১৯২৭ খ্রিঃ শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে "সাইমন কমিশন" নিযুক্ত করার ৮ বছর পর ১৯৩৫ সালে "ভারত শাসন আইন" প্রনয়ন করা হয়। এই আইনের দুটি মূল অংশ ছিলো -
- (ক.) ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশ ও দেশীয় রাজন্য শাসিত রাজ্য গুলি নিয়ে একটি "যুক্তরাষ্ট্র" গঠন, এবং
- (খ.) প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন।
(ক.) যুক্তরাষ্ট্র গঠন
(১.) ১৯৩৫ সালের আইনে ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশ ও দেশীয় রাজন্য শাসিত রাজ্য গুলি নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় "যুক্তরাষ্ট্র" গঠনের কথা বলা হয়। তবে কোন রাজন্য শাসিত প্রদেশ এই যুক্তরাষ্ট্রে চাইলে যোগ নাও দিতে পারে।
(২.) কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক ক্ষমতা বড়োলাট বা ভাইসরয়ের ওপর ন্যাস্ত করা হয়। অর্থাৎ এখন থেকে বড়োলাট'ই হবেন ইংল্যান্ডের রাজার তরফে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ।
(৩.) এইজন্য পূর্বের ভারত সচিবের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হয়। সচিব - কাউন্সিল বা পরিষদের বিলোপ করা হয় এবং সচিবের বদলে বড়োলাটের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে তাকেই ভারতীয় শাসনতন্ত্রে সর্বোচ্চ পদ দেওয়া হয়।
১৯৩৫,ভারত শাসন আইন |
(৪.) ঠিক হয়, যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা কেন্দ্রীয় গভর্নর জেনারেল ও তার অধীন একটি মন্ত্রীসভার হাতে থাকবে। এই মন্ত্রীগন কেন্দ্রীয় আইনসভা থেকে কেন্দ্রীয় গভর্নর জেনারেল কর্তৃক মনোনীত হবেন।
(৫.) যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতার বিষয় গুলোকে ৩ টি তালিকার মাধ্যমে ভাগ করে দেওয়া হবে। যথা - (ক.)কেন্দ্রীয় তালিকা - যার অন্তর্ভুক্ত থাকবে, সামরিক বিভাগ, অর্থ, সেনা, রেল, ডাক ও মুদ্রা। (খ.) প্রাদেশিক তালিকা - যার অন্তর্ভুক্ত থাকবে, আইন শৃঙ্খলা, পুলিশ, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়। (গ.) যুগ্ম তালিকা - এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে, সংবাদপত্র, মুদ্রন, দেওয়ানী ও ফৌজদারি আইন, বিবাহ ইত্যাদি বিষয়।
১৯৩৫, ভারত শাসন আইন |
(৬.) কেন্দ্রীয় তালিকা ভুক্ত বিষয় গুলিতে শুধু কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক তালিকা ভুক্ত বিষয় গুলিতে প্রাদেশিক সরকার আইন প্রণয়ন করতে পারবে। যুগ্ম তালিকা ভুক্ত বিষয় গুলিতে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই আইন প্রণয়ন করতে পারবে। তবে কোন কারনে যদি যুগ্ম তালিকা ভুক্ত কোন বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আইনের মধ্যে বিরোধ বাঁধে, তাহলে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের আইন'ই বলবৎ বা কার্যকর থাকবে।
(৭.) যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় তালিকা ভুক্ত প্রশাসনিক বিষয় গুলিকে আবার (অ) সংরক্ষিত এবং (আ) হস্তান্তরিত এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। বলা হয়, পররাষ্ট্র নীতি, দেশ রক্ষা, ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়, রেল, মুদ্রা, বন্দর প্রভৃতি সংরক্ষিত বিষয় গুলি গভর্নর জেনারেলের হাতে থাকবে। তিনি ৩ জন উপদেষ্টার সাহায্য নিয়ে ঐ সমস্ত বিষয় গুলি পরিচালনা করবেন।
(৮.) অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো হস্তান্তরিত বিষয় গুলি বিভাগীয় মন্ত্রীগন তত্ত্বাবধান করবেন। এইভাবে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতাকে গভর্নর জেনারেল এবং মন্ত্রীসভা - এই দুই ভাগে বিভক্ত করে কেন্দ্রে "দ্বৈত শাসনব্যবস্থা" প্রবর্তন করা হয়।
১৯৩৫, ভারত শাসন আইন |
(৯.) বলা হয়, গভর্নর জেনারেল তার কাজের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকবেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার মন্ত্রীগন তাদের কাজকর্মের জন্য ভারতীয় আইনসভার কাছে দায়ী থাকবেন।
(১০.) যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রণয়ন করার জন্য কেন্দ্রে একটি দু কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা গঠনের কথা বলা হয়। এর উচ্চকক্ষ "কাউন্সিল অব স্টেট" বা "রাষ্ট্রীয় পরিষদ"নামে পরিচিত ছিলো। এর সদস্য সংখ্যা ছিলো - ২৬০। নিন্মকক্ষ" ফেডারেল অ্যাসেম্বলি"বা "ব্যবস্থা পরিষদ" নামে পরিচিত ছিলো। এর সদস্য সংখ্যা ছিলো - ৩৭৫। উভয় কক্ষেই খ্রিষ্টান, মুসলিম, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
