লক্ষ্মৌ চুক্তি ও তার গুরুত্ব

 ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা ছিলো ১৯১৬ খ্রিঃ লক্ষ্মৌ চুক্তি। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের ভেদ নীতিকে কিছুদিনের জন্য হলেও, এই চুক্তি অসাড় ও অকেজো করে দিয়েছিলো। এই চুক্তির ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে যে অভূতপূর্ব সমন্বয় ও সদ্ভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিলো, তা ইতিপূর্বে অথবা পরবর্তীকালে আর কোন দিনই লক্ষ্য করা যায় নি। মূলত এই সমস্ত কারনেই লক্ষ্মৌ চুক্তি ইতিহাসের পাতায় স্মরনীয় হয়ে আছে।

লক্ষ্মৌ চুক্তি ও তার গুরুত্ব
লক্ষ্মৌ চুক্তি ও তার গুরুত্ব 

প্রেক্ষাপট

লক্ষ্মৌ চুক্তির প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে গেলে, শুরুতেই বলতে হয়, ১৯০৬ খ্রিঃ বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতার ফলস্বরূপ যে মুসলিম লিগের জন্ম হয়েছিলো, সেই মুসলিম লিগ আজীবন বিচ্ছিন্ন মানসিকতার'ই লালন পালন করে গিয়েছিলো, এবং দেশের জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে থাকার নীতি নিয়েছিলো। 

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিলো, যেগুলি মুসলিম সমাজের ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবকে শতগুন বৃদ্ধি করেছিলো। এই ব্রিটিশ বিদ্বেষী মানসিকতার'ই জন্যই লিগ কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলো এবং একত্রে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনাকে জাতীয় আন্দোলনের সাথে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলো।

খুব সংক্ষেপে লক্ষ্মৌ চুক্তির অর্থাৎ কংগ্রেস ও লিগের কাছাকাছি আসার মূল কারন গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি -

(১.) বঙ্গভঙ্গ রদ

১৯০৫ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার যখন বঙ্গভঙ্গ করে তখন বিভিন্ন সভা সমাবেশের মধ্য দিয়ে সরকার এটি বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো যে, হিন্দু প্রধান পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিম প্রধান পূর্ব বঙ্গ আলাদা হলে, সেখানে হিন্দু আধিপত্যের অবসান ঘটবে, এবং সবদিক থেকেই মুসলমান সমাজ উপকৃত হবে। বঙ্গভঙ্গ হবার পর রাজনৈতিক দিক থেকে মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষনের জন্য ঢাকাতে ১৯০৬ খ্রিঃ মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠিত হয়

কিন্তু বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে শুরু হয় স্বদেশী আন্দোলন। এই আন্দোলনের চাপে সরকার পিছু হটে এবং ১৯১১ খ্রিঃ বঙ্গভঙ্গ রদ করে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়াতে মুসলিম সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা যারপরনাই ব্রিটিশ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়।

(২.) আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারন

মুসলিমরা চেয়েছিলো, ভারতের যেকোন স্থানের মুসলিম কলেজকে আলিগড়ের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে। কিন্তু মুসলিম সমাজের এই দাবি সরকার কোন ভাবেই মেনে নেয় নি। বারানসী বিশ্ববিদ্যালয়ও অনুরূপ দাবি তুলতে পারে, একথা ভেবে ভারতসচিব আপত্তি জানান। এই ঘটনায় মুসলিম সমাজের ক্ষোভ ও হতাশা দুই'ই বৃদ্ধি পায়।

(৩.) তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের যুদ্ধ ঘোষনা

তুরস্কের সুলতান মুসলিম জগতে "খলিফা" বা ধর্মগুরু নামে পরিচিত ছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ইসলামীয় জগতের কাছে তুরস্ক একটি ধর্মীয় আবেগের বিষয় ছিলো। ভারতীয় মুসলমান সমাজও এই আবেগ ও চিন্তাধারার ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু ১৯১৪ খ্রিঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক মিত্র পক্ষ বিরোধী জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিলে ব্রিটেন তুরস্কে শত্রুদেশ বলে ঘোষনা করে।

এই কারনে ভারতের মুসলিম সমাজে ইংরেজ বিরোধী মানসিকতার বৃদ্ধি ঘটে। মুসলিম লিগেও মধ্যেও ব্রিটিশ বিরোধীতা লক্ষ্য করা যায়।

