ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে একটি অন্যতম স্মরনীয় ঘটনা ছিলো - "মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা"। ১৯২৯ খ্রিঃ ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার এই মামলা দায়ের করেছিলো।
এই মামলার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের সমস্ত সম্ভবনাকে একেবারে সমূলে বিনাষ করার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই মামলা দায়ের করে ব্রিটিশ সরকার ভারতে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানকে আটকে দিতে পারলেও, এই মামলার জন্যই কমিউনিস্ট আদর্শ ও চিন্তাধারা পরবর্তীকালে ভারতের এক বিরাট অংশে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এই বিশেষ কারনটির জন্যই "মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা" ইতিহাসে এতখানি স্মরনীয় হয়ে আছে।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা |
প্রেক্ষাপট
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপটকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি -
(১.) বলশেভিক বিপ্লবের প্রভাব
১৯১৭ খ্রিঃ রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব সংঘঠিত হলে অল্প কিছু দিনের মধ্যে ভারতেও তার প্রভাব এসে পড়ে।
এই সময় নানা প্রচার পুস্তিকা ও পত্র পত্রিকার মাধ্যমে কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও চিন্তাধারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষিপ্ত ও ইতস্তত ভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিলো। এর প্রত্যক্ষ প্রমান পাওয়া যায় ১৯২০ খ্রিঃ।
১৯২০ খ্রিঃ শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য লালা লাজপৎ রায়ের সভাপতিত্বে তৈরি হয়েছিলো - All India Trade Union Congress"(AITUC)। এই সময় লালা লাজপত রায় প্রকাশ্য সমাবেশে রুশ বিপ্লবকে অভিনন্দন জানান, ভারতীয় শ্রমিকদের সংগঠিত হবার কথা বলেন এবং তাদের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হবার পরামর্শ দেন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেলো ভারতে কমিউনিস্ট মতাদর্শ একটি গোষ্ঠীর মধ্যে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে আরম্ভ করেছে।
(২.) ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা
ভারতে কমিউনিস্ট মতাদর্শ ধীরে ধীরে একটি বা কয়েকটি গোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করলে এই মতাদর্শকে সংগঠিত ভাবে প্রচার করার জন্য ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯২০ খ্রিঃ রাশিয়ার তাসখন্দে প্রথমে মানবেন্দ্রনাথ রায় এবং অবনি মুখার্জি প্রমুখরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (ভারতের বাইরে প্রতিষ্ঠিত) প্রতিষ্ঠা করেন। এর ৪ বছর পর ১৯২৫ খ্রিঃ ২৬ ডিসেম্বর, কানপুরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গুলির একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকেই জন্ম নেয় "ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি"।
ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই ধীরে ধীরে ভারতে বামপন্থী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
(৩.) কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নানাবিধ অর্থনৈতিক কারনে ভারতের শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে নানা অসন্তোষ দেখা যায়। এই অসন্তোষকে ব্যবহার করে কমিউনিস্টরা ভারতে তাদের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করেন এবং শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
মনে রাখতে হবে, ভারতে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করার কাজটি প্রথম দিকে জাতীয় কংগ্রেস শুরু করলেও, ভারতে ১৯২৫ খ্রিঃ কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হবার পর সেই রাশ সরাসরি বামপন্থীদের দিকে চলে যেতে শুরু করে। ১৯২৬ খ্রিঃ ব্রিটেন থেকে ফিলিপ স্প্র্যাট ভারতে আসেন এবং ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ঘনীভূত করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তিনি কমিন্টার্নের অর্থ সাহায্যে ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, প্রকাশ্য সম্মেলন, ও সংবাদপত্র প্রকাশ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী করে তোলেন।
