এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, তার অল্প কিছুক্ষন আগেই বাংলাদেশের মৌলবাদী হামলার একটি ভিডিও ইউটিউবে দেখছিলাম। ওটা দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই ভিডিওটার কমেন্ট বক্সের দিকে নজর পড়ে গেলো। সেখানে অনেক খোঁজাখুঁজির পর কিছু মুসলিমের কমেন্ট পড়লাম। এদেরই একজন মৌলবাদী হিংসার ভিডিও ফুটেজ দেখে এতটাই উচ্ছসিত হয়ে পড়ে যে, মন্তব্য করে বসে আজ ঈদ ঈদ লাগছে। এদের একজন এমন মন্তব্যও করে বসে, আগামী ৫০ বছরে নাকি এইভাবে সকল হিন্দুদের মুসলমান করে নেওয়া হবে। নিজের বক্তব্যের স্বপক্ষে এরা বেশ কিছু উদাহরণও দিয়ে বসে।
হিন্দু ধর্ম কি সত্যিই একদিন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে? |
এদের "হিন্দু শূন্য করার এই তত্ত্ব" অবশ্য হিন্দু রক্ষাকারী কিছু হিন্দু সংগঠনের নেতাদের ভাষনেও শোনা যায়। দুই পক্ষই নিজ নিজ স্বার্থে এই জুজুকে ব্যবহার করে থাকেন। এই জুজু নিয়ে অবশ্য আমার আজকের লেখা নয়। আজকের লেখাটির মূল বিষয়বস্তু হলো, হিন্দু ধর্ম কি সত্যিই কালের গর্ভে বিলিন হয়ে যাবে? এমন আশঙ্কার কি কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে?
প্রথমেই বলি, এমন আশঙ্কা একেবারেই অমূলক। যারা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান রাখেন, তারা সকলেই জানেন হিন্দু ধর্মের বিনাষ কখনই সম্ভব নয়।
প্রিয় পাঠক, লেখনীর গভীরে প্রবেশ করার আগে আমার সীমাবদ্ধতার কথাও বলতে চাই। আমি কোন ধর্মতাত্ত্বিক বা ধর্ম বিশেষজ্ঞও নই। সামান্য একজন ইতিহাসের পাঠক মাত্র। ঐতিহাসিক চেতনা থেকেই বর্তমানের সব কিছুকে বিশ্লেষন করা আমার নেশা ও পেশা।
আর হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে আমার জ্ঞানের কথা যদি বলেন, তাহলে বলবো, হাজার বছরে হিন্দুধর্মে এমন কোন মহাজ্ঞানীর জন্ম হয় নি, যিনি সম্পূর্ণ ভাবে হিন্দু ধর্মকে ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন। এই হাজার বছরে অবশ্য এমন অনেক মহাপুরুষের জন্ম হয়েছে, যারা কালের প্রয়োজনে হিন্দুধর্মকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করে তার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছেন।
সুতরাং এই লেখা কোন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে লিখছি না। কেননা সে সম্পর্কে আমার যেটুকু জ্ঞান আছে, তা দিয়ে আর যাই হোক, কলমে খুব বেশি আঁচড় কাটা যায় না। এই লেখার ভিত্তিভূমি এবং পশ্চাৎপট হলো ঐতিহাসিক চেতনা।
প্রথমেই আসি, হিন্দু ধর্মের স্বরূপের আলোচনাতে। হিন্দু ধর্ম আসলে কি?
