বসু বিজ্ঞান মন্দির

 বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় কৃতিত্ব ও স্মারক ছিলো "বসু বিজ্ঞান মন্দির" প্রতিষ্ঠা। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ১৯১৭ খ্রিঃ ভারতে স্বাধীন ভাবে বিজ্ঞান চর্চার জন্য এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি নির্মান করেছিলেন।

বসু বিজ্ঞান মন্দির
বসু বিজ্ঞান মন্দির 

প্রেক্ষাপট

প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা কালে'ই জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষনার কাজে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে না ছিলো ভালো মানের ল্যাবরেটরি, না ছিলো কোন মৌলিক গবেষনা করবার সুযোগ বা পরিবেশ।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞান সাধনা ও গবেষনার জন্য একটি স্বাধীন স্বয়ং সম্পূর্ন গবেষনাগারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতিষ্ঠা এই ভাবনার'ই ফলশ্রুতি ছিলো বলা যায়।

এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা এখানে আমরা বলবো। বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড রেলে একবার জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবরেটরি দেখতে আসেন। যদিও রেলে এসেছিলেন বিনা আমন্ত্রণে, শুধুমাত্র জগদীশচন্দ্রের অনুরোধে।

এই ঘটনায় ঐ দিনই বিকালে কলেজের অধ্যক্ষ জগদীশচন্দ্র কে চার্জশিটের ভাষায় কৈফিয়ত তলব করেন, কেন কলেজের অনুমতি ছাড়া রেলের মতো একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে আসেন? 

এতে জগদীশচন্দ্র খুবই অপমানিত বোধ করেন এবং এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। এর ফলে কর্তৃপক্ষ তার গবেষণার কাজে বাধার সৃষ্টি করতে থাকে। এইজন্য জগদীশচন্দ্র মনস্থির করেন যে, তিনি নিজ তত্ত্বাবধানে এমন একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করবেন, যেখানে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারবেন। 

এই লক্ষ্যেই ১৯১৫ খ্রিঃ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯১৭ খ্রিঃ জগদীশচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠা করেন "বসু বিজ্ঞান মন্দির"।

বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ভবন নির্মাণ 

৯৩/১ আপার সার্কুলার রোডে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের নিজস্ব ভবন গড়ে ওঠে। ১৯১৭ খ্রিঃ ৩০ নভেম্বর, জগদীশচন্দ্রের ৬০ তম জন্মদিনে তাঁর বহু কাঙ্খিত স্বপ্ন সার্থক হয় "বোস ইনস্টিটিউশন" এর দ্বারোদঘাটনের মধ্য দিয়ে। 

জগদীশচন্দ্রের লক্ষ্য ছিলো বোস ইনস্টিটিউশনকে ইংল্যান্ডের রয়েল ইনস্টিটিউশনের মতো একটি উৎকৃষ্ট মানের বিজ্ঞান গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। 

উদ্দেশ্য 

জগদীশচন্দ্র বসু "বসু বিজ্ঞান মন্দির" প্রতিষ্ঠার পিছনে ৩ টি মূল উদ্দেশ্যের কথা বলেছিলেন - 

  1. প্রথমটি হলো - বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটানো, 
  2. দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি হলো - জ্ঞানের প্রসার ঘটানো, 
  3. তৃতীয় উদ্দেশ্যটি হলো - ভারতীয় গবেষকরা যাতে বিনা বাধায় স্বাধীন ভাবে বিজ্ঞান চর্চা করতে পারেন, তা সুনিশ্চিত করা। 
১৯১৬ খ্রিঃ ১৫ নভেম্বর, অধ্যাপক ভাইনস্ কে এক পত্রে জগদীশচন্দ্র লেখেন, ভারতে বিজ্ঞান মন্দিরের মতো একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আছে, যাতে এই দেশের তরুন বিজ্ঞান কর্মীরা আমার মতো বাধা বিঘ্নের সম্মুখীন না হয়। 

বসু বিজ্ঞান মন্দিরের আদর্শ 

বসু বিজ্ঞান মন্দিরের আদর্শ সম্পর্কে বলতে গিয়ে জগদীশচন্দ্র বসু বলেছিলেন, "আজ যাহা প্রতিষ্ঠা করিলাম তাহা মন্দির, কেবল পরীক্ষাগার নহে"

