কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ

 বাংলায় প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে একটি উল্লেখযোগ্য নাম ছিলো - কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ১৯১৪ খ্রিঃ ২৭ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় "ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি" প্রতিষ্ঠা করেন, যা "কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ" নামেই পরিচিত।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ
কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ 

প্রেক্ষাপট

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য বা কারন ছিলো ২ টি -

প্রথমত, বিজ্ঞান চর্চায় সরকারী প্রতিকূলতা দূর করা

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম পীঠস্থান হয়ে  উঠেছিলো প্রেসিডেন্সি কলেজ। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করেন, তখন থেকেই প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান গবেষনার কাজের সূত্রপাত হয়।

কিন্তু সেখানে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা গবেষনার কাজ চালাতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের সরকারি প্রতিকূলতা ও অসহযোগীতার সম্মুখীন হতে থাকেন। এর ফলে ভারতীয়দের স্বপক্ষে একটি স্ব শাসিত বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয়, যেখানে ভারতীয় গবেষকরা স্বাধীন ভাবে গবেষনা করার সুযোগ লাভ করবেন। বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠা এই উপলব্ধি ও ভাবনার'ই ফলশ্রুতি ছিলো।

দ্বিতীয়ত, স্যার আশুতোষের ভূমিকা -

 (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি উৎকৃষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিনত করার সংকল্প)

বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও উদ্যোগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।

স্বদেশী আন্দোলনের আত্মশক্তি ও স্বনির্ভরতার ভাবনা স্যার আশুতোষকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিলো। একমাত্র আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্য দিয়েই স্বনির্ভর জাতি গঠন সম্ভব, এটা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার উৎকর্ষের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে তিনি বিজ্ঞান শিক্ষার ওপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।

তাঁর এই ভাবনা এবং উদ্যোগের'ই অন্যতম ফলশ্রুতি ছিলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠা।

বিভিন্ন ব্যক্তির সাহায্য

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে "বিজ্ঞান কলেজ" প্রতিষ্ঠায় স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন দেশের প্রখ্যাত সব ব্যক্তিরা। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - আইনজীবী স্যার তারকনাথ পালিত এবং শিক্ষাবিদ স্যার রাসবিহারী ঘোষ। এরা কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য জমি ও প্রভূত অর্থ সাহায্য করেন।

এছাড়াও সরকারি অনুদানহীন এই কলেজকে ফিজিক্সের সমস্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন কাশিম বাজারের জমিদার মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র এবং শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক ব্রুল। কলেজের উন্নতিকল্পে রানি বাগেশ্বরী এবং খয়রার জনদরদি গুরুপ্রসাদ সিংও প্রভূত অর্থ সাহায্য করেন।

ক্যাম্পাস

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজের পঠন পাঠনের জন্য মূল ক্যাম্পাস ছিলো দুটি -

  1. ৯২, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রোডে অবস্থিত বিজ্ঞান কলেজের ক্যাম্পাসটি "রাসবিহারী শিক্ষা প্রাঙ্গন" নামে পরিচিত ছিলো, এবং
  2. ৩৫, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে অবস্থিত বিজ্ঞান কলেজের ক্যাম্পাসটি "তারকনাথ পালিত শিক্ষা প্রাঙ্গন" নামে পরিচিত ছিলো।

বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগ স্থাপন

১৯১৪ খ্রিঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে একের পর এক বিজ্ঞানের নানা বিভাগ সেখানে খোলা হতে থাকে।
  1. ১৯১৫ খ্রিঃ খোলা হয় রসায়ন বিভাগ,
  2. ১৯১৬ খ্রিঃ পদার্থ বিদ্যা ও গনিত বিভাগ চালু করা হয়,
  3. ১৯১৮ খ্রিঃ উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগ এবং ১৯১৯ খ্রিঃ প্রানী বিদ্যা বিভাগ খোলা হয় "তারকনাথ পালিত শিক্ষা প্রাঙ্গণে"।

বিজ্ঞান শিক্ষায় অবদান

বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আধুনিক ভারতের বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম প্রধান পীঠস্থান হয়ে ওঠে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

দেশের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও গবেষকরা এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রসায়ন বিভাগে এবং স্যার সি ভি রামন পদার্থ বিদ্যার অধ্যাপক পদে এবং গনেশ প্রসাদ গনিত বিভাগে নিযুক্ত হন। ১৯১৫ খ্রিঃ এই প্রতিষ্ঠানে গবেষনার কাজে নিযুক্ত হন মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি প্রমুখ বৈজ্ঞানিকরা। 

এখানকার উচ্চমানের গবেষনাপত্র গুলি বিশ্বের সেরা পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে স্যার সি ভি রমন পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অসামান্য মৌলিক গবেষনা বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হয়।

এইভাবে দেখা যায়, বিজ্ঞানের বিখ্যাত সব গবেষনা ও অসামান্য শিক্ষকদের যোগদানের ফলে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে এবং হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম সেরা বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। নিঃসন্দেহে, বিজ্ঞান কলেজের জন্যই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই অসামান্য গৌরব অর্জন করতে পেরেছিলো। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post