মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের পটভূমি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কতকগুলি বিশেষ পরিস্থিতির চাপে  ব্রিটিশ সরকার  মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন আনতে বাধ্য হয়েছিলো। ১৯১৮ খ্রিঃ ভারত সচিব মন্টেগু এবং বড়োলাট চেমসফোর্ডের যৌথ রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিঃ এই আইন প্রণয়ন হয়েছিলো বলে ইতিহাসে এটি "মন্ট - ফোর্ড সংস্কার আইন" নামেই অধিক পরিচিত।

মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের পটভূমি
মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের পটভূমি 


মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন নিয়ে আসার পশ্চাতে প্রধান কারন গুলি ছিলো -

(১.) মর্লে - মিন্টো আইনের প্রতি অসন্তোষ

১৯০৯ খ্রিঃ মর্লে - মিন্টো আইন মোটেই ভারতীয়দের খুশি করতে পারে নি। কারন - 

  • এই আইন দ্বারা ভারতে কোন দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় নি, তাছাড়া 
  • নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে এই আইনে কোন ক্ষমতাও দেওয়া হয় নি। 
এমতাবস্থায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয়দের আস্থা অর্জন ও ক্ষোভ প্রশমনের জন্য আরেকটি সাংবিধানিক আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ১৯১৯ খ্রিঃ মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের প্রবর্তন এই ঐতিহাসিক উপলব্ধির'ই ফলশ্রুতি ছিলো।

(২.) বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতীয়দের ক্ষোভ 

১৯১৪ খ্রিঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (১৯১৪ খ্রিঃ) মাদ্রাজ অধিবেশনে সমস্ত রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। 
  • যুদ্ধের সময় ভারতের অর্থ, সম্পদ ও সৈন্যকে ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধের কাজে নির্বিচারে ব্যবহার করে। 
  • এইজন্য ভারতীয়দের বহু কষ্ট স্বীকার করতে হলেও, ভারতবাসী আশা করতো, যুদ্ধান্তে ব্রিটিশ সরকার ভারতকে স্বায়ত্ত্বশাসন দেবে। 
  • যুদ্ধে ভারতীয়দের নির্বিচার সমর্থনের জন্য ভারত সচিব মন্টেগু ১৯১৭ খ্রিঃ ঘোষনা করেন, যুদ্ধের পর ভারতীয়দের স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার দেওয়া হবে। 
  • এমতাবস্থায়, ভারতীয়দের আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসা অর্জন করে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে সুস্থিত রাখবার জন্য একটি সাংবিধানিক আইন প্রণয়নের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯১৯ খ্রিঃ মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের প্রবর্তন এই প্রয়োজন পূরনের তাগিদেই আনা হয়। 

(৩.) ১৯১৬ সালের ৩ ঐতিহাসিক ঘটনার চাপ

১৯১৬ সালে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এমন ৩ টি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে, যা ব্রিটিশ সরকারের ওপর প্রবলভাবে  রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। এই ৩ টি ঘটনা ছিলো যথাক্রমে -
  • হোমরুল আন্দোলন, 
  • কংগ্রেসের নরমপন্থীদের সঙ্গে চরমপন্থীদের মিলন, 
  • লক্ষ্মৌ চুক্তিতে কংগ্রেসের সঙ্গে মুসলিম লিগের মিলন। 

(ক.) হোমরুল আন্দোলন - 

১৯১৬ খ্রিঃ বাল গঙ্গাধর তিলক ও শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত পৃথক ভাবে দুটি "হোমরুল লীগ" প্রতিষ্ঠা করে আয়ারল্যান্ডের ধাঁচে ভারতে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রবর্তন করার জন্য আন্দোলন শুরু করে। 
  • অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় হোমরুল আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। 
  • এই আন্দোলন দমনে সরকার তীব্র দমন নীতি গ্রহণ করলে জনমনে যে প্রচন্ড অসন্তোষের সৃষ্টি হয়, তার ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার জন্যই মূলত ১৯১৯ খ্রিঃ মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন প্রণয়ন করা হয়। 

(খ.) কংগ্রেসের মিলন - 

কর্মসূচি ও মতাদর্শগত বিরোধের কারনে ১৯০৭ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে কংগ্রেস চরমপন্থী ও নরমপন্থী এই দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো। ঐ অধিবেশনেই নরমপন্থীরা চরমপন্থীদের কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত করলে, কংগ্রেস যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। 