(৪.) লিগের নেতৃত্বে বদল

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুসলিম লিগ অভিজাত মুসলিমদের  নেতৃত্বাধীন ছিলো। কিন্তু অল্প কিছু দিনের মধ্যেই লিগে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম যুবকদের ভিড় বাড়তে থাকে। এরা আলিগড়ের সংকীর্ণ ধর্মীয় চিন্তাধারার বদলে উদার রাজনৈতিক মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। এইসব প্রগতিশীল যুবকদের মধ্যে ছিলেন - শিবলী নোমানী, ডঃ আনসারী, মৌলানা মহম্মদ আলি, সৌকত আলি প্রমুখ। ১৯১২ খ্রিঃ এইসব তরুনেরা মুসলিম লিগের নেতৃত্ব দখল করে।

এই সমস্ত প্রগতিশীল মুসলিম যুবকের কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই  সংখ্যা গরিষ্ঠ গোষ্ঠীর চাপেই লিগ লক্ষ্মৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত করেছিলো।

(৫.) মুসলিম জাতীয়তাবাদের জাগরন

উপরোক্ত কারনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুসলিমদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধীতা বৃদ্ধি পায়। ১৯১৫ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার আবুল কালাম আজাদের "আল হিলাল" ও মহম্মদ আলির "কমরেড" পত্রিকা দুটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ব্রিটিশ বিরোধীতার জন্য আলি ভ্রাতৃদ্বয়কে (মৌলানা মহম্মদ আলি ও তার ভাই সৌকত আলি) এবং আবুল কালাম আজাদকে সরকার অন্তরীন করে রাখে।

এই সমস্ত কারনে মুসলিম সমাজে জাতীয়তাবাদের জাগরন ঘটে এবং তারা ইংরেজদের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

(৬.) কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বদল

এই সময়ে সৌভাগ্য ক্রমে কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও একটি বদল আসে। ১৯০৭ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে কংগ্রেস নরমপন্থী ও চরমপন্থী এই দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু ১৯১৪ খ্রিঃ বাল গঙ্গাধর তিলক জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পুনরায় কংগ্রেসে ফিরে আসেন। মিসেস অ্যানি বেসান্ত কংগ্রেসের নরমপন্থীদের সঙ্গে চরমপন্থীদের মিলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। শেষ পর্যন্ত ১৯১৬ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে কংগ্রেসের দুই গোষ্ঠীর মিলন হয়।

এই সময় লিগের মধ্যেও যথেষ্ট ইংরেজ বিরোধীতা লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। ব্রিটিশ সরকার ঘোষনা করেছিলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডকে সাহায্য করার প্রতিদানে ভারতকে স্বায়ত্ত্বশাসন দেওয়া হবে। এই অবস্থায়, তিলক মুসলিম লিগের সঙ্গে আপোষ রফার দ্বারা ব্রিটিশ সরকারের ওপর কংগ্রেস লিগ যৌথ চাপ সৃষ্টিতে আগ্রহ দেখান। লিগও চরম ব্রিটিশ বিদ্বেষের কারনে কংগ্রেসের সঙ্গে তাল ও জোট বাঁধতে সম্মত হয়। 

এর ফলেই কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ একে অপরের কাছাকাছি আসে এবং ১৯১৬ খ্রিঃ জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে দুই দলের প্রধান নেতৃত্বের মধ্যে লক্ষ্মৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

 লক্ষ্মৌ চুক্তি স্বাক্ষর 

১৯১৩ খ্রিঃ মার্চ মাসে লিগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে স্বায়ত্ত্বশাসন অর্জনকে মুসলিম লিগের প্রধান লক্ষ্য হিসাবে ঘোষনা করা হয়। এইজন্য কংগ্রেস সহ অন্যান্য সম্প্রদায় গুলির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের কথা ঘোষনা করা হয়। 

এর ফলে লিগের সঙ্গে কংগ্রেসের একটি সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সহযোগিতার উদ্দেশ্যে এরপর থেকে কংগ্রেস ও লিগ একই সঙ্গে এবং একই সাথে তাদের বাৎসরিক অধিবেশন গুলি অনুষ্ঠিত করতে থাকে। 

১৯১৫ খ্রিঃ কংগ্রেস ও লিগের অধিবেশন বসে। পরের বছর ১৯১৬ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে লক্ষ্মৌ অধিবেশনে দুই দল একত্রে  শাসন সংস্কারের প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং যৌথভাবে আন্দোলন চালাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে এই রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়টিই ইতিহাসে "Lucknow pact" বা লক্ষ্মৌ চুক্তি নামে পরিচিত। 

এই চুক্তি সম্পাদনে বাল গঙ্গাধর তিলক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। 

