মূল স্বাদ কে অক্ষুন্ন রেখে উপন্যাসের কাহিনীকে যথাযথ ভাবে গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা যথেষ্ট কঠিন । তা সত্ত্বেও, এই পর্বে আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসটি কিছুটা গল্পের আকারেই তুলে ধরলাম। এর মূল উদ্দেশ্য একটাই যাতে এই কাহিনীটি পড়ে মূল উপন্যাসের সারাংশ সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীরা কিছুটা ধারণা করে নিতে পারে।
আনন্দমঠের মূল কাহিনী |
বিষয়বস্তু
আনন্দমঠের কাহিনী ৪ টি খন্ডে বিভক্ত -
- প্রথম খন্ডের বিষয়বস্তুতে আছে - ঘন নিবিড় অরন্য, আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ভয়ঙ্কর বর্ননা, এবং এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আনন্দমঠ ও সন্তানদলের আবির্ভাবের কথা।
- দ্বিতীয় খন্ডে রয়েছে - সন্তানদলের দীক্ষিত হবার বর্ননা, তাদের সাংগঠনিক কাজকর্ম, আত্মসংযম এবং সংসার যাপনের দৃশ্য।
- তৃতীয় ও চতুর্থ খন্ডের বিষয় - সন্তানদলের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ।
আনন্দমঠের প্রধান চরিত্র সমূহ
আনন্দমঠের অন্যতম প্রধান চরিত্র গুলি হলো - সত্যানন্দ, ভবানন্দ, জীবনানন্দ, মহেন্দ্র, কল্যানী এবং শান্তি।
- সত্যানন্দ বয়সে প্রবীন এবং আনন্দমঠের প্রধান অধ্যক্ষ বা গুরু। ঘন নিবিড় অরন্যে এক প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের মধ্যে গড়ে উঠেছিলো সন্ন্যাসীদের মঠ - "আনন্দমঠ"।
- ভবানন্দ এবং জীবানন্দ সত্যানন্দেরই অনুগত শিষ্য।
- অন্যদিকে মহেন্দ্র ছিলেন পদচিহ্ন গ্রামের এক ধনশালী সম্ভ্রান্ত জমিদার। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিলো - কল্যানী।
- মহেন্দ্র ও কল্যানীর একটি কন্যা সন্তান ছিলো, যার নাম ছিলো - সুকুমারী।
- শান্তি এই উপন্যাসের একটি বিশিষ্ট নারী চরিত্র। সে ছিলো জীবানন্দের স্ত্রী। একসময় সেও নারী হয়ে সন্তানব্রতে দীক্ষা নেয় এবং পুরুষের ছদ্মবেশে সন্তানব্রত পালনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
- এই চরিত্র গুলি ছাড়াও, আনন্দমঠ উপন্যাসে আরোও বেশ কিছু ছোট ছোট চরিত্র ছিলো।
এবার আনন্দমঠের মূল কাহিনীতে আসা যাক।
দুর্ভিক্ষ ও পদচিহ্ন গ্রামের কথা
আনন্দমঠ উপন্যাসের শুরুতেই রয়েছে ১১৭৬ এর মন্বন্তরের এক মর্মস্পর্শী বিবরন। পর পর কয়েকবছর অজন্মা, অনাবৃষ্টি এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তীব্র আর্থিক শোষনের ফলে বাংলা ১১৭৬ সনে (ইংরেজি ১৭৭০ খ্রিঃ) বাংলাদেশে দেখা যায় ভয়ঙ্কর ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।
এই দুর্ভিক্ষে বাংলার কয়েক লক্ষ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। একের পর এক গ্রাম শ্রীহীন ও লোকহীন হয়ে পড়ে। পদচিহ্ন গ্রামও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। এই গ্রামেই বাস কলতেন, ধনবান মহেন্দ্র সিংহ এবং তার স্ত্রী কল্যানী। সঙ্গে ছিলো তাদের আদরের শিশু কন্যা সুকুমারী।
