ভারতে কারিগরি শিক্ষার বিকাশ, বিকল্প কর্মসংস্থান ও বিকল্প শিক্ষা নীতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিলো "জাতীয় শিক্ষা পরিষদের" গঠন (১৯০৬)।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ |
প্রেক্ষাপট
(১.) স্বদেশী আন্দোলন :-
১৯০৫ খ্রিঃ লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে সারা দেশে শুরু হয় স্বদেশী আন্দোলন। এই আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকারকে সার্বিক ভাবে বয়কটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঔপনিবেশিক শিক্ষার বদলে দেশীয় শিক্ষার মধ্য দিয়ে স্বনির্ভর ও স্বাধীন হয়ে ওঠার "জাতীয় ভাবনা" এই সময় গুরুত্ব পায়।
(২.) কার্লাইল সার্কুলার :-
স্বদেশী আন্দোলনে বাংলার ছাত্রসমাজ বিপুলভাবে অংশগ্রহণ করে, যা সরকারের কাছে বিশেষ মাথাব্যথার কারন হয়ে দাঁড়ায়। স্বদেশী আন্দোলন থেকে বাংলার ছাত্রসমাজকে দূরে রাখবার জন্য বাংলা সরকারের সচিব টমাস কার্লাইল ১৯০৫ খ্রিঃ ১০ ই অক্টোবর, কুখ্যাত কার্লাইল সার্কুলার জারি করে।
এই সার্কুলারে বলা হয়, স্বদেশী আন্দোলনে যদি কোন ছাত্র অংশগ্রহণ করে তবে তাদের স্কুল কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হবে। বলা বাহুল্য, কুখ্যাত কার্লাইল সার্কুলার জারি করায় তাকে অগ্রাহ্য করে বাংলার ছাত্র সমাজ দ্বিগুন উৎসাহে স্বদেশী আন্দোলনে অংশ নেয়। এর ফলে বহু ছাত্রকে স্কুল ও কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
(৩.) অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি ও ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষার ভাবনা :-
এইসময় কুখ্যাত কার্লাইল সার্কুলারের বিরুদ্ধে শচীন্দ্র প্রসাদ বসুর নেতৃত্বে প্রায় ৩ হাজার ছাত্র কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে সমবেত হয়ে গড়ে তোলে "অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি"। এখানে -
- দেশীয় ছাত্র যুবকদের বিদেশী শিক্ষাকে বয়কট করে স্বদেশী শিক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
- এর পাশাপাশি কার্লাইল সার্কুলারে ক্ষতিগ্রস্ত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষা গ্রহণের কথা তুলে ধরা হয়। এই বিকল্প জাতীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্যই গঠিত হয় "জাতীয় শিক্ষা পরিষদ"।
(৪.) পার্কস্ট্রিটের সমাবেশ:-
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
- সতীশচন্দ্র মুখার্জি,
- গুরুদাস ব্যানার্জি,
- অরবিন্দ ঘোষ,
- রাসবিহারী ঘোষ,
- রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক,
- ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
(৫.) ঔপনিবেশিক শিক্ষা নীতির সমালোচনা:-
"জাতীয় শিক্ষা পরিষদ" প্রতিষ্ঠা
দেশীয় ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
- অরবিন্দ ঘোষ,
- রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক,
- গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়,
- হীরেন্দ্রনাথ দত্ত,
- ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্দেশ্য
- বিদেশী নিয়ন্ত্রন মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা,
- জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা প্রদান করা,
- মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার পাশাপাশি নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের শিক্ষার প্রসার ঘটানো,
- শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম ও দেশসেবার মনোভাব জাগ্রত করা,
- জাতীয় নিয়ন্ত্রনে ও জাতীয়ভাবে গন শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
মতপার্থক্য ও বিতর্ক
- একদল মনে করতো যে, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ'ই দেশের সব শিক্ষার দায়িত্ব বহন করবে। এই দলের অন্যতম সদস্যদের মধ্যে ছিলেন - গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীশ মুখার্জি, হীরেন দত্ত প্রমুখ।
- দ্বিতীয় দলটি মনে করতো, জাতীয় শিক্ষা পরিষদের মূল লক্ষ্য হবে কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। কারন একমাত্র কারিগরি শিক্ষার মধ্য দিয়ে আত্মশক্তি ও স্বনির্ভর জাতি নির্মান সম্ভব। এই দলের সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - তারকনাথ পালিত, ডঃ নীলরতন সরকার, মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী প্রমুখ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাঠ্যক্রম রূপায়ন
- কারিগরি শিক্ষাকে সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করার কথা তুলে ধরা হয়।
- বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হয়।
- জাতীয় পাঠ্যক্রম রূপে ৩ বছরের জন্য প্রাইমারি, ৭ বছরের জন্য সেকেন্ডারি ও ৪ বছরের জন্য কলেজ স্তরের কোর্স তৈরি করে তা কার্যকর করা হয়।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সীমাবদ্ধতা
- প্রথমত, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ছিলো কলকাতা ভিত্তিক। জেলা ও গ্রামে এর বিশেষ কোন প্রভাব বা অবদান ছিলো না।
- দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক সংকটের জন্য জাতীয় শিক্ষা পরিষদ তার বহু শিক্ষা ভাবনাকে যথাযথ ভাবে রূপায়িত করতে পারে নি।
- তৃতীয়ত, সরকারী অনুমোদন না থাকায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতে পাশ করা ছাত্রদের সরকারি চাকরি পাওয়ার কোন সম্ভবনা ছিলো না।