লক্ষ্মৌ চুক্তির শর্তাবলী

লক্ষ্মৌ চুক্তির শর্তাবলীকে দু ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে - 

  • (ক) কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা, এবং
  • (খ) সাংবিধানিক প্রস্তাব

(ক) পারস্পরিক সমঝোতা সূত্র

লক্ষ্মৌ চুক্তিতে কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা সূত্রে ঠিক হয়েছিলো -

  1. কংগ্রেস ও লিগ যৌথ ভাবে সরকারের কাছে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি পেশ করবে। 
  2. মুসলিম লিগ কংগ্রেসের "স্বরাজের আদর্শ" মেনে নেবে।
  3. কংগ্রেস মুসলিম লিগের "পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা" র দাবি মেনে নেবে।
  4. স্থির হয়, প্রতিটি প্রাদেশিক আইনসভায় মুসলিম সদস্য সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হবে।
  5. কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের মোট সদস্যদের তিনভাগের এক ভাগ সদস্য হবেন মুসলিম। 

(খ) সাংবিধানিক প্রস্তাব 

লক্ষ্মৌ চুক্তিতে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ যৌথভাবে দেশের জটিল সাংবিধানিক সমস্যার সমাধানের প্রয়াস চালিয়েছিলো।

লক্ষ্মৌ চুক্তির সাংবিধানিক প্রস্তাবে বলা হয় - 
  1. অন্যান্য ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন যে মর্যাদা ও প্রতিনিধিত্ব পেয়ে থাকে, ভারতকে তা দিতে হবে। 
  2. ভারত সচিবের কাউন্সিল তুলে দিতে হবে এবং তার বেতন দিতে হবে ব্রিটিশ সরকারকে। 
  3. ভারত সচিবের দুজন সহকারী থাকবেন। এদের মধ্যে একজন হবেন ভারতীয়। 
  4. কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে বৈদেশিক, রাজনৈতিক ও সামরিক বিভাগ, শুল্ক, ডাক, তার ও রেল। 
  5. প্রাদেশিক আইন সভার করস্থাপন ও ঋন গ্রহনের অধিকার থাকবে। প্রাদেশিক সরকার আইনসভার সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে। 
  6. প্রাদেশিক গর্ভনর এবং কেন্দ্রীয় গভর্নর জেনারেলদের শাসন পরিষদের অর্ধেক সদস্য আইনসভার নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে নিতে হবে। 
  7. প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইনসভায় নির্দিষ্ট হারে মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকবে এবং তাতে স্বতন্ত্র নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকবে।

লক্ষ্মৌ চুক্তির গুরুত্ব

ভারতের ইতিহাসে লক্ষ্মৌ চুক্তির গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম । সংক্ষেপে এই চুক্তির গুরুত্বের দিক গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -

(১.) হিন্দু মুসলিম ঐক্য স্থাপন

লক্ষ্মৌ চুক্তির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দিক থেকে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ মিলিত হয়েছিলো। এই মিলন আদতে ছিলো ভারতের দুই বৃহত্তম সম্প্রদায় হিন্দু - মুসলিমদের মিলন। এই মিলন একদিকে যেমন ব্রিটিশ সরকারের বিভাজন ও ভেদ নীতিকে ব্যর্থ ও ভোঁতা করে দিয়েছিলো, তেমনি এটিও প্রমান করে দিতে পেরেছিলো, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, জাতীয় প্রয়োজনে দুই সম্প্রদায় মিলিত হতে পারে এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ কখনই অনিবার্য নয়।

(২.) লিগের অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়া

লক্ষ্মৌ চুক্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ গুলিতে লিগ প্রাপ্য আসন অপেক্ষা কম আসন নিতে রাজি হয়। অন্যদিকে কংগ্রেস মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশ গুলিতে প্রাপ্য আসন থেকে অনেক বেশি আসন ছেড়ে দিতে রাজি হয়।

এর ফলে দেখা যায়, বাংলা ও পাঞ্জাবে লিগ অপেক্ষাকৃত কম আসন পেলেও, বোম্বাই, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, বিহার, গুজরাতের মতো মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশ গুলিতে লিগ অনেক বেশি আসন পায়। 

এর ফলে লিগের অভ্যন্তরে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। বাংলার লিগ নেতারা এই চুক্তির বিরোধীতা করেন। লক্ষ্মৌ চুক্তির ফলে পাঞ্জাবে মুসলিম লিগ ভেঙে যায়। সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মহামেডান এসোসিয়েশন লক্ষ্মৌ চুক্তি মানতে অসম্মত হন। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ গুলিতে মুসলিম লিগগকে প্রাপ্য আসন অপেক্ষা বেশি আসন ছেড়ে দেওয়ালে অনেক হিন্দু নেতৃত্ব এই চুক্তির বিরোধিতা করেন।

