উনিশ ও বিশ শতকে ভারতে বিভিন্ন নারী সংঘ

প্রাক্ বিপ্লব ফ্রান্সে "সালোঁ" নামে একধরনের মেয়েদের বৈঠকখানা বসতো, যেখানে মেয়েদের পোশাক, গয়না, গৃহস্থলির নানা বিষয়, মেয়েদের সামাজিক নানা সমস্যা, নারী শিক্ষা, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে চর্চা চলতো।

সালোঁ নামক বৈঠকখানা খুব বেশিদিন টিকে ছিলো না ঠিকই, কিন্তু ফ্রান্সে সালোঁ থেকে নারীদের সংঘবদ্ধ হওয়ার ভাবনা এবং নারী কেন্দ্রীক বিভিন্ন বিষয় গুলির চর্চার দিকটি সমগ্র ইওরোপের নারীকুলকেই প্রভাবিত করেছিলো। এর ফলস্বরূপ ইওরোপে ধীরে ধীরে একাধিক নারী সংঘ বা সমিতি গড়ে উঠতে আরম্ভ করে। মূলত ইওরোপের অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত মেয়েরাই এই নারী সংঘ গুলি গড়ে তুলেছিলেন। এই নারী সংঘ গুলির হাত ধরে ইওরোপে নারীর অধিকার ও সম্মান প্রতিষ্ঠা, নারী শিক্ষার প্রসার, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য দূরিকরন, নারীর ভোটাধিকার প্রভৃতি বিষয় গুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এবং এ সম্পর্কে আন্দোলন দানা বেঁধেছিলো।

ইওরোপের অনুকরনে ভারতেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একাধিক নারী সংঘ সমিতি গড়ে উঠতে শুরু করে। এই নারী সংঘ সমিতি গুলি মূলত শিক্ষিত নারীরাই গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তীকালে এই সংঘ সমিতি গুলিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে ভারতীয় নারীরা নিজেদের "ক্ষমতা ও অধিকার" সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে তেমনি এই সংঘ সমিতির হাত ধরে তারা রাজনৈতিক দিকেও সচেতন হয়ে ওঠেন। এরই ফলস্বরূপ বিংশ শতাব্দীতে দলে দলে ভারতীয় নারীরা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে সামিল হন এবং দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন দুর্বার হয়ে ওঠে।

উনিশ ও বিশ শতকে ভারতে বিভিন্ন নারী সংঘ
উনিশ ও বিশ শতকে ভারতে নারী সংঘ 

প্রেক্ষাপট 

উনিশ শতক থেকে ভারতে নারী শিক্ষার প্রসার ভারতীয় নারীদের অনেক বেশি আত্মসচেতন করে তোলে। তারা নিজেদের সামাজিক অবস্থান, নিজেদের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। এটিও উপলব্ধি করে, সমাজে নারীকেন্দ্রীক সমস্যা গুলি সমাজে কোন নারীর একজনের সমস্যা মাত্র নয়, তা নারীদের সকলের সমস্যা। সুতরাং এই সমস্যার সমাধান সকল নারীদের একত্রিত করেই দূর করতে হবে। ভারতের শিক্ষিত নারীদের এই ভাবনা থেকেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে একের পর এক নারী সংঘ গড়ে উঠতে আরম্ভ করে। 

"শিক্ষা" নারীদের মধ্যে এনে দিয়েছিলো স্বাধীনতাবোধ এবং অধিকার বোধের চেতনা। এই চেতনার ফলেই নারীরা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে মধ্যযুগীয় সামাজিক এবং পারিবারিক প্রতিকূলতার বন্ধন শিথিল ও ছিন্ন করে সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। ফলস্বরূপ নারীকেন্দ্রীক একাধিক সভা সমিতি গড়ে ওঠে। 

বৈশিষ্ট্য 

ঊনবিংশ - বিংশ শতাব্দীর নারীকেন্দ্রীক সভা সমিতি গুলির টি মূল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় - 

(১.) শুরুর দিকে ভারতে নারী কেন্দ্রীক সভা সমিতি গুলি প্রতিষ্ঠা করেন পুরুষ সমাজ সংস্কারকরা। এক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
(২.) তবে পরের দিকে অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে মেয়েদের নেতৃত্বেই বিভিন্ন নারী কেন্দ্রীক সমিতি গুলি প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। 
(৩.) নারী সমিতি গুলির প্রায় সব গুলিই ছোট বড়ো শহরমফস্বল অঞ্চলে গড়ে উঠেছিলো। 
(৪.) প্রথম দিকের সভা সমিতি গুলি নারীদের শিক্ষার প্রসার এবং সমাজ সংস্কার মূলক বিভিন্ন কাজের বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছিলো। পরবর্তীকালে এই সভা সমিতি গুলিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নারীরা রাজনৈতিক দিক থেকে সচেতন হয়ে ওঠে এবং সক্রিয় ভাবে জাতীয় আন্দোলনে সামিল হয়। 

