ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে দার্শনিকদের ভূমিকা কতখানি ছিলো?

ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে দার্শনিকদের ভূমিকা কতখানি ছিলো, তা একটি বিতর্কিত বিষয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের এর পক্ষে, বিপক্ষে নানা (ক.) মতবাদ, (খ.) তথ্য, এবং (গ.) যুক্তি আলোচ্য বিষয়টিকে করে তুলেছে জটিল এবং অমীমাংসিত
ফরাসি বিপ্লবের পিছুনে দার্শনিকদের ভূমিকা
ফরাসি বিপ্লবের পিছুনে দার্শনিকদের ভূমিকা 

দার্শনিকদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

১৭৮৯ খ্রিঃ ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হবার আগে সেদেশে বেশ কয়েকজন দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছিলো। এই সমস্ত দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - রুশো, মন্তেস্কু, ভলতেয়ার, দেনিস দিদেরো, দ্য এলেমবার্ট প্রমুখ। 

১৭৮৯ খ্রিঃ ফরাসি বিপ্লব শুরু হবার সময় এইসব দার্শনিকদের কেউই বেঁচে ছিলেন না। কিন্তু ফ্রান্সে বিপ্লব শুরুর অনেক আগে থেকেই এইসব দার্শনিকরা একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করে এমন সব বক্তব্য রাখেন, যা ফ্রান্সের চিন্তাবিদ মানুষের মনে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করে।

(১.) রুশো :- 

ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় ছিলেন জাঁ জেকুইস রুশো। তাকে "ফরাসি বিপ্লবের প্রিন্স", "ফরাসি বিপ্লবের ঝড়ের পাখি" এবং "ফরাসি বিপ্লবের জনক" বলে অভিহিত করা হতো। "Origin of Inequality" (অসাম্যের সূত্রপাত) গ্রন্থে তিনি দেখান, প্রত্যেক মানুষ সমান অধিকার নিয়ে স্বাধীন ভাবে জন্মায়। কিন্তু লোভী ও স্বার্থপর সমাজ ব্যবস্থা তাকে বঞ্চিত করে রাখে। রুশোর এই বক্তব্য ফ্রান্সের তৃতীয় সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদদের ভিষন ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। কেননা যোগ্যতা ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা ফ্রান্সের সমাজে সব দিক থেকেই বঞ্চিত ছিলেন। 

১৭৬২ খ্রিঃ প্রকাশিত হয় রুশোর সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থ "Contract Social" বা সামাজিক চুক্তি। এই গ্রন্থে রুশো বলেন, ঈশ্বর রাজা বা রাষ্ট্র সৃষ্টি করেন নি। জনসাধারনই চুক্তির মধ্য দিয়ে রাজা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটিয়েছিলো। রাজা ও রাষ্ট্র যদি জনসাধারণের প্রকৃত কল্যান না করতে পারে, তাহলে জনসাধারণের ক্ষমতা রয়েছে, রাজাকে সরিয়ে ফেলার এবং রাষ্ট্রের স্ট্রাকচার বা কাঠামোকে ভেঙে ফেলার। জনগন এটা করতে পারে, কারন জনগনই একটি রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। রাষ্ট্রের চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতা এই জনগনের হাতেই ন্যাস্ত।

রুশোর এই দার্শনিক মতবাদ বিভিন্ন দিক থেকে ফরাসি শিক্ষিত সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। সামাজিক চুক্তি মতবাদের দ্বারা রুশো - 
(১.) ফ্রান্সের বুঁরবো রাজতন্ত্রের ঈশ্বরীয় ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তার অযৌক্তিক দিকটি তুলে ধরেন। 
(২.) এর ফলে রাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভীতির জায়গাটি আসাড় হয়ে পড়ে। 
(৩.) মানুষ রাজার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। অভিজাতরা প্রথম রাজার নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিদ্রোহ করে। পরে তৃতীয় সম্প্রদায় রাজার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রকে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র এবং আরোও পরে রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। 

(২.) মন্তেস্কু :- 

ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মন্তেস্কু। তিনি বেশ কিছুদিন ইংল্যান্ডে বসবাস করেছিলেন এবং ইংল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হন। ১৭২১ খ্রিঃ তিনি প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ "Persian Letter's" (পারস্যের পত্রাবলী)। এই গ্রন্থে তিনি ফ্রান্সের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করেন।

