বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন

১৯০৫ খ্রিঃ লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বাংলায় শুরু হয়েছিলো "স্বদেশী আন্দোলন"। এই স্বদেশী আন্দোলনে কমবেশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষ অংশগ্রহণ করলেও, কৃষক সমাজের ভূমিকার দিকটি সাম্প্রতিক কালে ইতিহাস চর্চায় বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। 

নিন্মবর্গের ঐতিহাসিকরা স্বদেশী আন্দোলনে সমাজের বিভিন্ন অন্তজ শ্রেণী গুলির অংশগ্রহণের গতিপ্রকৃতির দিক গুলি নিয়ে পর্যালোচনা করছেন। এই পর্যালোচনারই একটি অন্যতম দিক - (১.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা কেমন ছিলো? (২.) কৃষকরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে কেমন দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখেছিলো? এবং (৩.) এই পর্বে সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের প্রকৃতি ও ধরন কেমন ছিলো?

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন 

(ক.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা :-

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা ছিলো অনেকটাই নিস্ক্রিয়, নির্লিপ্ত ও উদাসীন। 
(১.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রতি তাদের কোন আবেগ কাজ করে নি। 
(২.) এই আন্দোলন কৃষকদের স্পর্শ করতে পারেনি। 
(৩.) কৃষক সমাজ এই আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণও করে নি।
(৪.) তবে পূর্ব বঙ্গের কোন কোন অঞ্চলে জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষক অসন্তোষকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটানো হয়েছিলো। মোটামুটি এই ছিলো বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা ।

(খ.) কৃষকদের অংশগ্রহণ না করার কারন :-

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের নির্লিপ্ত ভূমিকা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ না করার পিছুনে অনেক গুলি কারন ছিলো। সংক্ষেপে এই কারন গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -

(১.) কৃষিভিত্তিক কর্মসূচির অভাব :-  

ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে, "সুনির্দিষ্ট কৃষিভিত্তিক কর্মসূচির" অভাবের কারনেই কৃষক সমাজকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা যায় নি। সুমিত সরকার তার "দ্য স্বদেশী মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল" গ্রন্থে দেখিয়েছেন, চরমপন্থী নেতারা নিস্ক্রিয় প্রতিরোধ নীতি গ্রহণ করলেও, খাজনা বন্ধের কর্মসূচি গ্রহণ করতে সক্ষম হননি। কৃষকদের ক্ষোভ ও দাবি দাওয়া নিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করার কোন প্রয়াস স্বদেশী নেতৃত্বের তরফ থেকে নেওয়া হয় নি। 

১৯০৭ খ্রিঃ "বেঙ্গল" পত্রিকায় বাংলায় রায়তদের ক্ষোভ সংক্রান্ত একটি দীর্ঘ চিঠি প্রকাশিত হয়। এই চিঠিতে কৃষকদের ওপর যথেচ্ছ হারে খাজনা চাপানো, আবওয়াব ধার্য করা ও কৃষকদের ওপর মহাজনদের অত্যাচার প্রভৃতি বিষয় গুলি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও, তা স্বদেশী নেতৃত্বের মধ্যে বিশেষ কোন প্রভাব ফেলে নি। স্বদেশী নেতৃত্ব অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গেই কৃষক সমস্যার বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করেছিলো।


(২.) নেতৃত্বের অনীহা :- 

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন অনেকাংশেই জমিদারদের অর্থ, সাহায্য ও সমর্থন দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলো। অন্তত বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম পর্বে এটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। আন্দোলনের নেতৃত্ব তাই কৃষক স্বার্থ অপেক্ষা, "জমিদারদের স্বার্থ সংরক্ষনেই" অধিক মনোনিবেশ করেছিলো। 

কৃষক বিদ্রোহ বা আন্দোলন জমিদারদের স্বার্থের পরিপন্থী ছিলো। তাই স্বদেশী নেতারা এমন কোন কর্মসূচি গ্রহণ করেন নি, যা পরোক্ষে কোন কৃষক আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে এবং জমিদারদের  অসন্তুষ্ট করতে পারে। এই মনোভাবের পরিচয় ১৯০৭ খ্রিঃ অরবিন্দ ঘোষের এক প্রবন্ধে পাওয়া যায়। 

১৯০৭ খ্রিঃ "নিস্ক্রিয় প্রতিরোধ" সংক্রান্ত এক প্রবন্ধে অরবিন্দ ঘোষ সরাসরি খাজনা বন্ধ করার আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। কারন তার মনে হয়েছিলো এটি করলে দেশপ্রেমিক জমিদাররা ক্ষুব্ধ হবেন। 