শেষপর্যন্ত দেখা যায়, এই সভা সমিতি গুলিই ভারতে নারী জাগরনের আখড়ায় পরিনত হয়।

বিভিন্ন নারী সংঘের বর্ননা 

ভারতে নারী সভা সমিতি প্রতিষ্ঠার কাজটি প্রথমে শুরু করেন পুরুষরাপরে সভা সমিতি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছিলেন মেয়েরা। 

(ক.) পুরুষ নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন নারী সংঘ

নারীদের সচেতন ও শিক্ষিত করে তোলার উদ্দেশ্যে ১৮৬৩ খ্রিঃ ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে গড়ে ওঠে "বামাবোধিনী সভা"। প্রতিষ্ঠানটি মেয়েদের জন্য কাজ করলেও, এর পুরোভাগে ছিলেন ব্রাহ্ম পুরুষরা। এরপর যথাক্রমে একে একে গড়ে ওঠে "ব্রাহ্মিকা সভা", "হিতৈষনী সভা", "বঙ্গমহিলা সমাজ" সহ একাধিক সংগঠন।

 মনে রাখতে হবে, শুরুর দিকে নারীদের নিয়ে গড়ে তোলা এই সমস্ত সভা সমিতি গুলিকে পরিচালনা করতেন নারীরা নয়, পুরুষরা। 

(খ.) নারী নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন নারী সংঘ 

বাংলায় সম্পূর্ণ নারী নেতৃত্বাধীন প্রথম নারী সংঘটি গড়ে ওঠে ১৮৮৬ খ্রিঃ। এই বছরটিতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা স্বর্নকুমারী দেবী প্রতিষ্ঠা করেন "সখী সমিতি"। এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো। তবে নারীদের স্বনির্ভর করে তোলার ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। 

এখানে মনে রাখতে হবে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে সখী সমিতির মতো একাধিক নারী সমিতি বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে আত্মপ্রকাশ করলেও, সেগুলি মূলত নারী শিক্ষার প্রসার, নারী উন্নয়ন এবং নারীকেন্দ্রীক নানা সামাজিক ভাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তবে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে নারী সমিতি গুলি এইসব অরাজনৈতিক নানা বিষয় ও কর্মসূচির পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মসূচির নানাবিধ দিক গুলিতে ক্রমশ ঝুঁকে পড়তে থাকে। 

(গ.) নারী সংঘে জাতীয়তাবাদের প্রবেশ 

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে সশস্ত্র আন্দোলন দেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটায়। এর ফলে নারী সমিতি গুলি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক আন্দোলনের শরিক হয়ে ওঠে। 

এই সময় বিদেশী পন্য বর্জন, স্বদেশী দ্রব্য উৎপাদন, চরকার ব্যবহার, পিকেটিং করা ইত্যাদি কর্মকান্ডে নারী সংঘ গুলি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ দিয়ে এই সময় একদিকে যেমন স্বদেশী আন্দোলনের "স্বদেশী কর্মসূচি"কে বলিষ্ঠতা প্রদান করা হয়, তেমনই এটির মধ্য দিয়ে নারীদের স্বনির্ভর করে তোলারও উদ্যোগ নেওয়া হয়। 

১৯১০ খ্রিঃ স্বর্নকুমারি দেবীর কন্যা সরলাদেবীর নেতৃত্বে লাহোরে "ভারত স্ত্রী মহামন্ডল" প্রতিষ্ঠিত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে এর শাখা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাই ছিলো ভারতের প্রথম সর্বভারতীয় মহিলা সংগঠন১৯১৭ খ্রিঃ মাদ্রাজে প্রতিষ্ঠিত হয় "women's Indian ASSOCIATION" (WIA)। এর শাখা দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলো। নারীর অধিকারবোধ বৃদ্ধির পাশাপাশি এই সংগঠন এডওয়াড মন্টেগুর কাছে পুরুষদের মতোই নারীদের ভোটাধিকারের দাবি জানিয়েছিলো। 

