ভারতে জাতীয়তাবাদের বিকাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গোরা উপন্যাসটি নানা ভাবে সাহায্য করেছিলো। ভারতে জাতীয়তাবাদের জাগরনে গোরা উপন্যাসের প্রধান ভূমিকা ও অবদানের দিক গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
জাতীয়তাবাদের বিকাশে গোরা |
(১.) জাতীয়তাবাদের স্বরূপ
জাতীয়তাবাদ কি, তার স্বরূপ কিরকম হতে পারে, তার ব্যাখ্যা ও বর্ননার মধ্য দিয়ে গোরা উপন্যাসটি জাতীয়তাবাদের প্রকৃত আদর্শ ভারতীয় সমাজের সামনে তুলে ধরেছিলো।
এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখান, জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেম কোন ধর্ম বা জাতপাতের গোন্ডিতে আবদ্ধ থাকতে পারে না।
(২.) উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদ
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের জাগরন ঘটতে শুরু করেছিলো। রবীন্দ্রনাথ এই জাতীয়তাবাদকে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিলেন। গভীর অন্তরদর্শন দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন, ভারতবর্ষ কোন বিশেষ ধর্ম বা জাতির একার নয়, তা সকলের।
সুতরাং ভারতের জাতীয়তাবাদের স্বরূপ হবে একদেশদর্শী নয়। তা হবে সার্বজনীন ও বহুমাত্রিক। এই জাতীয়তাবাদ বিশ্বমানবতার দর্শনের আদর্শেই গড়ে উঠবে। গোরার আত্মপলব্ধির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভারতে এই উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদেরই জাগরন ঘটিয়ে ছিলেন।
(৩.) ঐক্যবদ্ধ চেতনা
যে কোন দেশের জাতীয়তাবাদের প্রধান শর্তই হলো ঐক্যবদ্ধ চেতনা। অথচ উনিশ শতকে ভারতবর্ষ হিন্দু, ব্রাহ্ম, খ্রিষ্টান ইত্যাদি নানা ধর্মীয় দ্বন্দ্ব, জাতপাত ও আচার অনুষ্ঠানের জটিলতায় জর্জরিত ছিলো।
গোরা উপন্যাসে গভীর মনস্তাত্ত্বিক উপলব্ধির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এসব কিছুর অসাড়তা তুলে ধরেছেন। পরেশবাবুকে দিয়ে তিনি বলিয়েছেন, একটা বিড়াল মানুষের সঙ্গে খেতে বসলে জাত যায় না। অথচ একটা মানুষ আর একটা মানুষের পাশে বসে খেলে জাত চলে যায়। এটা কুসংস্কার ছাড়া আর কি!
জাতপাত এবং ধর্মীয় দ্বন্দ্ব যে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনার বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায়, তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছিলেন।
(৪.) মানবতাবোধের জাগরন ও ভারতের আসল রূপ
গোরা উপন্যাসটির আরেকটি দিক হলো, গোরার গ্রাম দর্শন ও তার নতুন বোধের জাগরন।
ভারতবর্ষের দর্শনকে হাতে কলমে বুঝতে গেলে আগে গ্রামকে জানতে হবে। সেখানকার সমাজ এবং মানুষদের গভীর অন্তর্দশন দিয়ে দেখতে হবে, বুঝতে হবে। কারন অর্ধেকের অধিক ভারত গ্রামেই বসবাস করে।
গ্রাম দর্শনে গোরার অন্তরে এক সুগভীর মানবতাবাদী দর্শনের জাগরন ঘটে। সে বুঝতে পারে, অপরিসীম সহনশীলতা ও সুগভীর স্নেহ দিয়ে ভারতবর্ষ বহু শতাব্দী ধরে টিকে আছে। সেখানে কোন ঘৃনা নেই। সংকীর্ণতা নেই। জটিলতা নেই। আছে শুধুই সরলতা এবং অসহায়তা।
গোরার গ্রাম দর্শনের নতুন বোধের জাগরন থেকে রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করাতে চেয়েছিলেন, মানবতাবোধ কে অস্বীকার করে কখনই জাতীয়তাবাদে পৌঁছানো যায় না। মানবতাবোধ ব্যতিত জাতীয়তাবোধ খন্ড এবং অসম্পূর্ণ।
(৫.) ভারতীয় ঐতিহ্য ও জাতীয়তাবাদ
গোরা উপন্যাসের একেবারে অন্তিম লগ্নে গোরার আত্মপরিচয় উন্মোচন করে গোরার মধ্যে নতুন উপলব্ধি ও চেতনার জাগরন ঘটিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবর্ষের চিরন্তন সার সত্যটিকে তুলে ধরেন।
"নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান / বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান" এর সুরে গোরার মুখ দিয়ে তিনি বলিয়েছেন - "আমি যা দিন রাত্রি হতে চাচ্ছিলাম, অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি। আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান কোন সমাজের বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সমস্ত জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।"
মূল্যায়ন
এইভাবে দেখা যায়, গোরা উপন্যাসের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের জাতীয়তাবাদী ধারনা ও চেতনাকে বিশ্বমানবতাবোধ ও সৌভ্রাতৃত্বের উচ্চনৈতিক আদর্শে উন্নীত করেন। এই জাতীয়তাবাদের মধ্যে কোন সংকীর্ণতার স্থান ছিলো না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরর মতে, ভারতের মতো বহু জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষাভাষির দেশে জাতীয়বাদের প্রকৃত স্বরূপ হওয়া উচিত উদারনৈতিক, যাতে সকলেই তার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে পারেন। এই বিশেষ বোধ ও উপলব্ধির জন্যই গোরা উপন্যাসটিকে ঐতিহাসিকরা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে থাকেন।