১৯২৬ - ২৮ খ্রিঃ মধ্যে বাংলা, বোম্বাই, পাঞ্জাব ও যুক্ত প্রদেশে "workers and peasants party" প্রতিষ্ঠা করে কমিউনিস্টরা সক্রিয় ভাবে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়।
(৪.) স্বরাষ্ট্র দপ্তরের গোপন রিপোর্ট
১৯২০ খ্রিঃ এবং তার পরবর্তীকালে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তরের একাধিক গোপন রিপোর্ট থেকে সরকার জানতে পারে, সোভিয়েত রাশিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতেই ভারতে জঙ্গি কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত করার গোপন ছক করা হয়েছে।
ভারতে কমিউনিস্ট চিন্তাধারার প্রসার সবদিক থেকেই ব্রিটিশ সরকারের কাছে মাথাব্যথার কারন হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটেন আশঙ্কা প্রকাশ করে, সোভিয়েত রাশিয়ার মতো যদি ভারতেও কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রসার ঘটে, তাহলে শ্রেনী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটবে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে রাশিয়ায় প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।
এমতাবস্থায়, ভারতের কমিউনিস্টদের দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার একাধিক মামলা দায়ের করে। ১৯২১ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার শুরু করে "পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা"। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই মানবেন্দ্রনাথ রায় ১৯২০ খ্রিঃ রাশিয়ায় তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত করেন। এই পার্টির সদস্য ছিলেন শতাধিক মুহাজির। এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারতে পাঠিয়েছিলো রাশিয়া। এদের বিরুদ্ধেই দায়ের হয়েছিলো পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা।
পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেও ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্টদের সম্পূর্ণ ভাবে নির্মূল করতে পারে নি। এজন্য পরবর্তীকালে ১৯২৪ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে আটজন অভিযুক্ত কমিউনিস্ট নেতার বিরুদ্ধে শুরু করে "কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা"।
(৫.) বিপ্লববাদের সঙ্গে সংযোগ
কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ভারতের বিপ্লববাদকে নানা ভাবে পরিপুষ্ট করে ও সুনির্দিষ্ট পথের দিশা দেখায়। মাথায় রাখতে হবে, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ভারতে প্রবেশের আগে বিপ্লবীরা বিক্ষিপ্ত ও ইতস্তত ভাবে নানা নাশকতামূলক কাজকর্ম চালালেও, তাদের লক্ষ্য, কর্মপন্থা, আদর্শ এবং ভবিষ্যত স্বাধীন ভারতের রূপরেখা নিয়ে অনেকেই ধোঁয়াশার মধ্যে থাকতেন।
কিন্তু কমিউনিস্ট মতাদর্শ বিপ্লবীদের সমস্ত ধোঁয়াশার নিরসন করে। কমিউনিস্ট মতাদর্শে স্বাধীনতার ঘোষনা ছিলো অত্যন্ত স্পষ্ট ও বিজ্ঞান সম্মত, তা হলো সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা করা এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে ভারতকে মুক্ত করা। কমিউনিস্ট মতবাদে শ্রেনীহীন, শোষনহীন সাম্যবাদী সমাজের রূপরেখা বিপ্লবীদের ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতের এক উজ্জ্বল পথের দিশা দেখায়। তারা স্বপ্ন দেখে, স্বাধীন ভারতবর্ষ এমন এক দেশ হবে, যেখানে কোন শ্রেনী বৈষম্য থাকবে না। শোষন থাকবে না। সকলের থাকবে সম অধিকার।
এই সকল কারনে কমিউনিস্ট মতাদর্শ ভারতে প্রবেশ করার পরে তা খুব দ্রুত বিপ্লবীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিলো। কমিউনিস্ট মতাদর্শকে সামনে রেখে বিপ্লবীরা তাদের বিপ্লবাত্মক কাজ গুলির যৌক্তিকতা দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছিলো। এককথায়, কমিউনিস্ট মতাদর্শ ভারতে বিপ্লবীদের বৌদ্ধিক ও আদর্শগত শক্তি বৃদ্ধি ঘটিয়েছিলো।
এদিকে ভারতের বিপ্লববাদের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সংযোগ থাকায়, বিপ্লববাদ দমনের জন্য কমিউনিস্টদের কোনঠাসা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে ব্রিটিশ সরকার বিবেচনা করে। এইজন্যই মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় কমিউনিস্টদের কোনঠাসা করতে চেয়েছিলো। সরকার ভেবেছিল, এর ফলে ভারতে রুশ প্রভাবকে যেমন আটকে দেওয়া সম্ভব হবে তেমনই একই সাথে ভারতীয় বিপ্লববাদকেও কোনঠাসা করে দেওয়া যাবে।
