গোরা উপন্যাসের মূল কাহিনী

 গোরা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলো গোরা। যার সম্পূর্ণ নাম ছিলো গৌরমোহন। গোরার পিতার নাম ছিলো কৃষ্ণদয়াল এবং মায়ের নাম ছিলো আনন্দময়ী। 

গোরা উপন্যাসের মূল কাহিনী
গোরা উপন্যাসের মূল কাহিনী 

গোরার প্রথম জীবন

প্রথম জীবনে কৃষ্ণদয়াল মদ মাংস খেয়ে এবং ইংরেজদের ঢঙে প্রায় বেপরোয়া ভাবে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই সময়টায় তিনি প্রচন্ড হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন এবং সুযোগ পেলেই গায়ে পড়ে হিন্দু পুরোহিত ও সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ঝগড়া করতেন।

কৃষ্ণদয়াল দুবার বিবাহ করেছিলেন। প্রথমবারের বউ একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেই মারা যান। কৃষ্ণদয়ালের তখন বয়স ছিলো মাত্র ২৩ বছর। প্রথম পক্ষের পুত্র টির নাম ছিলো মহিম। যাইহোক, প্রথম পক্ষের স্ত্রীর মৃত্যুর ছয়মাস পর কৃষ্ণদয়াল কাশী নিবাসী সার্বভৌম মহাশয়ের পিতৃহীনা পৌত্রী আনন্দময়ী কে বিবাহ করেন।

আনন্দময়ী দীর্ঘদিন নিঃসন্তান ছিলেন। ইতিমধ্যে ১৮৫৭ খ্রিঃ সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলে কৃষ্ণদয়াল দু একজন উচ্চপদস্থ ইংরেজ সাহেবের প্রানরক্ষা করে যথেষ্ট সুনাম ও অর্থ লাভ করেন। এই সময় এক আইরিশ ম্যানের স্ত্রী কৃষ্ণদয়ালের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেই মারা যান।এই পুত্র সন্তানটিকে নিঃসন্তান আনন্দময়ী পরম স্নেহে তার কোলে তুলে নেন। এই পুত্র সন্তানটিই পরবর্তীকালে গোরা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

সিপাহী বিদ্রোহ কিছুটা প্রশমিত হলে কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ী গোরাকে নিয়ে কাশী থেকে তাদের কলকাতার বাড়িতে ফিরে আসেন। এইসময় কৃষ্ণদয়াল তার বড়ো ছেলে মহিমকে মামাবাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং সরকারি খাতাঞ্জিখানায় তার জন্য একটি পাকা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।

গোরাকে কলকাতায় নিয়ে আসার পর কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ী দুজনেই ঠিক করলেন, গোরা জন্মসূত্রে বিদেশী হলেও, তাকে ব্রাহ্মন সন্তানের মতোই সমস্ত সংস্কার দিয়ে তারা মানুষ করে তুলবেন। সেই মতো কৃষ্ণদয়াল গোরাকে উপবীত বা পৈতাও দিয়েছিলেন।


গোরার সঙ্গে তার পিতার মতপার্থক্য 

গোরা অল্প একটু বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গেই অত্যন্ত দুরন্ত হয়ে উঠলো। সবার সাথে সর্দারি করাই যেন ছিলো তার প্রধান কাজ। গোরা যখন আরোও একটু বড়ো হয়ে উঠলো, তখন বাপের সঙ্গে তার বেশ কতকগুলি বিষয়ে পরস্পর বিরোধী পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো।

কৃষ্ণদয়াল প্রথম জীবনে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। এই সময়টাতে তিনি হিন্দু ধর্মের আচার অনুষ্ঠানের ঘোর বিরোধী হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কাশী থেকে কলকাতায় ফিরে আসবার পর তার মধ্যে এক গভীর পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো। তিনি গোড়া ব্রাহ্ম ধর্ম পরিত্যাগ করে হিন্দু ধর্মের দিকে সরে আসেন এবং ধীরে ধীরে আচার ব্যবহারে গোড়া হিন্দু হয়ে ওঠেন।

