রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ১২ টি উপন্যাসের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘতম এবং শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হলো - "গোরা"।
গোরা উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় |
প্রকাশকাল
- গোরা উপন্যাসটি প্রথমে "প্রবাসী" পত্রিকায় ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ খ্রিঃ মধ্যে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়।
- পরে ১৯১০ খ্রিঃ এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
প্রেক্ষাপট
- উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নব্য হিন্দুত্ববাদ, ব্রাহ্ম সমাজের আন্দোলন, দেশপ্রেম, নারী মুক্তি আন্দোলন এবং সামাজিক অধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই উপন্যাস রচিত।
- এককথায়, পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করা এই উপন্যাসটিতে রবীন্দ্রনাথ উনিশ শতকের সমাজ জীবনের চরম বাস্তবতা ও মনস্তাত্ত্বিক দিক গুলি তুলে ধরেন। এছাড়া,
- বহু জাতি, ধর্ম ও ভাষাভাষির দেশ ভারতে জাতীয়তাবাদের প্রকৃত স্বরূপ কি রকম হওয়া উচিৎ, তা এই উপন্যাসের মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুলে ধরেন।
প্রধান চরিত্র
গোরা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ছিলো - গোরা। তাকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছিলো। এছাড়া, এই উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র গুলির মধ্যে ছিলো -
- কৃষ্ণদয়াল,
- আনন্দময়ী,
- পরেশবাবু,
- সুচরিতা,
- ললিতা,
- বিনয়,
- পানুবাবু।
মূল উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত সার
গোরা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলো গোরা। জন্মসূত্রে সে ছিলো এক জনৈক আইরিশ ম্যানের পুত্র। সিপাহী বিদ্রোহের সময় কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ী গোরাকে পান। পরবর্তীকালে কৃষ্ণদয়াল গোরাকে ব্রাহ্মন আচার ও সংস্কার দিয়ে বড়ো করে তোলেন।
বড়ো হয়ে গোরা হিন্দুত্ববাদের প্রচারক হয়ে ওঠে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রচার করতে গিয়ে সে মিশনারিদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে এবং হিন্দুইজম নামে একটি বই লিখবার কথাও ভাবে।
হিন্দু ধর্ম নিয়ে গোরার এই অতি বাড়াবাড়িতে কৃষ্ণদয়াল অত্যন্ত বিরক্ত হন। তিনি ঠিক করেন, গোরার বিবাহ দেবেন। কিন্তু যেহেতু গোরা জন্মসূত্রে হিন্দু নন, সেহেতু কোন ব্রাহ্ম কন্যার সাথেই গোরার বিবাহ দেওয়া উপযুক্ত হবে বলে তিনি মনে করেন।
বিবাহের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণদয়াল তার ব্রাহ্ম বন্ধু পরেশবাবুর বাড়িতে গোরাকে পাঠান। পরবর্তীকালে ঘটনাচক্রে গোরা তার প্রকৃত আত্মপরিচয় জানতে পারেন। সে আচার সংস্কারে হিন্দু হলেও, জন্মসূত্রে একজন বিদেশী।
আত্মপরিচয় জানবার পরে গোরার ভিতরে এতদিনকার সমস্ত জাতিগত ও ধর্মীয় সংকীর্ণতা দূর হয়ে যায়, এবং গভীর মানবতাবাদী চেতনার জন্ম হয়।
গোরার এই আত্ম উপলব্ধির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবর্ষের প্রকৃত স্বরূপকে তুলে ধরেন এবং প্রমান করেন ভারতে জাতীয়তাবাদ কোন জাতপাত বা ধর্মীয় গোন্ডিতে আবদ্ধ থাকতে পারে না।
কেন ইতিহাস চর্চায় গোরা উপন্যাসটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে?
"গোরা" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বাংলা সাহিত্যের একটি অমর উপন্যাস। কিন্তু সাহিত্য ছাড়াও এই উপন্যাসটি ইতিহাসের পাঠ্যক্রমের মধ্যে কেন অন্তর্ভুক্ত করা হলো, সেটি জানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
মাথায় রাখতে হবে, গোরা উপন্যাসটি দুটি কারনে ঐতিহাসিক খ্যাতি অর্জন করে -
- প্রথমত, এই উপন্যাসটিতে উনিশ শতকে হিন্দুধর্ম বনাম ব্রাহ্মধর্মের বিষয়ে বাঙালিদের মানসিক দ্বিধা দ্বন্দ্ব, হিন্দু জাতীয়তাবাদের উদ্ভব এবং তা নিয়ে নানা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, দ্বন্দ্ব ইত্যাদি নানা বিষয় গুলির একটি প্রতিফলন পাওয়া যায়।
- দ্বিতীয়ত, এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবর্ষের প্রকৃত স্বরূপ এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত রূপটি কেমন হওয়া উচিত তা এক সুগভীর এবং বাস্তব বাদী উপলব্ধির মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন।
মূলত এই দুটি কারনের জন্যই গোরা উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাস চর্চারও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে এবং পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
মূল বৈশিষ্ট্য
গোরা উপন্যাসের ৩ টি মূল বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা যায় -
- গোরা ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সবচেয়ে দীর্ঘতম ও বৃহত্তম উপন্যাস।
- এটি ছিলো মূলত একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। এখানে উনিশ শতকের বাঙালি সমাজের নানা বিষয়ে মানসিক দ্বিধা দ্বন্দ্ব, বিরোধ ও মধ্যবিত্ত বাঙালির মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে।
- গোরা উপন্যাসের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের সার সত্য ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছিলেন।