ঔপনিবেশিক আমলে আদিবাসী ও দলিত

ঔপনিবেশিক আমলে (১.) ইংরেজদের আর্থ - সামাজিক শোষন,(২.) পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার, (৩.) ১৮৭২ খ্রিঃ থেকে জাতিভিত্তিক জনগননায় বিভিন্ন শ্রেণীর আর্থ সামাজিক অবস্থানের চিত্র,(৪.) বিভাজন ও শাসন নীতির প্রয়োগ এবং বিশেষ কিছু শ্রেনীর সুবিধা লাভ ভারতবর্ষে বিভিন্ন শ্রেণীর পাশাপাশি আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়েরও শ্রেনী সচেতনতা বৃদ্ধি করেছিলো।

 এর ফলে উক্ত দুই শ্রেনী দীর্ঘ শ্রেনী শোষনের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে মুক্তি লাভের জন্য আন্দোলন শুরু করে এবং নিজেদের আর্থ - সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের জন্য এবং রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য সচেষ্ট হয়।

ঔপনিবেশিক আমলে আদিবাসী ও দলিত
ঔপনিবেশিক আমলে আদিবাসী ও দলিত 

আদিবাসী সম্প্রদায়


(১.) পরিচয় :- 

আদিবাসীরা হলেন ভারত ভূখন্ডের আদি বাসিন্দা বা মূল অধিবাসী। ভারতের আদি বাসিন্দা হওয়ার জন্যই এদের নামকরন করা হয় "আদিবাসী"। ইংরেজীতে এদের বলা হয় "Scheduled Tribes" বা ST । 

আদিবাসীরা বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত ছিলেন। যেমন - সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুন্ডা, ওরাও, হো, খন্দ, নাগাদ, ভারলি প্রভৃতি। ভারতে আদিবাসীদের প্রায় ২০০ টির অধিক উপজাতি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিলো। 


(২.) প্রাচীন ইতিহাস :-
 

ভারতের আদিবাসীদের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, আর্যরা ভারতে প্রবেশ করার পর বেশ কিছুদিন ধরে অনার্যদের সঙ্গে অর্থাৎ আদিবাসীদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিলো। এই সংঘাতে আদিবাসীরা পরাজিত হয় এবং সমতল অঞ্চল ত্যাগ করে আত্মরক্ষার্থে দূর্গম পাহাড়ী এলাকা ও বনাঞ্চলে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীকালে ঐ সমস্ত দূর্গম এলাকা গুলিতেই তারা তাদের বাসস্থান গড়ে তোলে। 

প্রাচীনকালে উত্তর পূর্ব ভারতের বেশ কিছুটা অঞ্চল দূর্গম ছিলো। তাই উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্য গুলিতে, যেমন আসাম, মনিপুর, মেঘালয়, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে বেশিরভাগ আদিবাসীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া, দূর্গম দক্ষিণ ভারতের কোন কোন অঞ্চলেও আদিবাসীরা বাস করতো।

আদিবাসীদের আর্যরা তাদের বর্ন বিভক্ত হিন্দু সমাজে অন্তর্ভুক্ত করে নি। তবে সংস্কৃতির দিক থেকে হিন্দুদের সঙ্গে তাদের বহু মিল লক্ষ্য করা যায়। 

প্রাচীন ও মধ্য যুগে আদিবাসীরা ভারতে প্রায় নিরুপদ্রোপে স্বাধীন ভাবেই জীবন কাটিয়ে ছিলেন। এই সময়কালের শাসকরা আদিবাসীদের ওপর কোন শোষন চালান নি বা তাদের জীবনধারায় কোনরূপ হস্তক্ষেপও করেন নি। তাই এই সময়কালে ভারতে কোন আদিবাসী বিদ্রোহ ঘটে নি। 

(৩.) ঔপনিবেশিক আমলে প্রভাব :- 

কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলে বিভিন্ন কারণে আদিবাসীদের জীবনে সংকট নেমে আসে। তাদের জীবন ও জীবিকা বিঘ্নিত হয় এবং তারা আত্মরক্ষার্থে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। 

মাথায় রাখতে হবে, ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী শোষন ও নিপীড়ন শুধু সমতল অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, তা দূর্গম, দুর্ভেদ্য অঞ্চল ভেদ করেও নিজের সর্বব্যাপী নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রন ও শোষন প্রতিষ্ঠা করে। এই সুবাদেই পরাধীনতার কালো ছায়া আদিবাসী সমাজে এসে পড়ে এবং সহজ সরল আদিবাসী জনমনে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। 

এর ফলে আদিবাসীরা শুধু তাদের ভূমি বা জমি হারাতে আরম্ভ করলেন না, তাদের চিরাচরিত অধিকার গুলিও হারাতে শুরু করলেন। একাধিক আর্থ - সামাজিক শোষনের শিকার হয়ে তাদের জীবন জীবিকায় সংকট নেমে আসে এবং খ্রিষ্ট ধর্ম ও ঔপনিবেশিক নিয়ম কানুনে তাদের সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিঘ্নিত হতে থাকে। এসবের কারনে আদিবাসী জনসমাজে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়। 

 (৪.) অসন্তোষ ও ক্ষোভের বহুবিধ দিক :- 

ঔপনিবেশিক শাসনের মূল ৪ টি দিক কমবেশী সকল  আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো ইংরেজদের - (ক.) ভূমিরাজস্ব নীতি, (খ.) অরন্য আইন, (গ.) আদিবাসীদের শ্রমের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়া, এবং (ঘ.) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনা ও শোষন। 

(ক.) ভূমিরাজস্ব নীতি :- 

ইংরেজরা ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তঅন্যান্য ভূমি বন্দোবস্তের প্রসার ঘটাতে গিয়ে আদিবাসী এলাকার জমি গুলিকেও নতুন ভূমিবন্দোবস্তের আওতায় নিয়ে আসেন। এর ফলে -

