ভারতে ইংরেজদের "বিভাজন ও শাসননীতি"

 ভারতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছর ধরে তাদের ক্ষমতা ও আধিপত্য কায়েম করে রেখেছিলো। এত দীর্ঘ দিন ইংরেজদের ক্ষমতার থাকার পিছনে মূলত টি প্রধান কারন ছিলো। যথা -

  1. সুগঠিত ও দক্ষ আমলাতন্ত্রের গঠন,
  2. সামরিক বাহিনীর নির্বিচার আনুগত্য, 
  3. এদেশে বিভাজন শাসন নীতির প্রয়োগ, এবং 
  4. ইংরেজদের প্রতি একশ্রেনীর ভারতীয়দের সমর্থন ও সাহায্য।
মহাবিদ্রোহের পর থেকেই মূলত ইংরেজরা এদেশে "বিভাজন ও শাসন নীতির" খোলাখুলি প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলো। মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে "বিভাজন ও শাসন নীতি" কাকে বলে, সেই আলোচনাতে আসা যাক।

ভারতে ইংরেজদের বিভাজন ও শাসননীতি
ভারতে ইংরেজদের বিভাজন ও শাসননীতি 

বিভাজন ও শাসন নীতির সংজ্ঞা

"বিভাজন ও শাসন নীতি" বা "Divide and rule" হলো একধরনের শাসনতান্ত্রিক কৌশল, যেখানে বলা হয় "প্রথমে ভাগ করো, তারপর শাসন করো"। কোন জাতির মধ্যে বিভেদ বা অনৈক্য সৃষ্টি করে ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশলকেই সাধারণত "বিভাজন ও শাসন নীতি" বলা হয়।

মনে রাখতে হবে, "ঐক্যবদ্ধ প্রজা শক্তি" যেকোন শাসকের কাছেই ভয়ের কারন হিসাবে কাজ করে। কারন এর ফলে শাসকের ওপর যেকোন সময়ে প্রজা শক্তির সম্মিলিত প্রতিরোধ নেমে আসতে পারে। তাই একজন বিবেচক ও দক্ষ শাসকের প্রধান কাজ হলো সর্বদা প্রজাদের ভাগ করে রাখা। তাদের মধ্যে ছোটখাটো বিভেদ, অনৈক্য, যুদ্ধ গুলিকে জিইয়ে রাখা। প্রজাদের একটি গোষ্ঠীকে তোষন করে অপর গোষ্ঠীকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখা এবং এইভাবে নিরাপদে শাসন ক্ষমতা ভোগ করে যাওয়া। 

বিভাজন ও শাসন নীতির উদ্ভব

প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের শাসকরা সর্বপ্রথম শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে বিভাজন ও শাসন নীতির প্রয়োগ করে। ইওরোপ ও এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে থাকা সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্যকে ধরে রাখা রোমান শাসকদের কাছে রীতিমত একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিলো। 

রোমান সাম্রাজ্যে নানা জাতি, ধর্ম, বর্ন ও ভাষাভাষির মানুষ বসবাস করতো। তাদের সেই অনৈক্যকে কাজে লাগিয়ে অর্থাৎ একের সঙ্গে অন্যদের লড়াই লাগিয়ে দিয়ে অথবা তোষন করে রোমান শাসকরা সর্বপ্রথম "বিভাজন ও শাসন নীতির" প্রয়োগ করেন। এই নীতির কারনে সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্য দীর্ঘকালীন পর্যন্ত টিকে থাকতে পেরেছিলো। 

ভারতে বিভাজন ও শাসন নীতির প্রবর্তন

ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলার জন্য ১৮৫৯ খ্রিঃ বোম্বাইয়ের গভর্নর এলফিনস্টোন প্রথম শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে সুপ্রাচীন রোমের এই নীতি ভারতে অনুসরন করার কথা বলেন। 

তবে মাথায় রাখতে হবে, এলফিনস্টোনের অনেক আগে থেকেই ইংরেজ বুদ্ধিজীবীরা ভারতে "বিভাজন ও শাসন নীতির" প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছিলেন। 

(১.) ১৮১৭ খ্রিঃ জেমস মিল তাঁর "History of British India" গ্রন্থে এই নীতির প্রয়োগ করে ভারতের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করেন। 

