ভারতে জাতীয়তাবাদের বিকাশে যে সমস্ত সাহিত্য গ্রন্থ গুলি অসামান্য অবদান রেখেছিলো, তাদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছিলো - "আনন্দমঠ"।
আনন্দমঠ - সংক্ষিপ্ত পরিচয় |
রচনা ও প্রকাশকাল
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা "আনন্দমঠ" উপন্যাসটি ১৮৮১ খ্রিঃ প্রথম "বঙ্গদর্শন" পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। পরে ১৮৮২ খ্রিঃ এটি বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়। বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রকে এই উপন্যাসটি বঙ্কিমচন্দ্র উৎসর্গ করেছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের জীবদ্দশায় আনন্দমঠের মোট ৫ টি সংস্করন প্রকাশিত হয়। প্রতিটি সংস্করন প্রকাশের সময় তিনি উপন্যাসটির কিছু কিছু পরিবর্তন করেছিলেন।
অনেকেই মনে করেন, আনন্দমঠের পঞ্চম সংস্করনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব কথা আছে, উপন্যাস লিখবার সময়ে সেইসব স্থানে ইংরেজের কথা বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন। কিন্তু পরে রাজরোষের হাত থেকে বাঁচবার জন্য রাজকর্মচারী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিম ইংরেজ শব্দগুলি কেটে দিয়ে সেখানে যবন শব্দটি জুড়ে দেন।
কেন ইতিহাস চর্চায় আনন্দমঠের সন্নিবেশ?
আনন্দমঠ উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তা ভারতীয় জনমনে এক প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। ভারতের ইতিহাসে আনন্দমঠ উপন্যাসটি যতটা দেশবাসীর হৃদয়ে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সঞ্চার ঘটাতে পেরেছিলো, আর কোন সাহিত্য তা ঘটাতে পারে নি।
পরাধীন ভারতবর্ষে দেশকে মা হিসাবে তুলে ধরে এবং দেশের জনসাধারণকে তার সন্তান হিসাবে আখ্যায়িত করে, মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনে এমন এক ভাবগত আদর্শের বিজ এই উপন্যাস বপন করে - যা সমগ্র ইংরেজ শাসনাধীন ভারতবর্ষে গন উন্মাদনার সঞ্চার করে এবং দেশের লক্ষ কোটি সন্তান যুবকদর স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই পরাধীন ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে আনন্দমঠ হয়ে উঠেছিলো - "ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গীতা"। এই উপন্যাসে কথিত "বন্দেমাতারম" ধ্বনি এবং "বন্দেমাতারম" সঙ্গীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে লক্ষ কোটি দেশপ্রেমিক স্বাধীনতার মহাযজ্ঞে আত্মহুতি দেন। পরাধীন ভারতবর্ষে মৃত্যুযজ্ঞের থেকেও, দুর্ধর্ষ ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য এক মহামন্ত্র এবং সঞ্জিবনী সুধার দরকার পড়েছিলো। বন্দেমাতারম ধ্বনি এবং সঙ্গীত দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই প্রয়োজন মিটিয়েছিলো।
মূলত দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই ঐতিহাসিক অবদানের সাক্ষ্য রেখে যাবার জন্য পরবর্তীকালে আনন্দমঠ উপন্যাসটি শুধু সাহিত্য চর্চার গোন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। পরবর্তীকালে ইতিহাস চর্চারও এক আকর উপাদান হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসটি আত্মপ্রকাশের পর নিজেই আরেক নতুন ইতিহাসের জন্ম দেয়।
আর ঠিক এই কারনেই আনন্দমঠ উপন্যাসটি শুধু বাংলা সাহিত্যের জগতেই শুধু নয়, ঐতিহাসিক মহলে পর্যালোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে "আনন্দমঠ" পড়বার, বোঝবার এবং উপলব্ধি করবার মূল সার্থকতা এখানেই।
আনন্দমঠ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট
আনন্দমঠ উপন্যাসটি উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছিলো। এর প্রেক্ষাপট ছিলো বাংলা ১১৭৬ সালের মন্বন্তর, যা "ছিয়াত্তরের মন্বন্তর" নামে পরিচিত। অর্থাৎ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং সন্ন্যাসী বিদ্রোহ - এই দুই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে বঙ্কিমচন্দ্র এই কাল্পনিক উপন্যাসটি লিখেছিলেন।
আনন্দমঠ উপন্যাসের প্রকৃতি ও চরিত্র
ঐতিহাসিক পটভূমির ওপর "আনন্দমঠ" রচিত হলেও, বঙ্কিম অবশ্য একে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলতে অস্বীকার করেছেন। ১৮৮৪ খ্রিঃ বঙ্গদর্শনে বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন - "আনন্দমঠ প্রকাশিত হইলে পর অনেকে জানিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন, ঐ গ্রন্থের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কিনা। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ঐতিহাসিক বটে.. কিন্তু ঐতিহাসিক রচনা আমার উদ্দেশ্য ছিলো না। সুতরাং ঐতিহাসিকতার ভান করি নাই। "
সাহিত্য সমালোচক এবং ঐতিহাসিকদের অনেকেই অবশ্য আনন্দমঠের প্রকৃতিগত দিকটি বিশ্লেষন করে একে ঐতিহাসিক উপন্যাসের বদলে রাজনৈতিক উপন্যাস বলতেই অধিক আগ্রহী।
- হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবন,
- ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠা,
- দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ, এবং
- অনুশীলনবাদ
আনন্দমঠ রচনার গ্রন্থঋন
আনন্দমঠের অনুবাদ
সংক্ষিপ্ত তথ্যে আনন্দমঠ
- হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবন,
- ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠা,
- দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ,
- অনুশীলনবাদ।
বন্দেমাতারম সঙ্গীত সম্পর্কে তথ্য
- ১৯০৫ খ্রিঃ স্বদেশী আন্দোলনে বন্দেমাতারম ধ্বনি ও সঙ্গীত ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিলো।
- পরবর্তীকালে সমস্ত জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী আন্দোলনেরই মূল দেশাত্মবোধক শ্লোগান ছিলো "বন্দেমাতারম" ধ্বনি ও সঙ্গীত।