 (১.) আদিবাসীদের ওপর ভূমিরাজস্বের বোঝা চাপে যা পূর্বে কখনই ছিলো না। 
 (২.) আদিবাসী এলাকায় ধীরে ধীরে বহিরাগত জমিদার, ব্যবসায়ী ও মহাজনের প্রবেশ ঘটতে থাকে। 
(৩.) ইংরেজরা সহজ শর্তে আদিবাসী এলাকার জমি জমিদার ও ইজারাদারদের বন্দোবস্ত দেন। জমিদার ও ইজারাদাররা সুকৌশলে ধীরে ধীরে আদিবাসী এলাকায় ভূমি রাজস্বের পরিমান বাড়িয়ে দিতে থাকেন। 
(৪.) রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ইজারাদার ও জমিদাররা আদিবাসীদের জমির যৌথ মালিকানাকে  অস্বীকার করেন এবং ব্যক্তিমালিকায় গুরুত্ব দেন। ফলে আদিবাসীদের যৌথ সমাজ ব্যবস্থায় সংকট নেমে আসে। 
(৫.) আদিবাসীদের ওপর উচ্চহারে ও নগদে ভূমিরাজস্ব ধার্য হওয়ায়, অপারগ আদিবাসীরা দলে দলে মহাজনদের দ্বারস্থ হয় এবং তাদের কাছে চড়া হারে ঋন নিয়ে জমি গুলি হারাতে শুরু করেন। 
(৬.) আদিবাসী এলাকায় বহিরাগত ব্যবসায়ীরা প্রবেশ করে নানা ভাবে প্রতারনা করতে থাকে এবং সহজ সরল আদিবাসীদের অর্থনৈতিক দিকে ঠকাতে থাকে। 
(৭.) বহু এলাকায় রাজস্ব দিতে অপারগ আদিবাসীদের ইজারাদাররা জমি থেকে উচ্ছেদ করেন এবং তাদের ঐ সমস্ত জমিতে বহিরাগত কৃষকদের এনে জমি বন্দোবস্ত দেন। এইভাবে ধীরে ধীরে আদিবাসীদের জমি গুলি হাতছাড়া হয়ে যায় এবং তারা ভূমিচ্যুত হতে থাকেন। 

(খ.) অরন্য আইনের প্রভাব :- 

শুধু ভূমিরাজস্ব নীতি নয়, ঔপনিবেশিক আমলে অরন্য আইনের ফলেও আদিবাসী সমাজ নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৮৬৫ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার ঔপনিবেশিক অরন্য আইন পাশ করে। এই আইনের ফলে আদিবাসী সমাজের একটা বড়ো অংশ বন জঙ্গলের ওপর নিজেদের অধিকার হারান। 

এই আইনে গুরুত্বপূর্ণ অরন্য গুলি "সংরক্ষিত" ও "সুরক্ষিত অরন্য" বলে ঘোষনা করা হয়। ঐ সব অঞ্চলে আদিবাসীদের প্রবেশ,বনজ সম্পদ সংগ্রহ এবং বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যারা জোর করে অরন্যে প্রবেশ করে, তাদের "আইন অমান্যকারী" ও "অপরাধী" হিসাবে দেখা হয় এবং কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়। 

অরন্য আইন পাশের পর অরন্য অধ্যুষিত আদিবাসী এলাকা গুলিতে ব্রিটিশ সরকারের মদতপুষ্ট লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। আদিবাসী সমাজ জীবনে তাদের বারংবার হস্তক্ষেপ, প্রবেশ ও বিভিন্ন বাধানিষেধ সহজ সরল আদিবাসীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। 

কুখ্যাত অরন্য আইনের ফলে আদিবাসীরা - 

(১.) বনথেকে কাঠ, মধু ও অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহের অধিকার হারান। 
(২.) বনাঞ্চলে গো চারনের অধিকার হারান। 
(৩.) শিকার নিষিদ্ধ হওয়ায় আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও নিজস্ব জীবনধারা বিঘ্নিত হয়। 
(৪.) আদিবাসীদের একটা বড়ো অংশ আদিম পদ্ধতিতে ঝুমচাষের মাধ্যমে কৃষিকাজ করতো। কিন্তু ১৮৬৭ খ্রিঃ সরকার "সংরক্ষিত বনাঞ্চলে" ঝুমচাষ বন্ধ করায় আদিবাসী সমাজে খাদ্যের সংকট দেখা যায়। এছাড়া, 
(৫.) জঙ্গলের কাঠ, পশুর মাংস, মধু ইত্যাদি বনজ সম্পদ গুলি খোলা বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে তারা সরকারি লোকজন ও পুলিশের অত্যাচারের সম্মুখীন হন। 

এইভাবে দেখা যায়, অরন্য আইনের ফলে একাধিক দিক থেকে আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকায় ধীরে ধীরে সংকটের কালো ছায়া নেমে আসতে থাকে। এককথায়, অরন্য আইন "আদিবাসী অর্থনীতি"কে রক্তশূন্য করে দেয়।  

(গ.) শ্রমের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়া :- 

 ইংরেজদের ভূমিরাজস্ব নীতি এবং অরন্য আইনের ফলে আদিবাসীদের অর্থ উপার্জন ও কাজের ক্ষেত্র অনেকখানি সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিলো। এমতাবস্থায় ঔপনিবেশিক আমলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিমন্ডল ও পরিকাঠামোর মধ্যে আদিবাসী সমাজ কাজের অনুসন্ধান করতে থাকে। ইংরেজ পুঁজিপতিরা এই পরিস্থিতিতে আদিবাসীদের শ্রমকে খুব সহজলভ্য দামে ক্রয় করে। যেমন - 

(১.) আদিবাসীরা রেললাইন পাতার মতো কঠিন পরিশ্রমলব্ধ কাজে নিযুক্ত হয়। কিন্তু সেখানে তাদের নামমাত্র মজুরি দেওয়া হয়। 
(২.) একই ভাবে তাদের নামমাত্র মজুরিতে কফি, চা প্রভৃতি বাগিচা শিল্পে শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। (৩.) অনেক ক্ষেত্রেই আদিবাসীদের বিনা পারিশ্রমিকে বেগারও ঘাটতে হতো, শুধু ইংরেজ পুঁজিপতি ও কর্মচারীদের ঘরে নয়, জমিদার বাড়িতেও। 

(ঘ.) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনা ও শোষন :- 

শুধু অর্থনৈতিক শোষন নয়, আদিবাসীরা সামাজিক বঞ্চনারও শিকার হয়েছিলেন। মাঝে মধ্যেই ইংরেজ কর্মচারী ও তাদের অনুগ্রহপুষ্ট শ্রেনী গুলি আদিবাসী রমনীদের ধরে নিয়ে আসতেন এবং তাদের প্রতি অশালীন আচরন করতেন। উপরন্তু তারা আদিবাসীদের ঘৃনার চোখে দেখতেন এবং তাদের প্রতি নানা অভভ্য আচরনও করতেন।