এইসময় তিনি হিন্দু আচার ব্যবহারে এতটাই রক্ষনশীল হয়ে পড়েন যে, একজন বিদেশীর সন্তান হওয়ার জন্য নিজেরই পালিত পুত্র গোরাকে তিনি ম্লেচ্ছ মনে করতেন এবং সর্বদা তার ছোঁয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতেন। এমনকি গোরা পিতাকে পায়ে ধরে প্রনাম করতে গেলেও, কৃষ্ণদয়াল শতহাত দূরে পিছিয়ে আসতেন এবং প্রনাম নিতে অস্বীকার করতেন।

অন্যদিকে স্ত্রী আনন্দময়ী খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী দাসি লছমিয়াকে তার সঙ্গে রাখায় কৃষ্ণদয়াল নিজের শূচিতা বাঁচাতে স্ত্রীর ছোঁয়া থেকেও নিজেকে দূরে দূরে রাখতেন।

একই বাড়িতে থেকে এইভাবে শূচিতা রক্ষা করা বড়োই কঠিন মনে করে শেষটায় কৃষ্ণদয়াল একটি উপায় বের করলেন। তিনি বাড়ির একদিকে তার জন্য দু তিনটি ঘর নির্দিষ্ট করে সেখানে "সাধনাশ্রম" তৈরি করেন। ঐ সাধনাশ্রমে গোরা বা তার মা আনন্দময়ী কারোরই প্রবেশাধিকার ছিলো না। দূর দেশ থেকে বিভিন্ন রকমের সাধু সন্ত এই সাধনাশ্রমে আসতেন। তাদের নিয়ে কৃষ্ণদয়াল সাধন ভজন ও যাগ যজ্ঞ করতেন।

কৃষ্ণদয়াল যখন ব্রাহ্মধর্ম ত্যাগ করেন, ঠিক সেই সময়টাতে কেশবচন্দ্রের বক্তৃতা শুনে গোরা ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এই সময়টাতে পিতার হিন্দুয়ানী আচার ব্যবহার গুলিকে, বিশেষত জাতপাত, ছোঁয়াছুয়ি, শূচিতা ইত্যাদি বিষয় গুলিকে গোরা "মূঢ়তা" বলে মনে করে।

এ নিয়ে এই সময়টাতে পিতা পুত্রের মধ্যে ভয়ঙ্কর তর্ক বিতর্ক চলে। আনন্দময়ী কোনরকমে ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে পিতা পুত্রের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখেন।

এই সময় কৃষ্ণদয়ালের সাধনাশ্রমে যেসব সাধু সন্ত আসতো তাদের দেখলেই গোরা হিন্দু ধর্ম নিয়ে নানা তর্ক জুড়ে দিতো। অর্থলোভী ঐ সমস্ত সাধু সন্ন্যাসীদের জ্ঞান যৎসামান্য থাকায় তারা গোরার সঙ্গে তর্কে এঁটে উঠতো না। ওরা রীতিমত গোরাকে সমঝে চলতো।

এইসময় গোরার হিন্দু বিরোধী কাজ কর্ম ও আচার ব্যবহার দেখে কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ী খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। শেষপর্যন্ত দুজনে স্থির করলেন, প্রকৃত হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দেবার জন্য তারা গোরার শাস্ত্র শিক্ষার আয়োজন করবেন। সেই মতো কৃষ্ণদয়াল বিদ্যাবাগীশ মহাশয়কে নিযুক্ত করলেন।

তার কাছে বেদান্ত চর্চা করবার সময় গোরা ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপটি বুঝতে পারেন। বিদ্যাবাগীশ মহাশয়ের উদারতা আর বেদান্ত দর্শন গোরার মনে গভীর পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং ধীরে ধীরে গোরা পিতার মতোই এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পিতার থেকে আরোও বেশি হিন্দু হয়ে ওঠেন।

