ফরাসি বিপ্লবের জন্য ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজতন্ত্রের ভূমিকা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইওরোপের অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সেও রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিলো।
ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে রাজতন্ত্রের ভূমিকা |
ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজারা "নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র ও ঈশ্বরপ্রদত্ত রাজ ক্ষমতার তত্ত্ব" দ্বারা শাসন পরিচালনা করতেন। কিন্তু রাজার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য কোন প্রতিনিধি সভার অস্তিত্ব সেখানে ছিলো না। "স্টেটস জেনারেল" নামে একটি প্রতিনিধি সভা থাকলেও, ১৬১৪ খ্রিঃ পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ফলতঃ রাজা আইন, শাসন ও বিচারের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। প্রশাসনের সর্বত্র তার স্বৈরাচারীতার অবাধ প্রসার ঘটে। প্রশাসন হয়ে পড়ে ব্যক্তিকেন্দ্রীক। বুরবোঁ রাজারা এই ব্যক্তিকেন্দ্রীক প্রশাসনেরই এক জীবন্ত ও বাস্তব উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন। বুরবোঁ রাজা চতুর্দশ লুইয়ের "আমিই রাষ্ট্র" এই আপ্তবাক্যটির মধ্য দিয়ে এই ব্যক্তিরাষ্ট্রের পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া, ষোড়শ লুইয়ের "আমি যা ইচ্ছা করি সেটাই আইন" প্রভৃতি উক্তির মধ্য দিয়েও ব্যক্তিকেন্দ্রীক স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়।
ব্যক্তিকেন্দ্রীক প্রশাসনে "সবল ও যোগ্য" ব্যক্তি ক্ষমতায় থাকলে প্রশাসনে যে কার্যক্ষমতা দেখা যায়, দুর্বল শাসকের আমলে সেই প্রশাসনই দুর্নীতিপরায়ন ও অপদার্থ হয়ে পড়ে। ফ্রান্সের ক্ষেত্রেও তাই হয়। চতুর্দশ লুইয়ের দুর্বল উত্তরাধিকারী পঞ্চদশ লুই ও ষোড়শ লুইয়ের আমলে প্রশাসন হয়ে পড়ে দুর্নীতিপরায়ন। শাসকের অযোগ্যতায় বিভিন্ন প্রদেশে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। স্ব স্ব স্থানে রাজকর্মচারীরা স্বাধীন হয়ে ওঠে। এদের ঔদ্ধর্ত্য ও অত্যাচার ফরাসি জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার করে।
এমতাবস্থায়, ফরাসি রাজতন্ত্রের একাধিক অদক্ষতার দিক ৯৭% ফরাসি জনগনকে বিশেষত ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃতীয় সম্প্রদায়কে রাজতন্ত্রের বিরোধী করে তোলে। যেমন -
(১.) ফরাসি রাজারা কোন আধুনিক সংস্কার প্রনয়নে আগ্রহী ছিলেন না। ফলে ফ্রান্সে সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি এক প্রকার স্তব্ধ হয়ে যায়।
(২.) সংস্কার বিমুখতার জন্য তারা কর কাঠামোর কোন সংস্কার করেন নি। বিচার ব্যবস্থার উন্নতি ঘটান নি। তাদের আমলে বিচারকের পদ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো বংশানুক্রমিক। ফলে অযোগ্য বিচারকের কবলে পড়ে ফ্রান্সে ন্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
(৩.) প্রবল আর্থিক সংকটের মুখে রাজপরিবারের অত্যাধিক বিলাসপ্রিয়তা জনগনের মনে তীব্র ঘৃনা ও বিদ্বেষের জন্ম দেয়।
(৪.) দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে একাধিক যুদ্ধ ও আত্মঘাতী বৈদেশিক নীতিও দেশবাসী ভালোভাবে মেনে নিতে পারে নি। এটি ফ্রান্সের রাজকোষকে একেবারেই শূন্য করে দেয়।
(৫.) এছাড়া, প্রাক্ বিপ্লব মুহুর্তে "লেতর দ্য ক্যাশের" নির্বিচারে প্রয়োগও মানুষ ভালোভাবে নেয় নি। এটি ফ্রান্সের সাধারন মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরন করে।
প্রকৃতপক্ষে চতুর্দশ লুইয়ের পর তার দুর্বল বংশধরদের আমলে ইওরোপে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফ্রান্সের ক্রম ব্যর্থতা এবং সমুদ্র বানিজ্যে ইংল্যান্ডের সফলতা অর্জন ফরাসি জনগনকে বিশেষত তৃতীয় সম্প্রদায়ের বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের রাজতন্ত্রের বিরোধী করে তুলেছিলো। শেষ পর্যন্ত তীব্র আর্থিক সংকটে রাজা ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকলে বিপ্লব শুরু হয়। প্রকৃতপক্ষে লুইয়ের বাস্তববোধহীনতা ও ব্যক্তিত্বহীনতার জন্যই ফ্রান্সে বিপ্লব হয়। তিনি "স্টেটস জেনারেলে" তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি গুলি মেনে নিলে আর বিপ্লবের দরকার হতো না।
মনে রাখতে হবে, ফ্রান্সে বিপ্লবের প্রথম প্রকাশ কখনই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলো না। ছিলো অভিজাত ও অন্যান্য সুবিধাবাদী শ্রেনী ও প্রশাসনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে স্টেটস জেনারেলে রাজা ষোড়শ লুই সংস্কারের প্রস্তাব পুরোপুরি অস্বীকার করায় বিপ্লব রাজতন্ত্র বিরোধী হয়ে ওঠে। রাজতন্ত্র যদি অভিজাতদের "সুবিধা" গুলি হরন করতেন, তাহলে বিপ্লব হতো না। ফিশার তাই মনে করেন, রাজতন্ত্র বিশেষ সুবিধার প্রশ্নটির কোন সমাধান করতে পারেন নি বলেই বিপ্লব হয়। এখানেই বিপ্লবের পশ্চাতে রাজতন্ত্র ভূমিকা ও দায়িত্বের দিক মূল দিকটিকে খুঁজে নিতে হবে।