এছাড়া, আদিবাসীদের সারল্যের সুযোগ নিয়ে খ্রিষ্টান মিশনারিরা আদিবাসী এলাকায় প্রবেশ করে জোর করে তাদের খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করতে থাকেন। এর ফলে আদিবাসীদের নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিপন্নতার মধ্যে পড়ে এবং তাদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। 

(৫.) মুক্তির উদ্যোগ :- 

জটিল, দুর্বোধ্য এবং একপেশে ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো ও বিচার ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার পাওয়ার কোন আশা ছিলো না। ভারতে কেউ তা পায় নি। আদিবাসীরাও পায় নি। 

তাই ন্যায়বিচার ও ব্রিটিশ সরকারের বহুবিধ শোষনের হাত থেকে মুক্তি লাভের জন্য আদিবাসীরা একের পর এক বিদ্রোহের পথ বেছে নেয় - 

(১.) ১৭৬৮ খ্রিঃ মানভূম, মেদিনীপুর ও বাঁকুড়ার আদিবাসী চুয়াড়রা বিদ্রোহ শুরু করে। 
(২.) ১৭৭৬ খ্রিঃ চট্টগ্রামের চাকমা উপজাতিরা বিদ্রোহ করে। 
(৩.) ময়মনসিংহের গারো উপজাতি এবং ত্রিপুরার কুকি উপজাতিরা ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করে। 
(৪.) ছোটনাগপুরের আদিবাসী কোল এবং বাংলা, ঝাড়খণ্ডের সাঁওতালরা যথাক্রমে ১৮৩১-৩২ এবং ১৮৫৫ খ্রিঃ বিদ্রোহ করে। 
(৫.) ছোটনাগপুরের  মুন্ডারা ১৮৯৯ খ্রিঃ এবং বিহারের ওরাওঁ উপজাতিরা ১৯১৪ - ১৫ খ্রিঃ বিদ্রোহ শুরু করে। 
(৬.) অন্ধ্রপ্রদেশের কুভাপনা, নেলোর প্রভৃতি পার্বত্য অঞ্চলের কিছু উপজাতি আদিম খাদ্য সংগ্রহের অধিকার খর্ব হলে ১৯১৩ খ্রিঃ বিদ্রোহ শুরু করে। 
(৭.) এছাড়া, গোদাবরী অঞ্চলে রাম্পা জনজাতি ১৯১৬ খ্রিঃ, ঊড়িষ্যার খোন্ডরা ১৯২৪ খ্রিঃ, রাজস্থানে ভীলরা ১৯১৩ খ্রিঃ বিদ্রোহ করে। 

ফলাফল 

আদিবাসীদের একের পর এক সশস্ত্র বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। আদিবাসীদের সশস্ত্র প্রতিরোধ ব্রিটিশ সরকারকে এতটাই আতঙ্কিত করে তোলে যে, সরকার যে সব অঞ্চলে বড়ো আকারে আদিবাসী বিদ্রোহ হয়েছিলো, সেখানে আদিবাসীদের "স্বতন্ত্র অধিকার ও পৃথক সত্ত্বার" বিষয় গুলি স্বীকার করে নেয়। যেমন - 

সাঁওতাল বিদ্রোহের পর তাদের পৃথক বাসস্থান তত্ত্বকে মেনে নিয়ে "সাঁওতাল পরগনা" গঠন করা হয়। চুয়াড় বিদ্রোহের পর গঠন করা হয় আলাদা প্রশাসনিক অঞ্চল "জঙ্গলমহল"। কোল বিদ্রোহের পর গঠন করা হয় "দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি" নামক প্রশাসনিক অঞ্চল। মুন্ডা বিদ্রোহের পর তাদের "খুৎকাঠি প্রথা" অর্থাৎ যৌথ মালিকানার বিষয়টি মেনে নেওয়া হয়। প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আদিবাসী এলাকায় বহিরাগত লোকজনের গতিবিধি নিয়ন্ত্রন করা হয় এবং আদিবাসীদের প্রথা ও রীতি নীতিকে বিশেষ মান্যতা দেওয়া হয়। 

তবে ভারতবর্ষে সমস্ত আদিবাসীদের প্রথা, রীতি নীতি ও ভৌগলিক অবস্থান এক ছিলো না। বহিরাগত সমাজ ও বিদেশী ইংরেজদের পক্ষে সেসব প্রথা ও রীতি নীতির গুরুত্ব উপলব্ধি করা সম্ভবও ছিলো না। তাই সমগ্র ব্রিটিশ শাসনকাল জুড়েই ভারতবর্ষে কোন না কোন অঞ্চলে আদিবাসী বিদ্রোহ ঘটেই চলেছিলো। জাতীয় সংগ্রাম চলাকালীন সময়ে অনেক উপজাতি গোষ্ঠী অনুকূল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলো এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলো।

ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের পর জাতীয় নেতৃবৃন্দ আদিবাসীদের পৃথক সত্ত্বা ও ন্যায়বিচারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। সংবিধানে আদিবাসীদের স্বতন্ত্র সত্ত্বাকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের "Scheduled Tribes" বলে ঘোষনা করা হয় এবং শিক্ষা, চাকুরী, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব প্রভৃতি বহুবিধ ক্ষেত্রে আদিবাসীদের সংরক্ষণের সুবিধা প্রদান করা হয়। আদিবাসীদের জমি যাতে বহিরাগত সম্প্রদায় ক্রয় করে তাদের ভূমিচ্যুত করতে না পারে, সেজন্য বিশেষ বিলও পাশ করা হয়। 

বলা বাহুল্য,এইসব ব্যবস্থা গুলির মাধ্যমে আদিবাসীদের দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। 



দলিত সম্প্রদায় 

(১.) পরিচয় :- 

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে যারা "অস্পৃশ্য" বা "অচ্ছুত" ছিলেন তারাই "দলিত" নামে পরিচিত। সংস্কৃত "দল" শব্দটি থেকে "দলিত" শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিলো। দলিতরা অস্পৃশ্য বা অচ্ছুত ছিলেন বলে যেখানে সেখানে যত্রতত্র তাদের স্বাধীন ভাবে ঘোরার বিধান ছিলো না। একসাথে দল বেঁধে বা দলবদ্ধভাবে তাদের চলতে হতো বলে তাদের নামকরন করা হয় "দলিত"। দলিত কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন জ্যোতিবা ফুলে১৯৩০ দশক থেকেই মূলত অস্পৃশ্যরা নিজেদেরকে দলিত বা নিপীড়িত বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। 

