প্রশ্নোত্তরে ফরাসি বিপ্লব পর্ব - ০৪

ফরাসি বিপ্লবের সূচনা ও ঘটনাক্রম 


প্রশ্নোত্তরে ফরাসি বিপ্লব - পর্ব ০৪
প্রশ্নোত্তরে ফরাসি বিপ্লব - পর্ব ০৪


১. ১৭৯১ খ্রিঃ সংবিধান অনুসারে ফ্রান্সকে কটি প্রদেশ বা ডিপার্টমেন্টে ভাগ করা হয়?

উত্তর :- ৮৩ টি।

২. "অ্যাসাইনেট" কি?

উত্তর :- ফ্রান্সের সংবিধান সভা ফরাসি গির্জার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এবং ঐ সম্পত্তি আমানত রেখে তার সমমূল্যের একধরনের কাগজের নোট প্রচলন করে। ১৭৯০ খ্রিঃ প্রচলন করা এই কাগজের নোটকেই বলা হয় "অ্যাসাইনেট"।

৩. সিভিল লিস্ট কি? 

উত্তর :- সংবিধান সভা রাজপরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্য একটি খরচের তালিকা তৈরি করেছিলো। এই খরচের তালিকাকেই বলা হয় "সিভিল লিস্ট"। 

৪. সিভিল কনস্টিটিউশন অব দ্য ক্লার্জি কি?

উত্তর :- ১৭৯১ খ্রিঃ ফরাসি সংবিধান সভা ফ্রান্সের ধর্ম বিষয়ে যে আইন পাশ করে তাকে সিভিল কনস্টিটিউশন অব দ্য ক্লার্জি বলা হয়। এর দ্বারা ফ্রান্সের গীর্জার ওপর থেকে রোমের পোপের কর্তৃত্বের অবসান হয় এবং গীর্জার রাষ্ট্রের একটি দপ্তরে পরিনত হয়।

৫. কোহিয়ার কি ছিলো?

উত্তর :- ষোড়শ লুই জাতীয় সভার অধিবেশন ডাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর সকল শ্রেণীর প্রজাদের কাছ থেকে জাতীয় সভা সম্পর্কে তাদের প্রস্তাব ও অভিযোগ জানাতে বলেন। এগুলিকেই "কোহিয়ার" বলা হয়।

৬. ষোড়শ লুই পলায়ন করতে গিয়ে কোথায় ধরা পড়েন?

উত্তর :- ১৭৯১ খ্রিঃ ২০ জুন ষোড়শ লুই টুইলরি রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে অষ্ট্রিয়ার উদ্দেশ্যে পলায়ন করতে গিয়ে ফ্রান্স সীমান্তে অবস্থিত ভেরেন্নে গ্রামে জনতার হাতে ধরা পড়েন।

৭. পাদুয়ার ঘোষনাপত্র কে কবে প্রচার করেন?

উত্তর :- অষ্ট্রিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় লিওপোল্ড ১৭৯১ খ্রিঃ ৬ই জুলাই পাদুয়ার প্রচারপত্র প্রচার করেন। 

ষোড়শ লুই পলায়ন করতে গিয়ে ভেরেন্নে নামক গ্রামে ধরা পড়ার পর এই প্রচারপত্র প্রচার করে লিওপোল্ড ফরাসি রাজতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য ইওরোপীয় রাজন্যবর্গকে আহ্বান জানান।

৮. ব্রান্সউইক ঘোষনাপত্র কি?

উত্তর :- ১৭৯২ খ্রিঃ আগস্ট প্রাশিয়ার সেনাবাহিনীর প্রধান ব্রান্সউইক এক ঘোষনাপত্র প্রচার করে বলেন, ফ্রান্সের বিপ্লবী জনতা ফরাসি রাজ পরিবারের কোন ক্ষতি করলে প্যারিস নগরী ধ্বংস করা হবে। এই ঘোষনাপত্রকেই বলা হয় "ব্রান্সউইক ঘোষনাপত্র"।

৯. দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব কাকে বলে?