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে স্বদেশী নেতৃত্ব তাই অত্যন্ত সচেতন ভাবেই কৃষক সমস্যা সমাধানে এবং তাদের আন্দোলনে সংগঠিত করার বিষয়ে অনীহা দেখিয়েছিলো। নেতৃত্বের এই অনীহাই কৃষক সমাজকে আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো।

(৩.) স্বার্থের যোগ না থাকা :- 

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের উদাসীনতা আরেকটি বড়ো কারন ছিলো আন্দোলনের সঙ্গে তাদের শ্রেনী স্বার্থের কোন যোগ না থাকা। 

যদিও "শ্রেনী" হিসাবে তখন কৃষকদের মধ্যে কোন রাজনৈতিক সচেতনতাবোধ তৈরি হয় নি। তবুও, বাংলা ভাগ হওয়া বা না হওয়ার সঙ্গে কৃষক শ্রেনী স্বার্থের কোন সংযোগ বা কোন আত্মিক টান অনুভব করে নি।

(৪.) কৃষক সমাজের পক্ষে নেতৃত্বের অভাব :- 

স্বদেশী আন্দোলনে কৃষকদের দূরে থাকার আরেকটি বড়ো কারন ছিলো, এই আন্দোলনে কৃষক সমাজের পক্ষে কোন নেতা ছিলেন না। স্বদেশী নেতারা নিজেদের কৃষক প্রতিনিধি হিসাবে দাবি করলেও, কৃষকরা তা মনে করতেন না।

স্বদেশী আন্দোলনে নেতৃত্বদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চবর্নের। কৃষকরা দীর্ঘদিন এই উচ্চবর্নের শোষনে জর্জরিত ছিলেন। এই উচ্চবর্নের নেতৃত্ব গ্রাম বাংলার কৃষক সমাজের আর্থ - সামাজিক উন্নয়নে কোন সদর্থক ভূমিকাও পালন করে নি। এমতাবস্থায়, কৃষকদের পক্ষে খুব সহজে উপরতলার নেতৃত্বকে মেনে নেওয়াও সম্ভব ছিলো না। স্বদেশী নেতাদের বানিজ্যিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে কৃষকদের স্বার্থের যথেষ্ট ভিন্নতাও ছিলো

(৫.) হিন্দুধর্মের প্রতীক ব্যবহার :- 

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য চরমপন্থীরা যেসব ধর্মীয় রীতি নীতি, উৎসব ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, তা ছিলো হিন্দু প্রধান। আন্দোলনকে সংগঠিত করতে তারা বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় প্রতীক, বিশেষ করে শাক্ত দেবদেবীর মূর্তি ব্যবহার করেন। এটি মুসলিম ও নিন্মবর্গের হিন্দু কৃষকদের কিছুটা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। 

বারবারা সাউদার্ডের মতে, এই ধরনের প্রতীক ব্যবহারের ফলে মুসলমান কৃষকরা আন্দোলন থেকে দূরে সরে যায়। এমনকি এই প্রতীক ব্যবহারের ফলে পূর্ববঙ্গের নিন্মবর্গের নমঃশূদ্র কৃষকরাও দূরে সরে থাকেন। কারন এদের বেশিরভাগই ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীশাক্ত ধর্মের প্রভাবের আশঙ্কায় তারা আতঙ্কিত হন। 


(৬.) কৃষকদের ওপর জবরদস্তি :- 

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অনেক ক্ষেত্রেই হিন্দু জমিদাররা জোর করে কৃষকদের বয়কট আন্দোলনে সামিল করাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন । স্বদেশী পন্যের দাম বিদেশী পন্যের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার কারনে গরিব কৃষকরা স্বেচ্ছায় তা কিনতে চাইতো না। কিন্তু এক্ষেত্রে হিন্দু জমিদার ও স্বদেশী নেতৃত্ব কৃষকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে, অর্থনৈতিক কারনেই কৃষক অসন্তোষের জন্ম হয় এবং কৃষকরা আন্দোলন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন।

অনেক ক্ষেত্রে স্বদেশী নেতারা, বিশেষ করে অশ্বিনী কুমার দত্তের স্বদেশ বান্ধব সমাজের স্বেচ্ছাসেবকরা ধোপা নাপিত বন্ধ করে দেওয়া বা একঘরে করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে স্বদেশী আন্দোলনকে সমর্থন করার বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করলে কৃষক সমাজ সেটিকে ভালোভাবে নেয় নি। এনিয়ে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিলো। 