 তাঁর মতে, বিজ্ঞান সব সময়'ই সত্যকে জানার চেষ্টা করে। কিন্তু এমন কিছু সত্য আছে, যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পরিধির বাইরে থাকে। সেই সত্যকে বিশ্বাসের দ্বারা অর্জন করতে হয়। তাই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা। কারন একমাত্র মন্দির' ই হলো সেই বিশ্বাস প্রভাবিত সত্যকে বোঝবার উপযুক্ত জায়গা

 এই বিশ্বাস ও যুক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়েই জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর গবেষণাগারের নাম দিয়েছিলেন - "বসু বিজ্ঞান মন্দির"।

বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত এক ভাষনে বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও আদর্শ সম্পর্কে জগদীশচন্দ্র বলেন, "বিজ্ঞান প্রগতিকে সর্বসাধারনের মধ্যে পরিব্যাপ্ত করাই আমার উদ্দেশ্য। এই বিজ্ঞান মন্দিরে যেসব নতুন নতুন আবিষ্কার হবে, তার শুভফল ভোগে সব মানুষের সমান অধিকার থাকবে। এক মহত্তর উপায়ে আমি পৃথিবীকে সেবা করে যেতে চাই। বহু শতাব্দী আগে নালন্দা ও তক্ষশীলা জ্ঞানকেন্দ্রে পৃথিবীর নানা দেশে মানুষের জন্য দ্বার উন্মুক্ত ছিলো। সে ঐতিহ্যকে আমি পুনরুজ্জীবিত করতে চাই। "

জগদীশচন্দ্রের এই কথন ও অভিব্যক্তির মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, জগদীশচন্দ্রের বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার পিছনে ভারতীয় ঐতিহ্য ও সুমহান মানবতাবাদী দর্শন - মূল আদর্শের ভিত্তিভূমি হিসেবে কাজ করেছিলো। 

বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ভবন - স্থাপত্য 

বসু বিজ্ঞান মন্দিরের মূল ভবনটি মন্দিরের আদলেই তৈরি করা হয়েছিলো। মৌর্য যুগের স্থাপত্য শৈলী তে মূল গবেষনা ভবনটি নির্মিত। প্রবেশ পথের পাশে রয়েছে উদ্যান, সেখানে লজ্জাবতীর মতো স্পর্শকাতর ও স্পন্দনশীল বিভিন্ন উদ্ভিদ রোপিত। একদিকে ক্ষুদ্র জলাশয় ও কৃত্রিম প্রস্রবন, তার ওপরে এক নারীমূর্তি মন্দিরে প্রদীপ বয়ে নিয়ে চলেছে। 

বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠায় যেসব মানুষেরা জগদীশচন্দ্রকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিলেন, ভগিনী নিবেদিতা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়ে ভগিনী নিবেদিতা আর ইহলোকে ছিলেন না। 

খুব স্বাভাবিক ভাবেই মহান এই মহিলার অভাব জগদীশচন্দ্র গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। নিবেদিতার স্মৃতিকে স্মরন করে বিজ্ঞান মন্দিরে প্রতীক হিসাবে "বজ্র" এবং বিজ্ঞান মন্দিরের প্রবেশপথে জ্ঞানের আলোকবর্তিকাধারী নারীমূর্তি বসানো হয়। 

বিজ্ঞান মন্দিরের শিল্পমোহিত সৌন্দর্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে জগদীশচন্দ্র বলেছিলেন, "যেমন সত্য, সৌন্দর্য্যও তেমনি সত্য। সুতরাং বিজ্ঞানের সহিত সৌন্দর্যের বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী নহে।" 

বসু বিজ্ঞান মন্দিরের পরিচালনা 

বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার পর জগদীশচন্দ্র এর ভার অর্পন করেছিলেন ট্রাস্টির হাতে। এটি পরিচালনার জন্য যে তত্ত্বাবধায়ক সমিতি গঠিত হয়েছিলো, তার সদস্যদের মধ্যে ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ, নীলরতন সরকার, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুধাংশুমোহন বসু, সতীশরঞ্জন দাশ, অবলা বসু এবং জগদীশচন্দ্র বসু। 

দেশীয় ব্যক্তিদের সাহায্য 

বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার পর জগদীশচন্দ্র তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় এতে নিয়োজিত করেন। বিজ্ঞান মন্দির কে একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান কেন্দ্র রূপে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য প্রয়োজন পড়েছিলো প্রভূত অর্থের। জগদীশচন্দ্র দেশবাসীর কাছে এজন্য সাহায্যের প্রার্থনা করলে বহু জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে অর্থ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। 