১৭৪৮ খ্রিঃ প্রকাশিত হয় মন্তেস্কুর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ - "Spirit of Laws" বা আইনের মর্ম। এই গ্রন্থে মন্তেস্কু -(১.) রাজার ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতার তীব্র সমালোচনা করেন,
(২.) রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাগরিকদের ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলেন এবং
(৩.) নাগরিকদের ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরনের কথা বলেন। তাঁর এই পৃথকীকরনের তত্ত্ব "ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতি" নামে পরিচিত।

 মন্তেস্কুর মতে, একই ব্যক্তির হাতে ( অর্থাৎ রাজার হাতে) আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের দায়িত্ব থাকলে, ঐ ব্যক্তি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে বাধ্য। অন্যদিকে ঐ স্বৈরাচারী শাসনে নাগরিকদের ব্যক্তি স্বাধীনতাও লোপ পায়। ফরাসি বিপ্লবের আগে বুঁরবো রাজতন্ত্রের আমলে ফ্রান্সে এটাই ঘটেছিলো।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই মন্তেস্কুর মতবাদ ফরাসি বিপ্লবীদের চিন্তা ভাবনায় এক সুগভীর আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৭৯১ খ্রিঃ বিপ্লবী সংবিধানে মন্তেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির ব্যবহারিক প্রয়োগ করা হয়

(৩.) ভলতেয়ার :-

 প্রাক্ বিপ্লব ফ্রান্সের দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম আরেকজন ছিলেন ভলতেয়ার। তাঁর প্রকৃত নাম ছিলো ফ্রাঁসোয়া মারি আরুয়ে। তিনি - 
(১.) ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে ফ্রান্সের গির্জার দুর্নীতির কঠোর সমালোচনা করেন। 
(২.) ইংল্যান্ডের অভিজাতদের সঙ্গে ফ্রান্সের অভিজাতদের তুলনা করে দেখান, ইংল্যান্ডের অভিজাতরা ফ্রান্সের মতো বিশেষ কর্তৃত্ব বা সুবিধা ভোগ করে না।
(৩.) ইংল্যান্ডে তৃতীয় শ্রেণির যোগ্য লোকেরা সম্মানিত হলেও, ফ্রান্সে বঞ্চিতই থেকে যায়। এমনকি সে দেশে করভারও অনেক কম।
(৪.) ফ্রান্সের সামাজিক বৈষম্য ও অনাচারের বিরুদ্ধে, এবং স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ জানান।

১৭৩৪ খ্রিঃ প্রকাশিত "Letters Philosophiques" (লেতর ফিলজফিক), এবং ১৭৫৯ খ্রিঃ প্রকাশিত "Candid" (কাঁদিদ) গ্রন্থে ভলতেয়ার তার দার্শনিক মতবাদ ও চিন্তাভাবনাকে সংকলিত করেন।

(৪.) দেনিস দিদেরো ও দ্য এলেমবার্ট :- 

প্রাক্ বিপ্লব ফ্রান্সে চিন্তাবিদদের অন্যতম ছিলেন দেনিস দিদেরোদ্য এলেমবার্ট। এরা সমসাময়িক বিভিন্ন পন্ডিতের সহায়তায় ৩৫ টি খন্ডে একটি বিশ্বকোষ সংকলন করেন। এই খন্ড গুলি ১৭৫১ থেকে ১৭৮০ খ্রিঃ মধ্যে প্রকাশিত হয়।

দার্শনিকরা যে গ্রন্থ রচনা করেন, তার ভাব ও ভাষা জটিল ও বিমূর্ত থাকে। তা সর্বসাধারনের কাছে সহজবোধ্য করে পরিবেশনের জন্যই বিশ্বকোষ প্রনয়ন করা হয়েছিলো। বিশ্বকোষ ফ্রান্সের মানুষকে প্রচলিত সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মীয় জীবনের ক্রুটি বিচ্যুতি সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিলো

(৫.) ফিজিওক্রাটস প্রবক্তা :- 

উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও, ফ্রান্সে বিপ্লবের আগে ফিজিওক্রাটস নামে একদল অর্থনীতিবিদের আবির্ভাব ঘটেছিলো। এরা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রন ও কর্তৃত্বের বিরোধীতা করে উদার, মুক্ত ও অবাধ বানিজ্য নীতির কথা বলে।

ইংল্যান্ডে অ্যাডাম স্মিথ সর্বপ্রথম তার "The wealth of Nations" গ্রন্থে অবাধ বানিজ্য নীতির কথা বলেন। পরে ফ্রান্সে কুইসনে এই মতবাদকে ফ্রান্সে জনপ্রিয় করে তোলেন। এই মতবাদে বলা হয়, ভূমি বা জমি হলো সম্পদের মূল উৎস। সুতরাং ভূমির সকল মালিককেই কর দিতে হবে। এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে ফ্রান্সের যাজক ও অভিজাতদের স্বার্থের পরিপন্থী ছিলো।

