তিতুমিরের ওয়াহাবি আন্দোলন

 সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভির নেতৃত্বে যখন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হয়েছিলো, তখন তার ধারা থেকে বাংলাও ব্যতিক্রম ছিলো না। বাংলাদেশে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রবর্ত্তক ও প্রচারক ছিলেন মির নিসার আলি, যিনি তিতুমির নামেই আমাদের কাছে অধিক পরিচিত  ছিলেন।

তিতুমিরের ওয়াহাবি আন্দোলন
তিতুমিরের ওয়াহাবি আন্দোলন 

তিতুমিরের জীবনী

১৭৭২ খ্রিঃ চব্বিশ পরগনা জেলার বাদুড়িয়া থানার হায়দরপুর গ্রামে তিতুমির জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। চাষীর ঘরের ছেলে হলেও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তিতুমির অল্প বয়সেই লাঠিখেলা, তরোয়াল চালানো এবং তিরন্দাজিতে দক্ষ হয় ওঠেন ও সেই সুবাদে নদীয়ার এক জমিদারের অধীনে চাকরি পান। সেই সময় ঐ জমিদারের হয়ে অন্য জমিদারের বাহিনীর সঙ্গে দাঙ্গা হাঙ্গামায় তিতুমির জড়িয়ে পড়েন। এর ফলে তার কারাদন্ড হয়। পরে জেল থেকে বেরিয়ে এসে তিতুমির মক্কায় হজ করতে যান (আনুমানিক ১৮২২/২৩ খ্রিঃ)।

মক্কাতে যখন তিতুমির হজ করতে গিয়েছিলেন ঐ একই সময়ে সেখানে হজ করতে যান সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভি। মক্কায় সৈয়দ আহমদের সঙ্গে তিতুমিরের সাক্ষাৎ হয়। এই সময় সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভির কাছে তিতুমির ওয়াহাবি মতাদর্শ সম্পর্কে জানতে পারেন। পরে মক্কা থেকে ফিরে এসে তিতুমির বাংলায় ওয়াহাবি মতবাদ প্রচার করেন এবং তার আন্দোলন শুরু করেন।

নামকরন

বাংলায় তিতুমিরের নেতৃত্বে যে ইসলামের সংস্কার আন্দোলন চলেছিলো তাকে অনেকেই ইতিহাসে "তিতুমিরের বিদ্রোহ" বলে উল্লেখ করে থাকেন। যেহেতু তাঁর বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র ছিলো বারাসত, তাই অনেকে এই বিদ্রোহকে "বারাসাত বিদ্রোহ" বলেও অভিহিত করে থাকেন। আবার আধুনিক ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ তিতুমিরের বিদ্রোহকে "বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন" বলেও উল্লেখ করে থাকেন।

তিতুমির অবশ্য তার আন্দোলনকে উপরোক্ত নামগুলির কোনটির দ্বারাই আখ্যায়িত করেন নি। তিনি তাঁর আন্দোলনের নাম দিয়েছিলেন - "শরিয়ৎ ই মহম্মদী"।

বিদ্রোহের স্থান ও এলাকা

তিতুমিরের বিদ্রোহ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলো। চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, মালদহ, যশোহর, রাজশাহী, ঢাকা, প্রভৃতি অঞ্চল ছিলো এই বিদ্রোহের প্রধান স্থান।

বারাসাত ছিলো এই বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র

উদ্দেশ্য

ওয়াহাবি আন্দোলনের যা উদ্দেশ্য ছিলো, তিতুমিরের বারাসাত বিদ্রোহের উদ্দেশ্য তার থেকে মোটেই ভিন্ন ছিলো না। এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো ৩ টি। যথা -

  1. অমুসলিম সংস্কার গুলি দূর করে ইসলামকে তার বিশুদ্ধ রূপে প্রতিষ্ঠিত করা, 
  2. ভারতকে "দার উল হারব" (শত্রুর দেশ) থেকে "দার উল ইসলাম" বা মুসলমানের দেশে পরিনত করা, 
  3. ইংরেজ, জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করা। 

তিতুমিরের ওয়াহাবি মতাদর্শ প্রচার 

মক্কা থেকে হজ করে বাংলায় ফিরে আসবার পর তিতুমির ওয়াহাবি মতাদর্শ প্রচার করেন। এই সময় তিনি মুসলিমদের হিন্দু ধর্মীয় নানা আচার ও সংস্কার গুলি বর্জন করার কথা বলেন। ধীরে ধীরে অনেক দরিদ্র মুসলমান তার মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হন। এর ফলে তিতুমিরের অনুগামীর সংখ্যা যথেষ্ট বাড়তে থাকে। 

তিতুমির এইসময় বলেন -
  1. পীর পয়গম্বর মানার দরকার নেই, 
  2. ফয়তা বা শ্রাদ্ধ শান্তি করবার প্রয়োজন নেই, 
  3. সুদ গ্রহন ইসলামে হারাম। সুতরাং সুদ গ্রহন করা চলবে না, 
  4. প্রত্যেক মুসলমান আরবিতে নাম রাখবে, 
  5. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও রোজা পালন করবে, 
  6. প্রত্যেক মুসলমানকে তাদের স্বতন্ত্র পরিচিতির জন্য গোঁফহীন দাড়ি রাখতে হবে ইত্যাদি। 

জমিদারদের দমননীতি

তিতুমিরের নেতৃত্বে ধর্মীয় অনুশাসন ও কিছু প্রতীকের অনুসরনের মধ্য দিয়ে মুসলমান কৃষকরা যেভাবে এক ছাতার তলায় এসে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিলেন, সেটিতে জমিদারগন ব্যাপক ভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারন ঐক্যবদ্ধ প্রজা শক্তি যেকোন স্বৈরাচারী শাসকের কাছেই আতঙ্কের কারন হয়ে ওঠে। জমিদারগনও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধর্মীয় ছত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ কৃষকদের ভেঙ্গে ফেলার জন্য এইসময় বাংলার জমিদাররা নানা রূপ দমন মূলক নীতি নেন এবং ইসলামের পালনীয় নির্দেশিকা গুলির ওপর কর আরোপ করতে থাকেন।

পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় প্রথম এই ধরনের কাজ করেন। ওয়াহাবিদের দমন করার জন্য তিনি তিতুমিরের অনুগামীদের ওপর নানা রূপ কর আরোপ করেন। যেমন -
  1. দাড়ি রাখলে ২.৫০ টাকা অতিরিক্ত কর দিতে হবে।
  2. আরবিতে নাম রাখলে ৫০ টাকা কর দিতে হবে।
  3. পাকা মসজিদের জন্য ১,০০০ টাকা এবং কাঁচা মসজিদের জন্য ৫০০ টাকা কর দিতে হবে।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কৃষ্ণদেব রায়ের দেখাদেখি অন্যান্য জমিদাররাও এই সব কর আরোপ করতে থাকেন। এই সমস্ত কর দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের ওপর নিঃসন্দেহে ছিলো একধরনের অর্থনৈতিক শোষন। এই সমস্ত কর আরোপের ফলে কিছুদিনের মধ্যেই তিতুমিরের আন্দোলন জমিদার বিরোধী একটি অর্থনৈতিক আন্দোলনে রূপলাভ করে।

জমিদার বিরোধীতা ও আক্রমণ 

এইসময় তিতুমিরের নির্দেশে হিন্দু মুসলমান কৃষকরা -
  1. জমিদারদের খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেন এবং জমিদারদের বিরুদ্ধে পাল্টা খাজনা দাবি করে জমিদার, নীলকর ও মহাজনদের আক্রমণ করতে থাকেন। 
  2. এইসময় পুলিশ ও ইংরেজ সরকার জমিদারদের পাশে দাঁড়ালে এই আন্দোলন জমিদার ও ইংরেজ বিরোধী একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপলাভ করে।

বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র

এইসময় তিতুমির ব্রিটিশ প্রশাসনের সমান্তরাল একটি সরকার গঠন করে তার বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। তিনি -
  1. বারাসাত বসিরহাটের বিস্তৃর্ন অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষনা করে নিজেকে "বাদশাহ" ঘোষনা করেন।
  2. নিজ শক্তিকে সুসংহত করার জন্য চব্বিশ পরগনার নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি বাঁশের কেল্লা তৈরি করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং কেল্লাতে প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র মজুত করেন।
  3. মৈনুদ্দিনকে তার সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে তার সেনাপতি ঘোষনা করেন। 

বারাসাত বিদ্রোহ

অতঃপর তিতুমির বারাসাত কেন্দ্র থেকে নিজেকে স্বাধীন ঘোষনা করে টাকি ও গোবরডাঙ্গার জমিদারদের কাছ থেকে কর দাবি করতে থাকেন। বারাসাত অঞ্চল থেকে তিতুমিরের এই বিদ্রোহ ইতিহাসে "বারাসাত বিদ্রোহ" নামে প্রসিদ্ধ।

বিদ্রোহ দমন 

সমান্তরাল সরকার গঠন করে তিতুমিরের বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানালে, সরকারের পক্ষে কখনই তা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না। এর ফলে অল্প কিছু কালের মধ্যেই ব্রিটিশ সরকার তিতুমিরের বিদ্রোহ দমন করবার জন্য উদ্যোগী হয়।
  1. ১৮৩১ খ্রিঃ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তিতুমিরের বিরুদ্ধে কর্নেল স্টুয়াটের নেতৃত্বে এক সেনাবাহিনী পাঠিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করার ব্যবস্থা করেন।
  2. কর্নেল স্টুয়াট বাঁশের কেল্লার সামনে দাড়িয়ে বারংবার তিতুমিরকে আত্মসমর্পণের আদেশ দেন। 
  3. কিন্তু তিতুমির সেই আদেশ অগ্রাহ্য করলে স্টুয়াট কামানের গোলাতে বাঁশের কেল্লা ধ্বংস করে দেন। 
  4. এক খন্ড যুদ্ধের পর তিতুমির সহ ৬০ জন নিহত হন ও ৩০০ জন বন্দী হন।

সৈয়দ আহমদ ও তিতুমিরের মৃত্যু

আশ্চর্য জনক ভাবে ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের দুই প্রধান নেতা তিতুমির এবং সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভি একই বছর মারা যান।
  • ১৮৩১ খ্রিঃ বালাকোটের যুদ্ধে ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রবর্ত্তক সৈয়দ আহমদের মৃত্যু ঘটে।
  • এই একই বছর বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রবর্ত্তক তিতুমিরেরও মৃত্যু ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে হয়।
এইভাবে দেখা যায়, যে আন্দোলন পাঞ্জাব থেকে শিখদের এবং বাংলা থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করে ভারতকে "দার উল ইসলামে"পরিনত করার সংকল্প নিয়েছিলো, তা করতে গিয়ে দুই ভিন্ন শক্তির কাছে দুজনেই পরাভূত হয়ে যান।

তিতুমিরের আন্দোলনের চরিত্র 

  1. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিহারীলাল সরকার, কুমুদনাথ মল্লিক তিতুমিরের আন্দোলনকে একটি "সাম্প্রদায়িক আন্দোলন" বলেছেন।
  2. মাথায় রাখতে হবে, এই আন্দোলন জমিদারদের অপশাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিলো। সমকালীন সময়ের অধিকাংশ জমিদার হিন্দু হওয়ায় এই আন্দোলন হিন্দু বিরোধী মনে হলেও, বাস্তবে তা ছিলো না
  3. বিনয়ভূষন চৌধুরী, নরহরি কবিরাজ এই আন্দোলনের মধ্যে জমিদার, ইংরেজ বিরোধীতা বেশি লক্ষ্য করেছেন। তাদের মতে, এটি ছিলো নিন্মবর্গের বঞ্চিত মানুষদের অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার লড়াই। 
  4. বহু নিন্মবর্গের হিন্দু এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো এবং জমিদার শ্রেনীর প্রতি তাদের ক্ষোভ ও ক্রোধ প্রকাশ করেছিলো। বিদ্রোহীদের সিংহভাগ মুসলিম হলেও, তারা হিন্দু জমিদারদের পাশাপাশি মুসলিম জমিদারদেরও আক্রমণ করেছিলো। তাই এই আন্দোলন ছিলো ধর্মীয় ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত একটি কৃষক আন্দোলন

বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব

  1. তিতুমিরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন ছিলো ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি কৃষক আন্দোলন
  2. বহু নিন্মবর্গের হিন্দু এই আন্দোলনে যোগ দেয়। 
  3. জমিদার, ইংরেজ ও মহাজন বিরোধীতা ছিলো এই আন্দোলনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 
  4. এই আন্দোলনের ফলেই মুসলিমদের মধ্যে শ্রেনী সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। 
  5. যার ফলে পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িকতার বৃদ্ধি ঘটে এবং হিন্দু মুসলিম সম্পর্কে ফাটল ধরে। 
  6. তিতুমিরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিলো এর "মেসিয়ানিক চরিত্র"। অসহায় ও নির্যাতিতরা যে অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন অতিমানবের কল্পনা করেন, তিতুমির বাস্তবে তাই হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর নামে নানা মিথ, অতিকথা এই আন্দোলনের গতি নির্ধারন করেছিলো। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post