ইংরেজিতে দলিতদের "Depressed classes"বলা হয়ে থাকে। গান্ধীজি দলিতদের "হরিজন"(হিন্দু দেবতা হরি অর্থাৎ বিষ্ণুর জন বা মানুষ /ঈশ্বরের মানুষ) নাম  দিয়েছিলেন। ১৯৩৬ খ্রিঃ পরে অবশ্য সরকারি রেকর্ডে দলিত শব্দটি পাল্টে হয়ে দাঁড়ায় "তপসিলী জাতি"।

 ভারতের মোট হিন্দু জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ ছিলো দলিত। ভারতীয় সমাজ কাঠামোয় হাড়ি, ডোম, মুচি, মেথর, শবর, পুলিন্দ, মাহার, চামার, মালা, মেদিগা, হোয়েলা, এঝবা প্রভৃতি নীচু জাতি গুলি "দলিত" নামে পরিচিত ছিলো। বর্নহিন্দু সমাজ এদের "অচ্ছুত" বলতো এবং এদের ছোঁয়া এড়িয়ে চলতো। কারন এদের ছোঁয়া লাগলে বর্ন হিন্দুর জাত অর্থাৎ উচ্চবর্নত্ব নষ্ট হতো। 

(২.) প্রাচীন ইতিহাস :- 

হিন্দু বর্নব্যবস্থায় অস্পৃশ্যতার ধারনা জন্ম ও পেশার সঙ্গে সম্পর্কিত।

 বৈদিক আর্য সমাজ ৪ ভাগে বিভক্ত ছিলো। যথা - ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত, ক্ষত্রিয় বা যোদ্ধা, বৈশ্য অর্থাৎ কৃষক, বনিক ও সম্পদ উৎপাদক শ্রেনী এবং শূদ্র অর্থাৎ কায়িক শ্রমদানকারী (শারীরিক শ্রমদানকারী) শ্রেনী, যাদের কাজ ছিলো উক্ত তিন বর্নের সেবা করা। 

 বৈদিক যুগের পরবর্তীকালে উক্ত চার বর্নের পরস্পর  মিলনের ফলে (যেমন ব্রাহ্মনের সঙ্গে শূদ্রের) সমাজে কতকগুলি নতুন জাতির উদ্ভব ঘটে, যাদের "পঞ্চম" বা পঞ্চমজাতি /অতিশূদ্র /চন্ডাল বলা হয়। তাছাড়া, এইসময় বিদেশীদের ভারত আগমন ও অশাস্ত্রীয় বিবাহ নীতির ফলে ভারতীয় সমাজের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়। 

তাই ঋষি মনু ভারতীয় সমাজের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য চতুঃবর্ন প্রথার কঠোরতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এক বর্নের সঙ্গে অন্য বর্ন বা জাতির বিবাহে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এই নিষেধাজ্ঞা কঠোর ভাবে সমাজে বলবৎ করবার জন্য পরস্পর বিরোধী মিলনে উদ্ভুত নতুন জাতি গুলিকে অস্পৃশ্য বা অছুত বলে ঘোষনা করেন। খ্রীঃ তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে কোন এক সময়ে ভারতীয় সমাজে অস্পৃশ্যতার ধারনা বিকশিত হয়। 

অস্পৃশ্যরা যেহেতু সমাজে নিষিদ্ধ মিলনের ফলে উদ্ভূত ছিলেন এবং সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে শূদ্রশ্রেনীরও নীচে অবস্থান করতেন, (অস্পৃশ্যদের এইজন্য অতিশূদ্র বলা হতো) তাই সমাজের তথাকথিত একেবারে নিন্মতর কাজগুলি এই শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। নোংরা এবং দূষন ছড়ায় এমন সব  কাজ পেশাগত ভাবে পঞ্চমদের জন্য নির্দিষ্ট হয়। 

যারা নোংরা ও দূষণ ছড়ায় এমন সব কাজ পেশাগত ভাবে করেন, যেমন - মুচি (চামড়া, জুতো তৈরি), মেথর (নর্দমা, নোংরা পরিষ্কার), ডোম, চন্ডাল (মড়াপোড়ানো), ঝাড়ুদার, চামার (চামড়া তৈরি), তাদেরই সমাজে "অস্পৃশ্য" বলা হয়। কারন এইসব কাজ দূষন ছড়ায় বলে তাদের ছুঁলে দূষিত হতে হয়। তাই সমাজে দূষন রোধের জন্য পঞ্চমদের অস্পৃশ্য বা অচ্ছুত ( যাদেরকে ছোঁয়া নিষেধ) বলা হয়। 

(৩.) বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধ :- 

অচ্ছুতদের পেশাগত কাজ গুলি সমাজে অত্যন্ত অপরিহার্যঅত্যাবশ্যক ছিলো। এইজন্য অস্পৃশ্যদের হিন্দু সমাজ কাঠামোতে স্থান দেওয়া হয়। কিন্তু সমাজের অভ্যন্তরে এদের অবাধ যাতায়াত ও গতিবিধিকে নানা ভাবে নিয়ন্ত্রন করা হয়। যেমন - 

১. সমাজের উচ্চবর্নের সঙ্গে মেলামেশা, তাদের গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ,একাসনে খাদ্যগ্রহনের কোন বিধান এদের ছিলো না। 
২. সমাজের সাধারন বা উচ্চশ্রেনীর সঙ্গে একসঙ্গে শিক্ষা গ্রহণের কোন অধিকার এদের ছিলো না। 
৩. হিন্দু মন্দিরে প্রবেশের কোন অধিকার ছিলো না। 
৪. সর্বসাধারনের জন্য বা উচ্চবর্নের জন্য নির্দিষ্ট পুকুর বা কুয়ো ব্যবহারের বিধিও এদের ছিলো না। 
৫. এমনকি উচ্চবর্নের জন্য নির্দিষ্ট রাস্তাতে চলাফেরার বিধানও এদের দেওয়া হয় নি। 

অস্পৃশ্যরা গ্রামের একেবারে সীমান্তে বাস করতেন গ্রামে বা নগরে অথবা উচ্চবর্নের এলাকায় প্রবেশের সময় দলিত বা অস্পৃশ্যদের ঘন্টা বাজিয়ে একসঙ্গে দল বেঁধে প্রবেশ করতে হতো। 