ফ্রান্সের শিল্প ও বাণিজ্য ছিলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনাধীন। ফিজিওক্রাটসরা মার্কেনটাইল মতবাদ, সংরক্ষণ নীতি ও শিল্প - বানিজ্যে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনের বদলে অবাধ বানিজ্য ও বেসরকারি শিল্প স্থাপনের কথা প্রচার করে। ফিজিওক্রাটসদের এই মতবাদ ফ্রান্সের প্রচলিত ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য বুর্জোয়াদের অনেকাংশে উদ্বুদ্ধ করেছিলো।

দার্শনিকদের অবদান নিয়ে বিতর্ক :- 

ফরাসি বিপ্লবের আগে দার্শনিকরা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ও মতবাদ প্রচার করলেও, কোবান, লাব্রুস, লেফেভর, জোরেস, গুডউইন, থিয়ার্স, মর্স স্টিফেনস প্রমুখ ঐতিহাসিকরা ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে দার্শনিকদের দায় দায়িত্বকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী নন। দার্শনিকদের অবদানের বিপক্ষে এদের যুক্তি বেশ জোরালো। এদের মতে -

(১.) ফ্রান্সে সমকালীন বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতেই বিপ্লব ঘটে। দার্শনিকদের মতাদর্শ বা আদর্শের জন্য নয়। 
(২.) দার্শনিকরা কেউ বিপ্লবের স্রষ্টা ছিলেন না।
(৩.) দার্শনিকদের কেউই বিপ্লব করার কথাও বলেন নি, বা বিপ্লবে নেতৃত্বও দেন নি
(৪.) দার্শনিকরা কেউ বিপ্লবে অংশও নেন নি। রুশো বিপ্লব চান নি। তার মতে, বিপ্লব হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ ডেকে নিয়ে আসে। 
(৫.) বিপ্লব শুরু হবার আগেই দার্শনিকদের অনেকে মারা গিয়েছিলেন
(৬.) দার্শনিকদের মধ্যে কোন মতের বা আদর্শের মিলও ছিলো না। দার্শনিকদের মতাদর্শও সর্ববাদী সম্মত ছিলো না। রুশো প্রজাতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। মন্তেস্কু নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। অন্যদিকে ভলতেয়ার জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন।
(৭.) দার্শনিকরা কয়েকটি আদর্শের কথা প্রচার করলেও, সেগুলি কিভাবে বাস্তবায়িত করা হবে, তার কোন পথের সন্ধান দেন নি। 
(৮.) কোন নতুন আদর্শ বা ধ্যান ধারনার কথাও তারা প্রচার করেন নি। সার্বভৌমত্ব, সামাজিক সাম্য, ব্যক্তিস্বাধীনতা এগুলি বহুদিন ধরেই বিভিন্ন দেশের চিন্তাবিদরা বলে আসছিলেন। 
(৯.) সাধারণ মানুষ দার্শনিকদের রচনা পড়ে নি। সুতরাং সাধারণ মানুষকে তারা প্রভাবিত করেছিলেন, এমতের কোন যুক্তি নেই। বিপ্লব তাই দার্শনিক নয়, আর্থ - সামাজিক তথা রাজনৈতিক ক্ষোভেরই গর্ভজাত ছিলো

ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন এজন্য বলেছেন, ফরাসি বিপ্লবের পিছনে দার্শনিকদের ভূমিকা ছিলো "ক্ষিন, পরোক্ষ ও দূরবর্তী"। দার্শনিকরা পুরাতনতন্ত্রে ভালোই ছিলেন। তারা পুরাতনতন্ত্রের কিছু দুর্বলতা ও ক্রুটির কথা বললেও, বিপ্লব চান নি।

দার্শনিকদের স্বপক্ষে যুক্তি ও মত :- 

উপরোক্ত মতের বিরোধিতা করে ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকাকে স্বীকার করে অনেক ঐতিহাসিকই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। এদের মধ্যে আছেন টকভিল, আবেগ বারওয়েল, হল্যান্ড রোজ, তেইন, রুস্তান, মাদেলা, মাতিয়ে, সতাব্রিয়া, রুডে প্রমুখ।

