ফরাসি বিপ্লবের সূচনা ও ঘটনাক্রম
১. ষোড়শ লুই কত খ্রিঃ ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন? সিংহাসন আরোহনের পর তার প্রধান সমস্যা কি ছিলো?
উত্তর :- ১৭৭৪ খ্রিঃ ষোড়শ লুই ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন।
সিংহাসন আরোহনের পর ষোড়শ লুইয়ের প্রধান সমস্যা ছিলো ফ্রান্সের আর্থিক সংকটের সমাধান করা। লুইয়ের সিংহাসন বসার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ফ্রান্সে আর্থিক সংকট প্রবল হয়ে দেখা যায়। রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। বাজেটে প্রবল ঘাটতি দেখা যায়। বৈদেশিক ঋনের পরিমান বৃদ্ধি পায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মারাত্মক আকার ধারন করে।
২. তুর্গো কে ছিলেন?
উত্তর :- ষোড়শ লুইয়ের অর্থমন্ত্রী ছিলেন তুর্গো।
৩. "আমি ও তুর্গো ছাড়া দেশকে কেউ ভালোবাসে না" - এটি কার উক্তি?
উত্তর :- এটি ষোড়শ লুইয়ের উক্তি।
৪. ষোড়শ লুই অর্থমন্ত্রী হিসাবে কাদের নিযুক্ত করেন?
উত্তর :- ষোড়শ লুই ফ্রান্সের আর্থিক সংকট দূর করার জন্য পর পর চারজন অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন। এরা ছিলেন যথাক্রমে - তুর্গো, নেকার, ক্যালোন, ব্রিয়েন।
৫. অভিজাত বিদ্রোহ কাকে বলে?
উত্তর :- ষোড়শ লুই প্রবল আর্থিক সংকটে অভিজাতদের ওপর কর বসালে, অভিজাতরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাজার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেন, সেটাই "অভিজাত বিদ্রোহ" নামে পরিচিত।
৬. অভিজাত বিপ্লব বলতে কি বোঝা?
উত্তর :- ফ্রান্সে অভিজাত বিদ্রোহকে ঐতিহাসিক জর্জ লেফেভর "অভিজাত বিপ্লব" বলে অভিহিত করেছেন।
ফ্রান্সে ষোড়শ লুই অভিজাতদের ওপর কর বসালে অভিজাতরা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং রাজার ক্ষমতা সঙ্কোচনের জন্য পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এটি রাজার দৈবসত্বের ভিত্তিমূলে আঘাত করে।
অভিজাত বিদ্রোহের চাপে শেষপর্যন্ত ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হন। স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হয়। সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটানোর জন্য অভিজাত বিদ্রোহকে "বিদ্রোহ" না বলে "অভিজাত বিপ্লব" নামে অভিহিত করা হয়।
৭. "টালির দিন" বা "Day of tiles" কাকে বলে?
উত্তর :- ১৭৮৮ খ্রিঃ ৭ ই জুন, ফ্রান্সের গ্রেনোবল নামক স্থানে সাধারন মানুষ বাড়ির ছাদ থেকে রাস্তার টহলরত সেনাবাহিনীর ওপর টালির টুকরো নিক্ষেপ করেছিলো। এই ঘটনাকে "টালির দিন" বা "Day of tiles" বলা হয়।
৮. স্টেটস জেনারেল কাকে বলে? এটি কোথায় অবস্থিত ছিলো?
উত্তর:- বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সের জাতীয় প্রতিনিধি সভার নাম ছিলো "স্টেটস জেনারেল"।
এটি ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে অবস্থিত ছিলো।
৯. ফ্রান্সে স্টেটস জেনারেলের নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো? ষোড়শ লুই কবে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করেন?
উত্তর :- ১৭৮৯ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে ফ্রান্সে স্টেটস জেনারেলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৭৫ বছর পর নতুন ভোট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফ্রান্সে স্টেটস জেনারেলের সদস্যদের নির্বাচন করা হয়।
নির্বাচনের পর ১৯৮৯ খ্রিঃ ৫ ই মে, ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করেন।
১০. স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন শুরু হবার পর তৃতীয় সম্প্রদায় কি কি দাবি তুলেছিলো?
উত্তর :- স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন শুরু হবার পর তৃতীয় সম্প্রদায় - (১.) স্টেটস জেনারেলে যৌথ অধিবেশন ও (২.) সম্প্রদায় ভিত্তিক ভোটদানের বদলে মাথাপিছু ভোটের দাবি উত্থাপন করে।
১১. "what is the Third Estate" গ্রন্থটি কার লেখা?
