ব্রিটিশ সরকার ভারতে যেসব দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছিলো, তার মধ্যে অন্যতম কুখ্যাত একটি আইন ছিলো "রাওলাট আইন"। এই আইনের প্রকৃত নাম ছিলো - "Anarchical and Revolutionary crimes Act 1919। বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাটের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির সুপারিশ ক্রমে এই আইনটি প্রবর্তিত হয়েছিলো বলে, এটি" রাওলাট আইন" বা "Rawlatt Act" নামেই ইতিহাসে বেশি সুপরিচিত।
রাওলাট আইন
কিভাবে আইনটি তৈরি হয়েছিলো?
রাওলাট আইন নিয়ে আসার প্রস্তুতি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিক থেকেই ব্রিটিশ সরকার শুরু করে দিয়েছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতে রাজদ্রোহীতা ও বৈপ্লবিক কার্যকলাপ দমনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করার জন্য ১৯১৭ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ সরকার ইংল্যান্ডের বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাটের নেতৃত্বে ৫ জন সদস্যকে নিয়ে "সিডিশন কমিটি" গঠন করে। ১৯১৮ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে এই কমিটি তার সুপারিশ পেশ করে।
১৯১৯ খ্রিঃ ২১ শে ফেব্রুয়ারি, কেন্দ্রীয় আইনসভায় সিডিশন কমিটির পেশ করা সুপারিশ আইন রূপে গৃহীত হয়। ১৯১৯ খ্রিঃ ১৮ মার্চ আইনসভার বিলটি আইনে পরিণত হয়। বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাটের নেতৃত্বে এই আইন তৈরি হয়েছিলো বলে এটি "রাওলাট আইন" নামে পরিচিতি লাভ করে।
রাওলাট আইনের শর্তাবলী
রাওলাট আইনে বলা হয় -
- সরকার বিরোধী যেকোন প্রচার দন্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
- সন্দেহজনক যেকোন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে।
- বিনা বিচারে তাদের অনিষ্টকাল বন্দি করে রাখা যাবে বা নির্বাসন দেওয়া যাবে।
- বিনা সাক্ষ্য প্রমানে বিশেষ আদালতে তাদের বিচার করা হবে এবং এই বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপিল করা যাবে না।
- সরকার যেকোন ব্যক্তির বাড়ি বিনা পরয়ানাতে তল্লাশি করতে পারবে।
- এছাড়া, এই আইনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও খর্ব করে বলা হয়, কোন সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারবে না।
রাওলাট আইন প্রবর্তনের কারন
অনেক গুলি কারনে ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন নিয়ে এসেছিলো।কারন গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) যুদ্ধ নীতির ব্যস্ততা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধ নীতি নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলো। এমতাবস্থায়, ভারতীয় সাম্রাজ্যে কোন রূপ গন আন্দোলন দানা বাঁধুক, তা ব্রিটিশ সরকার কখনই চায় নি। যুদ্ধের পরেও, রনক্লান্ত ব্রিটেন আন্দোলন জনীত কোন রূপ ঝুঁকি নিতে চায় নি। এই কারনেই ভারতীয়দের সমস্ত রকম গন আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সরকার এই দমনমূলক আইন প্রণয়ন করে।
(২.) প্রতিরক্ষা আইনের মেয়াদ শেষ হওয়া
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দমনের জন্য সরকার ১৯১৫ খ্রিঃ "ভারত প্রতিরক্ষা আইন" নামে একটি দমনমূলক আইন প্রণয়ন করে। যুদ্ধাবসানে এই এই আইনটির মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। যুদ্ধান্তে নানাবিধ কারনে ভারতীয়দের ক্ষোভ চরমে উঠেছিলো। এমতাবস্থায়, অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য অনুরূপ একটি আইনের প্রয়োজন পড়েছিলো।
(৩.) মুসলিম সমাজে ক্ষোভের সঞ্চার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার পরাজিত তুরস্কের ব্যবচ্ছেদ ঘটালে এবং তুরস্কের সুলতানের ক্ষমতা খর্ব করলে ভারতের মুসলিম সমাজে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়। কেননা তুরস্কের সুলতান ইসলামীয় জগতে "খলিফা" বা প্রধান ধর্মগুরুর পদ অলংকৃত করতেন। তাই তুরস্কের অবমাননাকে মুসলিম সমাজ ইসলামের অবমাননার বিষয় হিসাবে দেখে।