(১১.) ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে বড়োলাটকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করা হয়। আইন সভা আহ্বান ও বাতিলের ক্ষমতা পেলেন বড়োলাট। বলা হল, গভর্নরের অনুমতি ব্যতীত কোন বিল আইনে পরিণত হবে না। ভারত শাসনের ৯৩ নং ধারা অনুযায়ী, গভর্নর জেনারেল বিশেষ অর্ডিন্যান্স জারি করে আইন প্রণয়ন করতে পারবেন। তবে এই আইন ছয় মাসের বেশি স্থায়ী হতে পারবে না। তবে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এই আইনকে অনুমোদন করলে তা ৩ বছর পর্যন্ত কার্যকরী থাকতে পারে। এছাড়া বলা হয়, জরুরি অবস্থা কালে বড়োলাট মন্ত্রীসভার পরামর্শ ছাড়াই কাজ করবেন।
১৯৩৫, ভারত শাসন আইনের রূপ |
(খ.) প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন ব্যবস্থা
১৯৩৫, ভারত শাসন আইন |
- প্রতিটি প্রদেশে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রবর্তিত হবে।
- প্রদেশের শাসনভার প্রদেশের গভর্নর (ছোটলাট) ও তার অধীন একটি মন্ত্রীসভার হাতে থাকবে। কেন্দ্রের মতোই প্রদেশ গুলিতে মন্ত্রীসভার সদস্যদের প্রাদেশিক গর্ভনর আইনসভা থেকে মনোনীত করবেন।
- প্রাদেশিক আইনসভা এককক্ষ অথবা দ্বি কক্ষ বিশিষ্ট হবে। যেমন - বাংলা, বিহার, মাদ্রাজ, বোম্বাই ও যুক্ত প্রদেশের আইনসভা হবে দ্বি কক্ষ বিশিষ্ট। বাকি ৫ টি ছোট প্রদেশের আইনসভা হবে এককক্ষ বিশিষ্ট।
- আইনসভার সদস্য পদ "সাধারন" ও "সাম্প্রদায়িক" এই দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। সাধারন সদস্য পদ গুলিতে আবার তপশিলি ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের জন্য আসন সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
- কেন্দ্রের মতোই প্রাদেশিক আইনসভাতে গভর্নরের অনুমতি ছাড়া কোন বিল আইনে পরিণত হবে না, বলা হলো।
- এছাড়া, বিশেষ জরুরি অবস্থা কালে প্রদেশে প্রাদেশিক গর্ভনর অর্ডিন্যান্স জারির অধিকার পেলেন। এমনকি এই আইনের ৯৩ ধারায় বলা হলো, তিনি আইন সভা ভেঙে দিয়ে প্রদেশের শাসন ক্ষমতা অধিকার করতে পারবেন।
- ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইনে উপরোক্ত বিষয় গুলো ছাড়াও, একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত স্থাপনের কথাও বলা হয়।
সমালোচনা
ক্রুটি
- ১৯৩৫ এর আইনে কোথাও ভারতীয়দের স্বাধীনতা দান অথবা পূর্ন ভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয় নি।
- কেন্দ্র ও রাজ্য দুটি সরকারেই আগের মতো গভর্নরের ক্ষমতা থাকে অপ্রতিহত ও নিরঙ্কুশ।
- আইনের ফাঁকে গভর্নরদের হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা দিয়ে ব্রিটিশ স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আগাম ব্যবস্থা এই আইনে করে রাখা হয়।
- গভর্নর জেনারেলকে তার কাজের জন্য ভারতীয় পার্লামেন্টের কাছে দায়ী না করে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দায়ী রাখার ব্যবস্থা করে, ব্রিটিশ সরকার সুকৌশলে বুঝিয়ে দেয়, তারা কোনভাবেই ভারতের শাসনতান্ত্রিক অধিকার ভারতীয়দের হাতে ছাড়তে প্রস্তুত নয়।
- এই আইনে পৃথক ও সাম্প্রদায়িক নির্বাচন ব্যবস্থার ঘোষনা করে ব্রিটিশ সরকার আদতে ভারতের জাতীয় ঐক্যকে ভেঙে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করার কূটনৈতিক পরিকল্পনা করে।
- কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলেও, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভাবে দেশীয় রাজ্য গুলির ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।
- এছাড়া, এই আইনে সমস্ত দেশবাসী ভোটাধিকারও লাভ করেন নি। জনসাধারণের মাত্র ১৪ %ভোটাধিকার পায়।
- প্রদেশ গুলিতে প্রাদেশিক গর্ভনরের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের সমস্ত সম্ভবনাকেই অঙ্কুরেই বিনাষ করে।
গুরুত্ব
- ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইন ছিলো ব্রিটিশ সরকার রাজের পরাধীন ভারতের শেষ সংবিধান।
- এই আইন দ্বারা ব্রহ্ম দেশকে ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ঊড়িষ্যা ও সিন্ধু নতুন প্রদেশ হিসাবে জন্মলাভ করে।
- এই আইন ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে।
- স্বাধীন ভারতের সংবিধানের কাঠামো ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইনের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিলো।
- এই আইন ও তার প্রয়োগ রাজনৈতিক দিক থেকে ভারতের ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।