উত্তর :- অ্যাবে সিয়েসের লেখা। ১৭৮৯ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে এটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে তথ্য ও যুক্তি পেশ করে অ্যাবে সিয়েস দেখান, তৃতীয় সম্প্রদায়ই হলো ফ্রান্সের প্রকৃত জাতি।
১২. তৃতীয় সম্প্রদায় কবে নিজেদের কক্ষকে জাতীয় সভা বলে ঘোষনা করেন?
উত্তর :- ১৭৮৯ খ্রিঃ ১৭ জুন।
১৩. টেনিস কোর্টের শপথ বলতে কি বোঝা?
অথবা, টেনিস কোর্টের শপথ কখন নেওয়া হয়? এর নেতৃত্ব কারা দিয়েছিলেন?
অথবা, টেনিস কোর্টের শপথ কেন নেওয়া হয়েছিলো?
উত্তর :- ১৭৮৯ খ্রিঃ ২০ শে জুন মিরাব্যু ও অ্যাবে সিয়েসের নেতৃত্বে তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা টেনিস কোর্টের শপথ নেয়।
১৭৮৯ খ্রিঃ ২০ শে জুন, তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা স্টেটস জেনারেলে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখেন তাদের সভাকক্ষ তালাবন্ধ। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ তৃতীয় সম্প্রদায় অ্যাবে সিয়েস ও মিরাব্যুর নেতৃত্বে স্টেটস জেনারেলের পাশে টেনিস খেলার মাঠে সমবেত হয়ে শপথ নেন, যতদিন না ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান তৈরি হচ্ছে, ততদিন তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই চালিয়ে যাবেন। এই শপথনামাকেই বলা হয় "টেনিস কোর্টের শপথ"।
১৪. ফ্রান্সের ইতিহাসে টেনিস কোর্টের শপথের গুরুত্ব কি ছিলো?
উত্তর :- ১৭৮৯ খ্রিঃ ২০ জুন তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা টেনিস কোর্টের শপথ নেন। টেনিস কোর্টের শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে - (১.) তৃতীয় সম্প্রদায়ের ঐক্য আরোও বেশি সুদৃঢ় হয়। (২.) তৃতীয় সম্প্রদায় ফ্রান্সের জন্য একটি যুগপোযুগি সংবিধান রচনার সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে ফরাসি বিপ্লবের গতি ত্বরান্বিত হয়।
১৫. ষোড়শ লুই কবে তৃতীয় সম্প্রদায়ের মাথা পিছু ভোট ও যৌথ অধিবেশনের দাবি মেনে নেন?
অথবা, বুর্জোয়া বিপ্লব বলতে কি বোঝা?
উত্তর :- ১৭৮৯ খ্রিঃ ২৭ জুন, ষোড়শ লুই তৃতীয় সম্প্রদায়ের যৌথ অধিবেশন ও মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নেন। এর ফলে স্টেটস জেনারেলের বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের মূল দাবি গুলি জয়যুক্ত হয়। এই ঘটনাকেই বলা হয় "বুর্জোয়া বিপ্লব"।
১৬. ফ্রান্সের "জাতীয় সভা" কবে "সংবিধান সভায়" রূপান্তরিত হয়?
উত্তর :- ১৭৮৯ খ্রিঃ ৯ ই জুলাই স্টেটস জেনারেলের "জাতীয় সভা" ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনার কাজ শুরু করলে জাতীয় সভা "সংবিধান সভায়" রূপান্তরিত হয়।
১৭. বাস্তিল দুর্গের পতন কবে হয়? এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব কি ছিলো?
উত্তর :- ১৭৮৯ খ্রিঃ ১৪ ই জুলাই প্যারিসে জনতার আক্রমণে বাস্তিল দুর্গের পতন হয়।
বাস্তিল দুর্গের পতনের প্রধান গুরুত্ব ছিলো -
(ক.) বাস্তিল দুর্গ ছিলো স্বৈরাচারী শাসনের প্রতীক। বাস্তিলের পতনকে তাই স্বৈরাচারী শাসনের পতন বলে মনে করা।
(খ.) বাস্তিলের পতনের দিনটি ফ্রান্সে "জাতীয় দিবস" হিসাবে পালিত হয়।
(গ.) বাস্তিল দুর্গের পতনের পরেই রাজা ও অভিজাতরা তাদের মনোবল হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং
(ঘ.) প্যারিসের শাসনভার বুর্জোয়াদের হাতে চলে যায়।
১৮. প্যারিস কমিউন কি?
