয়া বীরাঙ্গনা নারীদের মধ্যে আরোও একজন স্মরনীয়া নারী ছিলেন, উজ্জ্বলা মজুমদারবেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল ১৯৩৪ খ্রিঃ বাংলার গভর্নর অ্যান্ডারসনকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনারই অন্যতম দায়িত্বে ছিলেন উজ্জ্বলা মজুমদার১৯৩৪ খ্রিঃ মে মাসে দার্জিলিং এ লেবং রেসকোর্সের মাঠে তৎকালীন বাংলার গভর্নর জন অ্যান্ডারসনকে হত্যার চেষ্টা করেন। 

মূল্যায়ন 

এইভাবে দেখা যায়, ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে   
অংশ নিয়ে নারীরা স্বাধীনতা যুদ্ধে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। নিজের প্রান আর মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে দেশপ্রেমের এক অদম্য আবেগে ভর করে তারা দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, "মানবিক জোর এবং তেজস্বিতা থাকলে ভারতীয় নারী অগ্নিকন্যা হয়ে উঠতে পারেন।" সশস্ত্র বিপ্লবে তাদের "অগ্নিকন্যার" সেই ভূমিকার দিকটিই ভাষ্কর হয়ে উঠেছিলো। 

গ্রন্থঋন :- 

১. স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী - কমলা দাশগুপ্ত। 
২. বিংশ শতকের অগ্নিযুগে বাংলার অন্তপুরবাসিনী (১৯০০ - ১৯৩০ দশক) - শর্মিষ্ঠা দাস। 
৩. ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব - উপেন্দ্র কিশোর রক্ষিত রায়।
৪. জাতীয় আন্দোলনে বঙ্গনারী - যোগেশচন্দ্র বাগল।



Post a Comment (0)
Previous Post Next Post