ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন সময়ে তার "ভেদ নীতি" প্রয়োগ করার জন্য এবং জাতীয় নেতৃবৃন্দের নরমপন্থী গোষ্ঠীর ক্ষোভে "প্রলেপ দেওয়ার" জন্য যেসব একাধিক আইন প্রনয়ন করেছিলো, তার মধ্যে অন্যতম ছিলো "১৯০৯ খ্রিঃ মর্লে মিন্টো সংস্কার আইন।"
ভারতের ইতিহাসে এই আইনটির প্রধান গুরুত্ব ছিলো এখানেই যে, এই আইনটির মধ্য দিয়েই প্রথম ব্রিটিশ সরকার সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন ব্যবস্থার সূচনা করে ভারতের হিন্দু - মুসলিম জাতীয় ঐক্যতে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়।
পটভূমি
(১.) ১৮৯২ খ্রিঃ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল আইনের প্রতি অসন্তোষ, (২.) বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন, (৩.) সন্ত্রাসবাদ ও বিপ্লববাদের প্রাবল্য, (৪.) ১৯০৬ খ্রিঃ মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা ও পৃথক নির্বাচনের দাবি, (৫.) সর্বোপরি, ভারতের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসাবে কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব ভারতে যে জটিল পরিস্থিতি ও তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করেছিলো, তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সচিব মর্লে ও বড়োলাট মিন্টো ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে কিছু সংস্কারের কথা ঘোষনা করেন এবং ১৯০৯ খ্রিঃ "ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট" নামে একটি আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনটিই ভারতের ইতিহাসে "মর্লে মিন্টো সংস্কার" নামে পরিচিত ।
উদ্দেশ্য
মর্লে মিন্টো সংস্কার আইনের পিছনে ব্রিটিশ সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিলো - বিভাজন ও ভেদ নীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করে তোলা।
জাতীয় কংগ্রেসের পতাকার নীচে একটি চরমপন্থী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছিলো। এরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। কংগ্রেসের নরমপন্থী গোষ্ঠীর আবেদন নিবেদনের বদলে তারা সর্বাত্মক সক্রিয় আন্দোলনের দাবি তোলে। শেষপর্যন্ত, ১৯০৭ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে কংগ্রেসের দুই গোষ্ঠীর বিরোধ চরমে ওঠে এবং চরমপন্থীরা জাতীয় কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত হন।
কংগ্রেসের এই অন্তর্দ্বন্দকে কাজে লাগিয়ে নরমপন্থী গোষ্ঠীকে ব্রিটিশ সরকারের স্বপক্ষে এনে, কংগ্রেসকে চিরতরে দুর্বল করে রাখা এবং নরমপন্থী - চরমপন্থী বিরোধ কে দীর্ঘস্থায়ী করে রাখার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার মর্লে - মিন্টো আইন নিয়ে আসে।
এছাড়া, ১৯০৬ খ্রিঃ মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠিত হবার পর সিমলা দৌত্যতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে লিগ পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি তুললে, তাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্যও সরকার এই আইন নিয়ে এসেছিলো। প্রকারান্তরে এর মূল উদ্দেশ্যটি ছিলো - সাম্প্রদায়িক ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থার সূচনা করে হিন্দু - মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করা।
আইনের শর্তাবলী
১৯০৯ খ্রিঃ মর্লে মিন্টো আইনের দুটি প্রধান দিক ছিলো -
- কার্যনির্বাহক সভা বা পরিষদ, এবং
- আইন সভা বা আইন পরিষদ,
মর্লে মিন্টো সংস্কার আইন |
(ক.) কার্যনির্বাহক সভা বা পরিষদ
- কেন্দ্রে গর্ভনর জেনারেল বা বড়োলাটকে শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে সাহায্য করার জন্য একটি কার্যনির্বাহক পরিষদ গঠন করা হয়েছিলো। প্রদেশ গুলিতে প্রাদেশিক গর্ভনর ছোটলাটদের কাজের সুবিধার জন্যও অনুরূপ কার্যনির্বাহক পরিষদ বা সভা ছিলো।
- ১৯০৯ খ্রিঃ মর্লে মিন্টো সংস্কার আইনে বলা হয় -
- বড়োলাটের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ ও প্রতিটি প্রাদেশিক কার্যনির্বাহক পরিষদে এখন থেকে একজন করে ভারতীয় প্রতিনিধি গ্রহন করা হবে।
