একদিন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াবার সময় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এক টুকরো হাড় হাতে নিয়ে বুনসেন বার্নারে ওটা পোড়াতে লাগলেন। ছাত্ররা তাদের প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের কান্ডকারখানা বড়ো বড়ো চোখ করে দেখতে লাগলো। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই তাদের চোখ গুলি ছানাবড়া হয়ে গেলো, যখন কিনা পোড়া হাড়ের অবশেষটা হাতে নিয়ে পরম তৃপ্তিতে প্রফুল্ল স্যার গলাদ্ধকরন করে নিলেন।
রসায়ন স্যারের এমন কান্ডকারখানা দেখে ছেলেদের আর বিষ্ময়ের অন্ত রইলো না। মুচকি হেসে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছাত্রদের বললেন, কি ভাবছো! ওটা হাড় ছিলো, কিন্তু এটা ক্যালসিয়াম ফসফেট ছাড়া আর কিছুই নয়।
রসায়ন দিয়ে শুধু রসায়নের শিক্ষাই নয়, ছাত্রদের মন থেকেও ধর্মান্ধতার শিকড়কে উপড়ে ফেলতে যিনি শিখিয়ে ছিলেন, সেই মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন ভিষন ভাবে অসাম্প্রদায়িক, মুক্তমনা এবং স্বদেশী চেতনায় উদ্দীপিত আধুনিক ভারতের প্রথম রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
|
প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও বেঙ্গল কেমিক্যাল
|
সংক্ষিপ্ত জীবনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বছর জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই বছরটিতেই অর্থাৎ ১৮৬১ খ্রিঃ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন(১৮৬১ - ১৯৪৪)। ছাত্র জীবনে প্রথম থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।
শিক্ষা জীবন
১৮৮২ খ্রিঃ তিনি পড়াশোনার জন্য পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে। এরপর এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে ১৮৮৪ খ্রিঃ বি এস সি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৮৭ খ্রিঃ ডি এস সি ডিগ্রি অর্জন করেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে।
কর্মজীবন
১৮৮৮ খ্রিঃ বিদেশ থেকে কলকাতায় ফিরে এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত ও যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও, শুধুমাত্র ভারতীয় হবার কারনে অপেক্ষাকৃত কম মাইনে ও কম পদমর্যাদার প্রভিসিয়াল অধ্যাপক পদে তিনি যোগদান করতে বাধ্য হন।
তবে অল্প সময়েই সুন্দর বাচনভঙ্গী ও রসবোধ দিয়ে বাংলা ভাষায় রসায়ন শিক্ষাকে তিনি অত্যন্ত সহজ সরল ভাবে ছাত্রদের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হন। কিছুদিনের মধ্যেই রসায়নের সেরা শিক্ষক হিসাবে তাঁর খ্যাতি সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।
স্বনামধন্য ছাত্রছাত্রী
তাঁর স্বনামধন্য ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন -
- সত্যেন্দ্রনাথ বসু,
- মেঘনাদ সাহা,
- জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ,
- পঞ্চানন নিয়োগ,
- পুলিন বিহারী সরকার,
- এ কে ফজলুল হক প্রমুখ।
রসায়ন গবেষনা
শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাঁর গবেষনার কাজও চালাতে থাকেন। এমনই এক গবেষনার কাজ করতে করতে হঠাৎ করেই তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন রসায়নের এক অতি বিষম বস্তু মারকিউরাস নাইট্রাইট (HgNO2)। এটি ছিলো তাঁর জীবনের সেরা আবিষ্কার, যা তাকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়।
এছাড়া, তিনি তাঁর সমগ্র জীবনে ১২ টি যৌগিক লবন এবং ৫ টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন।
দেশকে স্বাবলম্বী করার সংকল্প গ্রহন
প্রফুল্ল চন্দ্র রায় একজন নিখাদ স্বদেশী চেতনায় উদ্দীপিত জাতীয়তাবাদী ছিলেন। তিনি চাননি দেশের শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় চিরদিন সরকারি চাকুরির মুখাপেক্ষী হয়ে ব্রিটিশ সরকারের গোলাম হয়ে থাকুক।
তিনি তাই রসায়নের নিত্য নতুন গবেষনার ওপর ভিত্তি করে নতুন শিল্প স্থাপন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা ভাবতে থাকলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সময় এই ভাবনাকেই তিনি পরিপূর্ণ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠা
১৮৯২ খ্রিঃ কলকাতার ৯১ আপার সার্কুলার রোডের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন - "বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্ক"। ১৯০১ খ্রিঃ এই প্রতিষ্ঠানটি পরিনত হয় - "বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্ক লিমিটেট কোম্পানি" তে। এটিই ছিলো ভারতের প্রথম রাসায়নিক দ্রব্য ও ঔষুধ তৈরির কারখানা।
কারখানা স্থাপন ও উৎপাদিত দ্রব্য
১৯০৫ খ্রিঃ কলকাতার মানিকতলায় এই কোম্পানির প্রথম কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয় । এরপর একে একে পানিহাটি (১৯২০), মুম্বাই (১৯৩৮), এবং উত্তর প্রদেশের কানপুরে (১৯৪৯), এই প্রতিষ্ঠানের কারখানা গুলি গড়ে ওঠে।
এই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত দ্রব্য গুলির মধ্যে ছিলো -
- চিকিৎসা সংক্রান্ত নানা ঔষুধ ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি,
- ন্যাপথলিন বল,
- ফিনাইল ইত্যাদি।
১৯২৬ খ্রিঃ বেঙ্গল কেমিক্যাল ১৪০০ দেশীয় শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে।
বেঙ্গল কেমিক্যাল ছাড়াও ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কস, বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কস, ন্যাশনাল ট্যানারি ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠায় প্রফুল্ল চন্দ্র'ই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা।
বিজ্ঞান শিক্ষা উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ ঘটিয়ে ভারতে শিল্পায়ন ঘটিয়ে দিতে পারে, এমন আশঙ্কায় ইংরেজরা এদেশে দীর্ঘদিন বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে উদাসীন ও গা ছাড়া মনোভাবের নীতি নিয়েছিলো। তাদের এই আশঙ্কা যে একেবারেই অমূলক ছিলো না, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তা প্রমান করে দিয়েছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলি প্রতিষ্ঠা করে।
রসায়নের ইতিহাস চর্চা
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের আরেকটি বিরাট কৃতিত্বের দিক ছিলো রসায়নের ইতিহাস নিয়ে গবেষনা করা। তিনি'ই প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস গবেষণা করে দেখান, প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে রসায়নের চর্চা করা হতো এবং তাও ছিলো অত্যন্ত উন্নত মানের।
সংকর ধাতু তৈরিতে ভারত পিছিয়ে ছিলো না। ইস্পাত আবিষ্কারের প্রথম কৃতিত্ব ভারতের। রসায়ন চর্চায় প্রাচীন ভারতবর্ষ যে কতটা এগিয়ে ছিলো, তা তুলে ধরার জন্য তিনি ১৯০২ খ্রিঃ প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত গবেষনা গ্রন্থ - "A History of Hindu Chemistry" ।
মোট দুটি খন্ডে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ড টি ১৯০২ এবং দ্বিতীয় খন্ডটি ১৯০৯ খ্রিঃ তিনি প্রকাশ করেন।
উপসংহার
এইভাবে দেখা যায়, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ঔপনিবেশিক সরকারের বৈষম্য ও নানা প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে একার প্রচেষ্টায় - (১.) রসায়ন শিক্ষাকে শুধু যে প্রসারিত করেন, তাই নয় (২.) তার অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার করেন, (৩.) বাস্তব জীবনে রসায়ন শিক্ষার উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তার দিকটি তুলে ধরেন, সর্বোপরি, (৪.) রসায়নকে কেন্দ্র করে আধুনিক শিল্প কারখানা স্থাপন করে বিকল্প কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন ও স্বনির্ভরতার দিশা দেখিয়ে যান।
একটি ছোট্ট গল্প
আজকের লেখা শেষ করবো ছোট্ট একটি গল্প দিয়ে। এই গল্পটি থেকেই উপলব্ধি করা যায়, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কি বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন।
প্রফুল্ল চন্দ্র রায় যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াতে, তখন পর পর কয়েক বছর ছেলেরা খুব খারাপ ফল করতে লাগলো। এসব দেখে শুনে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ এইচ আর জেমস প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে তলব করলেন।
অধ্যক্ষ প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে বললেন, "আপনি যে বিষয়টি পড়ানো ওটাতে ছেলেরা খারাপ রেজাল্ট করছে। কেন তারা ফেল করছে?
উত্তরে প্রফুল্ল চন্দ্র সটান জবাব দেন, কারন আমি ক্লাসে ওদের রসায়ন পড়াই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস পড়াই না।
একথা শোনার পর জেমস সাহেব আর কিছু বলতে পারেন নি।