ভারতবর্ষ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিই ছিলো ভারতীয় অর্থনীতির মূল ভিত্তি ও চালিকা শক্তি। ভারতীয় সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রধান জীবিকাও ছিলো কৃষিকাজ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজদের অর্থনৈতিক শোষনের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছিলো ভারতের কৃষকসমাজ। এর বিরুদ্ধে তারা ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু থেকেই একাধিক বিদ্রোহ সংগঠিত করে আসছিলেন।
অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন |
(ক.) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কৃষক বিদ্রোহের কারন
তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অসহযোগ আন্দোলনের হাত ধরে ভারতের কৃষক আন্দোলনে এক অভূতপূর্ব জোয়ার লক্ষ্য করা যায়। এর পিছনে অবশ্য দুটি কারন ছিল -
এক, গান্ধীজি ও কংগ্রেসের ভূমিকা :-
চম্পারন, খেদা প্রভৃতি কৃষক আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করেই গান্ধীজি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে পরিচিতি লাভ করেন। এই সময় তিনি কৃষকদের সংগ্রামী শক্তির পরিচয় পেয়েছিলেন। গান্ধীজি ভালো ভাবেই জানতেন, ভারত মূলত একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিই এখানকার সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের প্রধান জীবিকা। আর ভারতীয় জনসংখ্যার প্রায় ৮০% মানুষ কৃষিজীবী এবং তারা গ্রামে বসবাস করেন।
এমতাবস্থায়, কৃষক সমাজকে বাদ দিয়ে ভারতে কোন জাতীয় আন্দোলন সফল হতে পারে না। কারন কৃষকরাই একমাত্র মাধ্যম, যারা দেশের প্রান্তিক এলাকা - গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে জাতীয় আন্দোলনের শিকড়কে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম । এই কারনে জাতীয় আন্দোলনকে সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গান্ধীজির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস কৃষকদের সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে ।
এই প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি হিসাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক গুলি ছোট ছোট "কৃষক সভা" গড়ে উঠতে থাকে। এই "কৃষক সভা" বা "কিষান সভা" গুলির মূল উদ্দেশ্য ছিলো দুটি - (১.) কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যা ও অভাব অভিযোগের প্রতিকার করা এবং (২.) কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে জাতীয় আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত রাখা।
দুই, বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি :-
অসহযোগ আন্দোলনের সময় কৃষক আন্দোলন বৃদ্ধির আরেকটি বড়ো কারন ছিলো,প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি জনিত ক্ষোভ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে মজুরি হ্রাস পায়, শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়, দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, কর্মচ্যুতি ও বেকারদের একটা বড়ো অংশ জমিতে ভিড় করলে কৃষকদের মাথা পিছু আয় কমে যায়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মারাত্মক আকার ধারন করে, সর্বোপরি যুদ্ধের ব্যায় নির্বাহের জন্য কৃষকদের ওপর খাজনার পরিমান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা হয়।
এর ফলে কৃষকদের ক্ষোভ চরমে উঠেছিলো। কৃষক সমাজের এই ক্ষোভকেই সংগঠিত করে কংগ্রেস "জাতীয় আন্দোলনে" চালনা করার চেষ্টা করেছিলো। অসহযোগ আন্দোলনের সময় সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের ব্যাপকতার এটি ছিলো একটি অন্যতম কারন।
(খ.) অসহযোগ পর্বের কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ববর্তী যুগের কৃষক আন্দোলনের পার্থক্য :-
আমরা আগেই বলেছি, সমগ্র ঔপনিবেশিক শাসনকাল জুড়েই ভারতে কৃষক বিদ্রোহ চলেছিলো। তবে পূর্ববর্তী যুগের কৃষক আন্দোলন বা বিদ্রোহ গুলির সঙ্গে অসযোগ আন্দোলনের সময় কৃষক আন্দোলন গুলির একটি মৌলিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
(১.) প্রাক্ গান্ধী যুগে যে কৃষক বিদ্রোহ বা আন্দোলন গুলি হয়েছিলো সেগুলি ছিলো বিচ্ছিন্ন ও আঞ্চলিক চরিত্রের। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন পর্বের কৃষক আন্দোলন গুলি ছিলো অনেক বেশি সংগঠিত এবং জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
(২.) প্রাক্ গান্ধী যুগের কৃষক আন্দোলন গুলির নেতৃত্ব কৃষকদের মধ্য থেকেই উঠে এসেছিলো। কিন্তু অসহযোগ পর্বের কৃষক আন্দোলন গুলির নেতৃত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃষক সমাজের বাইরে থেকে এসেছিলো। অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ঐ সমস্ত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
(৩.) আরেকটি পার্থক্যের দিক হলো, প্রাক্ গান্ধী যুগের কৃষক আন্দোলন গুলি বিভিন্ন ক্ষোভ বিক্ষোভের কারনে সংগঠিত হয়েছিলো। সেখানে কোন আদর্শগত পটভূমি কাজ করে নি। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন পর্বের কৃষক আন্দোলন গুলির পিছনে বৃহৎ ও মহৎ আদর্শের অনুপ্রেরণা ছিলো। জাতীয়তাবাদ, অহিংসা নীতি ও জাতীয় মুক্তি অর্জনের মতো মহৎ আদর্শের দ্বারা এই সময়ের কৃষক আন্দোলন গুলি পরিচালিত হয়েছিলো।
এই জন্যই দেখা যায় অসহযোগ পর্বে যখনই কোন কৃষক আন্দোলন আদর্শচ্যুত পড়েছিলো অর্থাৎ অহিংসার নীতি থেকে সরে এসে উগ্র হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠেছিলো, তখনই জাতীয় কংগ্রেস হয় ঐ আন্দোলন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো অথবা আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে সরে দাড়িয়েছিলো।