- বড়োলাটের কার্যনির্বাহক পরিষদে প্রথম ভারতীয় সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ। কার্যনির্বাহক পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি নিয়োগের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলো যে, শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হচ্ছে।
- এছাড়া, এই আইনে বাংলা, বোম্বাই, মাদ্রাজ প্রভৃতি প্রদেশে কার্যনির্বাহক পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৪।
(খ.) আইন পরিষদ বা আইন সভা
- কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৬০।
- এদের মধ্যে ২৮ জন সরকারি কর্মচারীদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হবেন, বলা হয়। ২৭ জন জমিদার, মুসলিম সম্প্রদায়, বোম্বাই ও কলকাতার বনিকসভা গুলি থেকে এবং প্রাদেশিক আইনসভা থেকে নির্বাচিত হবেন। বাকি ৫ জন সদস্যকে বড়োলাট বিভিন্ন শ্রেনী ও সম্প্রদায় থেকে মনোনীত করবেন।
- কেন্দ্রের মতো প্রাদেশিক আইন পরিষদ বা সভার সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি হয়। বলা হয়, প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য সংখ্যা ৩০ থেকে ৫০ মধ্যে থাকবে।
- কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে সরকারি সদস্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো। কিন্তু প্রাদেশিক আইন পরিষদে যাতে নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা বেশি হতে পারে, সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছিলো।
- লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, এই আইনে প্রথম মুসলমান সম্প্রদায়কে পৃথক ভাবে সদস্য নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।
আইনসভার ক্ষমতা বৃদ্ধি
সমালোচনা
- এই আইন দ্বারা ভারতে কোন দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় নি।
- নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কোন ক্ষমতা বা মতামতের আদৌ কোন গুরুত্ব এই আইনে ছিলো না।
- গর্ভনর জেনারেল ছিলেন সকল ক্ষমতার অধিকারী।
- এই আইন দ্বারা ভারতে কোন সংসদীয় বা পার্লামেন্টারীয় ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয় নি।
- বৈদেশিক সম্পর্ক, রেল, সরকারি ঋন, দেশীয় রাজাদের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় গুলিকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়।
- এই আইন অনুযায়ী মুসলিমদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার ও সুবিধা প্রদান করা হলে, শিখ, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, দলিত ও ইওরোপীয় রা অনুরূপ সুযোগ সুবিধা দাবি করতে থাকে। এর ফলে দেশে সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পায়।
গুরুত্ব
- এই আইনে ভারতে পার্লামেন্টারীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত না হলেও, আইনসভার সদস্যরা সরকার পক্ষকে প্রশ্ন করার অধিকার পেয়েছিলো।
- মর্লে মিন্টো আইনের দ্বারা মোগল যুগ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সঙ্গে ব্রিটিশ - রাজের সাংবিধানিক রীতি নীতি ও আইনের শাসনের ধারনা যুক্ত হয়।
- এই আইনে নরমপন্থী পরম কাঙ্খিত স্বায়ত্ত্বশাসনের ধারনা ধাক্কা খেলেও, নরমপন্থী নেতারা এই আইনের পক্ষে প্রচার চালায় এবং কংগ্রেসের এলাহাবাদ অধিবেশনে এই আইনের পক্ষে কংগ্রেস প্রস্তাব গ্রহণ করে। তারা আশঙ্কা করে, এই আইনের ব্যর্থতা তুলে ধরলে চরমপন্থীরা জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। ফলতঃ যে বিভাজন নীতির প্রসার ঘটানোর লক্ষে ব্রিটিশ সরকার মর্লে মিন্টো সংস্কার আইন প্রবর্তন করে, তা সফল হয়।
- সর্বোপরি বলা যায়, ১৮৬১ খ্রিঃ থেকে যে সাংবিধানিক ইতিহাস শুরু হয়েছিলো, ১৯০৯ খ্রিঃ এসে তা অনেকটাই প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের কাছাকাছি পৌঁছেছিলো। এই আইনের নানা ক্রুটি ও অপূর্ণতা সত্ত্বেও, একটি কথা অস্বীকার করা যায় না, মর্লে মিন্টো সংস্কার আইন ১৮৯২ খ্রিঃ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল আইনের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলো।
- সবশেষে এটাও বলা দরকার, ১৯০৯ খ্রিঃ আইনের ফলে মুসলমান সম্প্রদায়ও লাভবান হয়েছিলো। মুসলিমদের পৃথক নির্বাচন নীতিতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত লিগ যথেষ্ট উজ্জিবিত হয়ে উঠেছিলো। প্রতিনিধি মনোনয়নের ক্ষেত্রে মুসলিমরা সংখ্যানুপাতের চেয়ে অধিক গুরুত্ব লাভ করেছিলো।