মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের শর্তাবলী

 ব্রিটিশ সরকার ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য বিভিন্ন সময়ে যেসব একাধিক সাংবিধানিক আইন প্রণয়ন করেছিলো, তার মধ্যে অন্যতম ছিলো - "মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন"।

নামকরন 

ভারত সচিব এডউইন মন্টেগু এবং ভারতের তৎকালীন বড়োলাট বা ভাইসরয় চেমসফোর্ডের যৌথ রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিঃ কাউন্সিল আইনটি তৈরি হয়েছিলো বলে, এটি সাধারণ ভাবে ইতিহাসে "মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন" বা ১৯১৯ এর ভারত শাসন আইন নামেই অধিক পরিচিত।

উদ্দেশ্য 

আপাত ভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতের অসন্তুষ্ট জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সন্তুষ্ট করে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে নিরাপত্তা প্রদানের  কূটনৈতিক উদ্দেশ্যই ব্রিটিশ সরকার এই আইনটি প্রবর্তন করেছিলো।

আইনের শর্তাবলী

১৯১৯ খ্রিঃ মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ও সাংবিধানিক পরিবর্তন ঘটানো হয়। এই আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারা গুলি আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি :-

(১.) প্রস্তাবনা

মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং এই আইনের মূল "সার সংক্ষেপ" তার প্রস্তাবনাতেই তুলে ধরা হয়। আইনের প্রস্তাবনার শুরুতেই ৩ টি কথা অত্যন্ত পরিস্কার ভাবে তুলে ধরা হয়। যথা -

  1. ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভুক্ত'ই থাকবে। অর্থাৎ মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনে যে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে না, তা শুরুতেই পরিস্কার করে জানিয়ে দেওয়া হয়।
  2. ভারতে ধাপে ধাপে দায়িত্বশীল সরকার গঠনের ব্যবস্থা করা হবে, মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন তারই অন্যতম একটি পদক্ষেপ।
  3. এই উদ্দেশ্যে প্রশাসনের বিভিন্ন শাখায় ভারতীয়দের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে।
অর্থাৎ সুস্পষ্ট ভাবে বললে, জাতীয় নেতৃবৃন্দকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ থেকে ক্ষমতার অলিন্দে মোহান্ধ করে জাতীয় আন্দোলনকে বিপথগামী করে তোলাই ছিলো এই আইনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের শর্তাবলী
মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের শর্তাবলী 

(২.) ভারত সচিব ও তার কাউন্সিল গঠন

  • মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনে ভারত সচিবের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ভারত সরকারের ওপর তার নিয়ন্ত্রন দৃঢ় করা হয়।

  • মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনে বলা হয়, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ শাসনতান্ত্রিক পদে থাকবেন ভারত সচিব। ভারত সচিব হবেন, ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার ভারত বিষয়ক মন্ত্রী। তিনি ইংল্যান্ডে অবস্থান (বসবাস) করার কারনে, ভারতে বড়োলাট বা ভাইসরয়ের মাধ্যমে তিনি "ভারত শাসন পরিচালনা" করবেন।
  • ভারত সচিব একটা কাউন্সিলের মাধ্যমে তার সব কাজকর্ম করবেন। এই কাউন্সিলের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন কথা বলা হলো। যেমন -
  1. এখন থেকে সচিব কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা জন থেকে বাড়িয়ে করা হবে ১২ জন।
  2. এইসব সদস্যদের বেতন, ভাতা আগে ভারতীয় রাজস্ব থেকে দেওয়া হতো। কিন্তু এখন থেকে এর বদলে ব্রিটিশ সরকার'ই এদের বেতন, ভাতা দেবে।
  3. কাউন্সিলের সদস্যদের ভারতে ১০ বছর বসবাস করার বা চাকুরি করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

(৩.) শাসন ক্ষমতার বন্টন

মন্টফোর্ড আইনে ভারতের শাসন ক্ষমতাকে একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং কতকগুলি রাজ্য সরকারের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।

মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের শর্তাবলী
মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের শর্তাবলী 

(ক.) কেন্দ্রীয় সরকার গঠন

  • ঠিক হয়, দেশ রক্ষা, বিদেশনীতি, রেল, মুদ্রা, শুল্ক,অর্থ, ডাক, দেওয়ানী ও ফৌজদারি আইন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো থাকবে কেন্দ্রের হাতে।
  • কেন্দ্রীয় সরকার এইসব বিষয় গুলো পরিচালনা করবে।
  • এই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান হবেন বড়োলাট বা ভাইসরয়
  • তাকে সাহায্যের জন্য থাকবে একটি কার্যনির্বাহক সভা বা শাসন পরিষদ। এই পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা হবে ৮ জন। এর মধ্যে ৩ জন ভারতীয় ও ৫ জন শ্বেতাঙ্গ সদস্য নিযুক্ত হবেন।