উত্তর :- লিওপোল্ডের পাদুয়ার ঘোষনাপত্র এবং ব্রান্সউইক ঘোষনাপত্রের পর ফ্রান্সের বিপ্লবী জনতার মনে বদ্ধমূল ধারনা হয় রাজা বিপ্লব ধ্বংসের জন্য বিদেশী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রান্সের জেকোবিন দলের নেতৃত্বে উত্তেজিত জনতা ১০ ই আগস্ট, ১৭৯২ খ্রিঃ রাজপ্রাসাদ আক্রমন করে রাজার দেহরক্ষী দলকে হত্যা করে। রাজা ও রানী প্রান ভয়ে আইনসভায় আশ্রয় নেন। উত্তেজিত জনতা আইনসভা ঘিরে রাজতন্ত্র উচ্ছেদের দাবি জানায়। শেষপর্যন্ত রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করে টেম্পল দুর্গের বিচারাধীন বন্দি হিসাবে রাখা হয়। এর ফলে রাজতন্ত্র ভেঙ্গে পড়ে এবং ১৭৯১ খ্রিঃ সংবিধান বাতিল হয়ে যায়। ঐতিহাসিক লেফেভরে এই ঘটনাকেই "দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব" বলে অভিহিত করেছেন।

১০. সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড কি?

উত্তর :- ১০ ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পর জেকোবিন দলের নেতৃত্বে উন্মোত্ত জনতা ২ থেকে ৭ ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্যারিসের কারাগার গুলিতে ঢুকে রাজপন্থী কয়েক হাজার বন্দিকে বিনা বিচারে হত্যা করে। অন্যান্য প্রদেশ গুলিতেও সেপ্টেম্বর মাসে এই হত্যাকান্ড চলে। একেই "সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড" বলা হয়।

১১. ন্যাশনাল কনভেনশন কি?

উত্তর :- ১৭৯২ খ্রিঃ গনভোটের মাধ্যমে ফ্রান্সে যে নতুন আইন সভা গঠিত হয়, তারই নাম ছিলো ন্যাশনাল কনভেনশন বা জাতীয় মহাসভা।

১৭৯২ খ্রিঃ ২১ সেপ্টেম্বর, জাতীয় মহাসভার প্রথম অধিবেশন বসে।

১২. "রাষ্ট্রকে বাঁচতে হলে রাজাকে মরতে হবে" - এটি কার উক্তি?

উত্তর :- জেকোবিন নেতা রোবসপিয়ারের উক্তি।

১৩. "আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার রক্ত ফ্রান্সের সুখ নিশ্চিত করুক" - এটি কার উক্তি?

উত্তর :- ষোড়শ লুইয়ের উক্তি।

১৪. ষোড়শ লুই কে কবে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়?

উত্তর :- ১৭৯৩ খ্রিঃ ২১ জানুয়ারি গিলোটিন নামক যন্ত্রে ষোড়শ লুইকে হত্যা করা হয়।

১৫. গিলোটিন কি? এটি কে আবিষ্কার করেন?

উত্তর :- গিলোটিন হলো শিরোচ্ছেদ করার একটি যন্ত্র। ফরাসি বিপ্লবে সন্ত্রাসের শাসন পর্বে এই যন্ত্রের ব্যাপক প্রয়োগ করা হয়।

গিলোটিন যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন ডক্টর গিলোটিন।

১৬. জেকোবিন ও জিরোন্ডিন কারা ছিলো?

উত্তর :- ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের দুটি রাজনৈতিক দল ছিলো যথাক্রমে জেকোবিন ও জিরোন্ডিন।

জেকোবিনদের সভা স্থানীয় জেকোবিন মঠের একটি হল ঘরে হতো বলে তাদের নাম এরূপ হয়েছিলো। এরা অত্যন্ত উগ্র স্বভাবের ছিলেন। ন্যাশনাল কনভেনশনে এরা বাম দিকে বসতো।

অন্যদিকে জিরোন্ডিন দলের বেশিরভাগ সভ্য ফ্রান্সের জিঁরোদ নামে একটি প্রদেশ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে এরা এরূপ নামে পরিচিত হন। ন্যাশনাল কনভেনশনে এরা ডান দিকে বসতো বলে এরা দক্ষিনপন্থী নামে পরিচিত ছিলো।

১৭. ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রথম শক্তি জোট কবে কাদের নিয়ে গঠিত হয়?