এখানে তিনি ভারতের প্রাচীন যুগকে "হিন্দু যুগ", মধ্য যুগকে "মুসলিম যুগ" এবং আধুনিক যুগকে "ব্রিটিশ যুগ" বলে ব্যাখ্যা করেন। মিলের ইতিহাস চর্চার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো মধ্য যুগের হিন্দু বিদ্বেষী অন্ধকারময় দিক গুলিকে তুলে ধরে হিন্দু মুসলমানের ঐতিহাসিক বিরোধকে চিরস্থায়ী করে রাখা এবং আধুনিক যুগকে" ব্রিটিশ যুগ" নামে অভিহিত করে ভারতে প্রগতিশীল সংস্কারের লক্ষ্যে ব্রিটিশ শাসনের ভিতকে শক্ত জনসমর্থনের ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করা। 

(২.) ১৮৭১ খ্রিঃ উইলিয়াম হান্টার "The Indian mussalman's" গ্রন্থে ভারতের মুসলমানদের আর্থ - সামাজিক অনগ্রসরতা ও দুর্দশার এক কাল্পনিক চিত্র অঙ্কন করেন এবং মুসলমানদের এই দুর্দশার জন্য হিন্দুদের দায়ী করেন। 

(৩.) তবে ভারতের বিভাজন ও শাসন নীতি প্রয়োগের সবচেয়ে শক্তিশালী একটি পদক্ষেপ ছিলো "জনগননা"। ১৮৭২ খ্রিঃ ইংরেজরা প্রথম ভারতে জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায় ভিত্তিক জনগননা শুরু করে। এই জনগননা থেকে উঠে আসে ভারতবর্ষ নানা জাতি, ধর্ম ও ভাষাভাষীতে বিভক্ত। এই জনগননার রিপোর্ট ধীরে ধীরে প্রতিটি জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে শ্রেনী সচেতনতা তৈরি করে। এই শ্রেনী সচেতনাকেই পরবর্তীকালে ইংরেজরা তাদের আইন ও প্রশাসনের নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার করে ভারতে "বিভাজন" নীতির প্রয়োগ করে।

"বিভাজন" নীতির উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা

বিভিন্ন সময়ে একাধিক উদ্দেশ্যে ইংরেজরা "বিভাজন ও শাসননীতিকে" গ্রহন করেছিলো এবং প্রয়োগ করেছিলো। এর কতকগুলি সাধারন উদ্দেশ্য ছিলো - 

(১.) ভারতে ইংরেজদের শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলা এবং শাসন ক্ষমতা ধরে রাখা
(২.) ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করে ব্রিটিশ শাসনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা, 
(৩.) ১৮৮৫ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের ঐক্যবদ্ধ জাতি নির্মানের বিপ্রতীপে বিভাজন নীতির প্রয়োগ করে কংগ্রেসকে দুর্বল করে রাখা, 
(৪.) বিভাজন নীতির মধ্য দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে শক্ত গোষ্ঠী ভিত্তিক জনসমর্থনের ভিতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করা। 

১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহে ইংরেজদের ওপর হিন্দু মুসলিমদের যৌথ প্রতিরোধ থেকে ব্রিটিশ সরকার শিক্ষা নেয়, ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় জনসমাজ একটি শক্তি। সুতরাং শাসন নীতির মধ্য দিয়ে ভারতীয় জনসমাজকে বিভক্ত ও দুর্বল করা না গেলে, কখনই অদূর ভবিষ্যতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করা যাবে না। 

তাই ১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার ধাপে ধাপে ভারতে বিভাজন ও শাসন নীতির প্রয়োগ করতে থাকে। 

ভারতে বিভাজন নীতির প্রয়োগ ও রূপ 

ভারতে ইংরেজদের বিভাজন নীতির ৩ টি রূপ লক্ষ্য করা যায়। যথা - 
(১.) মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের তোষন
(২.) হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের তোষন, এবং 
(৩.) হিন্দুদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের তোষন।

ভারতে ইংরেজদের বিভাজন ও শাসননীতি
ভারতে বিভাজন নীতির রূপ

প্রথম পর্বের বিভাজন ও শাসননীতি

হিন্দুদের তোষন

(ক.) জমিদারদের তোষন 

এদেশে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম পর্বে ইংরেজরা বেশ কিছুটা নির্বান্ধব ছিলো। এই অবস্থায়, ভারতে ইংরেজ শাসনকে সুস্থিত রাখার জন্য তাদের স্থায়ী বন্ধুর দরকার পড়েছিলো।