কিন্তু ১৯১৬ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে মতাদর্শগত বিরোধ ভুলে নরমপন্থী ও চরমপন্থীরা পুনরায় মিলিত হলে কংগ্রেস পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যা ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে প্রচন্ড মাথাব্যথার কারন হয়ে দাঁড়ায়। 

চরমপন্থীদের চাপে কংগ্রেস যাতে কোন গন আন্দোলন সংগঠিত করে ব্রিটিশ সরকারকে বাগে ফেলতে না পারে, সেইজন্য ব্রিটিশ সরকার এই সময় ভেদনীতির আশ্রয় নেয়, এবং কিছু সাংবিধানিক সুবিধা দিয়ে নরমপন্থীদের খুশি করার ও তাদেরকে সরকারের স্বপক্ষে রাখার কূটনৈতিক কৌশলের কারনেই ১৯১৯ খ্রিঃ মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন প্রবর্তন করে। 

(গ.) লক্ষ্মৌ চুক্তি ও "কংগ্রেস - লিগ" মিলন - 

১৯১৬ খ্রিঃ আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। লক্ষ্মৌ অধিবেশনে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে লক্ষ্মৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে মুসলিমদের পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা কংগ্রেস মেনে নেয়। বিনিময়ে মুসলিম লিগ কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথভাবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে সম্মত হয়। 

গন আন্দোলনের স্বপক্ষে কংগ্রেস ও লিগের এই মিলনও ব্রিটিশ সরকারকে প্রচন্ড বিচলিত করে তোলে। এমতাবস্থায়, ভারতীয়দের সমস্ত রকম গন আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসার জন্য সুস্পষ্ট সাংবিধানিক আইন প্রণয়নের প্রয়োজন পড়ে। এই প্রয়োজনীয়তার কারনেই সরকার মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন নিয়ে আসে। 

(৪.) বলশেভিক বিপ্লবের প্রভাব 

১৯১৭ খ্রিঃ রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ঘটলে ভারতেও তার প্রভাব এসে পড়ে। বলশেভিক বিপ্লবের প্রভাবে ভারতে কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে। যুদ্ধ জনিত করভার
 বৃদ্ধি ও দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি জনীত শোষন কৃষক ও শ্রমিক শ্রেনীকে সংঘবদ্ধ করতে থাকে। বলশেভিক বিপ্লবের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রচার ও সাফল্য ভারতের ব্রিটিশ সরকারকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। 

এমতাবস্থায়, ব্রিটেন, আমেরিকা ও পশ্চিমী শক্তি বর্গ যুদ্ধাবসানে বিশ্ববাসীর আস্থা ও সহযোগিতা লাভের জন্য উপনিবেশ গুলিতে গনতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। 

এই প্রতিশ্রুতির কারনেই ভারতীয়দের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের জন্য কিছু সাংবিধানিক সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। এই কারনেই মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন প্রণয়ন করা হয়। 

(৫.) আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিস্থিতি ভারতীয়দের গন আন্দোলনে প্রবলভাবে উৎসাহিত করে তোলে। আমেরিকা, আয়ারল্যান্ড সহ ইওরোপের বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন, স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি ও তার সফলতা ভারতীয়দের প্রবলভাবে উৎসাহিত করে তোলে। 

এমতাবস্থায়, ভারতীয়দের গন আন্দোলন থেকে নিরস্ত করার জন্য কিছু সাংবিধানিক সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্রিটিশ সরকার চিন্তা ভাবনা করে। এই লক্ষ্যেই তারা মন্ট ফোর্ড আইন প্রণয়ন করে। 

(৬.) বিপ্লবী কার্যকলাপ 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে ভারত ও ভারতের বাইরে ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপে বিপ্লবীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছিলো। ইংল্যান্ডের শত্রু জার্মানির সাহায্য নিয়ে এইসময় বিপ্লবীরা দেশব্যাপী বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে। 

বিশ্বযুদ্ধের পর এইসব বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে চাইছিলো। কিন্তু এজন্য দেশের নরমপন্থী গোষ্ঠীর সমর্থন আদায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিলো ।

এই কারনে ব্রিটিশ সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিমুখী রনকৌশল অবলম্বন করে। নরমপন্থীদের সন্তুষ্ট করে চরমপন্থীদের দমনের নীতি গ্রহণ করে। এই উদ্দেশ্যেই ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিঃ মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন নিয়ে আসে ।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post