১৯২৫ খ্রিঃ লেডি টাটা ও বোম্বাইয়ের অন্যান্য শিল্পপতি মহিলাদের উৎসাহে প্রতিষ্ঠিত হয় "National council of women" (NCIW)। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত উচ্চবিত্ত নারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। ১৯২৭ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয় "All India women's conference"। এই প্রতিষ্ঠানটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল নারীদের আহ্বান জানিয়ে নারী শিক্ষা, নারীর ভোটাধিকার, সম্পত্তির অধিকার, পরিবার পরিকল্পনা, গ্রামোন্নয়ন ইত্যাদি নানা বিষয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করে। 

অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান্ধিজী জাতীয় কর্মসূচি গুলি পালনে নারীদের আহ্বান জানান। এর ফলে বহু নারী অন্তঃপুর থেকে নির্দ্ধিধায় বেরিয়ে আসবার অনুকূল পথের সন্ধান পায়। অসহযোগ আন্দোলনের সময় পিকেটিং, চরখা কাটা, খদ্দরের ব্যবহার ইত্যাদি গঠনমূলক কর্মসূচি গুলি পালন করার জন্য বাংলার জেলায় জেলায় নারী সত্যাগ্রহ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। 

এগুলি ছাড়াও অসহযোগ আন্দোলনের সময় উর্মিলা দেবী "নারী কর্মমন্দির", হেমপ্রভা মজুমদার "মহিলা কর্মী সংসদ" (১৯২২ খ্রিঃ) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমস্ত সমিতি গুলি জাতীয় আন্দোলনের গঠনমূলক কর্মসূচি গুলি পালন করার পাশাপাশি নারীদের স্বনির্ভর করে তোলারও চেষ্টা করে। 

বলা বাহুল্য, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতে যে জাতীয়তাবাদের প্লাবন দেখা দিয়েছিলো, তা অচিরেই নারী সংঘ গুলিকে প্রভাবিত করে। গান্ধিজী ডাক দিয়েছিলেন, "নারীদেরও স্বাধীনতার অধিকার আছে"। আর নারী সমাজ উপলব্ধি করেছিলেন, দেশের পূর্নাঙ্গ স্বাধীনতা ব্যতীত দেশের কোন সম্প্রদায়ের পক্ষেই এমনকি নারীদের পক্ষেও স্বাধীনতার অধিকার সম্পূর্ণ ভাবে লাভ করা সম্ভব নয়। 

এইজন্য নারীরা জাতীয় আন্দোলনে শুধুমাত্র জাতীয় গঠনমূলক কর্মসূচি গুলি পালন করেই সন্তুষ্ট থাকতে রাজি ছিলো না। এই সময় "আত্মশক্তি অর্জন", "নিজেদের যোগ্যতা ও সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা", সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতার জন্য "কিছু একটা করবার" অদম্য আকাঙ্ক্ষা তাদের মনকে বিচলিত করে তোলে। 

বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে প্রতিষ্ঠিত নারী সংঘ গুলিতে এই মানসিকতারই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এই সময় প্রতিষ্ঠিত হয় লীলা নাগের "দিপালী সংঘ", কল্যাণী দাশের "ছাত্রী সংঘ", শান্তিসুধা ঘোষের "শক্তিবাহিনী", লতিকা ঘোষের "মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ", লাবন্যপ্রভা চন্দ্রের "কন্যা শিক্ষালয়"। 

শেষ কথা 

আপাতভাবে নারী শিক্ষা, সমাজ সেবা, নারী উন্নয়নের নানাবিধ কর্মসূচির অন্তরালে এইসব সংঘ গুলিতে চলতে থাকে নারীদের নানা শরীরচর্চা, লাঠিখেলা, সাঁতার ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ। এসবের মূল উদ্দেশ্য ছিলো  শারীরিক দিক থেকে নারীদের সক্ষম ও নির্ভিক করে  মুক্তিযুদ্ধের উপযোগী করে তোলা। 

পরবর্তীকালে এই নারী সংঘ গুলিই হয়ে উঠেছিলো নারী বিপ্লবীদের আঁতুরঘর। এর মধ্যে বহু নারী সংঘ কোন না কোন বিপ্লবী দলের সঙ্গে গোপনে যুক্ত হয়ে পড়েছিলো। আবার বেশ কয়েকটি নারী সংঘ কোন বিপ্লবী দলের শাখা সমিতি হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলো।

এইভাবে দেখা যায়, ঊনবিংশ - বিংশ শতাব্দীতে নারীদের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠা এবং ঔপনিবেশিক অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়বার, গড়বার, জোট  বাঁধবার এবং নিজেদের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করবার ক্ষেত্রে নারী সংঘ গুলি এক বিরাট ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়েছিলো।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post