(গ.) অসহযোগ পর্বের কৃষক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য :-
অসহযোগ আন্দোলন পর্বের কৃষক আন্দোলন গুলির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
(১.) এই সময়ের কৃষক আন্দোলন গুলি ছিলো অনেক বেশি সংগঠিত ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের সঙ্গে সম্পর্কিত।
(২.) পূর্ববর্তী যুগের কৃষক আন্দোলন গুলি কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু এই সময়ের কৃষক আন্দোলনে সমাজের বিভিন্ন স্তরের ও পেশার মানুষেরা যুক্ত হতে শুরু করেন। জওহরলাল নেহেরু, যার কৃষিকাজ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কোন অভিজ্ঞতা ছিলো না, তিনিও কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।
(৩.) এই সময়ের কৃষক আন্দোলনের বড়ো বৈশিষ্ট্য ছিলো কর বর্জন করা।
(৪.) ভারতে যেখানে জমিদারি ব্যবস্থা ছিলো না, অর্থাৎ রায়তওয়ারি অঞ্চলে কংগ্রেস দ্বিধাহীন ভাবে কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করে।
(৫.) কৃষক আন্দোলন গুলি হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠলে কংগ্রেস আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়।
(৬.) অসহযোগ আন্দোলন পর্বে সংগঠিত কৃষক আন্দোলন গুলির পিছনে বামপন্থী দলগুলির কোন ভূমিকা ছিলো না।
(৭.) চরিত্রগত দিক থেকে এই সময়কালের কৃষক আন্দোলন গুলি ছিলো নরমপন্থী। এই সময়কার আন্দোলনকারীরা জমিদারি ব্যবস্থার উচ্ছেদের কোন দাবি তোলেন নি। তারা চেয়েছিলেন, বর্ধিত করভার থেকে মুক্তি ও জমির অধিকার। তারা জমিদার ও সরকারকে ন্যায্য খাজনা ও রাজস্ব দিতে রাজি ছিলো।
(৮.) এই সময়কার কৃষক আন্দোলন গুলি স্থানীয় ভিত্তিতে সংগঠিত হলেও, শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ধারার সঙ্গেই মিশে যায়।
(৯.) এই পর্বের কৃষক আন্দোলন গুলির ক্ষেত্রে "গান্ধী মিথ" একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। এই সময় অনেক জায়গায় বহিরাগত নেতৃত্ব নিজেদের গান্ধীর দূত পরিচয় দিয়ে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করেন। সাঁওতালরা কৃষক বিদ্রোহের সময় গান্ধী টুপি পরে এই বিশ্বাসে যে গান্ধী টুপি পরলে ইংরেজ পুলিশের বন্দুকের গুলি তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
(ঘ.) অসহযোগ পর্বের কৃষক আন্দোলন গুলির পরিচয় :-
১৯২১ খ্রিঃ গান্ধীজির ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম সেরা সৈনিক ছিলেন কৃষকরা। প্রকৃতপক্ষে তারাই অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউকে ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামীন এলাকায় পৌঁছে দিয়ে তাকে সর্বভারতীয় চরিত্র দান করে। অসহযোগ আন্দোলনে কয়েকলক্ষ কৃষকের যোগদান এই আন্দোলনকে প্রকৃত অর্থে গন আন্দোলনে পরিনত করে।
গান্ধীজির আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে এইসময় - (১.) উত্তরপ্রদেশ, (২.) বিহার, (৩.) রাজস্থান, (৪.) বাংলা এবং (৫.) দক্ষিণ ভারতের কেরালা ও অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষকরা বিদ্রোহ বা আন্দোলন শুরু করে।
(১.) উত্তর প্রদেশের কৃষক আন্দোলন
অসহযোগ আন্দোলনের সময় উত্তর প্রদেশে দুটি কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়।
(অ.) একটি অযোধ্যা তালুকের কৃষক আন্দোলন ,
(আ.) অন্যটি উত্তর প্রদেশের হরদৈ, বারাবাঁকি, বাহারাইচ ও সীতাপুর অঞ্চলে সংগঠিত একা আন্দোলন।
(অ.) অযোধ্যা তালুকের কৃষক আন্দোলন :-
(১.) কৃষক অসন্তোষের কারন:-
উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা তালুকে কৃষক অসন্তোষের প্রধান কারন ছিলো - জায়গীরদার ও তালুকদারদের শোষন।
মহাবিদ্রোহের পর বিদ্রোহে উত্তপ্ত উত্তরপ্রদেশে ব্রিটিশ সরকার নিজের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য জায়গীরদার ও তালুকদারদের নিঃশর্তে পাট্টা দেন। পরবর্তীকালে সরকার জায়গীরদারদের নিজপক্ষে রাখার জন্য তাদের প্রতি সহানুভূতিমূলক মনোভাব নেন। এই সুযোগে উত্তর প্রদেশের জায়গীরদার ও তালুকদাররা কৃষকদের ওপর ক্রমাগত করের বোঝা বাড়াতে থাকেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পেলে কৃষকদের ওপর করের বোঝা মারাত্মক বৃদ্ধি পায়।
"১৮৮৬ খ্রিঃ অযোধ্যা খাজনা আইন" অনুসারে কৃষককে
জমিতে ৭ বছরের স্থায়ী স্বত্ব দেওয়ার পর পুনরায় তা নবীকরন করতে হতো। এই নবীকরনের সময় জায়গীরদার ও তালুকদাররা চড়া হারে নজরানা দাবি করতেন। নজরানা না দিতে পারলে কৃষকদের আর জমির স্বত্ব নতুন করে দেওয়া হতো না এবং জমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হতো। ১৯১৯ - ২০ খ্রিঃ শুধু প্রতাপগড় জেলাতেই ২, ৫৯৩ জন কৃষককে উচ্ছেদ করা হয়।
নজরানা ছাড়াও জায়গীরদাররা একাধিক বেআইনি কর আদায় করতেন। যেমন -
১. "হাতিওয়ানা" ( তালুকদাররা হাতি চাপার খরচ),
২. "মোটরওয়ানা" (মোটরগাড়ি চাপার খরচ),
৩."হারি" (বিনা পারিশ্রমিকে তালুকদাররা জমিতে চাষ করে দেওয়া),
৪.যজমানি (তালুকদারকে কম দামে পন্য বিক্রি করা), ৫.লড়াই চাঁদা (যুদ্ধ কর)
এইসব কারনে খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর প্রদেশে কৃষক অসন্তোষ তীব্র আকার ধারন করেছিলো।
(২.) কিষান সভা গঠন:-
অসহযোগ আন্দোলনের কয়েকবছর আগে উত্তর প্রদেশের কৃষক সমস্যার সমাধান করার জন্য এবং কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য গৌরিশংকর মিশ্র ও ইন্দ্রনারায়ন দ্বিবেদী ১৯১৮ খ্রিঃ "উত্তর প্রদেশ কিষান সভা" প্রতিষ্ঠা করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের ১৭৩ টি তালুকে কিষান সভার ৪৫০ টি শাখা স্থাপিত হয়। স্থানীয় অনেক কংগ্রেস নেতা এই কিষান সভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে অসহযোগ আন্দোলনে এই কিষান সভা গুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
