বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিলো - "বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের" প্রতিষ্ঠা।
|
বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট
|
প্রেক্ষাপট
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হবার পর শিক্ষা ভাবনাকে কেন্দ্র করে দুটি দলের সৃষ্টি হয়েছিলো। একটি দল চেয়েছিলো, দেশের সব শিক্ষা ব্যবস্থাই জাতীয় শিক্ষা পরিষদ পরিচালনা করবে। দ্বিতীয় দলটি মনে করে, জাতীয় শিক্ষার মূল নীতি হওয়া উচিত কারিগরি শিক্ষার বিকাশ ঘটানো। একমাত্র কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানোর মধ্য দিয়েই স্বনির্ভর জাতি গঠন এবং যথার্থ অর্থে আত্মশক্তি অর্জন করা সম্ভব।
দ্বিতীয় দলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন - তারকনাথ পালিত, নীলরতন সরকার, মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী প্রমুখ। এই দ্বিতীয় দলের উদ্যোগে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের জন্য আলাদা একটি পরিষদ গঠিত হয়। ১৯০৬ খ্রিঃ ১ জুন, প্রতিষ্ঠিত এই পরিষদটির নাম ছিলো - "সোসাইটি ফর প্রমোশন অব টেকনিক্যাল এডুকেশন (SPTE)। এই সংস্থাটির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন, তারকনাথ পালিত।
বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা
এই সোসাইটির উদ্যোগেই ১৯০৬ খ্রিঃ ২৫ জুলাই গঠিত হয় "বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট"। তারকনাথ পালিত এই প্রতিষ্ঠানটিকে নগদ ৪ লক্ষ্য টাকা এবং তার বসতবাড়িটি দান করেন। এখান থেকেই এই ইন্সটিটিউট কারিগরি শিক্ষা দানের কাজ শুরু করে।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন প্রমথনাথ বসু এবং প্রথম সভাপতি নিযুক্ত হন রাসবিহারী ঘোষ।
পাঠ্যক্রম
বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটে দু ধরনের পাঠক্রম চালু হয়।
- (১.) তিন বছরের অন্তর্বর্তী পাঠক্রম, এবং
- (২.) চার বছরের মাধ্যমিক পাঠক্রম ।
(১.) অন্তর্বর্তী পাঠক্রম
প্রবেশিকা পরীক্ষায় অনুত্তীর্ন ছাত্ররা অন্তর্বর্তী পাঠক্রমে পড়াশোনা করবার সুযোগ পেতো। অন্তর্বর্তী বিভাগের ছাত্ররা ছাপানো, রং মাখানো, ছুতোরের কাজ, বিভিন্ন ধরনের খোদাইয়ের কাজ, সাবান তৈরি করা, চামড়া পাকা করা, ইত্যাদি কাজ শিখতো।
পাঠক্রমের মধ্যে ছিলো - পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গনিত ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা।
(২.) মাধ্যমিক পাঠক্রম
প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা মাধ্যমিক পাঠক্রমে সুযোগ লাভ করতো। এদের শিক্ষা লাভের ৩ টি প্রধান বিষয় ছিলো -
- যন্ত্রবিজ্ঞান ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রবিজ্ঞান।
- ফলিত রসায়ন, এবং
- ভূ বিদ্যা।
শিক্ষকমন্ডলী
বহু প্রথিতযশা ব্যক্তি এই কারিগরি প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষাদানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সমস্ত শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন -
- প্রমথ বসু,
- শরৎ দত্ত,
- প্রফুল্ল মিত্র,
- যোগেশ ঘোষ,
- নিবারন রায়,
- সত্যদেব প্রমুখ।
কারিগরি শিক্ষার প্রসার
বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার পর বাংলায় কারিগরি শিক্ষার অভূতপূর্ব প্রসার ঘটে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এটি প্রতিষ্ঠার দুবছর পর ১৯০৮ খ্রিঃ এর ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় ১২৪ জন। ১৯১৬ সালে তা বেড়ে হয় ১৫০ জন। ১৯২০ সালে ২৪০ জন এবং ১৯২৪ সালে তা আরও বেড়ে হয় ৫২০ জনে।
১৯২৫ খ্রিঃ মধ্যে এই প্রতিষ্ঠান থেকে গড়ে প্রায় ১০০ জন সুযোগ্য ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হয়, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কারিগরি শিক্ষার বিকাশে নিয়োজিত হয়।
BTI এর নব রূপান্তর
বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (BTI) প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুকাল পরেই আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়।
ইতিমধ্যে ১৯১০ সাল নাগাদ জাতীয় শিক্ষা পরিষদের বিভাজন দূর হয়ে যায়। এই বিভাজন দূর হয়ে যাওয়ায় এবং প্রতিষ্ঠান গুলির আর্থিক সংকটের সমাধানের জন্য ১৯১০ খ্রিঃ বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট একসঙ্গে মিশে যায়। দুটি প্রতিষ্ঠান'ই এক হয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধিনে আসে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপায়ন
কিন্তু অল্প কিছু দিন পর বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এবং ১৯১৭ খ্রিঃ তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯২২ খ্রিঃ যাদবপুরে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের নতুন ভবন গড়ে ওঠে। ১৯২৪ খ্রিঃ বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটকে যাদবপুরে স্থানান্তরিত করা হয়।
১৯২৮ খ্রিঃ বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয় - "কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, বেঙ্গল।" ডঃ ত্রিগুনা সেনের নেতৃত্বে এই কলেজের উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৫৬ খ্রিঃ এটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিনত হয়।