ব্যক্তিগত ভাবে হিন্দু ধর্মকে আমি যতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি, তাতে মনে হয়েছে, জীবনবোধ ও কর্তব্যবোধের অপর নামই হলো হিন্দু ধর্ম। হিন্দু ধর্মে "ধর্ম" বলতে বোঝানো হয়, যেকোন বিশেষ মুহূর্তে আপনার করনীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য কি? তা পালন করার নামই হলো ধর্ম।
ছাত্র অবস্থাতে পড়াশোনা এবং চরিত্র গঠন হলো আপনার ধর্ম। যৌবনে বিবাহ এবং সংসার পালন হলো আপনার ধর্ম। আপনি হয়তো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, কোন একজন বিপদগ্রস্থ ব্যক্তি আপনার সাহায্য প্রার্থী। তাকে সাহায্য করা আপনার ধর্ম। কোনোও এক রাতে কয়েক হাজার লোক একজন চোরকে তাড়া করেছে। সে লুকিয়ে এসে আপনার কাছে আশ্রয় চেয়ে প্রান ভিক্ষা করেছে। তাকে আশ্রয় দেওয়া যেমন আপনার ধর্ম। তেমনই আক্রমণকারী জনতার রোষ থেকে তাকে রক্ষা করে সুবিচারের জন্য রাজার হাতে তুলে দেওয়াও আপনার ধর্ম। মনে রাখবেন, সাপ দংশন করবে জেনেও তাকে দুধ কলা খাইয়ে পুজো করার বিধান তো আমাদের ধর্মেই আছে।
হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর বলতে বোঝানো হয় পরমব্রহ্মকে। এখন পরমব্রহ্ম যে ঠিক কি, সেটা যুগ যুগান্ত ধরে কেউই ঠিক করে ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। খুব সহজে বুঝে নিতে গেলে বলতে হয়, পরমব্রহ্ম হলো এক অখন্ড শক্তি - জ্যোতিপুঞ্জ। জগতে সব কিছুই শক্তির দ্বারাই ক্রিয়াশীল। সেই শক্তি জগতের সমস্ত কিছুর মধ্যেই বিরাজমান।
এই জন্য বলা হয়ে থাকে, জগতে এমন কিছু নেই, যার মধ্যে ঈশ্বরের অংশ নেই। পৃথিবীতে এমন কোন জিনিস নেই যাকে হিন্দুরা দেবতা জ্ঞানে পুজো করে না। সে বিশ্বকর্মা রূপে আধুনিক যুগের কম্পিউটারই হোক, অথবা ষষ্ঠিদেবী রূপে আপনার রান্নার উনুন অথবা শিলনোড়া, সব কিছুকেই হিন্দুরা শক্তি অর্থাৎ ঈশ্বরের আধার রূপে আরাধনা করে থাকে। হিন্দু ধর্মে বহু দেবতার কনসেপ্ট সম্ভবত এই চেতনাবোধ থেকেই এসেছে। যদিও তাঁর মূল ভিত্তিভূমি হলো একেশ্বরবাদ।
হিন্দু ধর্মে ঈশ্বরের আরাধনা বলতে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনকেই বোঝানো হয়ে থাকে। যুগ যুগান্ত ধরে আমাদের ঋষিরা এই কাজটিই করে গেছেন। যারা সেই সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে পেরেছেন, তারা অন্তিমে পৌঁছে লাভ করেছেন অপার আনন্দ। এই আনন্দ সুধাই হলো হিন্দু ধর্মের মূল ফিলোজফি। আমরা সমস্ত ধর্মীয় উৎসবের মাধ্যমে সেই আপার আনন্দের কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করি। এই আনন্দকেই বলা হয়েছে অমৃত।