মাথায় রাখতে হবে, কৃষকরা এমনিতেই সমাজের উচ্চবিত্ত ও জমিদারদের শোষনে জর্জরিত ছিলো। এর ওপর স্বদেশী আন্দোলনের "স্বদেশীয়ানা" (অর্থাৎ দেশীয় দামি জিনিসপত্র কেনার চাপ ) কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত অর্থনৈতিক বোঝা চাপিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে হিন্দু প্রধান পশ্চিমবঙ্গে অথবা হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে এই চাপের মুখে কৃষকরা কিছুটা উদাসীন ও নিস্ক্রিয় ভূমিকা নিলেও, পূর্ববঙ্গের জনবিন্যাসের বৈপরিত্যের দরুন এই "চাপ" সেখানে "দাঙ্গা" রূপে আত্মপ্রকাশ করে

পূর্ববঙ্গের জনবিন্যাসে অধিকাংশ জমিদার ছিলেন হিন্দু। অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজা ছিলেন মুসলমান কৃষক। এমতাবস্থায়, ব্রিটিশ সরকার ও মৌলবাদীদের উস্কানীতে কৃষকদের অর্থনৈতিক ক্ষোভ ও চাপকে খুব সহজেই দাঙ্গার রূপ দেওয়া হয়। সুতরাং একথা বলা যায়, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় পূর্ববঙ্গের কৃষকপ্রজা বিদ্রোহ বা দাঙ্গা সংকীর্ণ অর্থে একধরনের কৃষক বিদ্রোহ বা আন্দোলন ছিলো। এই কৃষক আন্দোলনের মধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য ছিলো

(গ.) স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি কৃষকদের দৃষ্টিভঙ্গী :-

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মূল কান্ডারি ছিলেন উদীয়মান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। সুমিত সরকারের মতে, সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ এই আন্দোলনে সামিল হলেও, আন্দোলন "শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক" শ্রেনীর দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিলো। 

এই আন্দোলনকে হিন্দু ও মুসলিম কৃষকরা দুটি ভিন্ন পৃথক দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখেছিলেন। 

গ্রামাঞ্চলের নিন্মবর্নের হিন্দু কৃষকরা স্বদেশী আন্দোলনকে উচ্চবর্নের হিন্দু "ভদ্রলোক" শ্রেনীর আন্দোলন হিসাবেই দেখেছিলেন। ভদ্রলোকদের এই আন্দোলনের সঙ্গে কৃষক শ্রেনী কোন আত্মিক টান অনুভব করে নি। ভদ্রশ্রেনীর এই আন্দোলনে তাদের স্বার্থ পূরনেরও কোন সম্ভবনা ছিলো না। এই কারনে পূর্ববঙ্গের নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের নেতা গুরুচাঁদ ঠাকুর তার অনুগামী নিন্মবর্নের হিন্দু কৃষকদের স্বদেশী আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে বলেন। তিনি কৃষকদের বোঝান, বঙ্গ বিভাজনের সঙ্গে হিন্দু কৃষকদের কোন যোগ নেই। বঙ্গ বিভাজন হলে তারা লাভবানও হবেন না আবার ক্ষতিগ্রস্তও হবেন না।

অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে সংগঠিত করবার জন্য স্বদেশী নেতৃত্ব নানা হিন্দু ধর্মীয় প্রতীক (যেমন বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রত, বঙ্গলক্ষ্মী উপাধি ইত্যাদি) উৎসব ইত্যাদি ব্যবহার করায় এই আন্দোলন থেকে মুসলমান কৃষকরা দূরত্ব বজায় রাখেন। এমনিতেই হিন্দু জমিদারদের নানাবিধ শোষনে তারা জর্জরিত ছিলেন। এর উপরে বঙ্গভঙ্গের স্বপক্ষে সরকারি প্রচার এবং ঢাকার নবাব সলিমুল্লা শিবিরের নানা সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে পূর্ববঙ্গের কৃষকরা প্রভাবিত হয়। তারা স্বদেশী আন্দোলনকে "হিন্দু স্বার্থ সংরক্ষনের" একটি আন্দোলন হিসাবে দেখে।

 এই কারনে পূর্ব বঙ্গের মুসলিম কৃষকদের একটি বড়ো অংশ পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িকতার দিকে পরিচালিত হয় এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থনের বদলে বিরোধিতার ভূমিকা গ্রহণ করে। 