(৩.) নেতৃত্ব:-
১৯২০ দশকে কৃষক সভার মাধ্যমে উত্তর প্রদেশে কৃষক আন্দোলনের যে সূচনা ঘটে তাকে এক নতুন মাত্রা প্রদান করেন প্রতাপগড় ও রায়বেরিলী অঞ্চলের দুই কিষান নেতা ঝিঙ্গুরী সিং এবং দুর্গাপাল সিং। স্থানীয় জায়গীরদার ও তালুকদারদের শোষনের বিরুদ্ধে তারা অযোধ্যা তালুকের কৃষকদের সংগঠিত করেন।
ইতিমধ্যে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন বাবা রামচন্দ্র নামে এক মারাঠি সন্ন্যাসী। ১৩ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করা এই সন্ন্যাসী গ্রামে গ্রামে ঘুরে তুলসীদাসের রামায়নের গান পরিবেশন করতেন বলে লোকে তাকে বাবা রামচন্দ্র বলে ডাকতেন। রামচন্দ্র নিজেকে গান্ধীর শিষ্য বলে প্রচার করলে তা কৃষকদের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলে।
(৪.) বাবা রামচন্দ্র ভূমিকা:-
১৯২০ খ্রিঃ জুন মাসে রামচন্দ্র কয়েকশো কৃষককে নিয়ে এলাহাবাদে গৌরীশংকর মিশ্র ও জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কৃষকদের দুর্গতির কথা জানান। এর পর কৃষকদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার জন্য জওহরলাল বেশ কয়েকবার গ্রামে যান এবং কৃষক সভা পরিচালিত আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন।
ইতিমধ্যে রামচন্দ্রের নেতৃত্বে অযোধ্যা তালুকের কৃষকরা খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করে এবং অত্যাচারী জমিদারদের সামাজিক বয়কট শুরু করে। আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য ১৯২০ খ্রিঃ ১৪ আগস্ট রামচন্দ্র ও তার ৩২ জন অনুগামীকে মিথ্যা চুরির দায়ে গ্রেপ্তার করলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। প্রায় ৬০, ০০০ কৃষক রামচন্দ্রের মুক্তির জন্য প্রতাপগড় জেল অবরোধ করলে, গোলমালের আশঙ্কায় সরকার রামচন্দ্রকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
(৫.) নতুন কিষান সভা গঠন:-
ইতিমধ্যে কংগ্রেসের অর্ন্তদ্বন্দ্বে উত্তর প্রদেশের কিষান সভা গুলি ভেঙ্গে গেলে ১৯২০ খ্রিঃ অক্টোবর মাসে জওহরলাল নেহেরুর প্রভাবে বাবা রামচন্দ্র প্রতাপগড়ে "অযোধ্যা কিষান সভা" প্রতিষ্ঠা করেন। অল্প সময়ের মধ্যে এই কিষান সভা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
(৬.) আন্দোলনের হিংসাশ্রয়ী রূপ:-
১৯২০ খ্রিঃ ২১ ডিসেম্বর, কিষান সভা ফৈজাবাদের কাছে এক মহা সম্মেলন ডাকে। ঐ সম্মেলনে প্রায় এক লক্ষ কৃষক যোগ দেয়। এই সভায় বাবা রামচন্দ্র নিজেকে শিকলে বেঁধে সভায় আসেন। কৃষকরা কিভাবে নিপীড়িত, এটি ছিলো তার প্রতীকি সাজ।
এই মহাসম্মেলনের পর অযোধ্যার কিষান আন্দোলন হিংস্র হয়ে ওঠে। কৃষকরা বাজার দোকান ও জমিদার বাড়ি লুঠ করে। মাঠের ফসল কেটে নেয়। এমনকি নিজ নিজ অঞ্চলে স্থানীয় কৃষক নেতারা নিজেদের প্রধান শাসনকর্তা হিসাবে ঘোষনা করে।
(৭.) সরকারি দমন নীতি :-
অযোধ্যা তালুকের কৃষক আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠলে কংগ্রেস নেতৃত্ব ঐ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান। কংগ্রেস আন্দোলন থেকে হাত গুটিয়ে নেবার পরেই বাবা রামচন্দ্র সহ অন্যান্য কৃষক নেতাদের সরকার গ্রেপ্তার করে। ১৯২১ খ্রিঃ "অযোধ্যা খাজনা আইন" পাশ করে কৃষকদের কিছু সুবিধা এবং তালুকদারদের কিছুটা নিয়ন্ত্রন করে সাধারন কৃষকদের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করা হয়েছিলো।
(আ.) উত্তর প্রদেশের একা আন্দোলন :-
অযোধ্যা তালুকের কৃষক আন্দোলন স্তিমিত হবার পর ১৯২১ খ্রিঃ শেষ দিকে উত্তর প্রদেশে আরেকটি কৃষক আন্দোলনের জন্ম হয়। উত্তর প্রদেশের হরদোই, সীতাপুর, বারাইচ, বারাবাকী জেলায় সংঘঠিত এই কৃষক আন্দোলনের নাম ছিলো একা আন্দোলন বা একতা আন্দোলন।
আন্দোলন চলাকালে যে কোন অবস্থায় কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নেন বলে এই আন্দোলনের নাম হয়েছিলো একা আন্দোলন বা একতা আন্দোলন।
(১.) কারন:-
একা আন্দোলনেরও মূল কারণ ছিলো -
(১.) জমিদার ও জায়গীরদারদের শোষন,
(২.) ন্যায্য করের অতিরিক্ত আরও ৫০% কর আদায়,
(৩.) রাজস্ব আদায়কারী ঠিকাদারদের শোষন ও অত্যাচার,
(৪.) বেগার শ্রম ও নানা বেআইনি কর আরোপ,
(৫.) কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ।
(২.) নেতৃত্ব:-
একা আন্দোলনের সূচনা পর্বে কংগ্রেস নেতৃত্ব এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আন্দোলনের রাশ মাদারী পাশীর হাতে চলে যায়। প্রকৃতপক্ষে অনুন্নত সম্প্রদায়ের নেতা মাদারী পাশি ছিলেন একা আন্দোলনের প্রান পুরুষ। তার নেতৃত্বে অনুন্নত শ্রেনির কৃষকরা দলে দলে একা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
(৩.) কৃষকদের শপথ ও দাবিসমূহ :-
একা আন্দোলনে কৃষকরা মাটিতে গর্ত করে তাতে জল রাখতো। এই জলকে তারা গঙ্গাজল বলে বিশ্বাস করতো। এই জল হাতে নিয়ে তারা সমবেত ভাবে মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে শপথ নেয় - (১.) জমির স্বত্বের মেয়াদ শেষ হলেও তারা জমি ছাড়বে না। (২.) অতিরিক্ত খাজনা দেবে না। (৩.) রসিদ ছাড়া খাজনা দেবে না। (৪.) বেগার শ্রম দেবে না। (৫.) গ্রামের বিরোধ পঞ্চায়েতে মীমাংসা করবে এবং (৬.) যে কোন অবস্থায় নিজেদের একতা রক্ষা করবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি মারাত্মক আকার ধারন করলে কৃষকরা পন্যের বদলে টাকায় খাজনা দেওয়ার দাবি তোলে। কারন ফসলের দাম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিলো।ফলে ফসলে খাজনা দিতে গিয়ে কৃষকদের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছিলো।
(৪.) আন্দোলনে হিংসার প্রবেশ :-