হিন্দু ধর্মের এই আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের কনসেপ্ট বা দর্শনটি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়ে থাকে। এখানে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমাত্মা। আর শ্রীরাধা হলেন জীবাত্মা। শ্রীরাধা কৃষ্ণ প্রেমে তার আশপাশের সব কিছুর মধ্যেই কৃষ্ণকে দেখতে পান। তিনি যে খাবার খাচ্ছেন, তার মধ্যেও যেমন কৃষ্ণ এসে ধরা দেন। তেমনি যখন তিনি যমুনায় জল আনতে যান, তখন সেই জলের মধ্যেও শ্রীকৃষ্ণের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। আবার শ্রীরাধা যখন তার চুল বাঁধছেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে বাঁশি বাজিয়ে দূর থেকে ডাকছেন। সেই ডাক শুনে চুল বাঁধা অসম্পূর্ণ রেখেই রাধা বাঁশির ডাক অনুসরন করে ছুটে চলেছেন।
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, আপনি যতই লৌকিক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকুন না কেন, আপনার পরমাত্মা যখন আপনাকে ডাকবে, তখন শরীর নামক এই জীর্ন বস্ত্র ত্যাগ করে আপনাকে পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের জন্য ছুটে যেতেই হবে। এই দর্শনের কারনেই আজও কেউ মারা গেলে তার দাহকার্য করার সময়ে আমরা কৃষ্ণনাম করতে করতে নিয়ে যাই। অথবা তার মৃত্যু সমাচার লিখে থাকি, তিনি কৃষ্ণযাত্রা করেছেন।
শ্রীরাধা যেমন প্রেমের মধ্য দিয়ে জগতের সমস্ত কিছুর মধ্যেই পরমব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণকে খুঁজে পান, ঠিক তেমনি হিন্দুধর্মে জাগতিক সমস্ত কিছুর মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়ানো হয়ে থাকে। পরমাত্মার সঙ্গে জাগতিক জীবাত্মার এই মিলনের সহজ ও বোধগম্য প্র্যাকটিসের জন্য গুপ্ত যুগের শেষদিকে হিন্দু ধর্মে বহু মূর্তি পুজোর কনসেপ্ট ও লোকাচার এসে পড়ে। এবং এই লোকাচারটিকেই অনেকে প্রকৃত হিন্দুধর্ম ভেবে বসে।
এই কারনে আজকে বাংলাদেশে দূর্গা মূর্তি এবং মন্দির ধ্বংসে যারা আশঙ্কিত হয়ে পড়েন, তাদের জন্য বলি, তাদের ঐ আশঙ্কা একেবারেই অমূলক। কেননা মনে রাখবেন, আপনার ঈশ্বর ঐ মূর্তির মধ্যে থাকে না। আপনার শিব থাকে জীবের মধ্যে। আপনি যে রাস্তায় এখন হেঁটে চলেছেন, সেই রাস্তার অসংখ্য নুড়ির মধ্যে আপনি আপনার শিবকে খুঁজে পাবেন। কোন কিছুর বিনিময়ে বিধর্মীরা আপনার আরাধ্যকে আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। আপনি যদি লৌকিক উপাচারে আসক্ত হিন্দু না হন তো, হাজার চেষ্টা করেও কেউ আপনার বিশ্বাস ভেঙ্গে দিতে পারবে না।
হিন্দু ধর্ম শুধু লৌকিক মূর্তিপুজা নয়। জ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে অপার আনন্দে পৌঁছানোর নামই হলো সনাতন ধর্ম। এই কারনটির জন্যই প্রাচীন কালে দেব উপাসনার অনেক মন্দিরে সম্ভোগ কলার নানা ভাষ্কর্য খোদাই করা থাকতো। আপনি হয়তো খাজুরাহের মন্দির দেখেছেন। সেই মন্দিরে যৌন ক্রীড়ারত ভাষ্কর্য দেখে বিষ্মিত হয়ে ভেবেছেন, দেবতার মন্দিরের গায়ে এত যৌনতার ভাষ্কর্য কেন? আসলে আজকের দৃষ্টিভঙ্গিতে আপনি যেটা যৌনতা ভাবছেন, হিন্দু দর্শনে তা আদৌ যৌনতা ছিলো না। এই দর্শনের কারনে আজও আমরা শিব ও পার্বতির সঙ্গমরত লিঙ্গ পুজা করে থাকি।