দুর্ভিক্ষের সময় ধনী আর নির্ধনীর অবস্থা একই হয়। ক্রমে ক্রমে মহেন্দ্র সিংহের বাড়িতেও খাদ্যসংকট দেখা দিলো। এই অবস্থায় মহেন্দ্র এবং কল্যানী ঠিক করলেন, গ্রাম ছেড়ে যদি নগরে যাওয়া যায়, তাহলে হয়তো কিছু খাবার পাওয়া যেতে পারে। প্রান বাঁচাতে এছাড়া আর অন্য কোন উপায় ছিলো না। শেষপর্যন্ত, স্বামী স্ত্রী দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলেন, নিকটবর্তী কোন এক নগরে আশ্রয় নেবেন।
সেসময়ে গ্রাম থেকে নগরে যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিলো হাঁটা পথ। যদিও সে পথ ছিলো অতি দুর্গম। কেননা দুর্ভিক্ষের কালে চুরি ছিনতাই এবং ডাকাতির উপদ্রব অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিলো। পথে নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য তাই মহেন্দ্র সিংহ সঙ্গে নিলেন একটি বন্দুক, আর স্ত্রী কল্যানী নিলেন একটি ছোট বিষের কৌটা।
মহেন্দ্র ও কল্যানীর বিচ্ছেদ
পদচিহ্ন গ্রাম থেকে অনেকটা পথ অতিক্রম করে আসবার পর মহেন্দ্র সিংহ ও তার পরিবার একটি লোকহীন পরিত্যক্ত গ্রামে এসে হাজির হয়। এই গ্রামে হয় সকলেই মারা গিয়েছিলেন অথবা গ্রাম পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। যাইহোক, একটি পরিত্যক্ত ঘরে মহেন্দ্র তার স্ত্রী এবং শিশু কন্যাকে রেখে খাদ্যের সন্ধানে বের হয়।
মহেন্দ্র সিংহ খাদ্যের সন্ধানে বের হবার কিছু সময় বাদে ঐ পরিত্যক্ত ঘরে এসে হাজির হয় একদল ক্ষুদার্থ, কঙ্কালসার ডাকাত। তারা কল্যানী ও তার কন্যাকে অপহরন করে পার্শ্ববর্তী গভীর জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে ডাকাতদের মধ্যে ভয়ানক গোলযোগের সৃষ্টি হয়।
জঙ্গলে কল্যানীর গহনা লুঠ করার পর ডাকাতরা তার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে বিবাদ করতে থাকে। সকলে ডাকাত সর্দারের কাছে গহনার বদলে চাল দেওয়ার দাবি করতে থাকে। ডাকাত সর্দার তা না মানায় সকলে মিলে দলপতিকে হত্যা করে। এরপর সকলে খিদের জ্বালায় ঠিক করে দলপতির দেহ তারা ভক্ষন করবে।
ডাকাত দলের মধ্যে যখন এইসব চলছিলো, তখন সেই সুযোগে কল্যানী তার শিশু কন্যাকে নিয়ে আরোও গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে এবং রাস্তা হারিয়ে ফেলে। এমন সময় ঐ স্থানে আনন্দমঠের প্রধান মঠাধীশ সত্যানন্দের আবির্ভাব ঘটে।তিনি কল্যানী ও তার শিশু কন্যাকে উদ্ধার করে আনন্দমঠে নিয়ে আসেন।
গভীর জঙ্গলে এক প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের মধ্যে গড়ে উঠেছিলো "আনন্দমঠ"। সত্যানন্দ এই মঠেরই প্রধান আচার্য বা গুরু ছিলেন। আনন্দমঠে এসে কল্যানীর পূর্ব পরিচয় সম্পর্কে সত্যানন্দ জ্ঞাত হলেন। কল্যানী সত্যানন্দকে অনুরোধ করলেন, তাঁর স্বামী মহেন্দ্র সিংহ কে যেন খুঁজে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় সত্যানন্দ তার শিষ্য ভবানন্দকে ডেকে আদেশ দিলেন, মহেন্দ্র সিংহকে যেন সে আনন্দমঠে খুঁজে নিয়ে আসে।
আনন্দমঠে মহেন্দ্র সিংহের আগমন
এদিকে কিছু খাবার জোগাড় করে মহেন্দ্র পরিত্যক্ত বাড়িটিতে গিয়ে দেখেন সেখানে কল্যানী নেই। অনেক খোঁজা খুঁজির পর যখন স্ত্রী আর কন্যার কোন সন্ধান পাওয়া গেলো না, তখন মহেন্দ্র সিংহ ঠিক করলেন, নগরে গিয়ে রাজপুরুষদের সাহায্যে স্ত্রী কন্যার সন্ধান করবেন। সেই মতো তিনি নগরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন।
মহেন্দ্র যেপথ ধরে নগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিলেন, ঐ পথেই তখন ইংরেজ কোম্পানির লোকজন খাজনা আদায় করে একদল সিপাহীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসছিলো। পথে মহেন্দ্র সিংহকে বন্দুক হাতে দেখে সেপাইরা ভাবলো, মহেন্দ্র বুঝি ডাকাত। তাই তাকে হাত পা বেঁধে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে যেতে লাগলো। ঠিক এই সময়ে মহেন্দ্র সিংহের খোঁজে বেরিয়ে ছিলেন ভবানন্দ।
কল্যানীর কথা মতো পরিত্যক্ত গৃহটিতে এসে ভবানন্দ মহেন্দ্রর কোন সংবাদ পেলেন না। এই সময় ভবানন্দ চিন্তা করলেন, মহেন্দ্র সিংহ হয়তো নগরের দিকে চলে গেছে। তাই তিনি দেরি না করে নগরের পথে পা বাড়ালেন।
পথে কোম্পানির লোকজনের সাথে ভবানন্দের সাক্ষাৎ হলো। ভবানন্দের গৈরিক বসন দেখে কোম্পানির লোকজন তাকে ডাকাত সন্ন্যাসী ভেবে নিলো এবং মহেন্দ্র যে গরুর গাড়িতে ছিলো, সেই গাড়িতে ভবানন্দকে হাত পা বেঁধে তুলে দিলো। একই গাড়িতে ভবানন্দ ও মহেন্দ্র থাকায় ভবানন্দ অনায়াসে মহেন্দ্রকে চিনতে পারে এবং তার স্ত্রী ও কন্যার সংবাদ জানায়।
ইতিমধ্যে গভীর জঙ্গলে আনন্দমঠের সন্তানদল খাজনা লুঠ করে এবং সিপাহী দলের সঙ্গে খন্ডযুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই সময় মহেন্দ্র ভবানন্দের পরিচয় জানতে পারেন। মহেন্দ্র সন্তানদলের দস্যুতাকে নিন্দা করলে ভবানন্দ মহেন্দ্রর ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়ে বলে, এই দস্যুতা তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য করে না। করে মায়ের মুক্তি অর্জনের জন্য।
কে এই মা? - মহেন্দ্র ভবানন্দকে প্রশ্ন করলে, ভবানন্দ মহেন্দ্রকে আনন্দমঠে নিয়ে আসেন এবং পথে "বন্দেমাতারম" গানটি গেয়ে শোনান। আনন্দমঠে আসবার পর ব্যাকুল মহেন্দ্র মাতৃরূপ দর্শন করতে চাইলে সত্যানন্দ তাকে মন্দিরে নিয়ে যান।
- প্রথমে তিনি জগদ্ধাত্রী মূর্তির কাছে মহেন্দ্রকে নিয়ে গিয়ে বলেন, মা জগদ্ধাত্রী। সকলকে লালন পালন করেন। সদা প্রসন্ন। মা যা একসময় ছিলেন।
- তারপর কালি মূর্তির সামনে মহেন্দ্র নিয়ে গিয়ে বলেন, মা যা হয়েছেন। বস্ত্রহীন, ভূষনহীন, নগ্ন।
- এরপর দশভূজা দূর্গামূর্তির সামনে গিয়ে বলেন, মা যা হবেন। রনংদেহি।
মায়ের এই তিন রূপের দর্শন করিয়ে সত্যানন্দ ইংরেজ শোষনে নুহ্যমান দেশের বাস্তব অবস্থাটি তুলে ধরে বলেন, এই দেশকে আমরা মা হিসাবেই দেখি। আমরা সকলেই তার সন্তান। তাঁর কালিমা মোচনের জন্যই আমরা মহাসংগ্রামের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছি। এই ব্রত পালন করবার জন্যই আমরা স্ত্রী, সংসার পরিত্যাগ করে ব্রহ্মচর্য ব্রত নিয়ে সন্ন্যাসী হয়েছি।