মাদারী পাশির নেতৃত্বে অল্প সময়ের মধ্যে একা আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা কুমায়ুন অঞ্চলের সংরক্ষিত অরন্য জ্বালিয়ে দেয়। জমিদার ও তালুকদারদের বাড়ি আক্রমণ করে।
(৫.) দমন নীতি :-
আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠলে কংগ্রেস একা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। এর ফলে সরকারের পক্ষে আন্দোলনকে দমন করা অনেক সহজ হয়ে যায়। ১৯২২ খ্রিঃ জুন মাসে মাদারী পাশিকে গ্রেপ্তার করা হলে একা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
(২.) বিহারে কৃষক আন্দোলন
অসহযোগ আন্দোলন পর্বে বিহারে দুটি কৃষক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে।
(অ.) একটি দ্বারভাঙ্গার মহারাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন,
(আ.) অন্যটি ছোটনাগপুরের তানা ভগৎ আন্দোলন।
(অ.) দ্বারভাঙ্গা রাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন :-
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিহারের দ্বারভাঙ্গা রাজের বিরুদ্ধে ১৯১৯ - ১৯২০ খ্রিঃ এক ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। এই বিদ্রোহ বিহারের দ্বারভাঙ্গা, মুজঃফরপুর, ভাগলপুর, পূর্নিয়া ও মুঙ্গের জেলা জুড়ে সংগঠিত হয়েছিলো।
(১.) কারন:-
বিহারে কৃষকদের ক্ষোভের প্রধান কারন ছিলো -
(১.) দ্বারভাঙ্গা রাজ কর্তৃক গোচারন ভূমি ও বৃক্ষের ওপর করারোপ, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো (২.) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জনিত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও (৩.) মহারাজের অত্যাচার। (৪.) মহারাজের আমলারা উপরি আদায় করলে এবং (৫.) কৃষকদের চিরাচরিত অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে বিদ্রোহ শুরু হয়।
(২.) নেতৃত্ব:-
দ্বারভাঙ্গার বিদ্রোহে কৃষকদের নেতৃত্ব দেন বিশুবরন প্রসাদ নামে একজন সম্পন্ন চাষী, যিনি নিজেকে গান্ধীর শিষ্য বলে প্রচার করেন এবং "স্বামী বিদ্যানন্দ" নাম ধারন করেন।
(৩.) আন্দোলনের সূচনা ও বিস্তার:-
স্বামী বিদ্যানন্দের নেতৃত্বে ১৯১৯ খ্রিঃ জুন মাসে মধুবনী মহকুমায় কৃষকরা প্রথম সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনে অনেক মধ্যবিত্ত ভূমিহীন কৃষকও যোগ দেয়। এই আন্দোলনে কৃষকরা ফসলের পরিবর্তে নগদ অর্থে রাজস্ব প্রদানের দাবি তোলে ও কৃষকদের ওপর নানা বেআইনি করের প্রতিবাদ জানায়।
প্রথম দিকে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও, দ্বারভাঙ্গা রাজের প্ররোচনায় কয়েকটি জায়গায় হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। বিদ্রোহী কৃষকরা হাট বাজার লুঠ করে। জোর করে রাজার জঙ্গল থেকে গাছ কেটে নেয় এবং সব ধরনের কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
এই বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র ছিলো দ্বারভাঙ্গা, ভাগলপুর, পুর্নিয়া ও মুঙ্গের জেলা।
(৪.) কংগ্রেসের ভূমিকা :-
জাতীয় কংগ্রেস দ্বারভাঙ্গার কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করে নি। ১৯২০ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে বিহার প্রাদেশিক কংগ্রেসের একটি সভায় বিদ্যানন্দ দ্বারভাঙ্গার মহারাজার বিরুদ্ধে কৃষকদের ক্ষোভ অনুসন্ধানের একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিলে, কংগ্রেস সেটিকে নাকচ করে দেয়। বিদ্যানন্দ কৃষকদের সমর্থনে একটি সভা আহ্বান করে কংগ্রেস নেতৃত্বকে আমন্ত্রণ জানালেও, কংগ্রেস সেটিকে এড়িয়ে চলে।
দ্বারভাঙ্গার মহারাজা সহ বিহারের জমিদাররা ছিলেন কংগ্রেসের সমর্থক। সেইজন্য কংগ্রেস দ্বারভাঙ্গার আন্দোলন থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। কারন তাদের মনে হয়েছিলো, এই আন্দোলনে কংগ্রেস যুক্ত হয়ে পড়লে বিহারে কংগ্রেসের সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়বে।
(৫.) আন্দোলন দমন :-
কংগ্রেস দূরত্ব বজায় রাখাতে দ্বারভাঙ্গার মহারাজের পক্ষে আন্দোলন দমন করা সহজ হয়ে যায়। কংগ্রেস নেতাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে দ্বারভাঙ্গার রাজা অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন কৃষকদের কিছু সুবিধা প্রদান করলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।
(আ.) তানা ভগৎ আন্দোলন :-
অসহযোগ পর্বের আরেকটি কৃষক আন্দোলন ছিলো তানা ভগৎ আন্দোলন। বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে ওঁরাও, মুন্ডা, তানা ভগৎ প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়রা এই আন্দোলন সংগঠিত করে।
১৯১৯ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে তুরিয়া ভগৎ ও জিতুর নেতৃত্বে আন্দোলনকারী কৃষকরা চৌকিদারী ট্যাক্স ও জমিদারকে খাজনা না দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা জমিদারী শাসন ও ব্রিটিশ শাসনকে অস্বীকার করে ঘোষনা করে আদিবাসীরাই ছোটনাগপুর অঞ্চলের প্রকৃত শাসনকর্তা। গান্ধীজির ভাবাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলো এই সংস্কার আন্দোলন।
(৩.) রাজস্থানে কৃষক আন্দোলন
১৯২০ দশকের সূচনায় উদয়পুরের মহারানা ও তার ছত্রছায়ায় থাকা জায়গীরদারদের বিরুদ্ধে রাজস্থানে একাধিক কৃষক আন্দোলন ঘটে।
(ক.) ১৯১৫ - ১৬ খ্রিঃ মেবারের বিজলিয়াতে যে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছিলো তা বিজয় সিং পথিক ও মানিকলাল ভার্মার নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তীব্র হয়ে উঠেছিলো। এই আন্দোলনের ফলে বিজলিয়ার জায়গীরদাররা ১৯২২ খ্রিঃ বেগার প্রথা ও সেস সম্পর্কে তাদের চড়া দাবি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