মুসলিমদের আন্দোলন যাতে সরকারকে বিব্রত করতে না পারে, সেইজন্য একটি দমনমূলক আইনের প্রয়োজন পড়েছিলো।
(৪.) গন আন্দোলনের বিস্তার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খরা, মহামারি, বেকারত্ব বৃদ্ধি, ইত্যাদি কারনে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। এর ফলে সর্বত্র গন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
(৫.) বিপ্লবীদের সক্রিয়তা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে ভারতের বিপ্লবীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে নাশকতামূলক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। তাই বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে সুস্থিত রাখবার জন্য এদের দমন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
সেকারনেই ভারতীয়দের যাবতীয় বিক্ষোভ ও আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিঃ মার্চ মাসে "রাওলাট আইন" প্রবর্তন করে।
রাওলাট আইনের উদ্দেশ্য
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নানাবিধ কারণে ভারতীয় জনমনে যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম হয়েছিলো, তার ফলে যেকোন ছোটখাটো আন্দলনই দেশে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারতো। সেই পরিস্থিতি থেকে ভারতীয় সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই ব্রিটিশ সরকার এই দমনমূলক আইন নিয়ে আসে। এই আইনের প্রধান উদ্দেশ্য গুলি ছিলো -
- অতি সাধারণ বিচার প্রনালীর সাহায্যে দ্রুত অপরাধীদের বিচার করা এবং তাদের শাস্তি দান করা।
- শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ আদালত গঠন করা। যে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না।
- ওই বিশেষ আদালত এমন সব সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহন করবে, যেগুলি আইনগত ভাবে গ্রহনযোগ্য নয়।
- সামান্য সন্দেহ দেখা দিলেই যাতে যেকোন লোককে বন্দি করা যায় এবং বাড়িতে তল্লাশি চালানো যায়।
- বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতে যাতে খুব দ্রুত দমন নীতি প্রয়োগ করে ব্রিটিশ বিরোধী সমস্ত গন আন্দোলন এবং বিপ্লবী কাজকর্ম গুলিকে দমন করা যায় - সেই উদ্দেশ্যেই "রাওলাট আইন" প্রনয়ন করা হয়েছিলো।
ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া
কেন্দ্রীয় আইনসভায় ভারতীয় সদস্যদের প্রতিবাদ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাওলাট আইন পাশ হলে ভারতীয়রা এই দমনমূলক আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
- কেন্দ্রীয় আইনসভার সকল ভারতীয় সদস্য এই আইনটির তীব্র বিরোধিতা করেন।
- এই কুখ্যাত আইনের প্রতিবাদে মহম্মদ আলি জিন্নাহ, মদনমোহন মালব্য, মাজার উল হক আইন পরিষদের সদস্য পদ ত্যাগ করেন।
- অমৃতবাজার পত্রিকা, হিন্দু, দ্য নিউ ইন্ডিয়া, বোম্বাই ক্রনিক্যাল, কেশরী প্রভৃতি সংবাদপত্র গুলি এই কালা কানুনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
- রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে এবং এই আইনের প্রয়োগ করতে গিয়ে পাঞ্জাবে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ঘটে যায়, যা সারা দেশে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির জন্ম দেয়।
গান্ধীজি ও রাওলাট সত্যাগ্রহ আন্দোলন
রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সমকালীন রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের ক্ষমতার গোন্ডীর মধ্যে প্রতিবাদ জানালেও, মহাত্মা গান্ধী প্রথম রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে একটি সর্বভারতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।
গান্ধীজী কেন রাওলাট আইনের বিরোধিতা করেন?