এদের মধ্যে ছিলেন - (১.) কাশিম বাজারের মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী। তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ২ লক্ষ টাকা অর্থ সাহায্য করেন। (২.) এছাড়া, পাতিয়ালা, বরোদা, ও কাশ্মীর প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যের রাজারাও যথাসাধ্য অর্থ সাহায্য করেন। (৩.) বোম্বাই ও পুনার ছাত্র সমাজও জগদীশচন্দ্রের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রভূত অর্থ সাহায্য করেন।

বসু বিজ্ঞান মন্দিরের মুখপত্র 

বিদেশী জার্নালে গবেষনা পত্র প্রকাশ করবার বাধা বিঘ্ন সম্পর্কে জগদীশচন্দ্রের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছিলো। সেই অভিজ্ঞতার নিরিখেই জগদীশচন্দ্র ঠিক করেন, বিজ্ঞান মন্দিরের কর্মধারা ও গবেষনা প্রকাশ করবার জন্য তার নিজস্ব একটি মুখপত্র থাকবে। রয়েল সোসাইটি তে প্রকাশিত প্রবন্ধের গুনমানের মাপকাঠিতেই সেখানে প্রবন্ধ গুলি নির্বাচিত হবে। 

যাইহোক, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞান মন্দির থেকে প্রকাশিত মুখপত্র "ট্র্যানজ্যাকশনস" পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক মুখপত্র গুলির মধ্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে। 

প্রথম কয়েকবছর জগদীশচন্দ্রের সক্রিয় তত্ত্বাবধানে তার শিষ্যবর্গ যেসব গবেষনা করেন, "ট্র্যানজ্যাকশনস" এ মূলত তাই প্রকাশিত হয়। কালক্রমে এখানকার মৌলিক গবেষনা বিজ্ঞানী মহলে অকুন্ঠ প্রশংসা লাভ করে এবং অতি অল্প সময়ে "বসু বিজ্ঞান মন্দির" ভারতের প্রথম শ্রেণীর গবেষনাগার হয়ে ওঠে। 

বসু বিজ্ঞান মন্দিরের গবেষণা ও কৃতিত্ব 

বসু বিজ্ঞান মন্দিরে প্রথম দিকে পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন ও উদ্ভিদ বিদ্যা এই ৩ টি বিভাগে গবেষনা হলেও, পরবর্তীকালে আরোও নানা বিভাগ যুক্ত করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো - 
  1. প্ল্যান্ট বায়োলজি, 
  2. মাইক্রো বায়োলজি, 
  3. বায়ো কেমিস্ট্রি, 
  4. বায়ো ফিজিক্স ইত্যাদি। 
বিজ্ঞান গবেষনার ক্ষেত্রে বসু বিজ্ঞান মন্দির একাধিক কৃতিত্বের নজির সৃষ্টি করে - 
  1. এই গবেষনাগারে গবেষনা করেই জগদীশচন্দ্র প্রমান করেন, প্রানীদের মতো উদ্ভিদেরও শরীরে প্রান আছে। 
  2. জড় ও জীবের সম্পর্ক বিষয়ে পরীক্ষার জন্য এই গবেষনাগারেই ১৭ টি যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। যার মধ্যে অন্যতম ছিলো - ক্রেসকোগ্রাফ, স্ফিলমোগ্রাফ, পাটোমিটার, ফটোসিন্থেটিক বাবলার, রেজোনেন্ট রেকর্ডের, ইলেকট্রিক গ্লোব ইত্যাদি। 
  3. জীববিদ্যা ও জৈব সংক্রান্ত গবেষনায় এই প্রতিষ্ঠান বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। 
  4. বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষনা করেই শম্ভুনাথ দে কলেরার টিকা আবিষ্কার করেন। 
  5. বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্ট ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছে। 
  6. এখনও পর্যন্ত বসু বিজ্ঞান মন্দির থেকে ৩৩ জন গবেষক দেশ বিদেশে বিভিন্ন সায়েন্স একাডেমীতে ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন।

জগদীশচন্দ্র পরবর্তীকালীন বসু বিজ্ঞান মন্দির

জগদীশচন্দ্র বসুর মৃত্যুর পর বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তার দায়িত্ব নেন তাঁর ভাগ্নে দেবেন্দ্রমোহন বসু। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে একাধিক শিক্ষা বিভাগ, গ্রন্থাগার ও সেবাকেন্দ্র রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে জে সি বোস মিউজিয়াম, জগদীশচন্দ্র বসুর হাতে লেখা পান্ডুলিপি ও বাংলা ভাষায় রচিত জগদীশচন্দ্রের লেখা "অব্যক্ত" বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ এবং নানা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post