ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের সবচেয়ে নগ্ন ও পৈশাচিক অত্যাচারের ঘটনাটি ছিলো - "জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড"। পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানে ১৯১৯ খ্রিঃ ১৩ এপ্রিল এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব |
প্রেক্ষাপট
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট ও পটভূমি বিশ্লেষন করতে গেলে বলতে হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধজনীত নানাবিধ কারণে পাঞ্জাবের জনসাধারণের মধ্যে যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো এবং সেই ক্ষোভ ও অসন্তোষকে দমন করার জন্য যুদ্ধ পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার যে চূড়ান্ত দমন নীতি নিয়েছিলো, সেই দমন নীতির জন্যই ঘটে গিয়েছিলো এই হত্যাকাণ্ড।
মনে রাখতে হবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধজনীত নানা কারণে ভারতীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিলেও, তার প্রভাব একমাত্র পাঞ্জাবেই বেশি অনুভূত হয়। এই কারনে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পাঞ্জাবেই ব্রিটিশ স্বৈরতন্ত্র ও দমনমূলক নীতির সবচেয়ে বেশি প্রকাশ ঘটে। এই স্বৈরাচারী দমনমূলক নীতির কারনেই পাঞ্জাবে "জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের" মতো পৈশাচিক ঘটনাটি ঘটে যায়।
সুতরাং বলা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পাঞ্জাবের আর্থ - সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষন ও ক্ষোভ বিক্ষোভের নানা কারন গুলি বিশ্লেষন করলেই ১৯১৯, ১৩ এপ্রিলের "জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের" প্রেক্ষাপট বা পটভূমির অনুসন্ধান পাওয়া যাবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বেশ কিছু কারনে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি ভারতের অন্যান্য অঞ্চল অপেক্ষা অধিক অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। সংক্ষেপে এই কারন গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) বলপূর্বক সেনা সংগ্রহ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে বলপূর্বক সেনা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে পাঞ্জাব থেকে সবথেকে বেশি পরিমাণে সেনা নিয়োগ করা হয়। শুধু পাঞ্জাব থেকেই ৩ লক্ষ ৫৫ হাজার সেনা নিয়োগ করা হয়। যুদ্ধে এই সকল সেনাকে সবচেয়ে বিপদ সঙ্কুল রনক্ষেত্রে পাঠানো হয়। যুদ্ধের পর দায়িত্ব সহকারে এই বিপুল সেনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় নি বা যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত সেনাদের কোনরূপ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয় নি। যুদ্ধ শেষ হলে এই সকল সেনাদের বিনা ক্ষতিপূরনেই ছাটাই করা হয়।
এর ফলে পাঞ্জাবের জনসাধারণের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়। কেননা এই সকল সেনারা পাঞ্জাবের সাধারন পরিবার থেকেই উঠে এসেছিলেন। এই কারনে পাঞ্জাব অঞ্চলের গ্রাম গুলিতে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব দেখা যায়।
(২.) বলপূর্বক অর্থ সংগ্রহ
যুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য পাঞ্জাবের ব্রিটিশ সরকার সেখানকার জনসাধারণের ওপর করের বোঝা বিপুল ভাবে বাড়িয়ে দেয়। যুদ্ধের জন্য দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পেলে এবং কৃষিজাত দ্রব্যের দাম কম হওয়ায় জনসাধারণের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। অধ্যাপক রবীন্দ্রকুমার তার গবেষনায় দেখিয়েছেন, এর ফলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয় লাহোরের। যুদ্ধের সময় সেখানে সাধারণ মানুষের আয় ব্যায় খরচা গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৫০ টাকা ও ৪৭ টাকা। পাঞ্জাবের অন্যান্য এলাকা গুলির চিত্রও মোটামুটি একই রকম ছিলো।