(৪.) দলিত আন্দোলনের সূত্রপাত :- 

দলিতরা সমস্ত রকমের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্মান ও অধিকার থেকে ছিলেন বঞ্চিত। প্রাচীনকাল থেকেই তারা উচ্চবর্নের বিশেষত, ব্রাহ্মনদের অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন। ঔপনিবেশিক আমলেও এর অন্যথা হয় নি। 

শেখর বন্দোপাধ্যায় তার "পলাশী থেকে পার্টিশান" গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ভারতে মোট জনসংখ্যার মাত্র তিন শতাংশের কম হয়েও, ব্রাহ্মনরা ঔপনিবেশিক আমলে প্রায় ৪২ শতাংশ সরকারি চাকরি কুক্ষিগত করে রেখেছিলো। শিক্ষা, চাকুরী, নেতৃত্ব, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মনদের একচেটিয়া প্রাধান্য ছিলো। এই প্রধান্যের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্তির জন্য দলিতরা উদ্যোগী হয় ও আন্দোলন শুরু করে। 

দলিত আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্ব :- 

ইংরেজ আমলে শিক্ষা, চাকুরী, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক কাঠামো ভারতের প্রতিটি শ্রেনীকে আত্মসচেতনতা ও অধিকারবোধে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিলো। দলিত শ্রেনীও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। 

ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামো প্রাচীন যুগের মতো ব্রাহ্মন সর্বস্ব বা ব্রাহ্মন নিয়ন্ত্রিত ছিলো না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মোটামুটি সকল ভারতীয়র জন্যই পাশ্চাত্য শিক্ষার দরজা উন্মুক্ত ছিলো। ফলে ঔপনিবেশিক আমলে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে বেশ কিছু দলিত ব্যক্তি "নেতৃত্ব" দিয়ে ব্রাহ্মন আধিপত্যের বিপরীতে দলিতদের স্বতন্ত্র অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হন এবং আন্দোলন শুরু করেন। 

এইসব দলিত নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - জ্যোতিবা ফুলে, নারায়ন গুরু, বীরসালিঙ্গম পান্টালু, রামস্বামী নায়িকার, রামস্বামী মুদালিয়া, ড. ভীমরাও আম্বেদকর এবং আরোও অনেকে। 

এরা ব্রিটিশ "ঔপনিবেশিক কাঠামোতে" দলিতদের "আর্থ - রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা" এবং "ভারতের সমাজ কাঠামোতে" দলিতদের দীর্ঘ বঞ্চনা ও শোষনের অবসান ঘটিয়ে তাদের যোগ্য "সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার" প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। 

দলিত আন্দোলনের প্রকৃতি :- 

ঔপনিবেশিক আমলে দলিত আন্দোলনের ৩ টি ধরন বা প্রকৃতি লক্ষ্য করা যায়। যথা - 

(১.) সংস্কার আন্দোলন (Reformative Movement), 
(২.) সংস্কৃতায়ন আন্দোলন (Sanskriti station Movement), এবং 
(৩.) বিকল্প আন্দোলন (Alternative Movement), 

(১.) সংস্কার আন্দোলন :- 

সংস্কার আন্দোলনের মূল বক্তব্য ও লক্ষ্য ছিলো, হিন্দু সমাজের বর্ন কাঠামোর মধ্যে থেকেই অস্পৃশ্যতার অবসান করা। 

আর্যসমাজ সর্বপ্রথম এই ধরনের আন্দোলন শুরু করে। তারা অহিন্দুদের পাশাপাশি অস্পৃশ্যদেরও হিন্দু বর্ন কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচার চালায়। এইজন্য আর্যসমাজ শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করেছিলো। অস্পৃশ্যরাও যে হিন্দু, এবং তারা হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন অংশ বা সম্প্রদায় নয় - আর্যসমাজ এটি প্রচার করে। 

বলা বাহুল্য, ইতিপূর্বে হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্য বা দলিতদের সামাজিক দিক থেকে ব্রাত্য বা উপেক্ষিত করে রাখা হয়েছিলো। আর্যসমাজ এর বিরুদ্ধে প্রচার চালায়। তবে শুধু আর্যসমাজ নয়, বোম্বের প্রার্থনা সমাজও অস্পৃশ্য বা দলিতদের কল্যানের জন্য "Depressed class Mission Society" প্রতিষ্ঠা করে। 

আর্যসমাজ এবং প্রার্থনা সমাজ দুটি সংগঠনই বিশ্বাস করতো অস্পৃশ্যতা হিন্দু সমাজের একটি সামাজিক সমস্যা। সুতরাং তা দূর করার জন্য কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নিস্প্রয়োজন। 

অস্পৃশ্যতা দূরিকরনে আর্যসমাজ এবং প্রার্থনা সমাজের সংস্কার আন্দোলনের পরবর্তী উত্তরসূরী ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। আর্য সমাজের মতো মহাত্মা গান্ধীও বিশ্বাস করতেন হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্যতা একটি সামাজিক সমস্যা। সুতরাং অস্পৃশ্যদের প্রতি উদার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটলেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এইজন্য তিনি উচ্চবর্নের মানুষদের অস্পৃশ্যদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলের পরামর্শ দেন। 

অস্পৃশ্যরাও যে হিন্দু সমাজেরই অংশ, সেটি বোঝাতে তিনি অস্পৃশ্যদের হিন্দু দেবতা হরির নামানুসারে নতুন নামকরন করেন "হরিজন"। গান্ধীজি হরিজনদের জন্য হিন্দু ধর্মের অবরুদ্ধ মন্দিরগুলির দরজা খুলে দেওয়ার অনুরোধ করেন। এমনকি অস্পৃশ্যদের প্রতি যাবতীয় ঘৃনা, অবজ্ঞা দূর করার জন্য সামাজিক সচেতনতারও প্রচার চালান। হিন্দু মন্দির ছাড়াও, পুকুর, জলাশয়ের মতো সামাজিক স্থান গুলির অবরুদ্ধ দরজা অস্পৃশ্যদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য উচ্চবর্নের কাছে অনুরোধ করেন। 

মাথায় রাখতে হবে, গান্ধীজি অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা করলেও হিন্দু ধর্মের র্বন কাঠামোকে অস্বীকার করেন নি। ভেঙ্গে ফেলারও কথা বলেন নি। আসলে আর্য সমাজের মতো তিনিও বর্ন কাঠামোর মধ্যে থেকেই অস্পৃশ্যতা বা দলিত সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন। 