(ঘ.) বঙ্গভঙ্গ পর্বে কৃষক আন্দোলনের প্রকৃতি ও ধরন :-

(১.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে বাংলায় প্রকৃত কৃষক আন্দোলন ধাঁচের কোন আন্দোলন কখনই সংগঠিত হয় নি।
(২.) তবে এই সময় পূর্ব বঙ্গের কয়েকটি জেলায় হিন্দু জমিদার, মহাজন ও জোতদারের বিরুদ্ধে কৃষকদের ক্ষোভ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ নিয়েছিলো।
(৩.) হিন্দু জমিদার ও কিয়দংশ উচ্চবর্গ হিন্দুদের ওপর চালিত মুসলমান কৃষকদের আক্রমণকে অনেক ঐতিহাসিকরা "সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা" হিসাবে অভিহিত করলেও, তার ভিতরে কৃষক অসন্তোষের অনেক উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। তাই শ্রেনী সচেতনতার দ্বারা চালিত না হলেও ঐ আন্দোলনকে সংকীর্ণ অর্থে কৃষক আন্দোলন বলা যেতে পারে।
(৪.) পূর্ববঙ্গের এই কৃষক আন্দোলনের মধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র লক্ষ্য করা যায়।
(৫.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে (১৯০৫ - ১৯১১) ভারতের বেশ কয়েকটি স্থানে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিলো। যদিও ঐ সমস্ত আন্দোলন গুলির সঙ্গে স্বদেশী আন্দোলনের  সরাসরি কোন যোগ বা সম্পর্ক ছিলো না।
(৬.) অনেক সময়ে স্থানীয় ভিত্তিতেই ঐ আন্দোলন গুলি পরিচালিত হয়েছিলো।
(৭.) এই পর্বের কৃষক আন্দোলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, এই পর্বের কৃষক আন্দোলন গুলি কখনই সংগঠিত ভাবে ঘটে নি।
(৮.) এই পর্বের কৃষক আন্দোলনের তীব্রতা ও ব্যাপকতাও অনেক কম ছিলো। 

(অ.) বঙ্গভঙ্গ পর্বে বাংলায় কৃষক আন্দোলনের পরিচয় :-

১৯০৫ খ্রিঃ বাঙালি জাতীয়তাবোধকে দুর্বল করার জন্য লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করেন। এই সময় বঙ্গ ভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুরা "স্বদেশী আন্দোলন" সংগঠিত করলে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিকল্প রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য ব্রিটিশ সরকার সাম্প্রদায়িকতাকে সচেতন ভাবে ব্যবহার করে। 

এই সময় লর্ড কার্জন পূর্ব বঙ্গে গিয়ে নানা বক্তব্য রাখেন এবং বঙ্গভঙ্গ হলে মুসলমানরা কোন কোন দিকে লাভবান হবে, সেই বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন। এই সময় পূর্ব বঙ্গে হিন্দু জমিদার ও মুসলমান কৃষকের শ্রেনিগত অবস্থানকে সাম্প্রদায়িক বিরোধিতার রূপ দিতে ব্রিটিশ সরকার ঢাকার নবাব সালিমুল্লামোল্লা মৌলবীদের কাজে লাগায়। 

বাংলা ভাগকে সমর্থন করার জন্য ঢাকার নবাব সালিমুল্লাকে ব্রিটিশ সরকার ১৪ লক্ষ টাকা নামমাত্র সুদে ধার দেয়। ১৯০৬ খ্রিঃ ঢাকার নবাব সালিমুল্লা ও ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ঢাকায় "সারা ভারত মুসলিম লিগ" প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর বঙ্গভঙ্গের সমর্থনকে জোরদার করার জন্য সালিমুল্লা, মুসলিম লিগ এবং তাদের ছত্রছায়ায় মদতপুষ্ট মোল্লা ও মৌলবিরা পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতিকে উত্তেজক করে তোলে। এক্ষেত্রে পূর্ব বঙ্গে হিন্দু জমিদার ও মুসলমান কৃষকের জনবিন্যাসকে লিগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে।

১৯০৬ - ০৭ খ্রিঃ ইশ্বরগঞ্জ, কুমিল্লা, নদীয়া, দেওয়ানগঞ্জ, বক্সিগঞ্জ ও ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বাঁধে। মুসলমান কৃষকদের ক্ষোভের প্রধান কারন ছিলো কিছু হিন্দু জমিদারদের "ঈশ্বরবৃত্তি" নামক কর আদায়। হিন্দু দেব দেবী রক্ষণাবেক্ষণ ও উৎসব পার্বনের জন্য হিন্দু জমিদাররা এই কর আদায় করতেন।