রবীন্দ্রকুমারের মতে, পাঞ্জাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার ছিলো ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সবথেকে বেশি, প্রায় ১০০%। অথচ কারিগরদের মজুরি বৃদ্ধির হার ছিলো মাত্র ২০ - ২৫ %।
এই সকল কারনে পাঞ্জাবের জনসাধারণের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
(৩.) গদর আন্দোলন দমনের নামে অত্যাচার
১৯১৩ খ্রিঃ লালা হরদয়াল আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে গদর দল প্রতিষ্ঠা করেন। গদর দলের সিংহভাগ সদস্যই ছিলেন পাঞ্জাবী। ভারতে সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলন সংগঠিত করবার জন্যই গদর পার্টির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা ও ইওরোপ থেকে গদরপন্থী পাঞ্জাবীরা দেশে ফিরে আসায় পাঞ্জাব অশান্ত হয়ে ওঠে। এই সময় আমেরিকা থেকে গদরপন্থী পাঞ্জাবীরা কোমাগাতামারু নামে একটি জাপানি জাহাজ ভাড়া করে কলকাতায় অবতরন করলে ব্রিটিশ পুলিশ তাদের অবতরনে বাধা দেয়। ব্রিটিশ পুলিশের আক্রমনে নিরস্ত্র ২২ পাঞ্জাবীর মৃত্যু হয় এবং বহু আহত হয়।
এরপরেই সরকার গদর আন্দোলন দমনের নামে পাঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চলের নিরীহ মানুষের ওপর তল্লাশি ও দমন পীড়ন শুরু করে। এর ফলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের জনসাধারনের রাগ ও অসন্তোষ চরমে ওঠে।
(৪.) পাঞ্জাবে জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু মুসলিম ঐক্য
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পাঞ্জাবে অভূতপূর্ব জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফূরন লক্ষ্য করা যায়। এই সময় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবীদের একাধিক ক্ষোভ অসন্তোষ একদিকে যেমন এই জাতীয়তাবাদকে পরিপুষ্ট করে, তেমনি বুদ্ধিজীবীদের নানা বৌদ্ধিক প্রচার ও পাঞ্জাবের জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটায়।
এই সময় পাঞ্জাবের হিন্দু বনিক ও মুসলিমরা যথাক্রমে আর্য সমাজ এবং জাফর আলি খাঁ ও কবি ইকবালের লেখনী দ্বারা প্রভাবিত হয়। পাঞ্জাবের হিন্দু মুসলিম ঐক্য ও প্রবল জাতীয়তাবাদের সঞ্চার দেখে ব্রিটিশ সরকার অত্যন্ত বিচলিত হয়ে ওঠে। এই কারনে সরকার পাঞ্জাবে দমনমূলক নীতি নেওয়ার কথা ভাবে।
(৫.) রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে বিক্ষোভ
১৯১৯ খ্রিঃ মার্চ মাসে রাওলাট আইন প্রণয়ন করার পর সবরকম ভাবে এই আইনকে পাঞ্জাবে প্রয়োগ করা হয়। পাঞ্জাবের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিকে শান্ত করার জন্য ব্রিটিশ সরকার চূড়ান্ত দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে ও পুলিশি অত্যাচার শুরু করে।
ইতিমধ্যে গান্ধীজী কুখ্যাত রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দিলে পাঞ্জাবে তার প্রভাব সবথেকে বেশি অনুভূত হয়।
(৬.) পাঞ্জাবে রাওলাট সত্যাগ্রহ
রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের ৫ টি জেলায় - গুজরানওয়াল, লায়লাপুর, অমৃতসর, লাহোর, ও গুজরাটে সত্যাগ্রহ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। লাহোরের জনসাধারণ শান্তিপূর্ণভাবে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করলে পুলিশ বিনা প্ররোচনায় মিছিলের ওপর গুলিবর্ষন করলে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ।
(৭.) হরতাল ও হলগেট হত্যাকাণ্ড
পাঞ্জাবে সত্যাগ্রহ পরিচালনার জন্য ১৯১৯ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে "People's Committee" গঠন করে সত্যাগ্রহীরা সুশৃঙ্খল গন আন্দোলন চালিয়ে গেলে, ১০ ই এপ্রিল পুলিশ পাঞ্জাবের জনপ্রিয় দুই নেতা সৈফুদ্দিন কিচলু ও ডঃ সত্যপালকে গ্রেপ্তার করে।
এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে পাঞ্জাবের অমৃতসরে হরতাল পালিত হয়। রাস্তায় জনতা পুলিশ খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই সময় একটি মিছিল শান্তিপূর্ণ ভাবে অমৃতসরে হলগেট সেতুর কাছে গেলে পুলিশ বিনা প্ররোচনায় গুলি করে ৩০ জন সত্যাগ্রহীকে হত্যা করে।
এই ঘটনায় পাঞ্জাবে প্রচন্ড ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে।
(৮.) ডায়ারের শাসনভার গ্রহন
পাঞ্জাবে এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে সামরিক শাসনকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইকেল ও'ডায়ার ১২ এপ্রিল অমৃতসরের শাসনভার গ্রহন করেন। তিনি পুলিশি অত্যাচারের এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। জেনারেল ডায়ার সামরিক আইন জারি না করেই অসামরিক প্রশাসনের সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন।
এরপর যথেচ্ছভাবে তিনি গ্রেপ্তার ও সভা সমিতিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এই নিষেধাজ্ঞার সংবাদ ভুল করে অথবা ইচ্ছাকৃত ভাবে সর্বত্র প্রচার করা হয় নি। ডায়ার ১৩ এপ্রিল, বিকেলের দিকে সভা সমিতির ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। দুর্ভাগ্য ক্রমে এই নিষেধাজ্ঞার কথা সত্যাগ্রহীরা জানতেন না। ফলে সরকারী নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করেই সত্যাগ্রহীদের তরফে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানে একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। এই সমাবেশের সিদ্ধান্ত অবশ্য আগে থেকেই ঠিক করা হয়েছিলো।
সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে এই জনসমাবেশ ঘটানোর অপরাধে নিষ্ঠুর দমনমূলক নীতির অঙ্গ হিসাবে জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ঘটানো হয় - "জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড" ।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড
১৯১৯ খ্রিঃ, ১৩ এপ্রিল ছিলো বৈশাখী। ঐ দিন বৈশাখী মেলা দেখবার জন্য পাঞ্জাবের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বহু মানুষ অমৃতসর শহরে এসেছিলেন। ঐ দিন অপরাহ্নে জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানে লালা কানাইলালের সভাপতিত্বে রাওলাট আইনের প্রতিবাদে একটি সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। বহু বৃদ্ধ, নারী, শিশু সহ প্রায় দশ হাজার মানুষ এই সমাবেশে অংশ নেন।
সমাবেশ শুরুর কিছুক্ষণ পরে জেনারেল ডায়ার ৫০ জন সৈন্য নিয়ে প্রবেশ করেন এবং কোনরূপ সভা বন্ধ না করে সমাবেশের ওপর গুলি চালনার নির্দেশ দেন।
জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানটি প্রাচীর দিয়ে চতুর্দিকে ঘেরা ছিলো। সেই বন্ধ উদ্যানে একমাত্র প্রবেশ পথটি রুদ্ধ করে প্রায় ১০ মিনিট ধরে তিনি ১৬০০ রাউন্ড গুলি বর্ষন করেন। এতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত ও আহত হন। সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও, সরকারি মতে, এই হত্যাকাণ্ডে ৩৭৯ জন নিহত ও ১২০০ জন আহত হন। তবে বেসরকারি মতে এই হত্যাকাণ্ডে ১০০০ বেশি মানুষ মারা যায়।
হত্যাকাণ্ড পরবর্তী পাঞ্জাব
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর পাঞ্জাব সরকার "সান্ধ্য আইন" জারি করে সাধারন মানুষকে বাড়ির বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দেয়। এর ফলে জালিয়ানওয়ালাবাগে বহু আহত মানুষের মুখে একফোটা জলও কেউ দিতে পারে নি। আসলে সান্ধ্য আইন জারি করে সরকার এই নারকীয় ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলো।
সামরিক আইন জারি
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের একদিন পরেই ১৫ এপ্রিল জেনারেল ডায়ার "সামরিক আইন" জারি করেন। পাঞ্জাবের ৫ টি জেলাকে এই সামরিক আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়।