মোটকথা, অস্পৃশ্যতা বা দলিত সমস্যাকে সংস্কার আন্দোলনকারীরা একটি "সামাজিক সমস্যা" হিসাবে দেখেছিলেন। এই সামাজিক সমস্যাকে তারা "উদারনৈতিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারনের" দ্বারা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হন নি। 

(২.) সংস্কৃতায়ন আন্দোলন :- 

নিজেদের সামাজিক অবস্থানকে উচ্চতর বর্নকাঠামোয় স্থাপন করার জন্য দলিতরা যে আন্দোলন চালিয়েছিলো তাকেই বলা হয় "সংস্কৃতায়ন আন্দোলন"। 

সংস্কৃতায়ন আন্দোলনও ছিলো একটি সামাজিক আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দলিত জাতি "বর্ন - হিন্দুদের" ঘৃণা ও অবজ্ঞা থেকে মুক্তি লাভের জন্য এবং নিজেদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের উচ্চবর্নভুক্ত বলে দাবি করতে থাকে। একে সংস্কৃতায়ন আন্দোলন এইজন্য বলা হচ্ছে, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দলিতরা তাদের পূর্ব সংস্কার অর্থাৎ আচার আচরন ও পালনীয় সামাজিক নিয়মবিধি পরিত্যাগ করে উচ্চবর্নজাত সংস্কার গুলি গ্রহন করেন। 

সংস্কৃতায়ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে - 

(১.) জৌনপুরের চামার জাতি নিজেদেরকে "শিবনারায়ন" সম্প্রদায় বলে দাবি করে এবং ব্রাহ্মনদের পালনীয় আচার আচরণ ও সামাজিক নিয়ম বিধি গুলি অনুসরন করতে থাকে। 
(২.) তামিলনাড়ুর অস্পৃশ্য পল্লার জাতি নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে দাবি করে। 
(৩.) বাংলার পৌন্ড্র বা নমঃশূদ্ররা নিজেদের আর্য সম্প্রদায়ভুক্ত বলে ঘোষনা করে। তারা নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে দাবি করে। অস্পৃশ্যতা ও শূদ্রত্বের গ্লানি মোচনের  জন্য তারা ৩০ দিনের বদলে ক্ষত্রিয়ের মতো ১২ দিন অশৌচ পালন করতে শুরু করে। এছাড়া উচ্চবর্নের মতো তারা পৈতেও ধারন করতে শুরু করেন। 
(৪.) উত্তরবঙ্গের রাজবংশি সম্প্রদায় শূদ্রত্ব মোচনের জন্য নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে দাবি করে। এদের নেতৃত্ব দেন পঞ্চানন বর্মা। রাজবংশিদের মধ্যে প্রথম এম. এ পঞ্চানন বর্মা রাজবংশিদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। 

(৩.) বিকল্প আন্দোলন :- 

সংস্কার আন্দোলন এবং সংস্কৃতায়ন আন্দোলন প্রকৃতিগত দিক থেকে ছিলো নরমপন্থী আন্দোলন। সমাজের উচ্চবর্ন বিশেষত ব্রাহ্মনদের বিরোধিতার ফলে এই দুই আন্দোলন সেভাবে সফলতা লাভ করতে পারে নি। এর ফলশ্রুতিতেই দানা বাঁধতে শুরু করেছিলো দলিতদের বিকল্প আন্দোলন

এই বিকল্প আন্দোলন সংস্কার আন্দোলন এবং সংস্কৃতায়ন আন্দোলন থেকে প্রকৃতিগত দিক থেকে ছিলো অনেক বেশি উগ্র ও চরমপন্থী। বিকল্প আন্দোলন দলিত অধিকার অর্জনের জন্য ব্রাহ্মন্যবাদের বিরোধিতা করেছিলো এবং রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো। অর্থাৎ বিকল্প আন্দোলন বিশ্বাস করতো দলিত বা অস্পৃশ্য সমস্যা শুধু সামাজিক সমস্যা নয়। একটি আর্থ-রাজনৈতিক সমস্যা। সুতরাং শুধুমাত্র সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলের মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। 

ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ গুলিতে শুরু হয়েছিলো একের পর এক দলিত আন্দোলন। 

(ক.) মহারাষ্ট্র দলিত আন্দোলন :- 

ভারতে দলিত আন্দোলনের পথ প্রদর্শক ছিলেন মহারাষ্ট্রের জ্যোতিরাও ফুলে। তথাকথিত নিন্মবর্গীয় মালি পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং উচ্চ বর্ণের শোষনের শিকার হয়েছিলেন। 

১৮৬০ দশকে তিনি কুনবি, মালি, মাহার প্রভৃতি নিন্মবর্গের মানুষদের নিয়ে ব্রাহ্মন বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। শূদ্রের ওপর ব্রাহ্মনদের অত্যাচারের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য তিনি ১৮৭৩ খ্রিঃ লেখেন "গুলামগিরি" নামক গ্রন্থ । ঐ বছরেই তিনি নির্যাতিত নিন্মবর্গের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য "সত্যশোধক সমাজ" প্রতিষ্ঠা করেন। 

জ্যোতিরাও অস্পৃশ্যদের জন্য একাধিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের চেষ্টা চালান। তার মতে "শিক্ষা" এবং "সংগঠন" এমন দুই উপায়, যা ঐক্য এবং আত্মপরিচয়বোধ সৃষ্টি করবে। 

বলা বাহুল্য, শিক্ষা এবং সংগঠনের মধ্য দিয়ে জ্যোতিরাও ফুলে দলিত জাগরনের যে পথনির্দেশ দিয়ে যান, তা পরবর্তীকালের দলিত সংস্কারকদের ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছিলো। ড. বাবাসাহেব ভীমরাও রামজী আম্বেদকর জ্যোতিরাও ফুলের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে মহারাষ্ট্রের দলিত আন্দোলনকে সর্বভারতীয় আন্দোলনে পরিনত করেছিলেন।

(খ.) কেরালায় দলিত আন্দোলন :-

কেরালায় দলিত আন্দোলনের ক্ষেত্রে শ্রী নারায়ণ গুরু বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। কেরালায় নিন্মবর্গীয় এজভাদের নিয়ে তিনি অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯০২ - ৩ খ্রিঃ তিনি অস্পৃশ্যদের মন্দিরে প্রবেশাধিকারের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। তার আন্দোলন এজভাদের মধ্যে শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতার জাগরন ঘটায়। ক্রমে দক্ষিণ ভারতের সর্বত্র অস্পৃশ্যরা মন্দিরে প্রবেশাধিকারের জন্য একের পর এক আন্দোলন করতে থাকেন । 

