জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর বিজ্ঞান সাধনা

 পরাধীন ভারতে বিজ্ঞান চর্চার প্রসারে যেসব ব্যক্তিরা এগিয়ে এসেছিলেন, জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন তাদের'ই একজন।

জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর বিজ্ঞান সাধনা
জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর বিজ্ঞান সাধনা

সংক্ষিপ্ত জীবনী

ইংল্যান্ডে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা সমাপ্ত করার পর জগদীশচন্দ্র বসু দেশে ফিরে আসেন এবং তৎকালীন গর্ভনর লর্ড রিপনের অনুরোধে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক পদে যোগ দেন।

বর্ন - বৈষম্যবাদের শিকার

কিন্তু চাকরিতে ঢোকার পরেই জগদীশচন্দ্র না বর্ন বৈষম্যের শিকার হন। সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে ব্রিটিশ অধ্যাপকরা যে বেতন পেতেন, সেই তুলনায় একই পদে কর্মরত হওয়া সত্ত্বেও জগদীশচন্দ্রকে নামমাত্র বেতন দেওয়া হয়।

বর্নবৈষম্যের প্রতিবাদে জগদীশচন্দ্র বেতন না নিয়েই ৩ বছর প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার কাজ চালিয়ে যান। শেষপর্যন্ত, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষের চেষ্টায় তাঁকে স্থায়ী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত করা হয় এবং বকেয়া সমস্ত বেতন মিটিয়ে দেওয়া হয়।

বিজ্ঞান চর্চা ও আবিষ্কার 

জগদীশচন্দ্র যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন, তখন ইওরোপীয় শিক্ষকদের অনেকেই মনে করতেন, ভারতীয়রা বিজ্ঞান শিক্ষাদানে এবং বিজ্ঞান গবেষনা কজের উপযুক্ত নন। জগদীশচন্দ্র একের পর এক মৌলিক আবিষ্কার করে তাদের এই ধারনা ভুল প্রমাণ করে দেন।

(১.) রেডিও তরঙ্গ আবিষ্কার 

প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনাকালেই জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনিই প্রথম তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে গবেষনা করেন এবং সর্বপ্রথম রেডিও তরঙ্গ শনাক্ত করতে সেমিকন্ডাক্টর জাংশন ব্যবহার করেন। এছাড়া, এখানকার সময়ে ব্যবহৃত অনেক মাইক্রোওয়েভ যন্ত্রাংশেরও আবিষ্কর্তা তিনি।

রেডিও তরঙ্গ বিষয়ে জগদীশচন্দ্র তাঁর প্রথম গবেষণা পত্রটি ১৮৯৫ খ্রিঃ প্রকাশ করেন। ঐ একই বছর অক্টোবর মাসে তিনি তাঁর দ্বিতীয় গবেষণা পত্রটি প্রকাশ করেন।

(২.) আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার

অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর গবেষণা পত্রটি যথাযথ ভাবে রচনা করতে পারলেও, তার "পেটেন্ট" করতে পারেন নি। কখনো এটা করাতেও চান নি। কারন বিজ্ঞানের সুফলকে তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করার পক্ষপাতি ছিলেন না। তাই তিনি তাঁর গবেষণা পত্র সকলের কাছে উন্মুক্ত করে দেন।

এর ফলে রেডিও তরঙ্গ আবিষ্কারের পুরো কৃতিত্বটাই চলে যায় অন্য আরেক বিজ্ঞানী মার্কানির কাছে। পেটেন্ট না থাকায়, রেডিও তরঙ্গ প্রকৃত আবিষ্কর্তা হিসাবে জগদীশচন্দ্রের কোন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আজোও জোটে নি।

জগদীশচন্দ্র তাঁর গবেষণার মধ্য দিয়ে রেডিও ও অপটিক্স সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অনুসন্ধান করেন। তিনি এমন যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যার সাহায্যে কোন তার ছাড়াই বার্তা পাঠানো ও গ্রহন করা যেতো। 

তাঁর দেওয়া সমস্ত সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করেই আজকের দিনের Wireless Technology, যেমন - রেডিও, টিভি, মোবাইল কাজ করছে। অথচ ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কোন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি'ই তিনি পান নি। গবেষণা পেটেন্ট না করায় তিনি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হন।

(৩.) উদ্ভিদের শরীরে প্রানের অস্তিত্ব আবিষ্কার

জগদীশচন্দ্র বসু Bio Physics নিয়েও গবেষনা করেন। তিনি প্রমান করেন, মানুষের মতো উদ্ভিদের দেহেও প্রান আছে এবং তারাও ব্যাথা অনুভব করে এবং সুখ - দুঃখের অনুভব করে। উদ্ভিদের দেহে উদ্দীপনার আদান প্রদান ইলেকট্রনের মাধ্যমে হয়ে থাকে।