(৩.) পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি রচনা

লক্ষ্মৌ চুক্তিতে জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা রাজনৈতিক দিক থেকে হিন্দু মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লিগের পৃথক নির্বাচন নীতিকে মেনে নেন। তারা সাম্প্রদায়িকতার সূত্র মেনে নিয়ে চরম অদূরদর্শীতার পরিচয় দেন।

লক্ষ্মৌ চুক্তিতে আপাত ভাবে হিন্দু মুসলিম ঐক্য স্থাপিত হলেও, তার ভিত্তি যথেষ্ট দুর্বল ছিলো। কেননা এই চুক্তিতে  মুসলিমদের পৃথক সত্ত্বা ও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়ার অর্থ নিঃসন্দেহে জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী ছিলো। এই চুক্তি ভারতীয় রাজনীতিতে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রকৃত ভিত্তি রচনা করেছিলো বলে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করে থাকেন।

(৪.) জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব

লক্ষ্মৌ চুক্তি ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই চুক্তির ফলেই ভারতের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল পরস্পরের কাছাকাছি এসেছিলো। দুই রাজনৈতিক দলের এই মিলন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এক উত্তাল স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে, যা ব্রিটিশ সরকারের কাছে অত্যন্ত মাথাব্যথার কারন হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সরকারের বিভাজন ও ভেদ নীতি এই সময় সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে। এই সময়কার হিন্দু - মুসলিম সংহতির ওপর ভিত্তি করেই মহাত্মা গান্ধী খিলাফৎ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। 

সমালোচনা

লক্ষ্মৌ চুক্তিকে সমসাময়িক কালে অনেকে এবং পরবর্তীকালে প্রায় সমস্ত ঐতিহাসিকরাই সমালোচনা করে থাকেন। 
  • বলা হয়ে থাকে, লক্ষ্মৌ চুক্তি ছিলো একটি জোড়াতালি চুক্তি ।এই চুক্তি দ্বারা মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্যার কোন সমাধান হয় নি। 
  • সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দুই সম্প্রদায়ের উচ্চস্তরের নেতাদের মধ্যে এই চুক্তি সম্পাদিত হলেও, সাধারন মানুষের কোন স্বার্থ এই চুক্তির মধ্যে ছিলো না। সাধারন হিন্দু মুসলমানদের ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করার কোন চেষ্টা বা উপাদান এই চুক্তির মধ্যে ছিলো না। 
  • এর ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এই চুক্তি ভেঙে যায়। এই চুক্তির ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে যে সহযোগিতার বাতাবরন তৈরি হয়, তা ১৯২১ এর শেষের দিক থেকেই অস্তমিত হতে শুরু করে। 
  • আপাত রাজনৈতিক ঐক্যের অন্তরালে লক্ষ্মৌ চুক্তিতে সাম্প্রদায়িক ও মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবধারা কেই উৎসাহিত করা হয়। 
  • এই চুক্তিতে মুসলিমদের পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি জানিয়ে কংগ্রেস একরকম ভাবে মুসলিমদের পৃথক সত্ত্বাকেই মেনে নেয়। এবং এটি মেনে নেওয়ার বিনিময়ে কংগ্রেস তার ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে কালিমালিপ্ত করে। 
  • হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের ফাটলকে কাগজের চুক্তি দিয়ে মুছে দেওয়ার যে চেষ্টা করা হয়েছিলো, তা ভুল প্রমানিত হয়। 
  • লক্ষ্মৌ চুক্তির ব্যর্থতায় প্রমানিত হয়ে যায়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনকে উপেক্ষা করে কখনই শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হিন্দু মুসলিম ঐক্য স্থাপিত হতে পারে না। 
  • পরিনামে লক্ষ্মৌ চুক্তিকে ব্রিটিশ সরকার তার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ পূরনের ব্যবহার করে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এই চুক্তিকে মেনে নিয়ে ১৯১৯ খ্রিঃ মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে তাকে কার্যে পরিনত করে। ১৯০৯ খ্রিঃ মর্লে মিন্টো সংস্কার আইনের পর মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে মুসলিমদের পৃথক নির্বাচন ও পৃথক সত্ত্বাকেই সাংবিধানিক ভাবে স্বীকৃতি জানানো হয়। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post