কেন্দ্রীয় আইন সভা

কেন্দ্রের হাতে থাকা বিষয় গুলোর জন্য আইন তৈরির জন্য একটি "কেন্দ্রীয় আইনসভা" গঠনের কথা মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনে বলা হয়। ঠিক হয় -
  • কেন্দ্রীয় আইনসভা হবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় আইনসভার দুটো কক্ষ থাকবে। 
  • উচ্চকক্ষের নাম হবে - "কাউন্সিল অব স্টেট", এবং নিন্মকক্ষের নাম হবে - "সেন্ট্রাল লেজেসলেটিভ অ্যাসেম্বলী"।
  • উচ্চকক্ষ -" কাউন্সিল অব স্টেটের" মোট সদস্য সংখ্যা হবে ৬০ জন। এর মধ্যে ৩৩ জন সাম্প্রদায়িক নির্বাচন ব্যবস্থার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষের সব সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ থাকবে ৫ বছর।
  • অন্যদিকে নিন্মকক্ষ - "সেন্ট্রাল লেজেসলেটিভ অ্যাসেম্বলী"র মোট সদস্য সংখ্যা হবে - ১৪৫ জন। এর মধ্যে ১০৪ জন নির্বাচিত ও ৪১ জন মনোনীত হবেন। সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ থাকবে ৩ বছর।

কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচন পদ্ধতি

  • কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্যদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকার দেশবাসীকে মাথাপিছু ভোটের অধিকার দেয় নি।
  • সম্পত্তির ওপর আয়কর প্রদানের ভিত্তিতে মাত্র ১০% লোক এই আইনে ভোটাধিকার পায়।
  • সাম্প্রদায়িকার ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে এই আইনে হিন্দু - মুসলিম ঐক্য ভেঙে ফেলে জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করার পথ প্রশস্ত করা হয়।
  • বলা হয়, কেন্দ্রীয় আইনসভা ব্রিটিশ ভারত এবং এই স্থানে বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্য আইন তৈরি করবে।

বড়োলাটের ক্ষমতা 

মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনে বড়োলাটকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দিয়ে খুব সুকৌশলে ভারতে ব্রিটিশ স্বৈরতন্ত্রকে জিইয়ে রাখা হয়। বলা হয় - 
  1. বড়োলাট আইনসভা আহ্বান করতে পারবেন, মুলতুবি করতে পারবেন বা যেকোন সময়ে ভেঙে দিতে পারবেন।
  2. আইনসভার যেকোন আইন পদাধিকার বলে তিনি সংশোধন করতে পারবেন বা বাতিল করতে পারবেন। 
  3. আইনসভায় বিদেশনীতি ও সামরিক বিভাগ নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। তা একান্তই থাকবে বড়োলাটের হাতে। 
  4. বড়োলাট তার কাজকর্মের জন্য ভারতীয় আইনসভার কাছে দায়ী থাকবেন না। তিনি দায়ী থাকবেন ইংল্যান্ডের অবস্থানরত ভারত সচিব ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে। 
মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন
মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন 

 (খ.) প্রাদেশিক সরকার গঠন

মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন শৃঙ্খলা, পুলিশ, কৃষি, জলসেচ, ভূমিরাজস্ব ইত্যাদি প্রশাসনিক দায়িত্ব গুলো প্রাদেশিক সরকার গুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। 
  1. প্রদেশের হাতে থাকা এইসব বিষয় গুলোর পরিচালনার জন্য প্রদেশ গুলোতে দ্বৈত শাসনের আমদানি করা হয়।
  2. প্রাদেশিক সরকারের দায় দায়িত্বকে দু ভাগে ভাগ করা হয়। যথা - সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত। 
  3. ঠিক হয়, আইন শৃঙ্খলা, অর্থ, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার, শ্রম, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো সংরক্ষিত তালিকায় থাকবে। এগুলি পরিচালনা করবেন প্রাদেশিক গভর্নর। 
  4. কেন্দ্রের মতো প্রদেশেও একটা আইনসভা থাকবে। এই আইনসভা হবে এককক্ষ বিশিষ্ট। এই আইনসভার ৭০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন এবং বাকি ৩০ জন সদস্য সরকার মনোনীত হবেন।
  5. এই আইনসভা থেকে প্রাদেশিক গর্ভনর মন্ত্রীদের মনোনীত করবেন। 
  6. এই মন্ত্রীদের সাহায্যে তিনি হস্তান্তরিত বিষয়গুলো পরিচালিত করবেন। 
  7. শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস, ধর্ম, গ্রন্থাগার ইত্যাদি হস্তান্তরিত বিষয় গুলো পরিচালনা করার জন্য প্রাদেশিক গর্ভনর একটি মন্ত্রীসভা গঠন করবেন।
  8. এই মন্ত্রীসভার মন্ত্রীরা তাদের কাজকর্মের জন্য প্রাদেশিক আইনসভা ও প্রাদেশিক গর্ভনরের কাছে দায়ি থাকবেন। 
  9. মন্ত্রীদের হাতে বিভিন্ন দপ্তর থাকলেও সেই দপ্তরে ব্যয় বরাদ্দের আসল কর্তা ছিলেন প্রাদেশিক গর্ভনর। 
  10. কোন বিষয় নিয়ে মন্ত্রীদের সাথে গভর্নরের মতপার্থক্য হলে গভর্নরের সিদ্ধান্ত'ই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।