লিঙ্গ পুজা ও সম্ভোগ হিন্দুধর্মে সৃষ্টিশীলতার প্রতীক। পৃথিবীতে চাষাবাদের উৎপত্তি ঘটিয়েছিলেন মেয়েরা। লিঙ্গের সম্ভোগ ও কর্ষনে সন্তান উৎপাদনের ধারনা থেকে আদিম কালের নারিরা ভেবেছিলেন, মাটিকেও যদি পুরুষের মতো কর্ষন করা যায়, তাহলে মাটিও উৎপন্ন করবে। কৃষিকাজের জন্য ব্যবহৃত লাঙ্গলের উৎপত্তি লিঙ্গের এই বৌদ্ধিক কনসেপ্ট থেকেই এসেছিলো বলে নৃতাত্ত্বিকরা মনে করে থাকেন।
আপনি লক্ষ্য করবেন, প্রাচীনকালে জ্ঞান বিজ্ঞানে ভারতবর্ষ যে সৃষ্টিশীলতার চরম শিখরে পৌঁছেছিলো, তার পিছনে কাজ করেছিলো হিন্দু ধর্মের এই দর্শন। বর্তমান কালেও এই দর্শন বোধের কারনেই হিন্দু উৎসব গুলি শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিশীলতা, শিল্প সাধনা ও আনন্দের রূপ লাভ করে। এখানে আমি দুর্গাপুজার কথাটাই যদি বলি, যে ভাবে এই উৎসব পালন করা হয়, তা ঈশ্বর আরাধনাকে ছাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত শিল্প চর্চা ও সৃষ্টিশীলতার রূপ ধারন করে। এই সৃষ্টিশীলতা কিন্তু মোটেই হিন্দু ধর্ম ও দর্শনের বিচ্যুতি নয়।
প্রাচীন ভারতের ধর্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হিন্দু ধর্মে মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকেই সঙ্গীত, নৃত্য, স্থাপত্য ভাষ্কর্য ইত্যাদি কলা গুলির উৎপত্তি ঘটেছিলো। মন্দিরে দেবদাসীরা নৃত্য গীতের মাধ্যমে দেবতাদের সেবা করতেন। কালক্রমে এই সংস্কৃতি মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং হিন্দু ধর্মের একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আচ্ছাদন তৈরি করে।
কালক্রমে এই সংস্কৃতি হিন্দু সংস্কৃতি বা ভারতীয় সংস্কৃতি বলে অভিহিত হয়। এই সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতির আচ্ছাদনই যুগ যুগান্ত ধরে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করে চলেছে। মনে রাখতে হবে, ভারতকে বিভিন্ন বিদেশী শক্তি আক্রমণ করেছে। লুন্ঠন করেছে। কিন্তু সংস্কৃতির দিক থেকে ভারতবর্ষকে কোন শক্তি এমনকি শাসকরাই জয় করতে পারেন নি। সমকালীন সভ্যতা গুলি কালের স্রোতে হারিয়ে গেলেও আমাদের ভারতীয় সভ্যতা তার এই শক্তিশালী সংস্কৃতির জন্য আজও টিকে থাকতে পেরেছে।
এই সংস্কৃতির আকর্ষনে মুঘল সম্রাট আকবরের মতো অনেকেই হোলি খেলতে বাধ্য হয়েছিলেন অথবা হিন্দু উৎসব গুলিতে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারন হিন্দুদের উৎসব গুলি ঈশ্বর আরাধনা ব্যতিত আনন্দ, শিল্পচর্চা, সৃষ্টিশীলতা ও সাংস্কৃতিক চেতনার রূপ লাভ করে। যেগুলি প্রকৃতিতে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের হয়ে থাকে। এই আমোঘ শিল্পচর্চা ও সংস্কৃতি সাধনার টানে হিন্দু ধর্মের বহির্ভূতরাও হিন্দু ধর্মের প্রতি একটি অমোঘ টান ও আকর্ষন অনুভব করে। হিন্দু ধর্মও এই সুযোগে সুকৌশলে তাদের ধীরে ধীরে গ্রাস করতে এবং নিজের মধ্যে বিলীন করতে আরম্ভ করে।