জগদীশচন্দ্র "ক্রেসকোগ্রাফ" নামে একটি যন্ত্রের আবিষ্কার করেন, যার সাহায্যে উদ্ভিদের দেহের স্পন্দন মাপা যায়।

নিজ গবেষনাকে প্রমান করার জন্য জগদীশচন্দ্র একটি গাছকে ব্রোমাইড নামক বিষাক্ত গ্যাস যুক্ত একটি পাত্রে রেখে দেন। এরপর তিনি লক্ষ্য করেন, সেই গাছটির পালস্ সাধারণ জীবজন্তুর মতোই অস্থির হচ্ছে। কখনো গাছটির স্পন্দন কমে যাচ্ছে। আবার কখনো খুব বেড়ে যাচ্ছে। এইভাবে কিছুক্ষণ চলবার পর গাছটি শেষপর্যন্ত মারা যায়।

এই গবেষণা থেকে ডঃ বোস সিদ্ধান্তে আসেন, প্রানীদের মতো উদ্ভিদের দেহেও প্রান আছে

প্রথম পেটেন্ট নেওয়া ভারতীয় বিজ্ঞানী

যে যন্ত্রের সাহায্যে ডঃ জগদীশচন্দ্র বসু উদ্ভিদের শরীরে প্রানের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন, সেই "ক্রেসকোগ্রাফ" যন্ত্রের পেটেন্ট রেজিস্টার করাতেও তিনি অরাজী ছিলেন।

শেষপর্যন্ত বন্ধু বান্ধবদের অনেক অনুরোধের পর তিনি যন্ত্রটির পেটেন্ট রেজিস্টার করাতে রাজী হন। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, "ক্রেসকোগ্রাফ" 'ই ছিলো আমেরিকাতে কোন ভারতীয় বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের জন্য নেওয়া প্রথম পেটেন্ট

পেটেন্ট কি?

পেটেন্ট হলো এক ধরনের মেধাসম্পদ। পেটেন্টের মাধ্যমে আবিষ্কর্তাকে তাঁর আবিষ্কারের স্বীকৃতি স্বরূপ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একচেটিয়া মালিকানা প্রদান করা হয়। আবিষ্কারক কে পেটেন্ট প্রদানের অর্থ হলো, এই নির্দিষ্ট সময়ে অন্য কেউ তাঁর তৈরি আবিষ্কার তৈরি, ব্যবহার বা বিক্রি করতে পারবে না।

পেটেন্টের মূল উদ্দেশ্য দুটি -

  1. আবিষ্কারক বা উদ্ভাবনকারীকে স্বীকৃতি জানানো, এবং
  2. নকল পন্য বা অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতিহত করা। 
অনেক সময় অসাধু ব্যবসায়ী বা প্রতিযোগী সংস্থা নকল পন্য বাজারে বিক্রয় করে উদ্ভাবনকারীকে আর্থিক দিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি রোধ করার জন্যই এই পেটেন্ট আইনের উদ্ভব ঘটে। আবিষ্কর্তাকে পেটেন্ট নিতে হলে তার আবিষ্কারকে পেটেন্ট আইনে রেজিস্টার করাতে হয়। 

জগদীশ চন্দ্র বসু সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য 

জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন এরোপ্লেনের গতিপথের দিশারী রাডার ও কৃত্রিম মস্তিষ্ক আবিষ্কারের পথিকৃৎ। তিনিই প্রথম মানুষের স্মৃতিশক্তির যান্ত্রিক মডেলের নমুনা তৈরি করেন। পৃথিবীর নানা দেশে আমন্ত্রিত হয়ে জগদীশচন্দ্র বৈজ্ঞানিক গবেষনা বিষয়ে একাধিক ভাষন দেন। ১৯০৩ খ্রিঃ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব মেলার বিজ্ঞান শাখায় তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। 

জগদীশচন্দ্রের লিখিত গবেষনা পত্রের সংখ্যা ছিলো ১২৮ টি, এবং তাঁর রচিত পুস্তকের সংখ্যা ছিলো ১১ টি। "অব্যক্ত" তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত বই। বিজ্ঞান চর্চায় এই বিপুল অবদানের জন্য জগদীশচন্দ্রকে "ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞান চর্চার জনক" বলে অভিহিত করা হয়। 

এই লেখা আমরা শেষ করবো জগদীশচন্দ্রের একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে। দীক্ষা প্রবন্ধে তিনি বলেন - 
"জীবন সম্বন্ধে একটি মহাসত্য এই, যেদিন হইতে আমাদের বাড়িবার ইচ্ছা স্থগিত হয়, সেইদিন হইতে জীবনে মৃত্যুর ছায়া পড়ে। "

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post