সমালোচনা 

সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকরা মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনকে "ভারতবাসীর প্রতি ব্রিটিশ সরকারের দায়িত্ববোধ ও শুভেচ্ছার নিদর্শন" বলে আখ্যায়িত করলেও, এই আইন মোটেই ভারতীয়দের খুশি করতে পারে নি। এই আইনের বেশ কিছু ত্রুটি ভারতীয় জাতীয় নেতৃত্বকে চরমভাবে হতাশ করে।

ক্রুটি :-

  1. এই আইন দ্বারা ভারতে কোন প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোন চেষ্টা করা হয় নি। 
  2. কেন্দ্রে বড়োলাট এবং প্রদেশে ছোটলাটের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যবস্থা করে ব্রিটিশ স্বৈরতন্ত্রকে আইনের ফাঁকে অক্ষুন্ন রেখে দেওয়া হয়। 
  3. এই আইন দ্বারা প্রদেশে কোন স্বায়ত্ত্বশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। 
  4. প্রদেশে হস্তান্তরিত বিষয় গুলোর দায়িত্ব ভারতীয়রা পেলেও, সেখানে আর্থিক ব্যায় বরাদ্দের কোন ক্ষমতা তাদের হাতে ছিলো না। এই ক্ষমতা ছিলো প্রাদেশিক গর্ভনরের হাতে।
  5. গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর গুলো গভর্নর দের হাতেই রেখে দেওয়া হয়। 
  6. অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর গুলির দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে ছাড়া হয়। 
  7. আইনসভা গঠিত হলেও, বাস্তবে তার কোন ক্ষমতা ছিলো না। আইনসভার অধিবেশন ও আইন দুটোই যেকোন সময় গভর্নর বাতিল করে দিতে পারতেন। 
  8. প্রদেশে প্রাদেশিক আইনসভা থেকে মন্ত্রীদের মনোনীত করতেন প্রাদেশিক গর্ভনর । স্বাভাবিক ভাবেই মন্ত্রীদের স্থায়িত্ব বা বরখাস্ত গভর্নরের সন্তুষ্টি বিধানের ওপরেই নির্ভরশীল ছিলো। 
  9. এগুলি ছাড়াও, এই আইনে সাম্প্রদায়িক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে হিন্দু মুসলিম ঐক্য ভেঙে ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
  10. মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনে  সকল দেশবাসী ভোটাধিকারও লাভ করে নি। সম্পত্তির ওপর আয়করের ভিত্তিতে মাত্র ১০% ভারতীয় এই আইনে ভোটাধিকার লাভ করে।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের শর্তাবলী গভীর ভাবে পর্যালোচনা করে ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ মোটেই খুশি হতে পারে নি। জাতীয় কংগ্রেস মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের উপরে উল্লেখিত ক্রুটি গুলো অনুসন্ধান করে খুব সঙ্গত কারণেই বোম্বাই অধিবেশনে এই আইনকে "তুচ্ছ, বিরক্তিকর ও নৈরাজ্যজনক" বলে সমালোচনা করে।

গুরুত্ব 

মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের নানা ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলেও, এই আইনের গুরুত্বের দিক গুলোকে কখনই উপেক্ষা করা যায় না। যেমন - 
  1. এই আইনের মাধ্যমেই প্রথম ভারতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের সূচনা ঘটে। 
  2. এই আইনের ভারতীয়রা নির্বাচন ও আইনসভায় অংশ নেওয়ায় তাদের সাংবিধানিক অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা লাভের সুযোগ ঘটে। 
  3. এই আইনের দ্বারা প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাকে তার কাজের জন্য আইন সভার কাছে দায়ী রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে ভারতে দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে। 
  4. ভারতীয় মন্ত্রীরা হস্তান্তরিত দপ্তরের দায়িত্ব লাভ করে ভারতীয়দের বেশ কিছু সামাজিক অন্যায় ও দুর্নীতি গুলি দূর করতে সচেষ্ট হন। 
  5. সর্বোপরি, প্রদেশে ভারতীয়দের মন্ত্রী নিয়োগ করে ব্রিটিশ সরকারের ভারতীয়করনের পথ প্রশস্ত করা হয়। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post