এইসময় গোরা শূচিতা রক্ষা করার জন্য জাতপাতের ছোঁয়াকে মেনে চলে, প্রতিদিন দুবেলা গঙ্গাস্নান করে, টিকি রাখে, বিধর্মীদের ছোঁয়া থেকে নিজেকে সবসময় বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করে চলে।

ঘটনাচক্রে এই সময় একজন ইংরেজ মিশনারি এক সংবাদপত্রে হিন্দু শাস্ত্র ও হিন্দু সমাজকে আক্রমণ করলে গোরা তীব্রভাবে তর্ক বিতর্ক শুরু করে দেয়। বিদেশীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সে সংবাদপত্রে লড়াই শুরু করে, এবং শেষপর্যন্ত বিদেশীদের সব নিন্দাকে উপেক্ষা করে হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনের জন্য গোরা ইংরেজিতে "হিন্দুয়িজম" নামে একটি বই লিখবার কথা ভাবে।


গোরা ও তার বন্ধু বিনয় 

বিনয়ভূষন গোরার বিশেষ বন্ধু। বিনয় যখন খুব ছোট তখন সে তার বাবা মাকে হারিয়েছিলো। তার খুঁড়োই তাকে মানুষ করেন। পড়াশোনার সূত্রে বিনয় কলকাতার বাসায় একাই থাকে। গোরার মা আনন্দময়ী কে সে মা বলেই ডাকে। আনন্দময়ীও বিনয়কে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন।

 গোরাদের বাড়িতে প্রতিদিন যাওয়া আসা, খাবার দাবার খাওয়া, এমনকি কয়েকরাত কাটানো বিনয় যেন গোরাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠেছিলো। বিনয় কোনদিন গোরাদের বাড়িতে না এলে আনন্দময়ী অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে উঠতেন বিনয়ের জন্য। 

গোরার মানসিক বিবর্তনের একমাত্র সাক্ষী ছিলো তার বন্ধু বিনয়ভূষন। তারা যে শুধু একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে, তাই নয়। বহু রাত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুজনে তর্ক বিতর্ক করে কাটিয়েছে। কিন্তু গোরা যখন হঠাৎ করেই হিন্দু ধর্মের দিকে ঝুঁকে অতিমাত্রায় আচার সর্বস্ব হিন্দু হয়ে উঠলো, তখন এগুলোকে বিনয় কখনই মেনে নিতে পারে নি।

একদিন বিনয় গোরাদের বাড়িতে আসে। আনন্দময়ী বিনয়কে খেয়ে যেতে বললে, গোরা তার প্রতিবাদ করে বলে, মা তোমার বাড়িতে আমি ব্রাহ্মন বিনয়কে খেতে দেবো না। আনন্দময়ী খ্রিষ্টান দাসী লছমিয়াকে তার কাছে রাখতেন বলে, গোরা তার পিতার মতোই আনন্দময়ীর ছোঁয়া খাবার খেতেন না।

গোরা এতটাই রক্ষনশীল হয়ে ওঠে যে, যে খ্রিষ্টান লছমিয়া গোরাকে মানুষ করেছিলো, বড়ো হয়ে গোরা সেই লছমিয়ার ছোঁয়া জল খেতো না। এজন্য লছমিয়া মনে মনে খুবই দুঃখ পেতেন। মা আনন্দময়ীও গোরার এসব হিন্দুয়ানীকে ভালো নজরে দেখতেন না।

গোরার শূচিতা বাঁচানোকে বিনয়ও ভালো নজরে দেখে নি। একদিন সে সত্যি সত্যিই প্রতিবাদ করে বলে - "তুমি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছো গোরা"। গোরা এর প্রত্যুত্তরে জানায়, সমাজে থাকলে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কার কে তো মানতেই হবে।