সত্যানন্দের কথা শুনে মহেন্দ্রের ভিতরে গভীরভাবে দেশপ্রেম জাগ্রত হয় এবং তিনি ঠিক করেন, পদচিহ্ন গ্রামে স্ত্রী ও কন্যাকে নিরাপদে রেখে দিয়ে তিনিও এই মহামন্ত্রে দীক্ষা নেবেন। আনন্দমঠে নাটমন্দিরের বাইরে তখন কল্যানীর আর তার শিশু কন্যা অপেক্ষা করছিলো। সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে তাদের কাছে পৌঁছে দিলেন।
আনন্দমঠ থেকে পদচিহ্নের পথে
মহেন্দ্র ও কল্যানী তাদের শিশু কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দমঠ থেকে পদচিহ্ন গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই সময় মহেন্দ্র তার স্ত্রীর কাছে সন্তানব্রতে দীক্ষা গ্রহনের ইচ্ছার কথা জানান। বনের একস্থানে বসে দুজনের মধ্যে যখন এইসব নিয়ে কথাবার্তা চলছিলো, তখন সুকুমারী বিষের কৌটাটি খেলার উপকরন ভেবে বিষ খেয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ে।
কন্যাকে অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকতে দেখে কল্যানী ভাবলো বিষ খেয়ে কন্যার মৃত্যু হয়েছে। এমতাবস্থায়, সেও বিষ পান করে মৃত্যুর ইচ্ছা পোষন করলো। তার মৃত্যু হলে মহেন্দ্রর আর কোন পিছুটান থাকবে না এবং সে পূর্ন ভাবে মাতৃমুক্তির সাধনায় নিজেকে অর্পন করতে পারবে - এই ভেবে কল্যানীও বিষের কৌটা থেকে অবশিষ্ট বিষ পান করে আত্মহত্যা করে।
অকস্মাৎ ঘটে চলা এইসব ঘটনার ঘনঘটায় মহেন্দ্র বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়লেন। এমন সময় ঐ স্থানে উপস্থিত হলেন সত্যানন্দ। তিনি ক্রন্দনরত মহেন্দ্র কে সান্তনা দেন। ইতিমধ্যে খাজনা লুঠের ঘটনায় কোম্পানির লোকজন সন্ন্যাসীদের খোঁজে চারদিকে সিপাহী পাঠায়। তারই একটি দল সন্ন্যাসীদের খুঁজতে গিয়ে গিয়ে গভীর জঙ্গলে উপস্থিত হয়, এবং সত্যানন্দ ও মহেন্দ্র কে দেখতে পেয়ে গ্রেপ্তার করে।
এই সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। সত্যানন্দকে যখন সিপাহীরা গ্রেপ্তার করে নগরের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন পথমধ্যে সত্যানন্দ একটি ভক্তিগীতি গাইতে গাইতে যান। এই গানের মধ্যে বনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সন্তানদলের জন্য তিনি গোপন সংকেত রেখে যান।
জীবানন্দ সেই সংকেত বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ কল্যানী ও তার শিশু কন্যা সুকুমারীর কাছে উপস্থিত হন। সুকুমারীর দেহে তখনও প্রান ছিলো, তাই তৎক্ষণাৎ তাকে কোলে তুলে নিয়ে জীবানন্দ বোনের বাড়ি নিমির কাছে রেখে আসেন।
নিমির প্রকৃত নাম ছিলো নিমাই। তার কোন সন্তান ছিলো না। কাজেই সুকুমারীকে তিনি মানুষ করবেন বলে দাদার কাছ থেকে তাকে চেয়ে নেন। ঐ বাড়িতেই থাকতো জীবানন্দের স্ত্রী শান্তি। বোনের পীড়াপীড়িতে জীবনানন্দ শান্তির সঙ্গে দেখা করে আসেন এবং ব্রহ্মচর্য ভঙ্গের জন্য প্রায়শ্চিত্য করবার শপথ নেন।
এদিকে জীবানন্দ সুকুমারীকে নিয়ে চলে আসবার পরে বনের ঐ স্থানে হাজির হন ভবানন্দ। তিনি কল্যানীকে ঔষুধের দ্বারা বিষমুক্ত করে সুস্থ করে তোলেন। এরপর দূরসম্পর্কের এক দিদি গৌরিদেবীর কাছে তাকে রেখে আসেন। এরপরে শতশত সন্তানদল কারাগার ভেঙ্গে নগর আক্রমণ করে সত্যানন্দ ও মহেন্দ্রকে উদ্ধার করে।
এইসময় সত্যানন্দ তার শিষ্যদের কাছে গোপনে সংবাদ পেয়ে যান যে, মহেন্দ্রর স্ত্রী ও কন্যা দুজনেই সুস্থ আছে। পরে মহেন্দ্রকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন - তোমার স্ত্রী ও কন্যা জীবিত আছে। যে মহাব্রত তুমি পালন করবার শপথ নিয়েছ, তা পালন করবার পরেই তাদের সাথে তোমার সাক্ষাৎ হবে। মহেন্দ্র কন্যা ও স্ত্রীর চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে উঠলে, সত্যানন্দ তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, তার স্ত্রী ও কন্যা দুজনেই নিরাপদে আছে। সে যেন অনর্থক তাদের চিন্তা না করে। এইসময় সত্যানন্দ মহেন্দ্র কে ত্যাগের মহামন্ত্রে উজ্জিবিত করে তোলেন।
শান্তির সন্তান ধর্মে দীক্ষা গ্রহন
এদিকে জীবানন্দ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর জীবানন্দের স্ত্রী শান্তি সংকল্প গ্রহন করে, সেও সন্তান ধর্মে দীক্ষিত হবে। এখানে শান্তির পূর্ব পরিচয়টি একটু বলা প্রয়োজন।
জন্মের পরেই শান্তির মা মারা যান। তার পিতা ছিলেন একজন অধ্যাপক পন্ডিত। বাড়িতে বহু ছাত্রকে তিনি পড়াতেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই পুরুষ পরিবৃত হয়ে মানুষ হওয়ায় শান্তির মধ্যেও পুরুষদের পোশাক আশাক, পরিধান রীতি, শিক্ষা গ্রহণ ও অন্যান্য পুরুষালি গুনাবলী গুলি অনুকরন করবার প্রবনতা গুলি খুব ছোটবেলা থেকেই দেখা যেতে থাকে।
সে টোলের ছেলেদের সঙ্গেই খেলা করতো। মেয়েদের পোশাক না পরে সে ছেলেদের মতো করেই পোশাক পরতো। সর্বদা ছেলেদের সঙ্গে থাকবার ফলে তার মধ্যে পুরুষালি গুনাবলীর বিকাশ ঘটেছিলো। যাইহোক, শান্তি যখন যুবতী হন তখন তার পিতা মারা যান। এমতাবস্থায়, অভিভাবকহীন শান্তিকে ঐ টোলেরই এক ছাত্র তার বাড়িতে আশ্রয় দেন এবং তাকে বিবাহ করেন। এই ছাত্রটি পরে সন্তানধর্মে দীক্ষা নিয়ে জীবানন্দ নামে পরিচিত হন।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই সন্তান ধর্মে দীক্ষা নেবার বাসনা দীর্ঘদিন ধরেই শান্তির মনে ছিলো। একদিন সত্যি সত্যিই সে গভীর রাত্রে পুরুষের ছদ্মবেশ ধারন করে আনন্দমঠে সত্যানন্দের কাছে হাজির হন এবং সন্তান ধর্মে দীক্ষা নেবার বাসনার কথা জানান। নির্দিষ্ট এক শুভদিনে সত্যানন্দ মহেন্দ্র ও শান্তিকে সন্তান ধর্মে দীক্ষা দেওয়ার কথা জানান।
সেই মতো সত্যানন্দ প্রথমে মহেন্দ্র কে সন্তান ধর্মে দীক্ষা দেন। তারপর তাকে পদচিহ্ন গ্রামে অস্ত্রভান্ডার তৈরি ও দূর্গ নির্মান করবার তাকে নির্দেশ দেন। অতঃপর ছদ্মবেশী শান্তিকে দীক্ষা দানের সময় সত্যানন্দ শান্তির ছদ্মবেশ ধরে ফেলেন। নারী হওয়ায় শান্তিকে সন্তান ধর্মে দীক্ষা দিতে সত্যানন্দ অসম্মত হলে, শান্তি শাস্ত্রীয় যুক্তিতে সত্যানন্দকে পরাভূত করেন এবং ইস্পাতের ধনুকে লোহার তারের গুন পরিয়ে তার যোগ্যতার পরীক্ষা দেন।