(১.) ফরাসি ঐতিহাসিক মাদেলা বলেছেন, ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাই ছিলো পুরাতন ব্যবস্থার ভিত্তি। দার্শনিকরা পুরাতন ব্যবস্থার দোষ ক্রুটি তুলে ধরে ঐতিহ্যের দীনতাকে তুলে ধরেন এবং বিপ্লবের ভাবতরঙ্গ সৃষ্টি করেন।

(২.) টকভিলের মতে, দার্শনিকরা পুরাতন ব্যবস্থার দোষক্রুটি তুলে ধরে এই ব্যবস্থার অসাড়তার দিকটি উন্মোচন করেন। তার মতে, জাতির দারিদ্র্যতার জন্য বিপ্লব হয় নি। তিনি দেখিয়েছেন, আঠারো শতকে ফান্সের বানিজ্যে শ্রী বৃদ্ধি ঘটেছিলো। ফরাসি কৃষকরা জমির মালিকানা পেয়েছিলো। মধ্যবিত্তরা সচেতন ছিলো। আগামী দিনের জন্য এক উন্নত সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রত্যাশার বিপ্লব হয়েছিলো। এই উন্নত সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন দার্শনিকরা।

(৩.) আইরিশ পন্ডিত এডমন্ড বার্কের মতে, দীর্ঘদিন ধরেই দার্শনিকরা ক্যাথলিক চার্চের কঠোর সমালোচনা করে সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলে আসছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে সমাজে অবক্ষয় শুরু হয়েছিলো। এই অবক্ষয়ের অন্যতম মূল কারন ছিলো চিন্তাজগতের দীনতা। সেই সময় ফ্রান্সে ক্যাথলিক চার্চ মানুষের চিন্তা ভাবনাকে নিয়ন্ত্রন করতো। চার্চের নানা ভন্ডামি, অনাচার ও দুর্নীতির দিক গুলিকে দার্শনিকরা সামনে নিয়ে আসেন। তারা অন্ধবিশ্বাসের বদলে যুক্তিবাদের কথা বলেন। এই যুক্তিবাদের ফলে মানুষ রাজার ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতার অযৌক্তিকতার দিকটি বুঝতে পারে। দার্শনিকরা মানুষের মনে যে নতুন আশার স্বপ্নজাল রচনা করেন তার পরিনতিতে বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয়।

(৪.) ঐতিহাসিক জি. রুডে তার "Revolutionary Europe" গ্রন্থে দেখিয়েছেন, কিভাবে রুশো, মন্তেস্কু ও ভলতেয়ারের রচনা মানুষের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। ফ্রান্সের বিভিন্ন পানশালা গুলিতে রীতিমত দার্শনিকদের মতবাদ নিয়ে চর্চা চলতো। অজন্মা, মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি নানা আর্থিক ক্ষোভ বিক্ষোভ থাকলেও, প্রকৃতপক্ষে দার্শনিকরাই ফ্রান্সে বিপ্লবের মানসিকতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।

মাথায় রাখতে হবে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষোভ থাকলেই বিপ্লব হয় না। তার জন্য চাই মানসিক প্রস্তুতি ও বিপ্লব মনস্কতা। ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকরা - (ক.) অসাম্য সমাজ ব্যবস্থা, (খ.) চার্চের দুর্নীতি ও ভন্ডামি, এবং (গ.) রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারীতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনা করে পুরাতনতন্ত্রের অসড়তার দিকটি তুলে ধরেন। সমাজের অবক্ষয় তখনই হয়, যখন চিন্তায় দেখা দেয় দীনতা। দার্শনিকরা এই চিন্তার দীনতাকে দূর করতে যুক্তিবাদের ওপর গুরুত্ব দেন। যুক্তিবাদের দ্বারা মানুষ প্রচলিত আর্থ - সামাজিক তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে যাচাই করতে চাইলেই বিপ্লবের ভাবতরঙ্গ জেগে ওঠে। 

মূল্যায়ন :-

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে সিদ্ধান্তে একথা বলা যায়, ফরাসি বিপ্লবের পিছনে দার্শনিকদের অবদান এবং ভূমিকা, দুটিই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তবে দার্শনিকদের ভূমিকা ও অবদান ঠিক "কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো", এই পরিমাপের উত্তরে বলা যায়, বিপ্লবের পশ্চাতে দার্শনিকদের ভূমিকা ছিলো অনেকটাই "পরোক্ষ ও দূরবর্তী"। কেননা দার্শনিকরা কেউ বিপ্লবী ছিলেন না। বিপ্লব চলাকালীন সময়ে কেউ বেঁচেও ছিলেন না। বিপ্লব করার কথাও তাদের কেউ বলেন নি। বিপ্লবের সঙ্গে দার্শনিকদের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বা যোগাযোগও ছিলো না। বিপ্লব কথার আক্ষরিক অর্থ হলো প্রচলিত ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। প্রচলিত গতানুগতিক সিস্টেমের বদলে নতুন ধাঁচ ও ধরনের প্রবর্তন। দার্শনিকরা বিপ্লবের কথা সুস্পষ্ট ভাবে না বললেও, প্রচলিত ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কথা বলে প্রকারান্তরে "বিপ্লবের" কথাই বলেছিলেন।