গোরার বিবাহের প্রস্তাব 

বলা বাহুল্য, গোরার এই অতিরিক্ত হিন্দুয়ানীতে কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ী দুজনেই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। আনন্দময়ী কৃষ্ণদয়ালকে বলেন - অত করে বললুম ওকে পৈতে দিও না। কৃষ্ণদয়াল আফশোস করে বলেন, তখন কি আর জানতুম গোরা এমন হয়ে উঠবে।

শেষপর্যন্ত গোরার মন পরিবর্তন করবার জন্য কৃষ্ণদয়াল ঠিক করলেন, গোরার বিবাহ দেবেন। গোরার জন্মপরিচয় তখনও গোরা না জানলেও তা কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ী বিলক্ষণ জানতেন। রক্ষনশীল কৃষ্ণদয়ালের পক্ষে কোন হিন্দু ঘরে গোরার বিবাহ দেওয়া সম্ভব ছিলো না। গোরা ছিলো বিদেশী ও ম্লেচ্ছ। সুতরাং সব জেনে শুনে কৃষ্ণদয়াল অনাচার করার বিরুদ্ধে ছিলেন।

অনেক ভেবে শেষটায় তিনি ঠিক করলেন, কোন ব্রাহ্ম বাড়িতে গোরার বিবাহ দেওয়াটাই উপযুক্ত হবে। কেননা গোরার জন্য হিন্দু ধর্ম উপযুক্ত নয়। হিন্দু হওয়ার জন্য চাই জন্ম জন্মান্তরের স্বীকৃতি। গোরা ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হলে সেটাই হবে ওর উপযুক্ত পথ।

সবদিক বিবেচনা করে কৃষ্ণদয়াল একদিন গোরাকে পরেশ বাবুর বাড়িতে দেখা করতে যেতে বলেন। পরেশবাবু কৃষ্ণদয়ালের এক সময়ের বন্ধু ছিলেন। তারা দুজনেই সে সময়ে ব্রাহ্ম ছিলেন। পরে কৃষ্ণদয়াল হিন্দু ধর্মে ফিরে আসেন।কিন্তু পরেশবাবু এখনো ব্রাহ্মই আছেন। তার অনেক গুলি মেয়ে আছে। তার একটিকে গোরার পছন্দ হলে সবদিকই রক্ষা পাবে এবং সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। কারন ব্রাহ্ম কন্যাকে বিবাহ করতে হলে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হতে হবে। গোরার পক্ষে সেটিই মঙ্গল।

কৃষ্ণদয়াল তাই একটি চিঠি গোরার হাতে দিয়ে তাকে পরেশবাবু সঙ্গে সাক্ষাৎ করার নির্দেশ দিলেন।


পরেশবাবুর বাড়িতে গোরা ও বিনয়ের আগমন

পরেশবাবু কলকাতার হেদোতলায় থাকেন। তার স্ত্রীর নাম ছিলো বরদাসুন্দরী। তিনি গ্রাম্য মহিলা ছিলেন। কিন্তু কলকাতায় আসার সুবাদে হঠাৎ করেই আধুনিক হয়ে ওঠেন। সেইজন্য তার সাজ পোশাকে কৃত্রিমতার দিকটি তীক্ষ্ণ ভাবে ফুটে ওঠে। তিনি সাজ পোশাক ও খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে বড়ো বেশি ব্রাহ্ম অব্রাহ্ম বাছ বিচার মেনে চলেন।

মাটিতে বসে খাওয়াকে পর্যন্ত তিনি হিন্দুয়ানি বলে মনে করেন। সেইজন্য পালিতা কন্যা রাধারানীর নামে হিন্দুয়ানি ও পৌত্তলিকতা খুঁজে পেয়ে তিনি তার নাম পরিবর্তন করে রেখে দেন সুচরিতা।

বরদাসুন্দরীর তিন মেয়ে। বড়ো মেয়ের নাম লাবন্য, মেজো মেয়ের নাম ললিতা এবং ছোট মেয়ের নাম লীলা। এছাড়াও ছিলো পালিত মেয়ে সুচরিতা