(খ.) ১৯২১ - ২২ খ্রিঃ মতিলাল তেজওয়াত নামে এক মশলা ব্যবসায়ী নিজেকে গান্ধীর দূত পরিচয় দিয়ে বিজলিয়া অঞ্চলের ভীল উপজাতি কৃষকদের সংগঠিত করেন। ভীলরা খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করে।
(গ.) জয় নারায়ন ব্যাস একই ধরনের খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করেন মারবাড় অঞ্চলে।
আন্দোলন দমন
উদয়পুরের মহারানার বিরুদ্ধে সংগঠিত এইসব কৃষক আন্দোলন দমন করার জন্য মহারানা সহিংস দমন নীতি গ্রহণ করতে উদ্যোগী হন। এর ফলে মহারানার দমন নীতির বিরুদ্ধে কংগ্রেস একটি নিন্দা প্রস্তাব আনলে মহারানার বন্ধু ও কংগ্রেস নেতা মদনমোহন মালব্য তাতে বাধা দেন এবং বলেন তিনি মহারানাকে বুঝিয়ে চাষিদের কিছু সুবিধা আদায় করিয়ে দেবেন।
মলব্যের অনুরোধে মহারানা খাজনার হার কমালে "বিজলিয়া সত্যাগ্রহ" বন্ধ হয়।
(৪.) বাংলাতে কৃষক আন্দোলন
অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে বাংলাতেও ব্যাপক কৃষক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ।
(১.) কারন :-
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর একাধিক কারনে বাংলার কৃষকরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলো।
(১.) এই সময় কর বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জমিদার ও মহাজনদের শোষনের ফলে বাংলার কৃষকদের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠে।
(২.) তাছাড়া, বাংলায় পাটচাষীরা পাটের উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
(৩.) পূর্ব বঙ্গের এক বিরাট অঞ্চল জুড়ে ভাগচাষীরা ভূমি স্বত্ব লাভের দাবি জানাতে থাকেন।
১৯২১ খ্রিঃ বাংলায় (১.) কমিউনিস্ট নেতৃত্বের প্রভাব (২.) কিষান সভার প্রতিষ্ঠা এবং (৩.) অসহযোগ আন্দোলনের উদ্মাদনা, কৃষকদের প্রবল ভাবে উৎসাহিত করে। এরই প্রভাবে পূর্ব ও পশ্চিম, দুই বঙ্গেই এই সময় কৃষক আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করে।
(২.) পশ্চিমবঙ্গ:-
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মেদিনীপুর জেলাতে কৃষক আন্দোলনের ব্যাপক আকার ধারণ করেছিলো। ১৯২১ খ্রিঃ কংগ্রেস নেতা বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে কাঁথি ও তমলুক মহকুমাতে "ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী" আন্দোলন শুরু হয়। নতুন ইউনিয়ন বোর্ড কৃষকদের খাজনার হার অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিলো। এর বিরুদ্ধেই এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। আন্দোলনের প্রভাবে সরকার শেষ পর্যন্ত কর হ্রাস করতে বাধ্য হয়।
মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমায় সাঁওতালরা কংগ্রেস নেতা শৈলজানন্দ সেনের নেতৃত্বে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে এবং জঙ্গল কাটতে থাকে। তারা হাট ও পুকুরের মাছও লন্ঠন করে।
মেদিনীপুর ছাড়াও বীরভূম, বাঁকুড়া ও জলপাইগুড়িতে সাঁওতাল কৃষকরা গান্ধী টুপি পরে বিদ্রোহ করে।
(৩.) পূর্ববঙ্গ:-
কৃষক আন্দোলনের ঢেউ পূর্ববঙ্গের জেলা গুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে। (১.) ১৯২১ - ২২ খ্রিঃ পাবনা ও বগুড়াতে সরকারি জমি জরিপের কাজে কৃষকরা বাধা দেন। (২.) রাজশাহীতে নীলচাষের বিরুদ্ধে কৃষকরা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। (৩.) চট্টগ্রামের কৃষকরা জঙ্গল লুঠ করে। (৪.) ত্রিপুরা, কুমিল্লা, রংপুর ও দিনাজপুরের মুসলিম কৃষকরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয় কর বয়কট আন্দোলন শুরু করে।
অসহযোগ আন্দোলনের শেষ দিকে বাংলার ঢাকা,পাবনা, খুলনা ও নদিয়ার নমঃশূদ্র ও মুসলিম ভাগচাষী বা বর্গাদাররা ভূমিস্বত্ব লাভের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ক্রমে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করে।
(৪.) কংগ্রেসের ভূমিকা:-
কংগ্রেসের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জমিদাররা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাংলার কৃষকদের কর বয়কট আন্দোলন এবং বর্গাচাষীদের ভূমিস্বত্ব লাভের আন্দোলনকে কংগ্রেস নেতৃত্ব সমর্থন করে নি। ১৯২২ খ্রিঃ ১২ ফেব্রুয়ারি, বারদৌলিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটির বৈঠকে জমিদারদের আশ্বস্ত করা হয় যে তাদের অধিকারের ওপর কংগ্রেস কোন হস্তক্ষেপ করবে না। এর ফলে বাংলার কৃষক আন্দোলন বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যাইহোক, ইতিমধ্যে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করা হলে বাংলার কৃষক আন্দোলনও ঝিমিয়ে পড়ে। ১৯২৩ খ্রিঃ সরকার বর্গাদারদের জমিতে স্বত্ব দান করার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করলে জমিদার, ধনী কৃষক ও স্বরাজ্য দল তার বিরোধিতা করে।
(৫.) দক্ষিণ ভারতে কৃষক আন্দোলন
অসহযোগ আন্দোলনের সময় দক্ষিণ ভারতে তিনটি কৃষক বিদ্রোহ ঘটেছিলো।
(অ.) একটি ছিলো কেরালা রাজ্যের মালাবার অঞ্চলে মুসলমান কৃষকদের বিদ্রোহ, যাকে বলা হয় মোপলা বিদ্রোহ।
(আ.) অন্য দুটি ছিলো অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের গন্টুর জেলার কৃষক বিদ্রোহ ও
(ই.) অন্ধ্রের গোদাবরী উপত্যকার রাম্পা উপজাতির বিদ্রোহ।
(অ.) মোপলা বিদ্রোহ
(১.) মোপলাদের পরিচয় :-
দক্ষিণ ভারতে কেরালার মালাবার অঞ্চলের আরব বংশদ্ভুত মুসলমান কৃষকদের বলা হতো মোপলা। এদের পূর্ব পুরুষরা আরব দেশ থেকে মালাবারে এসেছিলো। টিপু সুলতানের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধের সময় বহু মোপলা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালায়।
(২.) মোপলা বিদ্রোহের কারন :-
মোপলাদের বিদ্রোহী হয়ে ওঠার পিছনে বেশ কিছু কারন ছিলো। যেমন -
(ক.) নতুন ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন
টিপুর পতনের পর ১৭৯২ খ্রিঃ মালাবার অঞ্চলে ইংরেজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় ইংরেজরা রাজস্ব সংগ্রহের জন্য মালাবারে হিন্দু জমিদারদের নিয়ে নতুন ভূমি বন্দোবস্তে প্রচলন করেন। নায়ার ও ব্রাহ্মন নাম্বুদ্রি সম্প্রদায়কে জমিদারি স্বত্ব দেওয়া হয়।
(খ.) হিন্দু জমিদারদের শোষন
জমিদারি স্বত্ব প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু জমিদাররা মালাবার অঞ্চলে নানাবিধ সামন্ততান্ত্রিক শোষন শুরু করে। নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মন ও নায়ার জমিদারদের বিরুদ্ধে মোপলাদের ক্ষোভের প্রধান কারন গুলি ছিলো -
(a.) অনিশ্চিত ভূমিস্বত্ব :- মালাবার অঞ্চলে মোপলা কৃষকদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভূমিস্বত্ব প্রদান করা হতো। দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার নবীকরনের জন্য তাদের চড়া টাকা ও নজরানা দিতে হতো।
(b.) জমি থেকে উচ্ছেদ :- ইংরেজদের নতুন ভূমি ব্যবস্থায় জমির মালিকানা দেওয়া হয়েছিলো হিন্দু জমিদারদের। এর ফলে হিন্দু জমিদাররা রাজস্ব প্রদানে অপারগ বা অবাধ্য মুসলিম কৃষকদের যখন তখন উচ্ছেদ করতে পারতো।
(c.) উচ্চ রাজস্বের হার :- মালাবার অঞ্চলে রাজস্বের হার ছিলো অত্যন্ত চড়া। উৎপন্ন ফসলের প্রায় ৩৫ - ৪০ শতাংশ মোপলাদের খাজনা হিসাবে দিতে হতো। খাজনা দিতে অপারগ মোপলাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হতো অথবা নানা রকম নিপীড়ন করা হতো।
(গ.) মোপলাদের ক্ষোভ ও বিদ্রোহ
মালাবার অঞ্চলে হিন্দু জমিদারদের ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়ায় মুসলমান মোপলা কৃষকরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দু বিদ্বেষী হয় এবং গোড়া ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত হয়। মালাবারে ১৮৩১ খ্রিঃ মসজিদের সংখ্যা ছিলো ৬৩৭। ১৮৫১ খ্রিঃ তার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০৫৮। মোপলারা স্থানীয় নিন্মবর্নের হিন্দু চেরুমারদেরও ইসলামে দীক্ষিত করে।
ধর্মীয় বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় মোপলাদের মনে বিদ্রোহের ভাব জেগে ওঠে। মালাবারে জমিদারকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় জেনমি। এই জেনমিদের বিরুদ্ধে মোপলারা ১৮৩৬, ১৮৫৪, ১৮৮২ এবং ১৮৯৬ খ্রিঃ বিদ্রোহ করে। এইসময় তারা জেনমি নায়ারদের সম্পত্তি দখল করে ও মন্দির আক্রমণ করে। পুলিশের গুলিতে যেসব মোপলারা নিহত হয় তাদের শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়।
(ঘ.) প্রাক্ অসহযোগ পরিস্থিতি
১৯২১ খ্রিঃ অসহযোগ আন্দোলনের আগে মালাবার অঞ্চলে ৩ টি রাজনৈতিক আন্দোলন মোপলাদের পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। একটি ছিলো জমির অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। অপর দুটি আন্দোলন ছিলো যথাক্রমে খিলাফৎ আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন।
(i.) জমির জন্য লড়াই :-
দক্ষিণ ভারতে ১৮৬৭ খ্রিঃ ত্রিবাঙ্কুরে এবং ১৯১৪ খ্রিঃ কোচিনে কৃষকদের "জমির অধিকার" স্বীকৃত হলেও, মালাবারে সেই অধিকার স্বীকৃত না হওয়ায় মোপলা কৃষকরা অসন্তুষ্ট হয়।
১৯১৬ খ্রিঃ জমিতে কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মালাবারে একটি আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯১৬ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয় "Malabar Tenants Association"।
১৯২০ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে মানজেরীতে মালাবার জেলা কংগ্রেসের অধিবেশনে মোপলা কৃষকদের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয় এবং এর জন্য আইন তৈরির সুপারিশ করা হয়। মানজেরী অধিবেশন মোপলা কৃষকদের প্রচন্ডভাবে উৎসাহিত করে তোলে। এর প্রভাবে মালাবার অঞ্চলে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উদ্যোগে অনেক গুলি কৃষক সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কৃষক সভা গুলির মধ্য দিয়ে মোপলা কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন।
(ii.) খিলাফৎ ও অসহযোগ আন্দোলন :-
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় যে দুটি আন্দোলন মোপলাদের নতুন ভাবে উৎসাহিত ও সংগঠিত করে তা হলো, খিলাফৎ আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলন।
মুসলমান মোপলা কৃষকরা ছিলো অশিক্ষিত ও ধর্মান্ধ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই খিলাফৎ আন্দোলন তাদের প্রচন্ড ভাবে উৎসাহিত ও উত্তেজিত করে তোলে। তারা স্বপ্ন দেখে খিলাফৎ প্রতিষ্ঠা হলে সেখানে বিধর্মী হিন্দু জমিদারদের আর শোষন থাকবে না।
গান্ধীজি ১৯১৯ খ্রিঃ খিলাফৎ আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ায় মোপলা আন্দোলনে এক নতুন জোয়ার আসে। গান্ধীজি, সৌকত আলি, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খাঁ প্রমুখ জাতীয় স্তরের নেতারা মালাবার পরিভ্রমন করে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন। এর ফলে মালাবারের বিভিন্ন স্থানে কংগ্রেস খিলাফৎ কমিটি গঠিত হয়। এই সময় বিভিন্ন কৃষক সমাবেশে মোপলারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় তাদের সংগ্রামী চেতনা বহুগুন বৃদ্ধি পায়।
(iii.) কল্পরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচার :-
এইসময় আলি মুসালিয়ার নামে একজন স্থানীয় মোপলা নেতা প্রচার করেন, মোপলা সন্ত মামপ্রত্তি থাঙ্গল তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছেন খিলাফৎ প্রতিষ্ঠার সময় এসে গেছে। এক নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে কোন ব্যক্তি সম্পত্তি থাকবে না। শোষন থাকবে না। এই ঘটনা অশিক্ষিত মোপলাদের ধর্মীয় উদ্মাদনা ও উৎসাহ বহুগুন বাড়িয়ে দেয়।
