ঔপনিবেশিক আমলে সংঘঠিত আদিবাসী বিদ্রোহ গুলির মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো সাঁওতাল বিদ্রোহ।
সাঁওতাল বিদ্রোহ |
সাঁওতালদের পরিচয়
- সাঁওতালরা ছিলো ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন একটি আদিবাসী সম্প্রদায়। উপজাতি সাঁওতালরা ভারতে কৃষিপদ্ধতির প্রথম আবিষ্কারক ছিলেন বলে কোন কোন গবেষক মনে করে থাকেন।
- সাঁওতালরা ৭ থেকে ৮ টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন। যেমন - হাঁসদা, মুর্মু, মান্ডি, কিস্কু,হেমব্রম, সরেন, টুডু ইত্যাদি। সাঁওতালদের নামের পদবীর সঙ্গে তাদের এই গোষ্ঠী পরিচয়ের উল্লেখ থাকে।
- সাঁওতালরা যৌথ সমাজ ব্যবস্থার ধারনায় বিশ্বাসী ছিলেন। একক কোন প্রচেষ্টা, উদ্যোগ বা অভ্যাস তাদের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে কখনই যুক্ত ছিলো না।
- সাঁওতালরা গ্রামে বসবাস করতেন এবং নিজেদের মধ্যে একজন সর্দার নির্বাচিত করে তার দ্বারা শাসিত হতেন। এই সর্দারকে তারা বলতেন গাঁও মাঝি। অর্থাৎ সাঁওতালরা স্বাধীন উপজাতীয় রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বসবাস করতেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগে এরা স্বাধীন ভাবেই থাকতেন।
- সাঁওতালরা অত্যন্ত পরিশ্রমী হয়ে থাকেন। সাধারনত আদিম পদ্ধতিতে কৃষিকাজ, বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে তা বিক্রি এবং শিকার ছিলো তাদের অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান অঙ্গ।
সাঁওতালদের নামকরন
সাঁওতালদের নামকরন এরূপ কেন হয়েছিলো, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা মতান্তর আছে। এ সম্পর্কে দুটি গ্রহনযোগ্য সম্ভাবনার কথা আমরা উল্লেখ করবো।
- অনেকে মনে করেন, সংস্কৃত "সামন্ত পাল" (সীমান্ত রক্ষক) শব্দটি মধ্যযুগে "সামন্ত আল" শব্দে পরিনত হয়। এর থেকেই সাঁওতাল শব্দের উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সাঁওতালরা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলার সীমান্তবর্তী অরন্য অধ্যুষিত দূর্গম অঞ্চলে বসবাস করে আসছিলেন।
- অনেকে আবার বলে থাকেন, মেদিনীপুরের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের "সাওন্ত"(সামন্ত ভূমি) নামক স্থানের অধিবাসী ছিলো বলেই সাঁওতালদের এইরূপ নামে অভিহিত করা হতো। সাওন্ত শব্দ থেকে কালক্রমে সাঁওতাল শব্দের (সাওন্ত - সাওতাল - সাঁওতাল) উৎপত্তি হয়েছিলো।
সাঁওতালদের আদি বাসভূমি
সাঁওতালরা আদিতে কটক, ধলভূম, মানভূম, বরাভূম, ছোটনাগপুর, পালমৌ, হাজারিবাগ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও বীরভূম অঞ্চলে যে বিশাল অরন্য ও পার্বত্যভূমি ছিলো সেখানে বসবাস করতো।
পরবর্তীকালে সাঁওতালদের অনেকে তাদের এই আদি বাসভূমি এলাকা ত্যাগ করে রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশে "দামিন ই কোহ" অঞ্চলে চলে আসে।
আদি বাসভূমি ত্যাগ ও অভিপ্রয়ান
১৭৬৫ খ্রিঃ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজমহল পার্বত্য এলাকার দেওয়ানী লাভ করার পরেও বিশেষ সুবিধা করতে পারে নি। প্রথমত, এই অঞ্চলটি ছিলো গভীর অরন্যে ঘেরা ও দুর্গম। দ্বিতীয়ত, রাজমহল পাহাড়ের উপরে পাহাড়িয়া নামে এক দুর্ধর্ষ উপজাতি বাস করতো। তারা মাঝে মধ্যেই সমতল ভূমিতে নেমে আসতো এবং কোম্পানির লোকজনকে আক্রমণ করতো। অনেক চেষ্টা করেও কোম্পানি পাহাড়িয়াদের বাগে আনতে পারে নি।