এক দুর্ঘটনা সূত্রে পরেশবাবুর সঙ্গে বিনয়ের সাক্ষাৎ হয়েছিলো। একদিন বিনয়ের বাড়ির সামনে একটি ঠিকাগাড়ির সঙ্গে বড়ো জুড়ি গাড়ির ধাক্কা লাগে। ঐ গাড়িতেই পরেশবাবুর ও তার মেয়ে ছিলেন। বিনয় আহত পরেশবাবুকে তার বাড়িতে এনে ডাক্তার ডেকে এনে সুস্থ করে তোলেন। কৃতজ্ঞ পরেশবাবুর এজন্য বিনয়কে তাদের বাড়িতে একটি বারের জন্য হলেও যেতে অনুরোধ করেন।

সেই সূত্রেই বিনয় যেদিন পরেশবাবুর বাড়িতে যান, সেই দনই কিছু পরে গোরা তার পিতার পত্র নিয়ে পরেশ বাবুর বাড়িতে হাজির হন।

পরেশবাবু বরদাসুন্দরীর সঙ্গে গোরার পরিচয় করিয়ে দেন। যদিও, বিনয়ের সাথে আলাপের সূত্রে ইতিমধ্যেই পরেশবাবুর পরিবার গোরার নাম জানতো। কিন্তু সামনা সামনি আসবার পর বরদাসুন্দরী গোরাকে খুব একটা পছন্দ করলেন না। এই সময় হিন্দু ধর্ম, সমাজ, এবং গোরার হিন্দুয়ানী নিয়ে বরদাসুন্দরী দু চারটা ব্যাঁকা ব্যাঁকা কথা বললে, গোরা ভয়ানক তর্ক জুরে দেয়।

ঘটনাচক্রে সেইদিনই পরেশবাবুর বাড়িতে এসেছিলেন পানুবাবু, যার আসল নাম ছিলো হারানচন্দ্র নাগ। পেশায় তিনি ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং পরেশবাবুর বিশেষ পরিচিত। পানুবাবু ব্রাহ্মসমাজের একজন বিশিষ্ট সদস্যও ছিলেন। পানুবাবুর সঙ্গে সুচরিতার বিবাহ পূর্বেই বরদাসুন্দরী ঠিক করে রেখেছিলেন। এই কারনে পরেশ বাবুর বাড়িতে পানুবাবু প্রায়ই আসা যাওয়া করতেন।

সুচরিতা পরেশবাবুর নিজের মেয়ে ছিলো না। সুচরিতার পিতার নাম ছিলো রামশরন হালদার। স্ত্রীর মৃত্যুর পর রামবাবু ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন এবং পরে পাড়া প্রতিবেশীদের অত্যাচারে ঢাকায় চলে যান। তখন থেকেই সুচরিতা পরেশ বাবুর কাছেই মানুষ হয়। সুচরিতা পরেশবাবুকে বাবা বলেই ডাকে।

যাইহোক, পরেশ বাবুর বাড়িতে যাতায়াতের সুবাদে বিনয়ের সঙ্গে ললিতার একটি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অন্যদিকে গোরাকে দেখেও সুচরিতার বিশেষ পছন্দ হয়। এদিকে বরদাসুন্দরী একদিন পানুবাবুর সহিত সুচরিতার বিবাহের প্রস্তাব দিলে, পরেশবাবু সুচরিতার মতামত জানতে চান। সুচরিতা এই বিবাহে অসম্মতি জানালে বরদাসুন্দরী ও পানুবাবুর দুজনেই চটে যান।

 প্রসঙ্গত, পানুবাবু ব্রাহ্ম বাড়িতে হিন্দু দুই যুবকের আনাগোনা একেবারেই পছন্দ করতেন না। এদিন খোলাখুলি সেকথা তিনি বলেও ফেলেন।