(৬.) কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার মাত্র ৩ বছরের মাথায় দেখা গেলো, সমাজতান্ত্রিক চিন্তা শুধু কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেই নয়, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কমিউনিস্ট মতাদর্শে স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষনা - সাম্রাজ্যবাদের বিনাশ বা বিরোধীতা, অনেককেই আকৃষ্ট করে।
১৯২৮ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে কয়েক হাজার শ্রমিক কংগ্রেসের প্যান্ডেল অধিকার করে। জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম জনপ্রিয় দুই নেতা সুভাষচন্দ্র বসু এবং জওহরলাল নেহেরু, দুজনেই এইসময় সমাজতান্ত্রিক আদর্শের দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হন।
এই ভাবে ভারতে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রসার ধীরে ধীরে জাতীয় কংগ্রেসের চিন্তা ভাবনাকেও আচ্ছন্ন করে তুলতে আরম্ভ করলে, ব্রিটিশ সরকার ভারতে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। সরকারের এই আশঙ্কাকে বহুগুনে বৃদ্ধি করে তোলে এই সময়কালে একের পর এক শ্রমিক ধর্মঘট।
(৭.) শ্রমিক ধর্মঘট ও শ্রমিক অসন্তোষ
ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে শ্রমিক ইউনিয়ন গুলিতে ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শ্রমিকদের নুন্যতম মজুরি বৃদ্ধি, কাজের সময় হ্রাস, ইত্যাদি নানাবিধ কারনে দেশের নানা স্থানে শ্রমিক ধর্মঘট হতে শুরু করে। ১৯২৯ খ্রিঃ বিশ্বব্যাপী আর্থিক মহামন্দার কারনে শ্রমিক ছাটাই বৃদ্ধি পেলে এই ধর্মঘটের সংখ্যা বহুগুন বৃদ্ধি পায়। শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে এইসময় কমিউনিস্টরা ভারতে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করতে থাকে। তারা এদেশে নিয়মিত ভাবে মে দিবস, লেনিন দিবস, রুশ বিপ্লব দিবস পালন করে শ্রমিক শ্রেনীকে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন।
এই সময় মাদ্রাজ, যুক্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, বাংলা,দেশের সর্বত্রই রেল, ট্রাম, কাপড়কল, পাটকল গুলিতে জঙ্গি ধর্মঘট চলতে থাকে। এই সমস্ত জঙ্গি ধর্মঘট ও শ্রমিক আন্দোলন সরকারের কাছে ভীষন উদ্বেগ ও আশঙ্কার কারন হয়ে দাঁড়ায়।
(৮.) দমনমূলক বিল প্রনয়ন
শেষপর্যন্ত সরকার দেশ থেকে শ্রমিক আন্দোলন ও কমিউনিস্ট ভাবধারা নির্মূলের জন্য দুটি দমনমূলক আইন প্রনয়ন করে।
(ক.) ১৯২৯ খ্রিঃ সরকার নিয়ে আসে - "Public safety Bill", এই আইনের প্রয়োগ করে ফিলিপ স্প্র্যাট ও বেন ব্র্যাডলিকে ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে বিতাড়িত করে। কেননা এই দুইজন কমিউনিস্ট নেতা বাংলা ও বোম্বের শ্রমিকদের সংগঠিত করে জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
(খ.) ঐ একই বছরে সরকার আরোও একটি আইন পাশ করে - "Trade Disputes Act", এই আইনে শ্রমিকদের ধর্মঘট বে আইনি বলে ঘোষনা করা হয় এবং সালিশি কমিটির মাধ্যমে শ্রমিক - মালিক বিরোধ মেটানোর কথা বলা হয়।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের
এই দুটি আইনের দ্বারা শ্রমিক ধর্মঘটের পথ রুদ্ধ করে প্রাথমিক ভাবে ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্টদের কোনঠাসা করার উদ্যোগ নেয়। এর পরেই কমিউনিস্টদের চূড়ান্ত ভাবে দমন করার জন্য সরকার আচমকা ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৩ জন (মতান্তরে ৩১ জন) প্রথম সারির কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের গ্রেপ্তার করে ২০ মার্চ ১৯২৯ খ্রিঃ "মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা" দায়ের করে।
উত্তর প্রদেশের মিরাট জেলা আদালতে এই মামলার বিচার চলেছিলো বলে, এটি "মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা" নামেই ইতিহাসে পরিচিত হয়।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার বিবরন
মামলা :- ভারতের গভর্নর জেনারেলের নির্দেশে ১৯২৯ খ্রিঃ ২০ মার্চ, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তার করে "মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা" দায়ের করা হয়।