১৯২১ খ্রিঃ ২১ ফেব্রুয়ারি, সরকার খিলাফৎ সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ঐ মাসেই মোপলাদের মধ্যে প্রচার করার অভিযোগে মাধবন নায়ার, ইয়াকুব হাসান, গোপাল মেনন, পি মৌদিন কোয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেস ও খিলাফতি নেতারা গ্রেপ্তার হন।
এই গ্রেপ্তারের পর মোপলা বিদ্রোহের নেতৃত্ব স্থানীয় মৌলবী ও হাজিদের হাতে চলে যায়। ধর্মান্ধ ঐ সব ব্যক্তিরা প্রচার সমাবেশে মোপলাদের উত্তেজিত করে তুলতে থাকেন।
(ঙ.) প্রত্যক্ষ কারন ও বিদ্রোহ :-
১৯২১ খ্রিঃ আগস্ট মাসে স্থানীয় একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। এই সময় তিরুরঙ্গাভি মসজিদে অস্ত্রের তল্লাশি করার জন্য পুলিশ অভিযান চালালে, মোপলাদের ধূমায়িত ক্ষোভ বিদ্রোহের আকারে প্রসারিত হয়।
বিদ্রোহীরা সরকারি দপ্তর, পুলিশ চৌকি, হিন্দু জমিদার বাড়ি আক্রমণ করে। প্রায় দশ হাজার মোপলা গেরিলা পদ্ধতিতে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালায়।
আন্দোলনের তীব্রতায় দক্ষিণ মালাবারের এরনাড ও বাল্লুবানাড তালুকের বেশ কয়েকমাস ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রন মুক্ত থাকে। মালাবারের বেশ কিছু অঞ্চলে সাময়িক ভাবে খিলাফৎ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
(চ.) সাম্প্রদায়িক চরিত্র লাভ :-
ক্রমে মোপলা বিদ্রোহ সাম্প্রদায়িক চরিত্রের রূপ নেয়। গোড়ার দিকে উদার হিন্দু জমিদারদের প্রতি সদয় ব্যবহার নেওয়া হলেও, আন্দোলন শেষের দিকে উগ্র ও ধর্মান্ধ হয়ে উঠে। ঐ সময় অবশিষ্ট হিন্দু জমিদার ও সাধারন নিরপরাধ হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। ধর্মান্ধ মোপলা কৃষকরা এই পর্বে প্রায় ৬০০ হিন্দুকে হত্যা করে এবং ২৫০০ হিন্দুকে বলপূর্বক ধর্মান্তকরন করে।
(ছ.) সরকারি দমননীতি
অবশেষে নির্মম দমন নীতি প্রয়োগ করে ব্রিটিশ সরকার মোপলা বিদ্রোহ দমন করে। সরকারি মতে ২৩৩৭, এবং বেসরকারি মতে ১০,০০০ মোপলাকে হত্যা করে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়। সামরিক আইন জারি করে ব্রিটিশ সরকার মোপলা বিদ্রোহকে নিয়ন্ত্রনে আনে।
মোপলা বিদ্রোহ ছিলো অসহযোগ আন্দোলনের সময় সংগঠিত ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি কৃষক বিদ্রোহ। অসহযোগ পূর্ববর্তী সময়কালের মোপলা বিদ্রোহ গুলি মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যেই বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনের সময় মোপলাদের বিদ্রোহ প্রকৃত অর্থেই একটি গন বিদ্রোহে পরিনত হয়েছিলো।
এই বিদ্রোহের প্রভাবে পরবর্তীকালে ১৯২৯ খ্রিঃ টেনান্সি অ্যাক্ট বা প্রজাস্বত্ব আইন পাশ করে মোপলা কৃষকদের অধিকার রক্ষার চেষ্টা করা হয়।
(আ.) অন্ধ্রপ্রদেশে কৃষক বিদ্রোহ
অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে কৃষক আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করেছিলো।
(ক.) গন্টুর জেলার কৃষক আন্দোলন :-
১৯২১ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাস থেকে ১৯২২ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশের গন্টুর জেলার কৃষকরা সরকারকে খাজনা দেওয়া বন্ধ রাখেন। কৃষকদের খাজনা বন্ধের এই আন্দোলনে সরকারের আদায়ীকৃত রাজস্বের পরিমান ১৪.৭৩ লক্ষ টাকা থেকে কমে দাঁড়ায় মাত্র ৪ লক্ষ টাকায়।
এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন আঞ্চলিক কৃষক নেতারা। কোন্ডা ভেঙ্কটাপ্পাইয়া, টি প্রকাশমের মতো অনেক কংগ্রেস নেতা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২২ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি মাসে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গন্টুর জেলার কৃষক আন্দোলনেরও অবসান ঘটে।
(খ.) রাম্পা বিদ্রোহ :-
অসহযোগ আন্দোলনের সময় অন্ধ্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও ভয়াবহ কৃষক বিদ্রোহ ছিলো গোদাবরী উপত্যকার রাম্পা উপজাতির বিদ্রোহ।
১৯২২ - ২৪ খ্রিঃ অন্ধ্রপ্রদেশের গোদাবরী উপত্যকায় রাম্পা উপজাতির কৃষকরা আল্লুরি সীতারাম রাজুর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেন। এটিই ইতিহাসে রাম্পা বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
(১.) পরিচয়:-
রাম্পারা ছিলো দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র অঞ্চলের একটি উপজাতি গোষ্ঠী। এরা গোদাবরী উপত্যকার অরন্য ও মোহনা অঞ্চলে বসবাস করতো। এই অঞ্চলটি খরাপ্রবন হওয়ায় রাম্পারা কৃষিকাজের পাশাপাশি অরন্যের উপরেও নানা ভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন পর্বে তারা নানা কারনে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলো।
(২.) বিদ্রোহের কারন :-
রাম্পাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠার পিছনে দুটি প্রধান কারন ছিলো। যেমন -
(ক.) ঔপনিবেশিক অরন্য আইন
ব্রিটিশ সরকার ঔপনিবেশিক অরন্য আইনকে গোদাবরী এলাকায় কার্যকর করলে রাম্পারা তাদের চিরাচরিত অধিকার গুলি থেকে বঞ্চিত হন। এর ফলে তারা -
১. জঙ্গল থেকে কাঠ, মধু ও জ্বালানি সংগ্রহের অধিকার হারান।
২. অরন্যে গোচারন ও শিকারের অধিকার হারান।
৩. ঔপনিবেশিক অরন্য আইনে ঝুম চাষ নিষিদ্ধ হওয়ায় রাম্পারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
(খ.) জমিদার ও মহাজনদের শোষন :-
রাম্পা বিদ্রোহের একটি অন্যতম প্রধান কারন ছিলো জমিদার ও মহাজনদের শোষন। মহাজন শ্রেনী ইংরেজদের জটিল আইনের সুযোগ নিয়ে নিরক্ষর রাম্পাদের ঋনভারে জর্জরিত করে এবং তাদের জমি গুলি দখল করে নিতে থাকে। এর ফলে রাম্পাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
(গ.) প্রত্যক্ষ কারন :-