(গ.) তামিলনাড়ুতে দলিত আন্দোলন :- 

তামিলনাড়ু বা মাদ্রাজে দলিত আন্দোলন সংগঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দেন রামস্বামী নাইকার। তিনি সমাজে জাতি ভেদ, অস্পৃশ্যতা, মনুবাদ এবং উচ্চ বর্ণের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। রামস্বামী তার আন্দোলনের নতুন নামকরন করেন "সেলফ রেসপেক্ট" (self Respect)। 

রামস্বামী "কুডি আরাসু" পত্রিকার মাধ্যমে তামিল দলিত জাগরনের চেষ্টা করেন। তিনি ব্রাহ্মন্যবাদকে তীব্র ভাবে আক্রমণ করেন এবং ব্রাহ্মন পুরোহিত ছাড়া শুভকর্ম সম্পাদন, বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পাদন, প্রকাশ্যে মনুস্মৃতি পোড়ানো, বলপূর্বক মন্দিরে প্রবেশ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করেন। রামস্বামী রামায়নের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতিকে বহিরাগত ও আক্রমণকারী  বলে ঘোষনা করেন এবং রাবনকে প্রকৃত বীর ও দেশপ্রেমিক বলে তুলে ধরেন। 

১৯১৬ খ্রিঃ ড. সি নাতেসা মুদালিয়ার অব্রাহ্মন প্রতিনিধিত্বের জন্য মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে জাস্টিস পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জাস্টিস পার্টি কংগ্রেসকে ব্রাহ্মনতন্ত্র ও উচ্চবর্নের প্রতিনিধিত্বের প্রতিষ্ঠান বলে মনে করতো। জাস্টিস পার্টিই ছিলো দলিতদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন। ১৯২০ খ্রিঃ মাদ্রাজ বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে জাস্টিস পার্টি মন্ত্রীসভা গঠন করে। 

তবে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় জাতীয় কংগ্রেসের তুমুল জনপ্রিয়তায় কংগ্রেস বিরোধী জাস্টিস পার্টি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। রামস্বামী জাস্টিস পার্টিকে নতুন করে সংগঠিত করেন এবং তার নাম বদলে রাখেন "দ্রাবিড় মুনাত্রা কাজাগাম বা D. M. K

(ঘ.) বাংলাতে দলিত আন্দোলন :- 

বাংলায় দলিত আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাপ রাখেন পৌন্ড্র বা নমঃশূদ্ররা। এরা পূর্ববাংলায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে থাকতেন এবং চন্ডাল বা চাঁড়াল নামে পরিচিত ছিলেন। সমাজের উচ্চবর্নের লোকেদের বিশেষকরে ব্রাহ্মনদের শোষনের শিকার হয়েছিলেন এরা। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য ১৮৭২ খ্রিঃ হরিচাঁদ বিশ্বাস (ঠাকুর) এবং গুরুচাঁদ বিশ্বাস (ঠাকুর) বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন শুরু করেন।

 গুরুচাঁদ চন্ডালদের নতুন নামকরন করেন নমঃশূদ্র। ঊনবিংশ শতকের তিনের দশক থেকে নমঃশূদ্ররা ব্রাহ্মন্য আচার বর্জন করে "মতুয়া ধর্ম" অনুযায়ী তাদের এক নতুন সমাজ ও ধর্ম সংগঠন তৈরি করেন। এই সম্প্রদায় ১৯৩০ খ্রিঃ "All India Depressed class Association" গঠন করে দলিতদের রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের জন্য লড়াই শুরু করেন। 

১৯২০ খ্রিঃ পর দলিত আন্দোলনের বিস্তার

১৯২০ খ্রিঃ পর দলিত আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং উত্তরপ্রদেশে দলিত আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করেছিলো। ১৯২৪ খ্রিঃ রামস্বামী মুদালিয়ার নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতের বেলগাঁওয়ে একটি দলিত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে দলিত আন্দোলনকে সংগঠিত করতে এগিয়ে আসেন বাবা সাহেব আম্বেদকর। তার নেতৃত্বে দলিত আন্দোলন গুলি এক ছত্রছায়ায় সর্বভারতীয় রূপ লাভ করে। 

দলিত সমস্যার প্রতি কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি :- 

প্রথম দিকের কংগ্রেসে উচ্চবিত্ত শ্রেনীর প্রাধান্য থাকায় কংগ্রেস নেতৃত্ব ১৯১৭ খ্রিঃ পর্যন্ত দলিতদের সমস্যার বিষয়টি উপেক্ষা করে। ১৯১৭ খ্রিঃ পর থেকে অর্থাৎ গান্ধীজি কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পর থেকেই কংগ্রেস দলিত সমস্যার বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করে। 

প্রকৃতপক্ষে গান্ধীজিই প্রথম অস্পৃশ্যতা বর্জনের গুরুত্বের বিষয়টি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেন। ১৯২০ খ্রিঃ অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিতে গান্ধীজি অস্পৃশ্যতা দূরিকরনকে অন্তর্ভূক্ত করেন।

 তবে গান্ধীজি মুখে অস্পৃশ্যতা দূরিকরনের কথা বললেও, ব্রাহ্মন্যবাদের বিরোধীতা করেন নি। উল্টে হিন্দু বর্নাশ্রম কাঠামোকে সমর্থন করতেন। ফলে দলিতরা কংগ্রেসের দলিত আন্দোলনে সেভাবে আস্থা রাখতে পারে নি। আর কংগ্রেসও দলিত সমস্যার সমাধানে খুব বেশি আন্তরিকও ছিলো না। এর সবথেকে বড়ো প্রমান মেলে, যখন দেখা যায় কংগ্রেস অসহযোগ আন্দোলনের পর দলিত সমস্যার বিষয়টি নিয়ে একেবারেই উদাসীন হয়ে পড়ে। আইন অমান্য আন্দোলনের পর গান্ধীজি দলিত সমস্যার জন্য হরিজন আন্দোলন সংগঠিত করলেও তা দলিতদের সামাজিক সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থই হয়।

কংগ্রেসে গান্ধীর পরবর্তী উত্তরসূরী নেহেরু জাতপাতের রাজনীতি নিয়ে একেবারেই অনাগ্রহীনিরুৎসাহি ছিলেন। ফলে কংগ্রেসী আন্দোলনে দলিতদের কাঙ্খিত অধিকার প্রতিষ্ঠার কোন জায়গাই ছিলো না। এমতাবস্থায় দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন ড. বাবাসাহেব ভীমরাও রামজী আম্বেদকর