১৯১৯ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার ভারতে দুটি আইন প্রণয়ন করেছিলো।নরমপন্থীদের সন্তুষ্ট করার জন্য একদিকে যেমন সরকার মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন নিয়ে আসে। অন্যদিকে সমস্ত ধরনের ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ ও আন্দোলন বন্ধ করার জন্য রাওলাট আইন প্রবর্তন করে।
গান্ধীজী মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও, রাওলাট আইন গান্ধীজীকে অত্যন্ত বিচলিত করে তুলেছিলো। রাওলাট আইনের বিরোধিতার পিছনে গান্ধীজীর যুক্তি ছিলো অনেক। যেমন -
- রাওলাট আইনে কিছু সন্ত্রাসবাদী দমনের অজুহাতে এমন সব শর্ত চাপানো হয়েছিলো, যাতে মনে হয়েছিলো ভারতবাসী মাত্রেই "অপরাধী",
- ভারতবাসীর বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদ সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার যেভাবে রাওলাট আইনকে কার্যকর করেছিলো, তাতে ভারতীয় জনমতের প্রতি আদৌ কোন শ্রদ্ধা দেখানো হয় নি।
- এই আইনে পুলিশের হাতে এত বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিলো যে, সাধারন মানুষের নিরাপত্তা বলে কিছু ছিলো না। যে কোন সময়ে যেকোন মানুষকে গ্রেপ্তার করা যাবে, এই আশঙ্কা সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে আতঙ্কিত করে তুলেছিলো।
- রাওলাট আইন ভারতীয়দের নাগরিক অধিকার গুলি কেড়ে নিয়ে তাদের ক্রীতদাসে পরিনত করতে চেয়েছিলো। সংবাদপত্র, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও মতামত প্রকাশের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়েছিলো এই আইন। এককথায়, ঈশ্বর প্রদত্ত সমস্ত মানবাধিকার এই আইন কেড়ে নিয়েছিলো।
- রাওলাট আইন জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রাজনীতিবিদদের ওপরে আঘাত করেছিলো। কারন এই আইনে এমন সব ধারা যুক্ত করা হয়েছিলো, যাতে যেকোন অজুহাতে যেকোন নেতাকে গ্রেপ্তার করে সমস্ত প্রতিবাদ আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়।
- এককথায়, ব্রিটিশ স্বৈরতন্ত্রকে চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়েছিলো রাওলাট আইন।
এই সমস্ত কারনে মহাত্মা গান্ধী রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং এই কুখ্যাত আইনের বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় আন্দোলনের ডাক দেন।
রাওলাট সত্যাগ্রহ
কুখ্যাত রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে গান্ধীজি হোমরুল লিগপন্থী সংগঠন, কয়েকটি ইসলামী গোষ্ঠী ও একটি সত্যাগ্রহ সভা নিয়ে আন্দোলন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। যমুনাদাস দ্বারকানাথ, শংকরলাল ব্যাংকের, ওমর শোভানি, ও বি জি হর্নিম্যান গান্ধীজি কে লোকবল ও অর্থ জোগানোর ব্যবস্থা করেন। তিলকের কিছু তরুন অনুগামী গান্ধীজির সঙ্গে যোগ দেন।
সত্যাগ্রহ সভা গঠন
রাওলাট আন্দোলন পরিচালনার জন্য গান্ধীজি প্রথমে বোম্বেতে "সত্যাগ্রহ সভা" গঠন করেন। তিনি নিজে এই সভার সভাপতি হন এবং সত্যাগ্রহ সভার নেতৃত্বে সারা দেশব্যাপী তিনি আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
রনকৌশল
আন্দোলনকে পরিচালিত করবার জন্য গান্ধীজি কতকগুলি রনকৌশল অবলম্বন করেন -
- তিনি কংগ্রেসের আবেদন নিবেদন নীতির বদলে অহিংস পথে আইন অমান্য করে সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেন।
- ১৯১৯ খ্রিঃ মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে তিনি বোম্বে, দিল্লি, এলাহাবাদ, লখনউ ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিভ্রমন করে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন।
- কুখ্যাত আইনের বিরুদ্ধে গান্ধীজি ১৯১৯ খ্রিঃ ৬ ই এপ্রিল ভারতব্যাপী হরতালের ডাক দেন।
- যেসকল স্থানে হরতাল শুরু হয়, সেখানে পুলিশ জনতা খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এর ফলে কোন কোন স্থানে আন্দোলন হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে।
তীব্র দমন নীতি ও আন্দোলন প্রত্যাহার