গোরার গ্রামদর্শন

এদিকে ভারতবর্ষকে জানবার জন্য গোরা একদিন কলকাতা থেকে গ্রাম দর্শনে বের হয়। তার সঙ্গী হয় চার বন্ধু - অবিনাশ, মতিলাল, বসন্ত ও রমাপতি। গ্রাম দর্শনে বেরিয়ে শিক্ষিত কলকাতা সমাজের বাইরে অন্য এক ভারতবর্ষের সন্ধান পায় গোরা। শহর কলকাতার সমাজের মতো কোলাহল সেখানে নেই। ধর্মের কোন বাড়াবাড়ি নেই। আছে অদ্ভুত এক প্রশান্তি, সরলতা এবং মানুষের অসহায়তার ছবি।

গ্রাম দর্শনে গোরা নিন্মবর্গের হিন্দুদের ওপর ব্রাহ্মনদের অত্যাচার প্রত্যক্ষ করে। প্রত্যক্ষ করে হিন্দু নাপিতের ঘরে মুসলমান সন্তান প্রতিপালনের চিত্র। এইসব দৃশ্য দেখে গোরার হৃদয়ে গভীর পরিবর্তন আসে। গ্রামে ইংরেজ পুলিশের অত্যাচারও গোরা প্রত্যক্ষ করে। এই সময় পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গোরার জেল হয়।


বিনয় ও ললিতার বিবাহ

গোরা যখন জেলের ভিতরে, ঠিক সেই সময় বিনয় ও ললিতার বিবাহ স্থির হয়। বরদাসুন্দরী বিনয়কে বিবাহের জন্য ব্রাহ্মধর্মকে গ্রহন করতে বললে, বিনয় তা প্রত্যাখ্যান করে বলে, হিন্দু নই একথা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

যাইহোক, শেষপর্যন্ত পরিস্থিতির চাপে বিনয় ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার এই সিদ্ধান্তের কথা সে আনন্দময়ী কে জানায়। আনন্দময়ী বিনয়ের সিদ্ধান্তের কথা শুনে বিরোধীতা করেন। শেষপর্যন্ত, বিনয় হিন্দু মতে'ই ললিতাকে বিবাহ করবার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরেশবাবু কে সে জানায় বিবাহের জন্য তারা কেউই ধর্ম পরিবর্তন করবে না।

যাইহোক, হিন্দু সমাজকে অস্বীকার করে বিনয়ের ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে বিয়েটি গোরা কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি। সে এই বিবাহের বিরোধীতা করে। এমনকি বিনয়ের বিবাহ অনুষ্ঠানে মা আনন্দময়ীকেও গোরা অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করে। পরেশ বাবু এইসময় গোরার কাছে এসে বিনয়ের বিবাহের ভার নিতে অনুরোধ করলে গোরা সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে।

শেষপর্যন্ত, দুই ভিন্ন ধর্মের বিবাহে কেউই অংশগ্রহণ করলো না। না বিনয়ের পরিবারের কেউ, না ব্রাহ্মসমাজের কেউ।


গোরার প্রায়শ্চিত্য ও আত্মপরিচয় 

গোরা অবশ্য কয়েকদিন আগেই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। কিন্তু জেল থেকে মুক্তি লাভ করবার পর তার মন সর্বদাই ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। জেলে থাকাকালীন অবস্থায় তার মন অশুচি হয়ে উঠেছিলো। তাই সে ঠিক করলো, প্রায়শ্চিত্য করবে।

 প্রায়শ্চিত্যের কথা গোরা কৃষ্ণদয়ালকে জানালে কৃষ্ণদয়াল তার বিরোধীতা করে বলেন, প্রায়শ্চিত্যের কোন প্রয়োজন নেই। কেননা প্রায়শ্চিত্য করবার কোন অধিকার গোরার নেই।