উত্তর :- ১৭৯৩ খ্রিঃ ইংল্যান্ড, অষ্ট্রিয়ার, প্রাশিয়া, স্পেন, পর্তুগাল, সার্ডিনিয়া ও নেপলস ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রথম শক্তি জোট গঠন করে।

১৮. জাতীয় কনভেনশনের দুটি রাজনৈতিক দলের নাম কর।

উত্তর :- জেকোবিন ও জিরোন্ডিন দল।

১৯. ব্রিসতিন কি?

উত্তর :- জিরোন্ডিন দলের নেতা বিসোর নাম অনুসারে ঐ দলকে ব্রিসতিন বলা হতো।

২০. মাউন্টেন কাদের বলা হতো?

উত্তর :- জেকোবিন দল ন্যাশনাল কনভেনশনের উঁচু আসন গুলিতে বসতো বলে তাদের মাউন্টেন বলা হতো।

২১. কোন ভারতীয় রাজা ফ্রান্সের জেকোবিন দলের সদস্য ছিলেন?

উত্তর :- টিপু সুলতান।

২২. জেকোবিন দলের কয়েকজন নেতার নাম বলো।

উত্তর :- রোবসপিয়ার, হিবার্ট, দাঁত।

২৩. সন্ত্রাসের শাসন বলতে কি বোঝা? ফ্রান্সে কোন সময়কালে সন্ত্রাসের শাসন শুরু হয়েছিলো? 

উত্তর :- ১৭৯৩ খ্রিঃ ষোড়শ লুইয়ের প্রানদন্ডের পর ফ্রান্সের ঘরে বাইরে যে সংকট দেখা যায়, তাকে মোকাবিলার জন্য জাতীয় কনভেনশনের জেকোবিন দল ফ্রান্সে যে কঠোর কেন্দ্রীভূত স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করে তাকেই সন্ত্রাসের শাসন বলা হয়।

ফ্রান্সে ১৭৯৩ খ্রিঃ ২ রা জুন থেকে ১৭৯৪ খ্রিঃ ২৭ জুলাই পর্যন্ত সন্ত্রাসের শাসন চলেছিলো।

২৪. ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের কয়েকজন নেতার নাম কর।

উত্তর :- রোবসপিয়ার ছিলেন সন্ত্রাসের শাসনের প্রধান নেতা। রোবসপিয়ার ছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন - হিবার্ট, দাঁতো।

২৫. রোবসপিয়ার কে ছিলেন?

উত্তর :- রোবসপিয়ার ছিলেন জেকোবিন দলের প্রধান নেতা। তার নেতৃত্বেই ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন শুরু হয়েছিলো। তিনিই ছিলেন ফ্রান্সের সন্ত্রাসের শাসনের প্রধান নায়ক।

২৬. সন্ত্রাসের শাসনের প্রধান সংগঠন গুলির নাম কর।

উত্তর :- (১.) জন নিরাপত্তা সমিতি, (২.) সাধারন নিরাপত্তা সমিতি, (৩.) সন্দেহের আইন, (৪.) বিপ্লবী বিচারালয়।

২৭. সন্দেহের আইন কি?

উত্তর :- সন্ত্রাসের শাসন কালের একটি কুখ্যাত আইন ছিলো সন্দেহের আইন। এই আইনের দ্বারা রাজপন্থী সন্দেহে যেকোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হতো এবং বিপ্লবী বিচারালয়ে তাদের বিচার করা হতো।

সন্ত্রাসের শাসনকালে সন্দেহের আইন প্রয়োগ করে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

২৮. বিপ্লবী বিচারালয় কি?

উত্তর :- সন্ত্রাসের শাসনকালের সময় প্রতিষ্ঠিত একটি আদালত ছিলো বিপ্লবী বিচারালয়। সন্দেহের আইনে যাদের গ্রেপ্তার করা হতো, বিপ্লবী বিচারালয় তাদের বিচার করে মৃত্যুদন্ড দিতো। 

২৯. গন নিরাপত্তা সমিতি কি? 