বিষয়টি একটু ভালোভাবে বোঝার জন্য একটু ইতিহাসে ফিরে যাবো আমরা। ভারতবর্ষে যখন প্রথমদিকটিতে ইসলাম প্রবেশ করতে আরম্ভ করেছিলো, তখন হিন্দুধর্ম ধীরে ধীরে ইসলামকে গ্রাস করার জন্য উদ্যত হয়েছিলো। হিন্দু ধর্মের প্রভাবে ইসলাম ধর্মে আসে সুফি, মাজার, পীরের ধারনা। এমনকি হিন্দু ধর্মের প্রভাবে ইসলামে মূর্তিপুজাও প্রবেশ করতে শুরু করে।
এইসময় ওলাবিবি নামে একটি দেবীর সৃষ্টি হয়। অনেকে একে দেবী দুর্গার মুসলমান সংস্করন বলে থাকেন। এছাড়া, মা শেতলা এমনই একজন দেবী ছিলেন, যার পুজা হিন্দু এবং মুসলমান সকলেই করতেন। এই সমন্বয় প্রক্রিয়া যদি চলতো, তাহলে সমগ্র ইসলাম ধর্মই হিন্দু ধর্মের স্রোতে বিলিন হয়ে পড়তো।
কিন্তু ইংরেজরা ভারতে আধিপত্য স্থাপনের পর এই সমন্বয় প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইংরেজরা ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে বিভাজন নীতির কৌশল নিয়ে মুসলমান সচেতনতা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে আগ্রাসী হিন্দু সংস্কৃতি থেকে ইসলামকে রক্ষা করবার জন্য এইসময় ইসলামী ধর্ম সংস্কারকরা ইসলামের একটা শক্ত খোলস তৈরি করার চেষ্টা করলেন। যাতে খুব সহজেই আগ্রাসী হিন্দু সংস্কৃতি সেটাকে গ্রাস করতে না পারে এবং ইসলাম শক্ত খোলসের মধ্যে সুরক্ষিত থাকে।
এই জন্য এই সময় থেকে মুসলমানদের আরবিতে নাম রাখা, গোফহীন দাড়ি রাখা, মাথায় ফেজ টুপি, পাঞ্জাবী পাজামা বা লুঙ্গি পরিধান, গো মাংস ভক্ষন, মন্দিরের বিপ্রতীপে মসজিদ নির্মাণ, ইত্যাদি নানা প্রতীক ও অভ্যাসে জোর দেওয়া হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের বিভিন্ন জলশাতে লৌকিক হিন্দু ধর্মের মুন্ডপাত এমন ভাবে করা হয়, যাতে সহজেই মুসলিমরা হিন্দুদের স্রোতে বিলীন না হয়ে পড়েন।
এসবের পরিনামে ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে সর্বদাই মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করা হয়। তিতুমির, হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ, দুদুমিঞা, সৈয়দ আহমেদ থেকে শুরু করে মহঃ জিন্নাহ এবং বর্তমান কালের অধিকাংশ উগ্র মুসলিম ধর্মগুরুরা ঠিক এই কাজটাই আজোও চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
বছরের পর পর বছর ধরে বাংলাদেশে দুর্গাপুজোয় দুর্গামূর্তি ভেঙে দিয়ে হিন্দু উৎসবকে পন্ড করার চেষ্টা যখন মৌলবাদীরা করেন, তখন আমি মোটেই বিস্মিত হই না। বরং ঐতিহাসিক চেতনা থেকে তাদের ভীতি ও আশঙ্কাকে দেখে আমার সত্যি খুব করুনা হয়। মৌলবীরা সর্বদাই এই আতঙ্কে বসে থাকে কখন না জানি হিন্দু ধর্মের দুর্বার স্রোত তাদের গ্রাস করে ফেলে।
একটু পিছনে ফিরে গেলে দেখতে পাবেন, হিন্দু ধর্ম এমন কাজ বহুবার করেছে। হিন্দু ধর্মের ভিতর দুটো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। একটি এর নমনীয় ও কোমল দিক, যা সমন্বয়ের কথা বলে। অন্যটি হলো এর কঠিন ও উগ্রতার দিক, যা লড়াই, যুদ্ধ ও সংগ্রামের কথা বলে। যুগে যুগে এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়েই হিন্দু ধর্ম তার বিরুদ্ধ শক্তিকে গ্রাস করেছে এবং নিজের মধ্যে ভষ্মীভূত করেছে।