গান্ধীজির নেতৃত্বে আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করলে ব্রিটিশ সরকার নৃশংস দমন পীড়ন চালিয়ে রাওলাট আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯১৯ খ্রিঃ ১০ই এপ্রিল দিল্লির পালওয়াল স্টেশনে গান্ধীজিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে রাওলাট সত্যাগ্রহে হিংসার প্রবেশ ঘটে। এর ফলে অহিংস আন্দোলনে হিংসার প্রবেশ ঘটায় গান্ধীজি অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং ১৯১৯ খ্রিঃ ১৮ এপ্রিল রাওলাট আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।
রাওলাট সত্যাগ্রহের গুরুত্ব
যে মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মহাত্মা গান্ধী রাওলাট সত্যাগ্রহের ডাক দিয়েছিলেন তা শেষ পর্যন্ত সফলতা লাভ করতে পারে নি। ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন প্রত্যাহার করে নি।
কিন্তু আইন প্রত্যাহার না করলেও, রাওলাট আন্দোলন সম্পূর্ণ বিফল ছিলো না। ইতিহাসে রাওলাট সত্যাগ্রহ ও আন্দোলন একাধিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যের বার্তা বহন করে এনেছিলো। যেমন -
প্রথমত, রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে গান্ধীজি যে গন আন্দোলন গড়ে তোলেন, তা ১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহের পর ছিলো সবচেয়ে বড়ো গন আন্দোলন।
দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলন গান্ধীজিকে সর্বভারতীয় স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলো।এই আন্দোলনের আদর্শ, চিন্তাধারা ও রনকৌশল সব কিছুই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করেছিলো। রাওলাট সত্যাগ্রহ গান্ধীকে একজন প্রভূত ক্ষমতাশালী সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে তুলে ধরেছিলো।
তৃতীয়ত, এই আইনের প্রতিবাদে গান্ধীজী ১৯১৯ খ্রিঃ ৬ ই এপ্রিল ভারতব্যাপী যে হরতাল বা ধর্মঘটের ডাক দেন, তা ছিলো ভারতের ইতিহাসে প্রথম সর্বভারতীয় ধর্মঘট।
চতুর্থত, রাওলাট আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধ হয়, বড়ো আন্দোলন পরিচালনার জন্য সুগঠিত ও সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজন। এই আন্দোলন থেকেই প্রথম জাতীয় কংগ্রেসের সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়। এইজন্য গান্ধীজি কংগ্রেসকে পুনগর্ঠিত করে সর্বভারতীয় আন্দোলন পরিচালনার কথা ভাবেন।
রাওলাট আন্দোলনের ফলেই ১৯২০ খ্রিঃ মধ্যে কংগ্রেস দল ও দলীয় রাজনীতি দুটি ক্ষেত্রেই মহাত্মা গান্ধী নিজের আধিপত্য স্থাপন করতে সক্ষম হন।
পঞ্চমত, রাওলাট আন্দোলনে গান্ধীজী কংগ্রেসের আবেদন নিবেদন নীতির বদলে অহিংস সত্যাগ্রহের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বা লড়াইয়ের যে আদর্শ স্থাপন করেন, তা ব্রিটিশ শাসনে নুহ্যমান দেশবাসীর মনে এক নতুন চেতনা ও আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার করে।
রাওলাট আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা
রাওলাট আন্দোলনের বিফলতার পিছনে কতকগুলি সীমাবদ্ধতা ছিলো। সবশেষে সেগুলিকেও স্মরন করা যেতে পারে। এই আন্দোলনের প্রধান সীমাবদ্ধতা গুলি ছিলো -
- সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার কারনে এই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে নি।
- সব শ্রেণীর মানুষ এই আন্দোলনে সামিল হয় নি।
- এই আন্দোলন ছিলো প্রধানত শহরকেন্দ্রীক।
- গ্রামাঞ্চলে এই আন্দোলনের তেমন কোন প্রভাব পড়ে নি।
- স্থানীয় মানুষ নানা কারনে ক্ষুব্ধ হয়ে এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলো।
- অহিংস নীতি ও সত্যাগ্রহ আদর্শের অনুশীলনে সাধারন মানুষকে খুব ভালো ভাবে অনুরক্ত করে তোলা যায় নি।
নিঃসন্দেহে, রাওলাট আইনের এই সীমাবদ্ধতা গুলি থেকে গান্ধীজি তার রাজনৈতিক শিক্ষা লাভ করেন এবং পরবর্তী গন আন্দোলন গুলিতে এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা গুলি দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।