উত্তর :- ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন ছিলো গন নিরাপত্তা সমিতি। এই কমিটির হাতেই সন্ত্রাসের শাসনের যাবতীয় প্রশাসনিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিলো। শাসন পরিচালনা, অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার সমস্ত দায়িত্ব পালন করতো গন নিরাপত্তা সমিতি। প্রথমে ৯ জন, পরে ১২ জন সদস্যকে নিয়ে গন নিরাপত্তা সমিতির গঠন করা হয়েছিলো। 

৩০. ল অফ ম্যাক্সিমাম কি?

উত্তর :- সন্ত্রাসের শাসনকালে প্রনয়ন করা একটি আইন ছিলো ল অফ ম্যাকসিমাম। জিনিস পত্রের সর্বোচ্চ মূল্যকে যে আইন দ্বারা নির্ধারন করা হয়েছিলো। 

৩১. লাল সন্ত্রাস ও শ্বেত সন্ত্রাস বলতে কি বোঝা?

উত্তর :- জেকোবিন দলের নেতৃত্বে সন্ত্রাসের শাসনের সময় সন্দেহের আইন প্রয়োগ করে কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়। একে বলা হয় "লাল সন্ত্রাস"। 

১৯৯৪ খ্রিঃ ২৭ জুলাই রোবসপিয়ারের হত্যার পর সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটে। সন্ত্রাসের শাসনের অবসানের পর ন্যাশনাল কনভেনশনের বুর্জোয়া সদস্যদের নেতৃত্বে জেকোবিন দলের অবশিষ্ট নেতাকর্মীদের হত্যা করা হতে থাকে। এই হত্যাকান্ডকেই বলা হয় শ্বেতসন্ত্রাস। 

৩২. থার্মিডোরিয় প্রতিক্রিয়া কি?

উত্তর :- ১৭৯৪ খ্রিঃ ২৭ জুলাই, রোবসপিয়ার বন্দি ও ক্ষমতাচ্যুত হন। বিপ্লবী বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী থার্মিডোর মাসে এই ঘটনা ঘটে। রোবসপিয়ারের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে ১৭৯৫ খ্রিঃ অক্টোবর মাস পর্যন্ত ন্যাশনাল কনভেনশনের শাসনকাল চলে।

ন্যাশনাল কনভেনশনের শেষ ১৪ মাসের শাসনকাল সন্ত্রাসের নায়কদের হত্যাকান্ডে ব্যায় করা হয়। এইজন্য এই সময়কালকে "থার্মিডোরিয় প্রতিক্রিয়া" বলা হয়।

৩৩. ফ্রান্সে তৃতীয় বর্ষের সংবিধান কবে প্রনয়ন করা হয়?

উত্তর :- ১৭৯৫ খ্রিঃ ফ্রান্সে তৃতীয় বর্ষের সংবিধান প্রবর্তন করা হয়। প্রজাতান্ত্রিক ফ্রান্সের তৃতীয় বৎসরে এই সংবিধান রচিত হয়েছিলো বলে এর নামকরন করা হয় তৃতীয় বর্ষের সংবিধান। এই সংবিধান অনুযায়ী ফ্রান্সে ডিরেক্টরির শাসন শুরু হয়।

৩৪. ডাইরেক্টরির শাসন কাকে বলে?

উত্তর :- ১৭৯৫ খ্রিঃ তৃতীয় বর্ষের সংবিধান অনুযায়ী আইনসভার ৫ জন সদস্য বা ডাইরেক্টরির হাতে যাবতীয় শাসন ক্ষমতা ন্যাস্ত করা হয়। ডাইরেক্টদের দ্বারা পরিচালিত এই শাসন ব্যবস্থা "ডাইরেক্টরির শাসন" নামে পরিচিত ।

ফ্রান্সে ১৭৯৫ থেকে ১৭৯৯ খ্রিঃ পর্যন্ত চলেছিলো ডাইরেক্টরির শাসন।

৩৫. ফরাসি বিপ্লবের গুরুত্ব কি?

উত্তর :- ফরাসি বিপ্লবের ফলে - 
(১.) ফ্রান্সে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে ও প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়।
(২.) ফ্রান্সে বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থার অবসান ঘটে।
(৩.) ফ্রান্স থেকে সামন্তপ্রথার অবসান হয়।
(৪.)"ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষনাপত্রের" মাধ্যমে সকল নাগরিকদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার গুলি সুনিশ্চিত করা হয়।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post