শান্তির পরীক্ষায় সত্যানন্দ সন্তুষ্ট হয়ে তাকে সন্তান ধর্মে দীক্ষা দেন এবং তার নতুন নামকরন করেন নবীনানন্দ। এখানে বলা প্রয়োজন, আনন্দমঠে জীবানন্দ এবং শান্তি পরস্পরকে চিনলেও দুজনেই এখানে সংযমের চরম দৃষ্টান্ত রাখেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের উর্দ্ধে উঠে তারা মহৎ আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ব্রহ্মচর্য পালন করেন।
ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ
এদিকে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলায় গভর্নর হয়ে আসবার পর সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দমনের জন্য উদ্যোগী হলেন। বিদ্রোহ দমনের ভার দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন টমাসের ওপর। টমাস দেশীয় জমিদার ও রাজাদের সৈন্য ও লাঠিয়ালদের সাহায্যে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দমনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করলেন।
শুরু হয় ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। এই যুদ্ধে সত্যানন্দ জীবানন্দ কে সন্ন্যাসী দলের প্রধান সেনাপতি ঘোষনা করেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শান্তি বৈষ্ণবীর ছদ্মবেশে ইংরেজ শিবিরে গিয়ে সমস্ত গোপন সংবাদ সংগ্রহ করে আনেন। ভয়ানক এই যুদ্ধে শেষপর্যন্ত সন্ন্যাসীদের জয় হয়। সমগ্র উত্তরবঙ্গ বিদ্রোহীদের দখলে চলে আসে।
প্রধান সেনাপতি জীবানন্দ মঠাধীশ সত্যানন্দকে নতুন রাজ্যের রাজা হতে অনুরোধ করলে, সত্যানন্দ তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, রাজা হওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমি ব্রহ্মচারী। ব্রহ্মচারী ই থাকতে চাই। তোমরা এবার স্ব স্ব কর্মে ফিরে যাও।
যুদ্ধ শেষে জীবানন্দ ও ভবানন্দের সহায়তায় মহেন্দ্র তার স্ত্রী ও কন্যাকে ফিরে পান। জীবানন্দ ও শান্তি আজীবন ব্রহ্মচর্যের ব্রত পালন করে অবশিষ্ট জীবন তীর্থদর্শন করে কাটিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ওদিকে সত্যানন্দ একাকি ফিরে আসেন আনন্দমঠে। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন এক মহান তেজস্বী পুরুষ। ইনি সত্যানন্দ প্রভুর গুরুদেব ছিলেন।
সত্যানন্দ ও মহাপুরুষ
ঐ তেজস্বী মহাপুরুষ সত্যানন্দকে বললেন - তোমার কাজ শেষ হয়েছে। এবার ফিরে চলো।
বিস্মিত হয়ে সত্যানন্দ বললেন - মুসলমান রাজ্য ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু হিন্দু রাজ্য তো প্রতিষ্ঠিত হয় নি।
মহাপুরুষ বললেন - হিন্দু রাজ্য এখন প্রতিষ্ঠিত হবে না। এখন ইংরেজ রাজা হবে। তোমরা দস্যুবৃত্তি করে মা র যুদ্ধ জয় করেছো। পাপের ফল কখনো ভালো হয় না। তোমরা দেশের উদ্ধার করতে পারবে না।
বিরক্ত, ক্ষুব্ধ সত্যানন্দ মহাপুরুষকে বললেন - যদি ইংরেজদেরই রাজা করবেন, তাহলে আমাদের দিয়ে এই দুষ্কর্ম করালেন কেন?