মুসলিম কৃষকরা ঈশ্বরবৃত্তি কর প্রদানে অসম্মতি জানায় এবং হিন্দু জমিদার বাড়ি আক্রমণ করে। হিন্দু মহাজনদের ওপরেও সাধারন মুসলিম কৃষকদের ক্ষোভ ছিলো। আন্দোলন ও বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে অনেক জায়গায় মুসলমান কৃষকরা ঋনপত্র ছিঁড়ে ফেলে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে। 

১৯০৭ খ্রিঃ মে মাসে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের একটি রিপোর্টে বলা হয়, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহতে কৃষকদের ক্ষোভ দাঙ্গায় প্রতিফলিত হয়েছিলো। এদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন হিন্দু জমিদার ও মহাজনেরা, যারা প্রতিমা পুজার জন্য মুসলমান প্রজাদের ওপর ঈশ্বরবৃত্তি চাপিয়েছিলেন। দরিদ্র মুসলমান চাষিরা অনেক জায়গায় এই সময় মহাজনদের ঋনপত্র গুলি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রেই তারা হিন্দু কৃষকদেরও সমর্থন পেয়েছিলেন।

তবে বঙ্গভঙ্গের সময়ে সংগঠিত কৃষক আন্দোলন অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকার নবাব সালিমুল্লাহের মদতপুষ্ট মৌলবী ও ব্রিটিশ সরকারের নানা উস্কানিতে সাম্প্রদায়িক আন্দোলনের রূপ লাভ করেছিলো।

(আ.) বঙ্গভঙ্গ পর্বে বাংলার বাইরে কৃষক আন্দোলনের পরিচয় :-

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে (১৯০৫ - ১৯১১) বাংলার বাইরে স্থানীয় ভিত্তিতে কয়েকটি কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়। যেমন -

(ক.) রাজস্থান :- 

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে রাজস্থানের মেবার অঞ্চলে একটি কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়।

মেবারের একটি বড়ো জায়গির বা জমিদারি ছিলো বিজোলিয়া। সেখানে দরিদ্র কৃষকদের ওপর প্রায় ৮৬ ধরনের বিভিন্ন সামন্ততান্ত্রিক কর ও উপকর চাপানো হয়। এই কর আরোপের বিরুদ্ধে ১৯০৫  থেকে ১৯১৩ খ্রিঃ পর্যন্ত কৃষকরা প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করে। তাদের এই প্রতিবাদ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সীতারাম দাস নামে জনৈক সাধু। 

১৯০৫ খ্রিঃ শুরু হওয়া এই আন্দোলন ১৯১৫ খ্রিঃ বিনয় সিংপথিকের নেতৃত্বে ব্যাপক আকার ধারন করেছিলো।

(খ.) বিহার :-

 নীলকরদের আরোপ করা অতিরিক্ত খাজনা এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিহারের চম্পারন জেলার মোতিহারী বেট্টিয়া অঞ্চলের কৃষকরা ১৯০৫ - ০৮ খ্রিঃ মধ্যে ব্যাপক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলন প্রায় এক দশক ধরে চলতে থাকে। এই বিদ্রোহে নীলকর সাহেব ব্লুমফিল্ড নিহত হন। বহু কৃষককে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। 

বিহার কংগ্রেসের কিছু নেতা পরের দশক পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যান। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজকুমার শুক্লা১৯১৬ খ্রিঃ লক্ষ্মৌ কংগ্রেসে শুক্লার সঙ্গে গান্ধীজির যোগাযোগ হয়। আর তার পরেই গান্ধী চম্পারনের নীল চাষিদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। 
 
১৯১৭ খ্রিঃ গান্ধীজির নেতৃত্বে এখানকার কৃষকরা চম্পারন সত্যাগ্রহ শুরু করেছিলেন। আন্দোলনের চাপে শেষপর্যন্ত সরকার বিহারে বাধ্যতামূলক নীলচাষ বাতিল করে।

(গ.) পাঞ্জাব :-  

১৯০৬ খ্রিঃ পাঞ্জাবে চিনাব নদীসংলগ্ন খালপারের বসতি এলাকায় ব্রিটিশ সরকার "চেনাব বসতি আইন" পাশ করে কৃষকদের ওপর খাজনা ৫০% বৃদ্ধি করে। খাজনা বৃদ্ধি ছাড়াও কৃষকদের ওপর জলকর আরোপ করা হয়।

এর বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের স্থানীয় কৃষকরা প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে। তাদের নেতৃত্ব দেন লালা লাজপত রায় এবং অজিত সিং। তীব্র আন্দোলনের চাপে শেষপর্যন্ত সরকার জলকর ও ভূমিকর কমানোর ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করে। 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post