এরপর শুরু হয় জঙ্গলের শাসন। নাগরিকদের সমস্ত অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে প্রধান রাস্তা গুলিতে জনসাধারণকে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে বাধ্য করা হয়। শহর গুলিতে জল ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যথেচ্ছ গ্রেপ্তার ও বেত্রাঘাত চালানো হতে থাকে।
বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া ও গুরুত্ব
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের খবর পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার ও ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সবরকম ভাবে চেপে রাখার চেষ্টা করে। কংগ্রেস কমিটির নেতৃবৃন্দ দীর্ঘ চার মাস পর লোকমুখে গুজব আকারে এই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পান। আট মাস পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও ব্রিটিশ জনসাধারণকে জানানো হয় নি।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নেতাদের পাঞ্জাবে যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিলো। কিন্তু বর্ষার কালো মেঘ যেমন সূর্যকে চিরদিন ঢেকে রাখতে পারে না, তেমনি শত চেষ্টা করেও ভারতে ব্রিটিশ সরকার জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সত্যকে চেপে রাখতে পারে নি।
(১.) জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সংবাদ প্রকাশ্যে আসা মাত্র সারা দেশ রাগ ও ক্রোধে ফুঁসে ওঠে।
(২.) এই হত্যাকাণ্ড ইংল্যান্ডের জনসাধারণের মধ্যেও প্রচন্ড আলোড়ন ও ঘৃনা সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ সাংসদ ল্যান্সবেরী প্রকাশ্য সমাবেশে এই হত্যাকাণ্ডকে "ইংরেজ জাতির লজ্জা" বলে অভিহিত করেন। ভারতসচিব মন্টেগু, চার্চিল, সকলেই এই ঘটনার নিন্দা করেন।
(৩.) জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিশ্ববাসীর সামনে ব্রিটিশ শাসনের পশুসুলভ আচরনকে তুলে ধরেছিলো, এবং ভারতীয়দের ব্রিটিশ বিদ্বেষকে বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছিলো।
(৪.) তীব্র জনমতের চাপে এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত তথ্য অন্বেষনের জন্য জাতীয় কংগ্রেস একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলে, আতঙ্কিত ব্রিটিশ সরকার লর্ড হান্টারের সভাপতিত্বে "হান্টার কমিটি" গঠন করে। এই কমিটির রিপোর্ট থেকে পাঞ্জাবের সামরিক শাসন ও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের নগ্ন চিত্র প্রকাশ্যে এসে পড়ে।
(৫.) এর ফলে সারা দেশে প্রচন্ড ক্ষোভ ও ক্রোধের সঞ্চার হয়। এই ঘটনার পর এমন অনেক সাধারন ও উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবেন, যারা আগে কখনই দেশের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেন নি।
(৬.) কুখ্যাত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পাওয়ার মাত্র প্রচন্ড রাগ আর ঘৃনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে দেওয়া ব্রিটিশ সরকারের "নাইট" উপাধি ত্যাগ করেন। মাদ্রাজ হাইকোর্টের ভূতপূর্ব প্রধান বিচারপতি সুব্রাক্ষনীয় আয়ার তার সরকারি "কে সি এস আই" খেতাব ত্যাগ করেন এবং উদারপন্থী স্যার শঙ্করন নায়ার বড়োলাটের "একজিকিউটিভ কাউন্সিল" থেকে পদত্যাগ করে প্রতিবাদ জানান।
(৭.) ব্রিটিশ সরকার পাঞ্জাবের সামরিক সরকার ও সামরিক কর্মচারীদের অপরাধ ছোট করে দেখাতে চাইলে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে গন আন্দোলন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। তাই এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সুবিচিরের দাবিতে গান্ধীজী ১৯২০ খ্রিঃ দেশব্যাপী অসহযোগ গন আন্দোলনের ডাক দেন, যা কিছুদিনের জন্য হলেও, ভারতে ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো।