ফরাজি আন্দোলন

 উনিশ শতকে ইসলামের সংস্কারবাদী আন্দোলন গুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিলো - ফরাজি আন্দোলন

ফরাজি আন্দোলন
ফরাজি আন্দোলন 

সময়কাল

বাংলাদেশে ফরাজি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৮১৮ খ্রিঃ এবং তা চলে ১৯০৬ খ্রিঃ পর্যন্ত। অর্থাৎ বলা যায় - 

ফরাজি আন্দোলন ওয়াহাবি আন্দোলন থেকে অনেক আগে শুরু হয়েছিলো এবং তা ওয়াহাবি আন্দোলনের সময়কাল থেকে (১৮২২ - ১৮৮৫) অনেক বেশিদিন পর্যন্ত (১৮১৮ - ১৯০৬) চলেছিলো। ওয়াহাবি আন্দোলন চলেছিলো প্রায় ৬০ বছর ধরে। কিন্তু ফরাজি আন্দোলন চলেছিলো সুদীর্ঘ ৮০ বছর ধরে। 

নামকরন 

  • ফরাজি আন্দোলনের "ফরাজি" কথাটি "ফরাজ" অর্থাৎ আল্লাহের আদেশ থেকে এসেছিলো। 
  • আরবি ভাষায় ফরাজি কথাটির অর্থ ছিলো - "ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য"। 

উদ্দেশ্য 

ফরাজি আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো ৪ টি - 
  1. ইসলাম ধর্মের মধ্যে অমুসলিম নানা প্রথা ও সংস্কার গুলি দূর করা।
  2. ইসলামকে তার বিশুদ্ধ রূপে প্রতিষ্ঠিত করা।
  3. ভারতকে "দার উল হারব"(শত্রুর দেশ) থেকে "দার উল ইসলাম" বা মুসলমানের দেশে পরিনত করা। 
  4. বাংলা থেকে জমিদার, নীলকর ও মহাজনদের বিতাড়িত করা। 

নেতৃত্ব ও প্রবর্ত্তক 

ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্ত্তক ছিলেন হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ ও তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন, যিনি দুদুমিঞা নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নোয়ামিঞা। 

ফরাজি আন্দোলনের প্রধান স্থান ও কেন্দ্র 

  • ফরাজি আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিলো ফরিদপুর জেলার বাহাদূরপুর। 
  • পরে ফরিদপুর থেকে এই আন্দোলন খুলনা, যশোহর, ময়মনসিংহ, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও ঢাকাতে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের বিস্তৃর্ন অঞ্চলে এই আন্দোলনের বিস্তার ঘটেছিলো। 

ফরাজি আন্দোলনের রূপ ও পরিচয় 

ফরাজি আন্দোলনের মধ্যে ৩ টি রূপ বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
  1. হাজি শরিয়ৎ উল্লাহের সময় এই আন্দোলন ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
  2. দুদুমিঞার সময় এই আন্দোলন জমিদার বিরোধী একটি অর্থনৈতিক ও কৃষক আন্দোলনের রূপ নেয়।
  3. নোয়ামিঞার সময় এই আন্দোলন পুনরায় ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মধ্যে প্রত্যাবর্তন করে। 

(১.) শরিয়ৎ উল্লাহ ও ফরাজি আন্দোলন 

  • হজ ও শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ ১৭৯৯ খ্রিঃ মক্কায় যাত্রা করেন। পরে ১৮১৮ খ্রিঃ তিনি মক্কা থেকে নিজ গ্রাম বাহাদূরপুরে ফিরে আসেন। 
  • এই সময় তিনি ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধনের জন্য তার ধর্মমত প্রচার করেন এবং  "ফরাজি" নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় তৈরি করেন। 
  • শরিয়ৎ উল্লাহ তার ধর্মমতে প্রত্যেক মুসলমানকে - (১.) অমুসলিম প্রথা ও আচার অনুষ্ঠান থেকে সরে আসার নির্দেশ দেন। (২.) কলমা, নামাজ, রোজা, জাকাৎ ও হজের মতো ইসলামীয় অনুশাসন গুলি পালন করার কথা তুলে ধরেন। (৩.) এছাড়া, সেসময়ে প্রচলিত জুম্মা প্রার্থনা, ইদের নামাজ এবং পীর ও মুরিদের মতো বিষয় গুলি থেকে মুসলিমদের দূরে থাকবার কথা বলেন। 
যাইহোক, এর ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ফরাজি আন্দোলন পূর্ববঙ্গের  মুসলিম কৃষকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 

প্রথম পর্বের বৈশিষ্ট্য - 

হাজি শরিয়ৎ উল্লাহের সময় ফরাজি আন্দোলন ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।

(২.) দুদুমিঞা ও ফরাজি আন্দোলন

শরিয়ৎ উল্লাহের মৃত্যুর পর দুদুমিঞা ফরাজি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। তাঁর সময়ে ফরাজি আন্দোলন ধর্মসংস্কার আন্দোলন থেকে একটি অর্থনৈতিক ও কৃষক আন্দোলনে রূপলাভ করে। 
  • দুদুমিঞা ঘোষনা করেন, এই পৃথিবীর মালিক আল্লাহ। কৃষি জমিরও মালিক আল্লাহ। সুতরাং জমিদারদের ভূমি রাজস্ব আদায়ের কোন নৈতিক অধিকার নেই। 
  • ধর্মীয় তত্ত্ব দ্বারা তিনি কৃষকদেরকে সংগঠিত করেন এবং জমিদারদের ভূমি রাজস্ব সহ সমস্ত বে আইনি কর দিতে নিষেধ করেন। তার ডাকে দলে দলে কৃষকরা ফরাজি মতবাদে দীক্ষিত হন এবং জমিদারদের কর প্রদান বন্ধ করে দেন। 
  • কৃষকরা কর প্রদান বন্ধ করে দিলে জমিদাররা পাল্টা ফরাজিদের বিরুদ্ধে দমন মূলক নীতি নেন।
  • এই ঘটনায় দুদুমিঞা জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করবার জন্য বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করে তার এক একটি ভাগে একজন করে খলিফা নিযুক্ত করেন এবং তাদের নিজ নিজ এলাকায় কৃষকদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেন। 
  • অতঃপর জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকদের আক্রমণ পরিচালিত হয়। কৃষকরা দলবদ্ধ ভাবে একের পর এক জমিদার বাড়ি ও নীলকুঠি আক্রমণ করতে থাকে। 
এই ঘটনায় দুদুমিঞাকে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হলেও, উপযুক্ত প্রমাণ ও সাক্ষীর অভাবে সরকার তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৮৬২ খ্রিঃ তার মৃত্যু হয়। 

দ্বিতীয় পর্বের বৈশিষ্ট্য - 

দুদুমিঞার নেতৃত্বে দ্বিতীয় পর্যায়ের যে ফরাজি আন্দোলন চলেছিলো, তার গতি প্রকৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, তার সময়ে ফরাজি আন্দোলন ধর্মসংস্কার আন্দোলন থেকে একটি অর্থনৈতিক ও কৃষক আন্দোলনে পরিনত হয়। 

(৩.) নোয়ামিঞা ও ফরাজি আন্দোলন

দুদুমিঞার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নোয়ামিঞা ফরাজি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

 ইতিমধ্যে দুদুমিঞার নেতৃত্বে ফরাজি আন্দোলন একটি জঙ্গি কৃষক আন্দোলনে পরিনত হয়েছিলো।এর ফলে জমিদার ও সরকার দু তরফেই ফরাজিদের ওপর নানা দমন পীড়ন নেমে এসেছিলো। বিদ্রোহের অপরাধে অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়। এর ফলে মূল আন্দোলনের অনেকখানি ক্ষতি হয়। 

নোয়ামিঞা তাই ইংরেজ ও জমিদার বিরোধী কর্মসূচির পরিবর্তে পুনরায় ধর্মসংস্কারের দিকে জোর দেন। অর্থাৎ কৃষক আন্দোলন থেকে ফরাজি আন্দোলনের অভিমুখ ধর্মসংস্কার কর্মসূচির দিকে প্রত্যাবর্তন করান। 

এর ফলে ফরাজি আন্দোলন তার পূর্বের সংগ্রামী শক্তি ও উৎসাহ উদ্দীপনা হারায় এবং ধীরে ধীরে এই আন্দোলন দূর্বল হয়ে পড়তে থাকে। 

