ঔপনিবেশিক আমলে সংঘঠিত আদিবাসী বিদ্রোহ গুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিদ্রোহ ছিলো কোল বিদ্রোহ।
কোল বিদ্রোহ |
পরিচয় ও আদি বাসভূমি
কোলরা ছিলো ভারতের অন্যতম একটি আদিবাসী সম্প্রদায় বা উপজাতি সম্প্রদায়। এদের আদি বাসভূমি ছিলো বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে। কোলরা হো, মুন্ডা, ওরাও প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলো।
কোলদের জীবনধারন পদ্ধতি
কোলরা ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। আমরা জানি, আদিবাসী মাত্রই অত্যন্ত পরিশ্রমী হয়ে থাকেন। কোলরা যখন বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে এসেছিলো, তখন এই অঞ্চলটি দুর্ভেদ্য অরন্য দ্বারা ঘেরা ছিলো। কোলরা ছোটনাগপুরে জঙ্গল কেটে কৃষিক্ষেত্র তৈরি করেছিলো। সেখানে তারা যৌথভাবে অর্থাৎ একসঙ্গে কৃষিকাজ করতো এবং নিজেদের পৃথক উপজাতীয় আইন ও বিচার ব্যবস্থা দ্বারা নিজেদেরকে স্বাধীন ভাবে পরিচালিত করতো।
অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে নিরুপদ্রবে কোলরা বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে তাদের জীবন যাত্রা অতিবাহিত করতো।
কোল বিদ্রোহের কারন
ভারতবর্ষে ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রতিটি জনজাতিই পরাধীনতার শিকার হয়। আদিবাসী সমাজও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল ও অরন্য অধ্যুষিত অঞ্চলে আদিবাসীরা প্রাচীন কাল থেকেই স্বাধীন ভাবে পরিচালিত হতেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের কোন শাসকই তাদের বিব্রত করতো না বা তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতো না। কোলরাও আদিবাসী সমাজের এই জীবন ধারার ব্যতিক্রম ছিলেন না।
কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বিশেষত, ১৮২০ দশকের পর থেকেই কোলদের স্বাধীন জীবনধারা ও স্বাধীন সত্ত্বা বিঘ্নিত হয় এবং তারা ঔপনিবেশিক শোষনের শিকার হয়ে পড়ে। এর ফলেই কোলরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
সংক্ষেপে কোলদের অসন্তোষের প্রধান কারন গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা
১৮২০ খ্রিঃ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছোটনাগপুর অঞ্চলের শাসনভার গ্রহন করে সেখানে নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। সমগ্র অঞ্চলটি কয়েকটি ভাগে ভাগ করে ইজারাদারদের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এই ইজরাদারি ব্যবস্থা কোলদের জীবন ও সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে তুললে তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে বাধ্য হন।
বিশেষত, ছোটনাগপুর অঞ্চলে জঙ্গল পরিষ্কার করে কোলদের কষ্টার্জিত কৃষিজমি গুলি কেড়ে নিয়ে যেভাবে বহিরাগত ইজারাদারদের জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়, তা নিয়ে কোলদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভ আর অসন্তোষের জন্ম হয়েছিলো।
(২.) ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থার প্রবর্তন
ছোটনাগপুরের বহিরাগত (হিন্দু, মুসলিম, শিখ) ইজারাদাররা রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য জমির মালিকানার ক্ষেত্রে যৌথ মালিকানার বদলে ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। এর ফলে কোলদের সমাজ ব্যবস্থায় অস্থিরতা ও বিক্ষোভ দেখা যায়।
জমির ব্যক্তি মালিকানার ফলে সহজেই জমিথেকে অবাধ্য কৃষককে উচ্ছেদ করে অন্যদের অপেক্ষাকৃত বেশি ভূমি রাজস্বের দরে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যেতো।
আমরা জানি, আদিবাসী মাত্রই সম্প্রদায়গত ভাবে একসঙ্গে থাকেন ও কাজ করেন। তাদের সমাজে ব্যক্তি মালিকানার কোন ধারনা নেই। কিন্তু জমির ক্ষেত্রে ইজারাদাররা ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে কোলদের পারিবারিক জীবনে অশান্তি দেখা যায় এবং ব্যক্তি মালিকানার বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
(৩.) উচ্চ হারে ভূমিরাজস্ব আরোপ
ইজারাদাররা অত্যন্ত উচ্চহারে কোলদের ওপর ভূমিরাজস্ব আরোপ করে। এই ভূমি রাজস্বের পরিমান তারা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে থাকলে কোলদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ভূমি রাজস্বের পাশাপাশি ইজারাদার ও সরকার কোলদের ওপর আরোও নানা ধরনের অবৈধ কর আরোপ করে। এছাড়া, রাস্তা, বাড়ি নির্মান, ইত্যাদি নানা ধরনের কাজে কোলদের প্রায়ই বেগার খাটানো হতো।
(৪.) জমি থেকে উচ্ছেদ ও নির্যাতন
ইজারাদারদের উচ্চ ভূমিরাজস্ব কোলরা পরিশোধ করতে না পারলে তাদের প্রায়ই জমি থেকে উচ্ছেদ করা হতো। এমনকি তাদের পরিবারকে বন্দী করে নানারকম সামাজিক নির্যাতনও চালানো হতো।
(৫.) নগদে রাজস্ব আদায় ও মহাজনদের শোষন
ছোটনাগপুর অঞ্চলে সরকার নগদে ভূমিরাজস্ব আদায়ের প্রথা চালু করলে এই অঞ্চলে মহাজনী কারবার ফুলে ফেঁপে ওঠে। কারন সমকালীন সময়ে গ্রামীন অর্থনীতিতে মহাজনরাই নগদ অর্থের জোগান দিতেন এবং ব্যাঙ্কারের ভূমিকা পালন করতেন। ছোটনাগপুরে ইজারাদাররা উচ্চ হারে খাজনা আদায় শুরু করলে জমি বাঁচানোর জন্য কোলরা মহাজনদের ঋনের সম্মুখীন হন।
মহাজনরা এই সুযোগে সহজ সরল কোলদের ঋনের ফাঁদে জড়িয়ে তাদের সর্বস্ব লুঠ করতে শুরু করে।
(৬.) মদের ওপর কর বৃদ্ধি
কোলদের অসন্তোষের আরেকটি বড়ো কারণ ছিলো তাদের প্রিয় পানীয় মদের ওপর কর বৃদ্ধি। মদের ওপর সরকার চড়া হারে কর বসালে কোলদের অসন্তোষ চরমে ওঠে।
(৭.) বাধ্যতামূলক আফিম চাষ
ঊনবিংশ শতাব্দীতে চিনা বানিজ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য ইংরেজরা ভারতে আফিম চাষ শুরু করে। ইংল্যান্ড চিন বানিজ্যে চিনারা ইংল্যান্ডের কাছে কোন কিছুই কিনতো না। ফলে চিনা বানিজ্যে চিনের জিনিস পত্র কিনতে গিয়ে ইংল্যান্ডের প্রচুর অর্থ চিনে চলে যেতে থাকে। এই অবস্থায়, চিনের বানিজ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ইংরেজরা ভারতে আফিম চাষ শুরু করে এবং ঐ আফিম চিনে চোরাচালান করে আন্তর্জাতিক বানিজ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করে। ভারতে কোলদের দিয়ে ইংরেজরা এই আফিম চাষ করাতো।
কিন্তু কোম্পানি সরকার কোলদের দিয়ে জোর করে আফিম চাষে বাধ্য করলে কোলদের মধ্যে প্রচন্ড অসন্তোষের জন্ম হয়। কেননা আফিম চাষ করবার ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন মার খায়। এর ফলে কোল সমাজে খাদ্যশস্যের অভাব বা ঘাটতি দেখা যায়।
(৮.) কোলদের ঐতিহ্য ও স্বাধীন সত্ত্বায় আঘাত
ছোটনাগপুর অঞ্চল ঔপনিবেশিক শাসনের আওতায় আসায় এখানে বহিরাগত মানুষদের প্রবেশ ঘটে। এইসব বহিরাগতদের কোলরা দিকু বলতো। দিকুদের উৎপাত ও শোষনের ফলে কোলদের স্বাধীন সত্ত্বা ও সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে পড়ে। ঔপনিবেশিক ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা কোলদের যৌথ সমাজ ব্যবস্থায় আঘাত হানে। ঔপনিবেশিক প্রশাসন, আইন ও বিচার ব্যবস্থা কোলদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এখানে কোলরা সুবিচার তো পায় নি, উল্টে শোষন ও অবজ্ঞার শিকার হয়।
ধীরে ধীরে এইসব শোষন বাড়তে থাকলে কোলরা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। ১৮২০ দশকে ছোটনাগপুর এলাকায় কোম্পানির শাসনের মাত্র ১০ বছরের মাথায় কোলরা বিদ্রোহ ঘোষনা করতে বাধ্য হয়।