উত্তর :- প্যারিসে বাস্তিল দুর্গের পতনের পর প্যারিসের নিয়ন্ত্রন বুর্জোয়াদের হাতে চলে যায়। প্যারিস নগরে বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের দ্বারা পৌর স্বায়ত্ব শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। একেই বলা হয় "প্যারিস কমিউন"।
ষোড়শ লুই পরে প্যারিস কমিউন মেনে নিলে পরে অন্যান্য নগরীতেও অনুরূপ কমিউন গড়ে উঠেছিলো।
১৯. প্যারিস কমিউনে জাতীয় রক্ষী বাহিনী বা নাগরিক সেনাদল কার নেতৃত্বে গঠিত হয়?
উত্তর :- লাফায়েতের নেতৃত্বে গঠিত হয় "ন্যাশনাল গার্ড" বা "জাতীয় রক্ষী বাহিনী"।
২০. মহা আতঙ্ক বা "Great Fear" কি?
উত্তর :- প্যারিসের অভ্যুত্থান ও বাস্তিল দুর্গের পতনের পর ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চল গুলিতে তীব্র উত্তেজনা দেখা যায়। এই সময় গুজব রটে যায় যে, গ্রামের কৃষকদের শায়েস্তা করার জন্য অভিজাতদের ভাড়াটে গুন্ডা ও রাজার সেনাবাহিনী গ্রামে এগিয়ে আসছে। এর ফলে গ্রামাঞ্চলে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, যা "মহা আতঙ্ক" নামে পরিচিত।
মহা আতঙ্কে ক্ষুব্ধ কৃষকরা গ্রামীন অভিজাতদের বাড়ি আক্রমণ করলে ফ্রান্সে সামন্ততন্ত্রের পতনের পথ সুনিশ্চিত হয়।
২১. ফ্রান্সে কবে সামন্ততন্ত্রের বিলোপ করা হয়?
উত্তর :- ১৭৮৯ খ্রিঃ ৪ ঠা আগস্ট ফ্রান্সের "সংবিধান সভা" এক ঘোষনা মারফৎ সামন্তপ্রথা বিলোপ করা হয়।
২২. "ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার পত্র ঘোষনা কবে প্রচার করা হয়? এতে কি বলা হয়েছিলো?
উত্তর :- ১৭৮৯ খ্রিঃ ২৬ আগস্ট, সংবিধান সভা "ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার পত্রের" ঘোষনা করে।
এই ঘোষনাপত্রে বলা হয় -
(ক.) স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার,
(খ.) আইনের চোখে সবাই সমান,
(গ.) বাক্ স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা, সম্পত্তি ভোগের স্বাধীনতা মানুষের সার্বজনীন অধিকার,
(ঘ.) জনগনই হলো রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
২৩. রাজতন্ত্রের শবযাত্রা কোন ঘটনাকে বলা হয়?
উত্তর :- ১৭৮৯ খ্রিঃ ৫ই অক্টোবর, ফ্রান্সের একদল নারী খাদ্যের দাবিতে ভার্সাই শহরে উপস্থিত হন এবং ভার্সাই রাজপ্রাসাদ থেকে রাজাকে শোভাযাত্রা করে প্যারিসে নিয়ে আসেন। প্যারিসে নিয়ে আসার পরেই বুরবোঁ রাজতন্ত্রের পতনের পথ সুগম হয় বলে এই ঘটনাকে "রাজতন্ত্রের শবযাত্রা" বলে অভিহিত করা হয়।
২৩. ফ্রান্সের প্রথম সংবিধান কবে প্রবর্তন করা হয়? এর অভিনবত্ব কি ছিলো?
উত্তর :- ফ্রান্সের প্রথম সংবিধান ১৭৯১ খ্রিঃ প্রবর্তিত হয়। এটি ছিলো ফ্রান্সের প্রথম লিখিত সংবিধান।
২৪. পুরানোতন্ত্রের মৃত্যু পরোয়ানা কাকে বলা হয়?
উত্তর :- ১৭৮৯ খ্রিঃ ২৬ আগস্ট, ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার পত্রের ঘোষনাকে পুরানোতন্ত্রের মৃত্যু পরোয়ানা বলে অভিহিত করা হয়।
২৫. ফরাসি বিপ্লবের তিনটি আদর্শ কি ছিলো?
উত্তর :- সাম্য,মৈত্রী ও স্বাধীনতা ছিলো ফরাসি বিপ্লবের ৩ টি আদর্শ।