ঝড়ের সময় বেত গাছ যেমন মাটিতে মিশে যায় এবং ঝড় থেমে গেলে আবার মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ায়, আমাদের হিন্দু ধর্ম ঠিক তেমনি ভাবেই যুগ যুগান্ত ধরে টিকে আছে। এই বিষয়টা বোঝার জন্য কয়েকটা ঐতিহাসিক উদাহরন দেওয়া যাক।
বৈদিক যুগের শেষদিকে সনাতন ধর্ম এতটাই লোকাচারে নিমগ্ন হয়ে পড়ে যে, তার মধ্যে নানা অনাচার ও দুর্বৃত্ত প্রবেশ করে। এই সুযোগে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান ঘটে। এই বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের দাপটে হিন্দু ধর্ম প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে । এই সময়টা ছিলো ঝড়ের কাল। কিছুকাল পরে হিন্দু ধর্ম নমনীয় হয়ে ওঠে এবং ভগবান বুদ্ধকে বিষ্ণুর এক অবতার বলে প্রচার করে বুদ্ধকে হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভূক্ত করে নেয়। কালক্রমে বৌদ্ধ ধর্মে বুদ্ধের মূর্তি পুজা শুরু হয়। অর্থাৎ সমন্বয়বাদের প্রয়োগ করে বৌদ্ধ ধর্মের আগ্রাসন থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করে এবং হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটায়।
একই ভাবে জৈন মন্দির গুলিরও দখল নেওয়া হয়। জৈন মূর্তি গুলির পাশে শিব, দুর্গা সহ অন্যান্য মূর্তি গুলি রেখে দিয়ে মন্দির গুলির দখল নেওয়া হয় এবং সেগুলিকে হিন্দু মন্দিরে পরিনত করা হয়। বাঁকুড়া জেলা জৈন ধর্মের একটি প্রখ্যাত কেন্দ্র ছিলো। এখানকার ওন্দা ব্লকের বহুলাড়া সিদ্ধেশ্বর মন্দির অথবা সোনাতপলের সূর্য মন্দিরে গেলেই এর সত্যতা যাচাই করে নিতে পারবেন।
অর্থাৎ উদারতা, নমনীয়তা ও সমন্বয়বাদ দ্বারা হিন্দু ধর্ম তার বিরুদ্ধ শক্তি গুলিকে তার স্রোতে বিলীন করে নেয় । উনিশ শতকে খ্রিষ্টান ধর্ম এবং ব্রাহ্মধর্ম যখন ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মকে বিপন্ন করে তুলেছিলো, তখন ঠিক সেই সময় রামকৃষ্ণদেব হিন্দু ধর্মের সমন্বয়বাদের প্রচার করেন। তার সমন্বয়বাদী ভাবধারা আদি ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হবার পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আকৃষ্ট করে। পরে কেশবচন্দ্রকে আকৃষ্ট করে। তিনি তখন হিন্দু ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এইভাবে দেখা যায়, ধীরে ধীরে সমগ্র সমাজটিই নব্য হিন্দু ধর্মের স্রোতের সঙ্গে বিলীন হয়ে পড়ে।