ফরাজি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব 

ফরাজি আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব গুলি হলো - 
  1. এটি ছিলো ধর্মীয় ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত একটি কৃষক আন্দোলন
  2. সাম্প্রদায়িক মনোভাব এই আন্দোলনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো।
  3. সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে যেমন ফরাজিরা জমিদার বাড়ি ও জমিদার প্রশাসনকে আক্রমণ করেছিলো। তেমনই হিন্দু জমিদাররাও ফরাজিদের প্রতি একাধিক সাম্প্রদায়িক মনোভাব দেখিয়েছিলেন।
  4. সংকীর্ণ ধর্মীয় চেতনার ওপর এই আন্দোলন গড়ে ওঠায় এটিকে রক্ষনশীল মুসলিম সমাজ সমর্থন করেন নি। 
  5. একই ভাবে হিন্দু মন্দির আক্রমণ ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক কাজকর্মের জন্য হিন্দুরাও এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলো। 
  6. সংকীর্ণ ধর্মীয় চিন্তাধারার কারনে এই আন্দোলন পূর্ব বাংলার একটি সংকীর্ণ স্থানেই আবদ্ধ ছিলো। 
  7. প্রথম দিকে ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসাবে এর সূচনা হলেও দুদুমিঞার নেতৃত্বে এটি একটি অর্থনৈতিক ও কৃষক আন্দোলনে পরিনত হয়েছিলো।
  8. এই আন্দোলন মুসলিম কৃষকদের আত্মপরিচয়ের পাশাপাশি তাদের শ্রেনী সচেতনতাও বৃদ্ধি করেছিলো। তারা তাদের প্রধান সমস্যা ও শত্রুদের এই আন্দোলন থেকেই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। 
  9. সর্বোপরি, পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের শ্রেনী সচেতনতার জাগরনে ফরাজি আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।

ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতি ও চরিত্র 

ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতি ও চরিত্রের দিকগুলিকে নিন্মলিখিত ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় - 
  1. ফরাজি আন্দোলন ধর্মীয় আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও, স্বল্প কালের মধ্যেই তা জমিদার, মহাজন ও নীলকর বিরোধী কৃষকদের একটি শ্রেনী সংগ্রামের রূপ নেয়।
  2. কোন কোন ক্ষেত্রে এই আন্দোলনটি সাম্প্রদায়িক রূপ নিলেও তা হিন্দু জমিদার ও জমিদারী প্রশাসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। 
  3. জমিদার প্রশাসনের বাইরে নিন্মবর্নের ও সাধারন হিন্দুদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন পরিচালিত হয় নি। 
  4. এটি ছিলো ধর্মীয় শ্রেনী সচেতনতার মোড়কে একটি কৃষক আন্দোলন এবং কৃষকদের অর্থনৈতিক সংগ্রাম। 

ফরাজি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারন 

ফরাজি আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হলেও শেষপর্যন্ত সফল হতে পারে নি এবং তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলিকেও পূরন করতে পারে নি। ফরাজি আন্দোলনের এই ব্যর্থতার পিছনে একাধিক কারন ছিলো।

কারন গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি - 
  1. ফরাজি আন্দোলন পূর্ববঙ্গের একটি সংকীর্ণ স্থানেই সীমাবদ্ধ ছিলো। 
  2. সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারনে এই আন্দোলন থেকে হিন্দু কৃষকরা দূরে ছিলেন। 
  3. সংকীর্ণ ধর্মীয় চিন্তাধারার জন্য এই আন্দোলনটিকে রক্ষনশীল মুসলিম সমাজ এবং সাধারন হিন্দুরা সমর্থন করে নি। 
  4. ফরাজিরা উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, জোর জুলুম ও সন্ত্রাসের ব্যবহার করায় ধীরে ধীরে এই আন্দোলন জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে। 
  5. দুদুমিঞার মতো সাংগঠনিক ক্ষমতা তার পরবর্তী উত্তরসূরী নেতাদের মধ্যে ছিলো না। 
  6. ব্যক্তিগত জীবনে দুদুমিঞা তিতুমিরের মতো কলঙ্কশূন্য ছিলেন না। তিনি ১৮ টি বিবাহ করেছিলেন। লুন্ঠিত ধন সম্পদ তিনি নিজ ব্যক্তিগত কাজে লাগাতে। ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা দুদুমিঞার এই সমস্ত কাজকে হারাম ও ইসলাম বিরোধী বলেই মনে করতেন। ফলে দুদুমিঞার সময় থেকেই এই আন্দোলন নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন চিহ্ন উঠতে শুরু করেছিলো। 
  7. জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ফরাজিরা কোন শক্তিশালী প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারেন নি। 
  8. তাদের রাজনৈতিক চেতনা, লক্ষ্য, পরিকল্পনা এবং কর্মসূচির মধ্যে কোন স্পষ্টতা ছিলো না।
 এই সব কারনে ফরাজি আন্দোলন তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে নি এবং তা শেষপর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post