পিতার অমত সত্ত্বেও গোরা শেষপর্যন্ত প্রায়শ্চিত্য করবার সংকল্প গ্রহন করে। দেশের অনাচার ও দুরাচারের প্রায়শ্চিত্য করবার জন্য গোরা এক প্রায়শ্চিত্য সভার আয়োজন করে। ঠিক হয়, বিরাট হোম যজ্ঞ ও বেদমন্ত্র পাঠ করে প্রায়শ্চিত্য করা হবে। গোরার বন্ধু অবিনাশ এই প্রায়শ্চিত্য সভার সংবাদ কলকাতার সব সংবাদপত্রে প্রচার করে দেন।

খবরটা শেষপর্যন্ত কৃষ্ণদয়ালের কানেও ওঠে। তিনি গোরাকে নিষেধ করে বলেন, প্রায়শ্চিত্য করলে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করতে হয়। আর শ্রাদ্ধ করার কোন অধিকার গোরার নেই। পিতার শত অনুরোধ সত্ত্বেও, গোরা প্রায়শ্চিত্য করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে।

 গোরা এক বিরাট প্রায়শ্চিত্য সভার আয়োজন করে। এই সময়টায় কৃষ্ণদয়াল অত্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। হঠাৎ করেই গোরার কাছে খবর আসে কৃষ্ণদয়াল বাবুর মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে, তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। গোরা পিতাকে দেখবার জন্য বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

এইসময় অসুস্থ কৃষ্ণদয়াল গোরাকে বলেন - "মনে করেছিলাম কোনদিনই তোমাকে বলার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু এখন দেখছি বলতেই হবে। আমার মৃত্যুর পর তুমি আমার শ্রাদ্ধ করতে পারবে না। " এর পরেই গোরা তার মা আনন্দময়ীর কাছ থেকে তার জন্ম পরিচয়ের কথা জানতে পারে। যেমন -  মিউটিনির সময় গোরা কুড়িয়ে পাওয়া এক ছেলে। তার পিতা ছিলেন একজন আইরিশম্যান। কৃষ্ণদয়াল এবং আনন্দময়ী তাকে পুত্র জ্ঞানে কোলে তুলে নেন এবং মানুষ করেন।


গোরার নতুন বোধের জাগরন

আত্মপরিচয় জানবার পর গোরার মধ্যে এক নতুন বোধের জাগরন ঘটে। তার সমস্ত অহংকার, সংস্কার চূর্ন বিচূর্ন হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে তার মা নাই, বাপ নাই, দেশ নাই, জাতি নাই, নাম নাই, গোত্র নাই, দেবতা নাই।

আত্মপরিচয় জানবার পরে গোরা পরেশবাবুর কাছে গিয়ে বলে, পরেশবাবু, আজ আমার কোন বন্ধন নেই। আমি মুক্ত। ভারতবর্ষের উত্তর থেকে দক্ষিণ সমস্ত দেবালয়ের দ্বার আমার কাছে রুদ্ধ হয়ে গেছে। আজ আর আমাকে পদে পদে মাটির দিকে চেয়ে শূচিতা বাঁচিয়ে চলতে হবে না।

নিজের আত্মপরিচয় জানবার পর আজ আমি এমন শূচি হয়ে উঠেছি যে, চন্ডালের ঘরেও আমার আর অপবিত্রতার ভয় রইলো না।

গোরা আরোও বলে, আমি যা দিন রাত্রি হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি। আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান কোন সমাজের কোন বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।

নব চেতনায় উদ্ভাসিত গোরা সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে এসে আনন্দময়ীর সামনে প্রনাম জানিয়ে বলে -

"মা, তুমিই আমার মা। যে মাকে খুঁজে বেড়াছিলুম, তিনি আমার ঘরের মধ্যেই বসেছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃনা নেই। তুমি শুধু কল্যানের প্রতিমা। তুমিই আমার ভারতবর্ষ... ।"

উচ্ছসিত গোরা মাকে বলে, "মা এইবার তোমার লছমিয়াকে ডাকো। তাকে বলো আমাকে জল এনে দিতে।" 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post