বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে প্রথম পর্বে (বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশ - ইওরোপীয় উদ্যোগ) আমরা এদেশে বিজ্ঞান শিক্ষায় বিভিন্ন ইওরোপীয় ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার দিক গুলি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজ আমরা বিজ্ঞান শিক্ষায় বিভিন্ন ভারতীয় ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার দিক গুলি নিয়ে আলোচনা করবো।
বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশ - ভারতীয় উদ্যোগ |
রাজা রামমোহন রায় ও বিজ্ঞান শিক্ষা
ভারতীয় ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র রামমোহন রায় সর্বপ্রথম এদেশে আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধি করেন।
- ১৮২৩ খ্রিঃ তিনি গভর্নর লর্ড আমহাস্টকে এক পত্র মারফৎ এদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রবর্তনের দাবি জানান।
- এছাড়া, রামমোহন রায় নিজে বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক বইও রচনা করেন।
- জ্যামিতি বিষয়ে তিনি "দ্রাঘিজ্যা" নামে একটি বই লেখেন। বলা হয়ে থাকে, গনিত শাস্ত্রে "জ্যামিতি" নামটি তাঁরই দেওয়া।
- বিজ্ঞান বিষয়ক বেশ কিছু প্রবন্ধ রামমোহন রায় তাঁর "সংবাদ কৌমুদি" পত্রিকায় ছেপে বের করেন।
বিজ্ঞান চর্চায় এই বিপুল অবদানের জন্য অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন রামমোহন রায়কে" ভারতে বিজ্ঞান চর্চার আদিগুরু" বলে অভিহিত করেন।
হিন্দু কলেজ ও বিজ্ঞান শিক্ষা
রামমোহনের পাশাপাশি রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের মতো রক্ষনশীল মানুষেরাও এদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এই উপলব্ধির ফলস্বরূপ দেশীয় ব্যক্তিদের উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিঃ গড়ে ওঠে "হিন্দু কলেজ"।
সূচনা কালে হিন্দু কলেজের দুটি বিভাগ ছিলো - স্কুল ও কলেজ। কলেজ বিভাগে ভাষা ও ইতিহাস চর্চার পাশাপাশি ক্রনোলজি, জ্যোর্তিবিদ্যা, গনিত শাস্ত্র এবং রসায়ন বিদ্যা সহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা গুলিতে শিক্ষাদান করা হতে থাকে।
ইয়ংবেঙ্গল ও অন্যান্য বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা
১৮৩০ দশক থেকে বাঙালিদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার তাগিদটি আরোও বেড়ে যায়। এইসময় ইয়ং বেঙ্গলদের "একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন" এবং "পার্থেনন" পত্রিকায় বিজ্ঞান চর্চা ও যুক্তিবাদের প্রসারের কথা বলা হয়।
এছাড়া, অক্ষয় কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদির মতো বহু প্রথিতযশা ব্যক্তি ব্যক্তিগত ভাবে যেমন বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেন, তেমনি এদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারেও জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন।
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয় কুমার দত্ত "বাহ্য বস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ" (১৮৫২) এবং "পদার্থবিদ্যা"(১৮৫৬) নামে দুটি বিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক বই লেখেন। এজন্য তাকে "ভারতের বেকন" বলা হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখেন, "বিজ্ঞান রহস্য প্রবন্ধ"। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী তাঁর" মায়াপুরী" গ্রন্থে লেখেন -" বিশুদ্ধ জ্ঞান আহরনের জন্য বিজ্ঞানই একমাত্র রাস্তা"।
" বিজ্ঞান চর্চা ও শিক্ষার" প্রাতিষ্ঠানিক রূপ
ধীরে ধীরে "বিজ্ঞান শিক্ষা" বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন চর্চার ধারা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলির মধ্যে সংগঠিত হতে আরম্ভ করে।
- শ্রীরামপুর কলেজে প্রথম বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়।
- ১৮১৭ খ্রিঃ হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে,সেখানে পাঠ্যক্রমের মধ্যে বিজ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া, এইসময় স্কুল বুক সোসাইটি বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক পুস্তক প্রকাশ করেও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
- কলকাতা মাদ্রাসা, সংস্কৃত কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতে অঙ্ক ও বিজ্ঞান পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
- সরকারি স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের বিষয়টিও ধীরে ধীরে গুরুত্ব লাভ করে। ১৮৩৫ খ্রিঃ জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য অঙ্ক ও ফিলসফি বিষয়ে অধ্যাপক পদ সৃষ্টির জন্য সুপারিশ করে। ১৮৫৪ খ্রিঃ চার্লস উড তার শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন।
- ১৮৫৭ খ্রিঃ গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানে ডিগ্রিদানের ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে অঙ্ক, অজৈব রসায়ন, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, প্রানীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও ভূ বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
- বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলো চিকিৎসা বিজ্ঞানও। ১৮৩৫ খ্রিঃ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষায় বিপ্লব আসে। ১৮৩৬ খ্রিঃ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ করেন মধুসূদন গুপ্ত। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই এম ডি ডিগ্রি লাভ করেন মহেন্দ্রলাল সরকার।
এইভাবে ধীরে ধীরে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞান শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।
বিজ্ঞান শিক্ষার বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা
ঔপনিবেশিক আমলের প্রথম পর্বে এবং পরবর্তী পর্ব গুলিতে বিজ্ঞান শিক্ষার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
- বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষায় সরকারীভাবে কোন উদ্যোগ বা তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় নি।
- বাংলার বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞান শিক্ষার বেশিরভাগটাই চলেছিলো ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা বেসরকারী উদ্যোগে।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতে যেটুকু বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো, তা সবই ছিলো থিওরি ক্লাস নির্ভর।
- প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের কোন ব্যবস্থা সেখানে ছিলো না।
- বিজ্ঞানের বিষয় গুলি পড়ানোর উপযুক্ত শিক্ষকও তখন পাওয়া যেতো না।
- বিজ্ঞানের সিলেবাসও তখন আকর্ষনীয় ছিলো না।
- উচ্চস্তরে বিজ্ঞান পঠন পাঠন বা গবেষণার বিশেষ কোন সুযোগও ছিলো না।
- দেশের রক্ষনশীল মানসিকতাও বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিলো। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম শবব্যবচ্ছেদের বিরুদ্ধে রক্ষনশীলদের সমাজ চ্যুতির হুমকি ও তীব্র বিরোধিতার কথা প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়।
- বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণার বিষয়ে কোন প্রতিষ্ঠান সরকারীভাবে গড়ে ওঠে নি।
আমরা আগেই বলেছি, ঔপনিবেশিক স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখতে এবং জনমতের চাপে সরকার দায়সারা ভাবে যেটুকু না করলে নয়, বিজ্ঞান শিক্ষায় সেটুকুই আয়োজন করেছিলো।
কোন গবেষণাগার বা উচ্চ বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতিষ্ঠান সরকার গড়ে তোলে নি। কারন বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্য দিয়ে মৌলিক গবেষণা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ ঘটুক, এটা ইংরেজরা মনে প্রানে কখনই চায় নি।
"উন্নত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান" ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যে একটি বড়ো হাতিয়ার, ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব তা প্রমান করে দিয়েছিলো। এমতাবস্থায়, পরাধীন ভারতবর্ষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বলবান হোক, এটা সরকার চায় নি বলেই বিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষা ও গবেষনায় উদাসীনতা দেখায়।
তবে মনে রাখতে হবে, সরকারী এই উদাসীনতা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষায় অভূতপূর্ব জাগরন ঘটে। এর একটি বড়ো কারন ছিলো স্বদেশী আন্দোলন।
স্বদেশী আন্দোলনে (১৯০৫) ইংরেজদের সমস্ত কিছুকে বয়কট করে "স্বদেশী" অর্থাৎ "আত্মশক্তি" অর্জনের শপথ নেওয়া হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় গোলামীর বদলে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার সংকল্প নেওয়া হয়। চাকুরির বদলে বিকল্প স্বাধীন কর্মসংস্থানের ভাবনা গুরুত্ব পায়। স্বাধীন মানসিকতার জন্ম হয়। আর এ সবই এদেশে বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞান শিক্ষাকে প্রভাবিত করে।
এই সময় বিজ্ঞান সাধনার মধ্য দিয়ে আত্মশক্তি অর্জনের জন্য দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানীরা এগিয়ে আসেন। সরকারী শিক্ষা কাঠামোর মধ্যে স্বাধীন ও মৌলিক গবেষণার কোন সুযোগ ছিলো না বলে,
- আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠা করেন - "বেঙ্গল কেমিক্যাল",
- জগদীশ চন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠা করেন - "বসু বিজ্ঞান মন্দির",
- সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রতিষ্ঠা করেন - "বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ",
- মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠা করেন - "ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভিশন অফ সায়েন্স" এর মতো মৌলিক গবেষনাগার।
নতুন আবিষ্কার আর মৌলিক গবেষণার বিচ্ছুরনে তাঁরা বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চায় ভারতীয়দের "মেধা ও মননকে" আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির স্তরে পৌঁছে দিয়ে জাতীয় গৌরব বৃদ্ধি করেন। পরবর্তী পর্ব গুলিতে তাদের এই বিশেষ কৃতিত্বের দিক গুলিকে নিয়ে আমরা পৃথক পৃথক ভাবে আলোচনা করবো। আজকের পর্বটির আলোচনা আপাতত এই পর্যন্তই..।
তৃতীয় পর্ব - মহেন্দ্রলাল সরকার ও IACS