মনে রাখতে হবে, যে কোন বিপ্লবের জন্ম হয় প্রথমে মানুষের মনে। যতদিন পুরাতন সমাজ ব্যবস্থা ও পুরাতনতন্ত্রের প্রতি আস্থা ও আনুগত্য থাকে ততদিন বিপ্লব আসে না। দার্শনিকরা পুরাতনতন্ত্রের দুর্বলতা, দোষক্রুটি  ও সীমাবদ্ধতার দিক গুলির নিরন্তর সমালোচনা করে "প্রাচীন আমলের" প্রতি জনগনের শ্রদ্ধা ও আস্থা নষ্ট করে দেন এবং পরিবর্তন ও বিপ্লবের পক্ষে তাদের মানসিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।

সমালোচকরা বলেছেন, দার্শনিকদের রচনা সমাজের সাধারণ মানুষ পড়েন নি। ঠিক কথা। সমাজের সকলেই যে দার্শনিকদের রচনা পড়বেন, বুঝবেন, এমনটা আশা করা উচিৎ নয়। সমাজের কিছু সংখ্যক মানুষ দার্শনিকদের রচনা পড়েন এবং তারাই নেতৃত্ব দেন। অবশিষ্ট সমাজ সেই নেতৃত্বকে মেনে নেয়। ফরাসি দেশেও তাই হয়েছিলো। দার্শনিকরা পুরাতনতন্ত্রের নিরন্তর সমালোচনা করে পুরাতনতন্ত্রের সমর্থকদের মনোবল ভেঙে দেন এবং বিপ্লবের আগমনের পথকে সুনিশ্চিত করেন। সুতরাং একথা নিসংঙ্কোচে বলা যায়, ফরাসি বিপ্লবের প্রকৃত সলতে দার্শনিকরাই রচনা করে গিয়েছিলেন।

ফরাসি বিপ্লবকে দার্শনিকদের চিন্তাভাবনা যে কতখানি প্রভাবিত করেছিলো তার বহু প্রমান পাওয়া যায়। 
(১.) ১৮ মাসে মন্তেস্কুর "The spirit of Laws" এর ২২ টি সংস্করণ একেবারে নিঃশেষ হয়েছিলো। এতে ফ্রান্সে দার্শনিক মতের জনপ্রিয়তার প্রমান পাওয়া যায়।
(২.) একই ভাবে ১৭৬৫ খ্রিঃ দেনিস দিদেরো ও দ্য এলেমবার্টের বিশ্বকোষ গ্রন্থের ৪ হাজার কপি বিক্রি হয়।
(৩.) বিপ্লবের আগে এবং বিপ্লব চলাকালীন সময়ে ফ্রান্সের পানশালা গুলিতে দার্শনিকদের মতবাদ নিয়ে রীতিমত তর্কবিতর্ক চলতো
(৪.) ১৭৮৯ খ্রিঃ ২৬ আগষ্ট ফ্রান্সে যে "ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষনাপত্র" প্রচার করা হয়েছিলো, তাতে মন্তেস্কু ও রুশোর আদর্শের প্রভাব ছিলো অত্যন্ত স্পষ্ট।
(৫.) ১৭৯১ খ্রিঃ বিপ্লবী ফ্রান্সের প্রথম সংবিধান রচনার সময় মন্তেস্কুর "ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন" নীতিকে প্রয়োগ করা হয়েছিলো।
(৬.) ১৭৯৩ খ্রিঃ" প্রজাতান্ত্রিক সংবিধানে" রুশোর গন সার্বভৌমত্বের দাবিকে বাস্তবায়িত করা হয়েছিলো।
(৭.) এমনকি নেপোলিয়ন, যিনি নিজেকে "বিপ্লবের সন্তান" বলে দাবি করেছিলেন, তিনিও রুশো ও ভলতেয়ারের রচনা দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত ছিলেন।

উপরোক্ত এই সমস্ত তথ্যপ্রমান থেকেও বলা যায়, ফরাসি বিপ্লবের পশ্চাতে দার্শনিকরা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post