 এমতাবস্থায়, ভারতে ভূমি বন্দোবস্তের সূত্র ধরে ইংরেজরা একদল ইংরেজ অনুগত জমিদার শ্রেনী তৈরি করে। এই জমিদাররা বিভিন্ন সময়ে বিপদে আপদে ইংরেজদের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং ভারতীয় প্রজাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ তুলে এনে ইংরেজদের হাতে দেয়। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের একেবারে শেষদিন পর্যন্ত এইসব জমিদাররা ইংরেজদের পাশে ছিলেন। 


(খ.) দেশীয় রাজাদের তোষন

মহাবিদ্রোহে পর ইংরেজরা দেশীয় রাজাদের প্রতিও একই ভাবে তোষন নীতি নিয়ে তাদেরও জমিদারদের মতো ইংরেজদের বংশবদে পরিনত করে। এর ফলে বিভিন্ন সময়ে জাতীয়তাবাদী ও বৈপ্লবিক আন্দোলনে দেশীয় রাজারা বাধা সৃষ্টি করেন এবং তাদের নিজ নিজ রাজ্যের প্রজাদের আন্দোলন থেকে বিরত রাখেন। 

(গ.) হিন্দুদের তোষন

প্রথম দিকে ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেছিলো, তখন অধিকাংশ রাজ্য গুলিতে শাসন ক্ষমতায় ছিলেন মুসলিমরা। তাদের উচ্ছেদ করেই ইংরেজরা ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত করে। 

খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভারতে মুসলিম শ্রেনী ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের মনোভাব নেয় এবং তাদের শত্রু হিসেবে দেখে। এই ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতার জন্য তারা ইংরেজদের আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাকেও বর্জন করে। এই সময় হিন্দুরা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে এবং ইংরেজদের অধীন বিভিন্ন অধস্তন পদ গুলিতে চাকরিতে নিয়োগ হয়। চাকুরি বাঁচানোর তাগিদে ও সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে তারা ইংরেজদের নানা ভাবে সমর্থন করতে থাকেন। ইংরেজরাও পাল্টা মধ্যবিত্ত হিন্দুদের সংস্কার আন্দোলনে নানা ভাবে  সাহায্য ও সহযোগিতা করতে থাকে। 

অর্থাৎ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে ইংরেজরা হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে পর্যাপ্ত সরকারি চাকুরি না পাওয়া ও আরোও নানাবিধ কারণে হিন্দুদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদের সূচনা হলে ইংরেজরা হিন্দু তোষনের পরিবর্তে মুসলিমদের তোষন করার নীতি নেয়। 

দ্বিতীয় পর্বের বিভাজন ও শাসননীতি

মুসলিম তোষন 

ইংরেজ শাসনের প্রথম পর্বে হিন্দুরা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে অনেকখানি বলিয়ান হয়ে উঠলে, মুসলিম সমাজে নানা হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এই হতাশা ও ক্ষোভ থেকে তারা রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করলে ব্রিটিশ সরকার সেই আন্দোলনকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে চালিত করে তাকে সাম্প্রদায়িক আন্দোলনে পরিনত করে। এই সময় নানাভাবে হিন্দুদের বিপরীতে ব্রিটিশ সরকার মুসলিম তোষন শুরু করে। এই পর্বের ঘটনা ক্রমকে নিন্মলিখিত ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় - 

(১.) মহাবিদ্রোহের পর মুসলিমদের অগ্রগতির জন্য সৈয়দ আহমেদ আলিগড় আন্দোলন শুরু করলে, ইংরেজরা এই আন্দোলনকে সমর্থন করে এবং একে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আন্দোলনে পরিনত করে। 

(২.) আলিগড় আন্দোলনের পরবর্তীকালে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কানি দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ খ্রিঃ  (লর্ড কার্জন) বঙ্গভঙ্গ করে। এই সময় পূর্ব বঙ্গে নানা সভা সমাবেশ করে ব্রিটিশ সরকার বুঝিয়ে দেয়, হিন্দু প্রধান পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিমরা আলাদা থাকলে সব দিক থেকেই তারা লাভবান হবে। 

(৩.) আলিগড় আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যে শ্রেনী সচেতনতা তৈরি করে, তা থেকে মুসলিম সমাজের পৃথক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য পরের বছর ১৯০৬ খ্রিঃ ঢাকাতে প্রতিষ্ঠিত হয় "মুসলিম লিগ"। 

(৪.) ইতিমধ্যে সরকার প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন করতে চাইলে মুসলিমরা হিন্দু প্রাধান্যের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই সময় মুসলিমদের পৃথক নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বের জন্য আলিগড় কলেজের অধ্যক্ষ আর্চিবল্ড সহ ৩৫ জন মুসলিম নেতা ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সঙ্গে সিমলায় সাক্ষাৎ করেন। 

(৫.) মিন্টো মুসলিমদের পৃথক নির্বাচন নীতি মেনে নেওয়ায় মুসলিমরা পৃথক সংগঠনের চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। এর জন্যই ১৯০৬ খ্রিঃ মুসলিমরা গড়ে তোলে "মুসলিম লিগ"।

(৬.) ১৯০৯ খ্রিঃ মর্লে মিন্টো সংস্কার আইনে ব্রিটিশ সরকার মুসলিমদের পৃথক নির্বাচনের দাবি মেনে নেয় এবং মুসলিমদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। এই আইনের মধ্য দিয়ে সরকার প্রথম আইন ও শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে "বিভাজন ও শাসন নীতির" প্রয়োগ ঘটায়।

(৭.) এর পরবর্তীকালে বিভিন্ন ভাবে মুসলিম লিগ দেশের অভ্যন্তরে মুসলিম সমাজের পৃথক সত্ত্বা ও অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠায় লড়াই চালায়। সেই সব লড়াইকে নানা ভাবে ইন্ধন যুগিয়ে চলে ব্রিটিশ সরকার। 

(৮.) ১৯১৬ খ্রিঃ লক্ষ্মৌ চুক্তিতে কংগ্রেস নীতিগত ভাবে মুসলিমদের পৃথক নির্বাচন নীতিকে মেনে নেয়। ১৯১৯ খ্রিঃ মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে ব্রিটিশ সরকার মুসলিমদের পুনরায় স্বতন্ত্র নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। 

(৯.) ১৯২৮ খ্রিঃ সাইমন কমিশনের প্রতিবাদে ভারতীয়রা "নেহেরু রিপোর্ট" তৈরি করলে জিন্নাহ মুসলিমদের পৃথক নির্বাচনআসন সংরক্ষণের দাবিতে অনড় থাকেন। তার অনমনীয় মনোভাবের কারনে নেহেরু রিপোর্ট বাতিল হয়ে যায়। 

(১০.) ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সরকার মুসলিম প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বৈঠকে অন্যান্য মুসলিম নেতাদের অপেক্ষা জিন্নাকে অধিক পরিমানে তোষন করতে থাকে ও গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এই সুযোগে জিন্না মুসলিমদের পৃথক নির্বাচন ও আসন রফার বিষয়টিকে ক্রমে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণের ধুঁয়া তুলে ভারতের রাজনীতিকে চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িকতা ও দেশভাগের দিকে টেনে নিয়ে যান। 

তৃতীয় পর্বের বিভাজন ও শাসননীতি

হিন্দুদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের তোষন 

ভারতের ইতিহাসে ১৯২০ দশক থেকে হিন্দুদের নেতৃত্বে কংগ্রেসের গন আন্দোলন এবং ভারতের নানা স্থানে বৈপ্লবিক আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করলে ব্রিটিশ সরকার হিন্দুদের মধ্যেও বিভাজন নীতির প্রয়োগ করে। 

(১.) ব্রিটিশ সরকার হিন্দুদের বর্ন হিন্দুঅনুন্নত হিন্দু এই দুই ভাগে ভাগ করে অনুন্নত হিন্দুদের তোষন করার নীতি নেয়। এই নীতির ফলশ্রুতিতেই ১৯২১ খ্রিঃ মাদ্রাজে এবং ১৯২৫ খ্রিঃ বোম্বাইয়ে অব্রাহ্মন ও অনগ্রসর হিন্দুদের সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়। এর কয়েকবছর বাদে ১৯৩২ খ্রিঃ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রেমসে ম্যাকডোনাল্ড অনগ্রসর হিন্দুদের আসন সংরক্ষণ ও পৃথক নির্বাচনের ঘোষনা করেন, যা "সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা" নামে প্রচারিত হয়। অনগ্রসর হিন্দুদের পাশাপাশি এখানে মুসলিম, শিখ, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদেরও পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়। 