বিদ্রোহের সময়কাল ও স্থান
(১.) প্রথম পর্বের বিদ্রোহ
১৮২০ খ্রিঃ কোলরা প্রথম বিদ্রোহ শুরু করে। এই সময় পোড়াহাটের করদ রাজা ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করে কোলদের কাছ থেকে বলপূর্বক খাজনা আদায় শুরু করলে কোলরা বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। এই সময় কোলরা রাজপরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করলে পোড়াহাটের রাজা ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই সুযোগে ইংরেজ কোম্পানি ছোটনাগপুর এলাকায় নাক গলানোর সুযোগ পেয়ে যায়।
যাইহোক, প্রথম পর্বের বিদ্রোহে ১৮২১ খ্রিঃ চাইবাসার যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি রোগসেস এর কাছে কোলরা পরাজিত হয়। এর পর ছোটনাগপুর এলাকায় কোম্পানির নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাদের ওপর জমিদার, মহাজন ও বিদেশী দিকুদের শোষন নেমে আসে। এই শোষন তীব্র আকার ধারন করলে ১৮৩১ খ্রিঃ কোলরা দ্বিতীয় বার বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
(২.) দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহ
১৮৩১ খ্রিঃ রাচী জেলার মুন্ডা ও ওঁরাও সম্প্রদায়ের কোলরা প্রথম এই বিদ্রোহ শুরু হয়। পরে তা সিংভূম, মানভূম, হাজারিবাগ ও পালমৌতে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ বর্তমান বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দ্বিতীয় পর্বের কোল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিলো।
বিদ্রোহের প্রধান নেতৃত্ব
কোল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন -
- বুদ্ধ ভগত,
- জোয়া ভগত,
- ঝিন্দরাই মানকি এবং
- সুই মুন্ডা।
বিদ্রোহ দমন
কোল বিদ্রোহ অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক আকার ধারন করলে ইংরেজ সরকার তা দমন করতে এগিয়ে আসে।
- লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আমলে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়।
- বিদ্রোহ দমন করেছিলেন ক্যাপ্টেন উইলকিনসন।
- তীব্র দমন নীতি প্রয়োগ করে প্রায় দু বছরের চেষ্টায় ১৮৩৩ খ্রিঃ এই বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিলো।
ফলাফল ও গুরুত্ব
- কোল বিদ্রোহ নিন্মবর্গের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার দিকটিকে তুলে ধরেছিলো।
- এই বিদ্রোহ পরবর্তীকালের বিদ্রোহীদের মধ্যে অনুপ্রেরনার সঞ্চার করেছিলো।
- কোল বিদ্রোহের পর কোলদের জন্য দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি গঠন করে ব্রিটিশ সরকার কোলদের পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়।
- দুধর্ষ কোলরা যাতে পুনরায় বিদ্রোহী হয়ে তা অন্যান্য জনজাতির মধ্যে বিদ্রোহকে সংক্রমণের আকারে ছড়িয়ে দিতে না পারে, সে কারনে ব্রিটিশ সরকার এই কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
- দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি থেকে মহাজনদের বিতাড়িত করা হয় এবং কোলদের জমি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
- এছাড়াও উক্ত অঞ্চলে ব্রিটিশ আইন কানুনের বদলে কোলদের নিজস্ব আইন কানুন প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
কোল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য
- এটি ছিলো একটি উপজাতি বিদ্রোহ বা আদিবাসী বিদ্রোহ।
- এই বিদ্রোহ ছিলো বহিরাগত দিকু বিরোধী অর্থাৎ বহিরাগত জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ী ও ইংরেজ বিরোধী।
- সহিংস প্রতিরোধ ও আক্রমণ ছিলো এই বিদ্রোহের অপর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।