রাম্পা বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারন ছিলো অরন্য ও পার্বত্য অঞ্চলে জোর করে রাম্পাদের দিয়ে রাস্তা তৈরি করানো। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাম্পা কৃষকদের জোর করে বেগার খাটানো হয়। ব্যাস্টিয়ন নামে গুডেমের এক ইংরেজ তহশিলদার বল প্রয়োগ করে রাম্পা কৃষকদের রাস্তা নির্মানে নিযুক্ত করলে রাম্পারা উত্তেজিত হয়ে বিদ্রোহ ঘোষনা করে।
(৩.) নেতৃত্ব :-
রাম্পা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন আল্লুরি সীতারাম রাজু নামের জনৈক ভবঘুরে সাধু। আল্লুরী সহজ সরল আদিবাসীদের তার ধর্মীয় মতবাদের দ্বারা সংগঠিত করেন। তিনি নিজেকে কল্কি অবতার ও মহাত্মা গান্ধীর অনুগামী বলে প্রচার করেন। রাম্পা উপজাতির মানুষ বিশ্বাস করতো সীতারাম রাজু নানা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। আল্লুরী রাজুর অলৌকিক ক্ষমতার প্রচার রাম্পা কৃষকদের মনে সাহসের সঞ্চার করে।
(৪.) বিদ্রোহ ঘোষনা :-
সীতারাম রাজুর নেতৃত্বে রাম্পা কৃষকরা সরকারি আইন লঙ্ঘন করলে তাদের দমন করার জন্য সরকার পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করে। এই সময় রাজুর নেতৃত্বে রাম্পা কৃষকরা গেরিলা যুদ্ধ চালায়।
অল্প সময়ের মধ্যেই রাম্পা বিদ্রোহ হিংসাত্মক হয়ে পড়ে। রাম্পা কৃষকরা মহাজন বাড়ি ও পুলিশ থানা গুলিতে আক্রমণ করে। প্রায় ২৫০০ বর্গ মাইল এলাকায় এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ভদ্রাচলম্ থেকে পার্বতীপুরম্ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে এই আন্দোলনের বিস্তার হয়।
(৫.) দমন নীতি
রাম্পা উপজাতির আন্দোলন শেষদিকে হিংসাত্মক হয়ে উঠলে ব্রিটিশ সরকার মালাবারের স্পেশাল পুলিশ ও আসাম রাইফেলদের সাহায্যে তীব্র দমন নীতি নিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করে। ১৯২৪ খ্রিঃ ৬ ই মে রাজু ধরা পড়লে রাম্পা বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহ দমন করতে মাদ্রাজ সরকারকে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা খরচা করতে হয়। রাম্পা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও, তা ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করেছিলো।
(৬.) অসহযোগ পর্বের কৃষক আন্দোলন গুলির সীমাবদ্ধতা :-
অসহযোগ আন্দোলন পর্বের কৃষক আন্দোলন গুলি গভীর ভাবে পর্যালোচনা করলে এই পর্বের কৃষক আন্দোলনের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার দিক লক্ষ্য করা যায় । যেমন -
(১.) এই সময়ের কৃষক আন্দোলন গুলি জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারার সঙ্গে মিশে যাওয়ায় সর্বভারতীয় ভিত্তিতে কোন সুনির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্র কৃষক আন্দোলনের উন্মেষ ঘটে নি।
(২.) এই সময়ে কৃষক আন্দোলন গুলির সংগঠন ও নেতৃত্বের ভার কৃষক সমাজের বাইরে বহিরাগত শ্রেনীর হাতে থাকায় সত্যিকারের কৃষক আন্দোলন বলতে যা বোঝায়, তা এইসময় ঘটে নি।
(৩.) জাতীয় কংগ্রেসের স্থানীয় ও সর্বভারতীয় নেতৃত্ব নিজ দল ও দলীয় স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে অনেক সময়ে আপোষ করেন। কৃষক আন্দোলন যখনই সহিংস ও জমিদার বিরোধী চরিত্র লাভ করেছিলো, তখনই কংগ্রেস কৃষক আন্দোলন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
(৪.) জাতীয় কংগ্রেসের সবচেয়ে বড়ো পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জমিদাররা। এই কারনে মহাত্মা গান্ধী বা কংগ্রেস কেউই কৃষক আন্দোলনকে শ্রেনী সংগ্রামের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চান নি। কৃষক আন্দোলন যখনই জমিদারদের স্বার্থে আঘাত করতে শুরু করেছিলো, তখনই কংগ্রেস কৃষক আন্দোলন থেকে পিছিয়ে এসেছিলো।
(৫.) আসলে কংগ্রেস কৃষক আন্দোলনের রাশকে জাতীয় সংগ্রামের মূল স্রোতধারার মধ্যে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলো। কংগ্রেস সব সময়ে স্বতন্ত্র, জঙ্গী কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলো। কৃষক আন্দোলনকে স্বতন্ত্র সর্বভারতীয় চরিত্র দিতেও প্রস্তুত ছিলো না। ফলে অসহযোগ পর্বে কৃষক আন্দোলন সুসংহত ও সুগঠিত সংগ্রামী চরিত্র লাভে ব্যর্থ হয়।
(৬.) এই পর্বের কৃষক আন্দোলনের আরেকটি সীমাবদ্ধতার জায়গা হলো, এই সময়ে কৃষকদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব গড়ে উঠে নি। কৃষক নেতারা কমন বা সাধারন অর্থনৈতিক নীতি বা কর্মসূচির ভিত্তিতে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে কোন অখন্ড কৃষক আন্দোলনের জন্ম দিতে পারেন নি।
(৭.) অবদান:-
তবে এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অসহযোগ আন্দোলন পর্বের কৃষক আন্দোলন গুলি মোটেই উপেক্ষনীয় ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে এই পর্বের কৃষক আন্দোলন গুলি -
(১.) অসহযোগ আন্দোলনে এক নতুন প্রান ও উন্মাদনার সঞ্চার করে।
(২.) অসহযোগ আন্দোলনকে প্রকৃত গন আন্দোলনে পরিনত করে এবং
(৩.) ভারতবর্ষের প্রান্তিক গ্রামীন ও দুর্গম অরন্য অধ্যুষিত এলাকায় অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউকে পৌঁছে দেয়।
গ্রন্থঋন:-
১. আধুনিক ভারত (পলাশি থেকে নেহরু) - সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়।
২. আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৭০৭ - ১৯৬৪) - সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়।
৩.আধুনিক ভারতের ইতিহাস (ব্রিটিশরাজ থেকে নেহেরু) - রতন কুমার বিশ্বাস।
৪. আধুনিক ভারতের রূপান্তর - রাজ থেকে স্বরাজ - সমর কুমার মল্লিক।
৫. আধুনিক ভারত ও বিশ্বের ইতিহাস - জীবন মুখোপাধ্যায়।
৬. ভারত ইতিহাস পরিক্রমা - প্রভাতাংশু মাইতি ও অসিত কুমার মন্ডল।
৭. ভারতের ইতিহাস - আধুনিক যুগ ১৭০৭ - ১৯৬৪ - তেসলিম চৌধুরী।
৮. পলাশী থেকে পার্টিশান - শেখর বন্দোপাধ্যায়।
৯. আধুনিক ভারতের ইতিহাস - বিপান চন্দ্র।