ভারতে ৩ টি মামলার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ভারতে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানকে আটকে দেয়। এর মধ্যে প্রথম দুটি মামলা ছিলো - পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২১) এবং কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৪), তৃতীয় মামলাটি ছিলো - মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯)।
অভিযুক্ত :- মিরাট ষড়যন্ত্র মামলাতে ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাকে অভিযুক্ত করা হয়।
ভারতীয় অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - মুজাফফর আহম্মদ, ধরনী গোস্বামী, গোপেন চক্রবর্তী, গোপাল বসাক, রাধারমন মিত্র প্রমুখ।
ব্রিটিশ অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - ফিলিপ স্প্র্যাট, বেনজামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলি, লেস্টার হাচিনসন।
প্রধান অভিযোগ :- মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৩ টি প্রধান অভিযোগ নিয়ে আসা হয় -
(১.) আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগঠনটিকে (কমিন্টার্ন) ব্রিটিশ ভারতে শাখা সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলার উদ্দেশ্যে কমিউনিস্ট নেতারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
(২.) ব্রিটিশ ভারতের সার্বভৌম ক্ষমতা হরন করার উদ্দেশ্যে তারা ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
(৩.) উক্ত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে তারা মিরাটে "ওয়ার্কাস অ্যান্ড প্রেজেন্টস পার্টি" গঠন করেছে।
মামলার সময়কাল ও স্থান :- ১৯২৯ খ্রিঃ ১২ জুন, মিরাট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। দীর্ঘ প্রায় ৪ বছর ধরে এই মামলা চলেছিলো। ১৯৩৩ খ্রিঃ ১৬ জানুয়ারি, মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায় বের হয়।
মামলার রায় :- (১.) মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দিদের অনেকের দীর্ঘমেয়াদের কারাদন্ড হয়। (২.) কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় প্রচারকার্য নিষিদ্ধ করা হয়। (৩.) এর ফলে ১৯৩৪ খ্রিঃ কমিউনিস্ট পার্টি ও তার সকল গন সংগঠনকে বেআইনী ঘোষনা করা হয়। ১৯৪২ খ্রিঃ পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিলো।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ভারতের ইতিহাসে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম -
(১.) ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে বিচারের ইতিহাসে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার মতো এত বড়ো মাপের মামলা ইতিপূর্বে আর হয় নি। প্রায় চার বছর ধরে এই মামলা চলেছিলো।
(২.) মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার ফলে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠিত হওয়ার আগে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
(৩.) এই মামলায় প্রথম শ্রেণীর নেতাদের গ্রেপ্তার করায় কমিউনিস্টরা সাংগঠনিক ভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে আপাতভাবে একটি বড়ো ধাক্কা লাগে।
(৪.) এই মামলায় রাজনৈতিক নেতাদের যেভাবে ফাঁসানো হয়েছিলো, তার বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সকলে তীব্র প্রতিবাদ জানান। গান্ধীজী স্বয়ং কমিউনিস্ট নেতাদের সমর্থন করেন এবং জেলে গিয়ে বন্দি নেতাদের শুভেচ্ছা জানান।
(৫.) এই মামলার ফলে কমিউনিস্টরা আদালতে দাড়িয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শ (কমিউনিস্ট মতবাদ) প্রচারের সুযোগ পেয়েছিলো। পরে তা সংবাদপত্রের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ভারতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ দ্রুত প্রসার লাভ করে।
(৬.) এর ফলে বহু মানুষ পরবর্তীকালে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।
(৭.) মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থীদের সংযোগ তৈরিতে সহায়তা করে। এই মামলার পর ১৯৩৪ খ্রিঃ কমিউনিস্ট পার্টি ও তার সকল গন সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে দেওয়া হয়।
এরপর অনেক কমিউনিস্ট নেতা জাতীয় কংগ্রেসে চলে আসেন। ১৯৩৪ খ্রিঃ কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই প্রতিষ্ঠিত হয় "কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল"। কালক্রমে কংগ্রেসে "দক্ষিণপন্থী" ও "বামপন্থী" - এই দুটি গোষ্ঠীর জন্ম হয়।