মহাত্মা বললেন - ইংরেজরা এখন বনিক। অর্থসংগ্রহেই তাদের মন। তারা রাজ্য শাসনের ভার নিতে চায় না। তারা রাজ্যে অভিষিক্ত হবে বলেই এই বিদ্রোহের আবশ্যক ছিলো।
মহাপুরুষ আরোও বললেন -
তেত্রিশ কোটি দেবতার পুজাকে যারা হিন্দু ধর্ম বলে মনে করে, তারা হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ জানে না। প্রকৃত হিন্দু ধর্ম জ্ঞানাত্মক, কর্মাত্মক নয়। এই জ্ঞান দুই প্রকার - বহির্বিষয়ক এবং অন্তর্বিষয়ক। অন্তর্বিষয়ক যে জ্ঞান সেটিই সনাতন ধর্মের প্রধান অংশ। কিন্তু বহির্বিষয়ক জ্ঞান আগে না জন্মালে অন্তর্বিষয়ক জ্ঞান জন্মাবার সম্ভবনা নাই।
স্থুল কি তা না জানলে সূক্ষ্ম কি তা জানা যায় না। এখন দেশে অনেকদিন থেকে বহির্বিষয়ক জ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই প্রকৃত সনাতন ধর্মও লোপ পেয়েছে। থেকে গেছে কেবল ৩৩ কোটি দেবতা পুজার লৌকিক অপকৃষ্ট কর্ম।
ইংরেজ বহির্ষয়ক জ্ঞানে অতি সুপন্ডিত। ইংরেজি শিক্ষায়, পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের শিক্ষায় এদেশের মানুষ যখন বহির্ষয়ক জ্ঞানে সুশিক্ষিত হয়ে উঠবে তখনই প্রকৃত ধর্ম আপনা আপনিই পুনরুজ্জীবিত হবে। যত দিন না হিন্দু আবার জ্ঞানবান, গুনবান আর বলবান না হয়, ততদিন ইংরেজ রাজ্য অক্ষয় থাকবে।
বলা বাহুল্য, আনন্দমঠ উপন্যাসের একেবারে অন্তিম লগ্নে বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দু ধর্মের যে প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেন, তা ছিলো সমস্ত রকমের সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে। লৌকিক আচার সর্বস্ব ধর্মকে তিনি হিন্দুধর্ম বলতে চান নি। প্রকৃত হিন্দু ধর্ম জ্ঞান আর গুনের ঐতিহ্যনুসারী। জ্ঞান আর গুনের সমন্বয়ে জড় থেকে সূক্ষ, সাধনা থেকে পরম সত্যে, আর সৃষ্টিশীলতা ও নান্দনিকতা থেকে সৃষ্টি সুখের অপার আনন্দে পৌঁছানোর অনুশীলনের নামই হলো - হিন্দুধর্ম। এর মৃত্যু নাই। আছে কেবল রূপান্তর।
সুতরাং সবশেষে এটা বলা যায়, আনন্দমঠের জন্য যে সমস্ত সমালোচক বঙ্কিমচন্দ্রকে সাম্প্রদায়িক বলে দেগে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তারা হয় বঙ্কিমচন্দ্রকে বোঝেন নি। নয়তো হিন্দুধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা কোনটাই ঠিকমতো বুঝতে পারেন নি।