বঙ্কিমচন্দ্র তার আনন্দমঠ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর সামনে বেশ কয়েকটি নতুন বিশ্বাস ও আদর্শ তুলে ধরেন, যা ভারতে জাতীয়তাবাদের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
জাতীয়তাবাদের বিকাশে আনন্দমঠের অবদান |
(১.) দেশকে জননী রূপে তুলে ধরা
আনন্দমঠ উপন্যাসে দেশকে "জননী" রূপে তুলে ধরে বঙ্কিমচন্দ্র বিমূর্ত জাতীয়তাবাদকে সর্বসাধারনের কাছে অনেক সহজ ও বোধগম্য করে তোলেন।
বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠের লেখেন, দেশ কোন জড় বস্তু নয়, দেশ হলো আমাদের মা। সত্যানন্দকে দিয়ে তিনি বলিয়েছেন, "জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদ্বপি গরীয়সী" অর্থাৎ জননী স্বরূপা জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও বড়ো।
(২.) মায়ের ৩ টি রূপ
আনন্দমঠে সত্যানন্দকে দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র মায়ের ৩ টি রূপের দর্শন করিয়েছেন।
- মা যা ছিলেন, অর্থাৎ মায়ের জগদ্ধাত্রী মূর্তি,
- মা যা হয়েছেন, অর্থাৎ মায়ের কালীমা মূর্তি এবং
- মা যা হবেন, অর্থাৎ মায়ের দশভূজা মূর্তি।
এই রূপ বিশ্লেষনের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র ভারতের অতীত ইতিহাসকে দর্শন করিয়ে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আধ্যাত্মবাদের সমন্বয় ঘটান।
(৩.) সন্তান ধর্মের আদর্শ
গর্ভধারিনী মায়ের মতোই দেশমাতা আমাদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান দিয়ে আমাদের ধারন করে আছেন। আমরা সকলেই তার সন্তান। সুতরাং পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মাকে মুক্ত করাই সন্তানদের প্রধান ব্রত।
আনন্দমঠ উপন্যাসে বর্নীত সন্তান দলের এই আদর্শ লক্ষ কোটি ভারতবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্তব্যবোধে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিলো।
(৪.) দেশপ্রেমের আদর্শ
বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠে দেশপ্রেমের এক নতুন সংজ্ঞা দেন। তিনি দেশপ্রেমকে আধ্যাত্মিক পর্যায়ে উন্নীত করে বলেন - দেশপ্রেমই ধর্ম এবং ধর্মই দেশপ্রেম। এই ধর্মের নাম সন্তানধর্ম।
(৫.) সন্ন্যাসের নতুন আদর্শ
বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠে সন্ন্যাসের নতুন সংজ্ঞা দিয়ে বলেন, সন্ন্যাসীর লক্ষ্য শুধু নিজ মুক্তি অর্জন নয়, সমষ্টির মুক্তি, সর্বোপরি দেশহিতৈষনা।
বঙ্কিম তার এই সন্ন্যাস ধর্মে গৃহীদেরও আহ্বান জানান। আনন্দমঠ উপন্যাসের এই প্রেক্ষাপট ভারতের লক্ষ কোটি যুবকদের ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়ে বিপ্লবী ভাবাদর্শে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করেছিলো।
(৬.) সশস্ত্র প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের শিক্ষা
বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য আবেদন নিবেদনের বদলে সশস্ত্র প্রতিরোধ এবং সংগ্রামের যে আদর্শ স্থাপন করেন, তা পরবর্তীকালে ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিলো।
(৭.) বন্দেমাতারম ধ্বনি ও জনজাগরন
আনন্দমঠের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ ছিলো এর বন্দেমাতারম ধ্বনি ও সঙ্গীত। এটি ছিলো দেশমাতা পূজনের ও সাধনার বীজ মন্ত্র। স্বদেশী আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত এই বীজ মন্ত্রের ওপর ভর করেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিলো।
মূল্যায়ন
সবশেষে বলা যায়, ভারতে জাতীয়তাবাদের বৌদ্ধিক প্রেক্ষাপট রচনার পাশাপাশি বিভিন্ন ভাবে তার বাস্তব রূপায়ন ঘটাতেও আনন্দমঠ প্রভূত ভাবে সাহায্য করেছিলো।
- আনন্দমঠের আদর্শেই ভারতে ১৯০২ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয় "অনুশীলন সমিতি"। ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র আনন্দমঠ থেকেই "অনুশীলন সমিতি" নামটি গ্রহন করেছিলেন। এই অনুশীলন সমিতি থেকেই ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনের জন্ম হয়েছিলো। প্রথম দিকে শরীর চর্চার উদ্দেশ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত হলেও, শেষের দিকে এর সদস্যরা শারীরিক শক্তি অর্জনের মধ্যেই নিজেদের সন্তুষ্ট রাখতে পারলেন না। তারা ব্রিটিশ রাজের ওপর সেই শক্তির প্রয়োগ ঘটাতে চাইলেন। এর ফলে আদর্শগত বিরোধ ঘটলো। ফলে পরবর্তীকালে বেশ কিছু সদস্য অনুশীলন সমিতি থেকে বেরিয়ে এসে গঠন করেন "যুগান্তর সমিতি" । যুগান্তর সমিতির নেতৃত্বেই সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের জন্ম হয়।
- আনন্দমঠ উপন্যাসে বর্নীত সন্তানদলের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই ভারতের লক্ষ লক্ষ তরুন যুবকরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রত্যেক যুবকদর কাছে আনন্দমঠ ছিলো অবশ্য পাঠ্য একটি বই এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের গীতা।
- এই উপন্যাসে বর্নীত শান্তি, কল্যানীর মতো চরিত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীকালে ভারতের বহু শিক্ষিত নারী স্বাধীনতা আন্দোলনে এগিয়ে এসেছিলেন। যাদের মধ্যে অন্যতমা ছিলেন - বীনা দাস, প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার, কল্পনা দত্ত।
- যে কোন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবথেকে বড়ো অস্ত্র হলো - জনজাগরন। আনন্দমঠ উপন্যাসের "বন্দেমাতারম" ধ্বনি ও সঙ্গীতকে ব্যবহার করেই পরাধীন ভারতবর্ষে ঘটেছিলো প্রকৃত জনজাগরন। ভারতের প্রতিটি স্বাধীনতা আন্দোলনে শুধুমাত্র বন্দেমাতারম ধ্বনি ও সঙ্গীতের অমোঘ টানে লক্ষ লক্ষ দেশবাসী দেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের সর্বস্ব পন করেন। পরাধীন দেশে বন্দেমাতারম ছিলো জনজাগরনের প্রকৃত মন্ত্র।
আনন্দমঠের এই বিরাট ঐতিহাসিক অবদানের দিকটি পর্যবেক্ষণ করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছিলেন,
যে তিনটি গ্রন্থ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অপরিসীম ভূমিকা নিয়েছিলো তার প্রথম দুটি ছিলো শ্রীকৃষ্ণের গীতা এবং বিবেকানন্দের রচনাবলী। অন্যটি নিঃসন্দেহে বঙ্কিমচন্দ্রের "আনন্দমঠ"।