দলিত আন্দোলনে আম্বেদকরের ভূমিকা :- 

গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের (১৯২২) পরের বছরই ১৯২৩ খ্রিঃ আম্বেদকর ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরেন এবং দলিত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। 

আম্বেদকর অস্পৃশ্য সম্প্রদায় থেকে উঠে এসেছিলেন। মহারাষ্ট্রের অস্পৃশ্য মাহার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং শৈশব থেকেই উচ্চবর্নের নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই দলিতদের যোগ্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আন্দোলন সংগঠিত করেন। 

(১.) হিন্দুসমাজের মূল স্রোত থেকে বহিষ্কৃত অস্পৃশ্যদের নিয়ে তিনি ১৯২৪ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠা করেন "বহিষ্কৃত হিতকারিনীসভা"।
 (২.) সভা সমিতির মাধ্যমে তিনি দলিতদের সংগঠিত করতে থাকেন। 
(৩.) ১৯২৭ খ্রিঃ তিনি দলিতদের নিয়ে মহারাষ্ট্রে সত্যাগ্রহ শুরু করেন এবং প্রকাশ্যে মনুস্মৃতি পুড়িয়ে ব্রাহ্মন্যবাদের বিরোধীতা করেন। 
(৪.) ঐ বছরেই তিনি অস্পৃশ্য মাহাদদের নিয়ে চৌদার পুকুর অভিযান করে অস্পৃশ্যদের জন্য ব্রাত্য চৌদার জলাশয়ের জল স্পর্শ করেন। 
(৫.) ১৯৩০ খ্রিঃ "All India Depressed Classes congrress" প্রতিষ্ঠা করে তিনি দলিতদের পৃথক অধিকার ও পৃথক রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। 
(৬.) ১৯৩০১৯৩১ খ্রিঃ লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে তিনি দলিতদের রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা ও পৃথক প্রতিনিধিত্বের জন্য সুপারিশ করেন। 
(৭.) ১৯৩২ খ্রিঃ রেমসে ম্যাকডোনাল্ড সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষনা করে হিন্দুদের দলিত ও উচ্চবর্ন - এই দুটি ভাগে ভাগ করে দলিতদের পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে, গান্ধীজি এই বিভাজনের বিরুদ্ধে অনশন শুরু করেন। শেষপর্যন্ত ১৯৩২ খ্রিঃ গান্ধীজির সঙ্গে আম্বেদকর পুনা চুক্তি করেন এবং দলিতদের আসন সংরক্ষণের বদলে যৌথ নির্বাচনের বিষয়টি মেনে নেন। 
(৮.) আম্বেদকর দলিতদের শ্রমিক বলে অভিহিত করেন। ১৯৩৬ খ্রিঃ দলিতদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য আম্বেদকর গঠন করেন "Independent Labour Party"। ১৯৩৭ খ্রিঃ এই দল বিপুল ভোটে বোম্বাইয়ে জয়লাভ করেছিলো। 
(৯.) ১৯৪২ খ্রিঃ আম্বেদকর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দলিত আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন "All India scheduled caste Federation"।
(১০.) এছাড়া "মূকনায়ক","বহিষ্কৃত ভারত", "জনতা" প্রভৃতি পত্র পত্রিকার মাধ্যমেও তিনি দলিতদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। 
(১১.) স্বাধীনতা লাভের পর আম্বেদকর সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান এবং নেহেরু মন্ত্রীসভার প্রথম আইনমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হন। এইসময় আম্বেদকর সাংবিধানিক রক্ষাকবচের মাধ্যমে দলিত জনগনের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করেন। এর ফলে সরকারি চাকরিতে (১২ % সংরক্ষণ) ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দলিতদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। 
(১২.) অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অধিকার প্রতিষ্ঠার পরেও অবশ্য ভারতীয় সমাজে দলিত অবজ্ঞার বিষয়টি থেকেই যায়। ইতিমধ্যে খসড়া হিন্দু কোড বিলের সমর্থনের প্রশ্নে কংগ্রেসের সঙ্গে আম্বেদকরের বিরোধ দেখা যায়। পুরানো কংগ্রেস নেতারা আম্বেদকরের এই বিলকে সমর্থন করতে অস্বীকার করেন। এর ফলে ১৯৫১ খ্রিঃ আম্বেদকর নেহেরু মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন
(১৩.) দলিত অধিকার প্রতিষ্ঠায় রক্ষনশীল হিন্দু সমাজের সঙ্গে কার্যত একা নিরন্তর লড়াই, সংগ্রাম চালিয়ে আম্বেদকর শেষপর্যন্ত হতাশ ও রনক্লান্ত হয়ে পড়েন। মৃত্যুর দেড় মাস আগে চরম অভিমানে কয়েক লক্ষ অনুগামী নিয়ে তিনি হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে ১৯৫৬ খ্রিঃ বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেন। 

অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আম্বেদকরের ডাকে সেদিন মাত্র কয়েক লক্ষ দলিত সাড়া দিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। দলিতদের একটি বৃহৎ অংশ হিন্দু ধর্মেই থেকে যান। আম্বেদকর উপলব্ধি করেছিলেন, বর্নবিভক্ত হিন্দু সমাজ কখনই নিন্মবর্গ দলিতদের যোগ্য সামাজিক মর্যাদা ও আধিকার প্রদান করবে না। চিরদিন তাদের অবজ্ঞার চোখেই দেখবে। দলিতদের যোগ্য সামাজিক সম্মান ও অধিকার অর্জনের একমাত্র জায়গা হলো বৌদ্ধধর্ম, যেখানে সকল মানুষের সম অধিকার ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছিলো। 

আম্বেদকরের উপলব্ধি যে মিথ্যা ছিলো না তার প্রমান আজও পাওয়া যায়। স্বাধীনতার এতগুলি বছর পরেও স্বাধীন ভারতের আনাচে কানাচে আজও দলিত নিপীড়ন ও অবজ্ঞার খবর ভেসে আসে। আজও দলিত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বেশ কিছু রাজনৈতিক দলকে  লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। 

তবে এখনও পর্যন্ত দলিতরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে যতটুকু অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন, তা একান্তভাবে আম্বেদকরের জন্যই।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post