মধ্য যুগে বাংলায় ইসলামের দুর্বার প্লাবন আসে।এই সময় বলপূর্বক ভাবে একের পর এক হিন্দুদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হতে থাকে অথবা অনেকে লৌকিক হিন্দু ধর্মে ব্রাহ্মন দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকেন। হিন্দু ধর্ম এই সময় প্রায় বিলীন হয়ে যেতে বসেছিল। এই সময় ইসলামের এই প্লাবনকে একা নাম সংকীর্তনের মাধ্যমে আটকে দেন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু। আমরা যে আজ পশ্চিমবঙ্গে আছি তা মূলত এই মানুষটির জন্যই। যদিও আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষ দেশের ইতিহাসে তার অবদানের সঠিক মূল্যায়ন কোন এক অজ্ঞাত কারনেই করা হয় নি।
আজ বাংলায় হিন্দুজাতি যে এখনোও টিকে আছে, তা একমাত্র শ্রী চৈতন্য দেবের জন্যই। তিনি যদি সেদিন আর্বিভূত না হতেন তাহলে আজ হয়তো আমরা বাংলাদেশে থাকতাম। কোন মৌলবাদীর ভিড়ে হয়তো হারিয়ে ফেলতাম আমাদের আত্মপরিচয়। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত হয় নি।
খোল করতালের আওয়াজের এমনই একটি মায়াবি জাদু আছে যে তা যেকোন মানুষের হৃদয় পরিবর্তন করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। শ্রী চৈতন্য দেব সমন্বয়বাদ, প্রেম এবং খোল করতালের মাধ্যমে এমন এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম দিলেন, যা শেষপর্যন্ত ইসলামের ধর্মান্তকরনের বিজয়রথকে স্তব্ধ করে দেয় এবং হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করে নববলে বলীয়ান করে তোলে। শ্রী চৈতন্য দেব কে সম্ভবত এই কারনেই বাংলা থেকে ঊড়িষ্যায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। এর পিছনে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলো অত্যন্ত স্পষ্ট।
সুতরাং এই ঐতিহাসিক পর্যালোচনা থেকে আমরা বলতে পারি, যারা হিন্দুধর্ম বিলীন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেন এবং যেসব মৌলবীরা হিন্দু ধর্মকে বিলীন করে দেওয়ার দিবা স্বপ্ন দেখেন, তারা দুজনেই মূর্খের স্বর্গে বাস করেন। তারা আসলেই জানেন না, হিন্দু ধর্ম আসলে কি? হিন্দু ধর্মকে আজ পর্যন্ত যারাই গ্রাস করতে গিয়েছে, কিছুকাল স্তব্ধ থাকার পর বেত গাছের মতোই মাথা উঁচিয়ে উল্টে হিন্দু ধর্মই তাদের গ্রাস করে ফেলেছে।
মৌলবীদের সব আশায় কিছুটা জল ঢেলে দিয়েই এই লেখা শেষ করবো। মনে রাখবেন, উপনিষদে হিন্দু ধর্মে একেশ্বরবাদের কথা বলা হয়েছে। আপনারা যাকে আল্লাহ বলেন, উপনিষদে তাকেই পরমেশ্বর বা পরমব্রহ্ম বলা হয়েছে। লৌকিক হিন্দু ধর্মের লোকেরা মূর্তিপুজাকেই ঈশ্বর আরাধনা বলে মনে করে। একদিন ইসলাম এসে যদি এই লৌকিক হিন্দুধর্মকে বিনাষ করে, তাতে সনাতন হিন্দু ধর্মের কিছু এসে যাবে না।
মনে রাখবেন, ইসলামের আল্লাহের ধারনা থেকে উপনিষদের নিরাকার পরমেশ্বরের ধারনা অনেক ব্যপক ও সর্বগ্রাসী। লৌকিক হিন্দু ধর্মের বিনাষের পর উপনিষদের এই সর্বব্যাপী পরমব্রহ্মের ধারনা থেকে পুনরায় সনাতন ধর্মের পুনরুত্থান ঘটবে। ইসলামীয় ধারনা তাতে অনুঘটকের কাজ করবে এবং সবশেষে ইসলামও একদিন সনাতন ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়বে। এই ঐতিহাসিক ধারাতেই যুগ যুগান্ত ধরে সনাতন ধর্ম টিকে আছে।