(২.) ১৯৩০ দশকে ভারতে নিন্মবর্গের হিন্দুরা মন্দিরে প্রবেশের জন্য আন্দোলন করলে, এক্ষেত্রেও ব্রিটিশ সরকার বিভাজন নীতিকে প্রয়োগ করে। এই সময় ব্রিটিশ পুলিশ উচ্চবর্নের হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়ে নিন্মবর্গের হিন্দুদের মন্দিরে প্রবেশে নানা ভাবে বাধা দেয়। 

(৩.) একই ভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী আদিবাসীদের প্রতি পৃথক আইন ও শাসনতান্ত্রিক নীতি নিয়ে সরকার তার বিভাজন নীতিকে প্রয়োগ করে। অদম্য ও অপ্রতিরোধ্য আদিবাসী সমাজকে কিছু বিশেষ সুবিধা দিয়ে বাকি জনসমাজ থেকে ইংরেজরা কিছুটা পৃথক রাখার নীতি নেয়।

আদিবাসীদের প্রতি এই নীতি অবশ্য ব্রিটিশ সরকার একেবারে প্রথম দিকেই নিয়েছিলো। বোঝার সুবিধার্থে এটিকে আমরা তৃতীয় পর্বের বিভাজন ও শাসননীতির অন্তর্ভুক্ত করেছি। 

বিভাজন ও শাসননীতির ফলাফল 

ভারতের ইতিহাসে বিভাজন ও শাসননীতির ফলাফল কখনই শুভ হয় নি। ভারতের ইতিহাসে এর একাধিক কুফল লক্ষ্য করা যায় - 

(১.) বিভাজন ও শাসননীতি ভারতে ঐক্যবদ্ধ জাতি নির্মানে বাধার সৃষ্টি করে এবং এটি
(২.) জাতীয় ঐক্যের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। 
(৩.) এই নীতি ভারতে ইংরেজদের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে সাহায্য করে। 
(৪.) ইংরেজদের এই বিভাজন ও শাসননীতি প্রতি পদে পদে ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল 
করেছিলো। এই জন্য জাতীয় কংগ্রেসকে প্রতিটি গন আন্দোলন শুরু করার আগে প্রত্যেকবারই বিভিন্ন ধর্ম ও মতালম্বী গোষ্ঠী গুলির সঙ্গে সমঝোতায় বসতে হতো। 
(৫.) বিভাজন ও শাসননীতি ভারতের রাজনীতিকে "সাম্প্রদায়িকতার" দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো, এবং
(৬.) এই সাম্প্রদায়িকতা শেষপর্যন্ত ভারত বিভাজনদেশভাগের পথ প্রশস্ত করেছিলো। 
(৭.) বিভাজন ও শাসননীতির অবশ্য কিছু ইতিবাচক দিকও ছিলো। বিভাজন ও শাসননীতি অনগ্রসর হিন্দু সমাজে যে শ্রেনী সচেতনতার জন্ম দেয়, তা থেকে শুরু হয় "দলিত আন্দোলন"। 
(৮.) এককথায়, "বিভাজন ও শাসননীতি" ভারতীয় জনসমাজকে হিন্দু, মুসলিম, দলিত ও আদিবাসী প্রভৃতি নানা ভাগে বিভক্ত করেছিলো। 

স্বাধীনতা লাভের পর ঐক্যবদ্ধ দেশ ও জাতি নির্মান হলেও, ক্ষমতায় টিকে থাকার নির্লজ্জ স্বার্থে ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল গুলো ইংরেজদের মতোই বিভাজন ও শাসন নীতিকে প্রয়োগ করে যাচ্ছে। ইংরেজদের মতো বর্তমান কালেও তারা বিভাজন নীতিকে কার্যকর করতে গিয়ে সম্প্রদায় ভিত্তিক"তোষন নীতি" চালিয়ে যাচ্ছে।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post