এমতাবস্থায়, সরকার রাজমহলের পাদদেশ এলাকায় একটি উপনিবেশ স্থাপন করবার পরিকল্পনা করে। ঠিক হয় রাজমহলের পাদদেশ এলাকায় জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন ও কৃষিজমি তৈরিতে পাহাড়িয়াদের উৎসাহিত করা হবে। এর ফলে সাপও মরবে আর লাঠিও ভাঙ্গবে না।
কেননা পাহাড়িয়ারা জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিজমি তৈরি করলে, একদিকে যেমন রাজমহল এলাকা থেকে রাজস্ব প্রাপ্তি হবে, অন্যদিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলে, পাহাড়িয়াদের বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়বে।
পরিকল্পনা মাফিক সরকার ঘোষনা করে পাহাড়িয়ারা যদি রাজমহলের পার্বত্য এলাকায় কৃষিজমি তৈরি করে বসতি গড়ে তোলে তাহলে ৩ বছর তাদের কাছ থেকে কোনরূপ কর আদায় করা হবে না। তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে সেখানে বসবাস করতে পারবে।
কিন্তু সরকারের এই ঘোষনা পাহাড়িয়ারা কানেই তুললো না। ফলে সরকারের পরিকল্পনা বানচাল হবার উপক্রম হলো। ইতিমধ্যে কর্নওয়ালিশ বাংলায় ১৭৯৩ খ্রিঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রচলন করে ফেলেছিলেন। সাঁওতালদের আদি বাসভূমি এলাকা গুলোকেও এই ব্যবস্থার মধ্যে আনা হয়েছিলো।
ফলে সাঁওতালদের আদি বাসভূমি এলাকায় জমিদার ও বহিরাগত লোকজন প্রবেশ করে তাদের নানা ভাবে বিব্রত করতে আরম্ভ করেছিলো। সাঁওতালদের ওপর জমিদাররা ধীরে ধীরে করের বোঝাও বাড়িয়ে দিতে শুরু করেন।
ইতিমধ্যে সরকার রাজমহলের পাদদেশ এলাকায় পাহাড়িয়াদের বসতি স্থাপনে আহ্বান জানিয়েছিলো, সেকথা আমরা আগেই বলেছি। পাহাড়িয়াদের প্রত্যাখ্যানের পর সাঁওতালরা রাজমহলের পাদদেশ এলাকায় বসতি স্থাপনে এগিয়ে আসে। সাঁওতালরা ভেবেছিল, রাজমহল এলাকায় তারা স্বাধীন ভাবে বসবাস করতে পারবে। কোন জমিদার, মহাজন এসে তাদের আর বিব্রত করবে না।
সাঁওতালদের অভিপ্রয়ানকে উৎসাহিত করার জন্য সরকার ঘোষনা করে, রাজমহলের পার্বত্য এলাকায় সাঁওতালরা সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে বসবাস করতে পারবে। তিন বছর তারা নিষ্কর জমি ভোগ করতে পারবে। তারপর তাদের ওপর রাজস্ব ধার্য করলেও, তার পরিমান হবে খুবই স্বপ্ন - নগন্য।
সরকারের এই ঘোষনায় এবং আদি বাসভূমি এলাকায় জমিদারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাঁওতালরা বরাভূম, শিখরভূম, বীরভূম, ধলভূম, সিংভূম, ছোটনাগপুর, পালমৌ, হাজারিবাগ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, থেকে দলে দলে সাঁওতালরা রাজমহলের পাদদেশ অঞ্চল অর্থাৎ দামিন ই কোহ তে আসতে আরম্ভ করে।
দামিন ই কোহ অঞ্চল
দলে দলে সাঁওতালদের আগমনের ফলে রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশ অঞ্চল জেগে উঠলো। সাঁওতালরা এখানে বনাঞ্চল পরিষ্কার করে তাদের বসতি ও কৃষিজমি তৈরি করে। তারা এই নতুন অঞ্চলের একটি নাম দেয়। সাঁওতালি পরিভাষায় যাকে বলা হতো - "দামিন ই কোহ" বা পাহাড়ের প্রান্তদেশ।
রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ভাগলপুর, বীরভূম এবং মুর্শিদাবাদের একাংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিলো "দামিন ই কোহ" অঞ্চল। সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রাক্কালে এই অঞ্চলে ছিলো সাঁওতালদের ১,৪৭৩ টি গ্রাম, যেখানে বসবাস করতো ৮২,৭৯৫ জন সাঁওতাল।
" দামিন ই কোহ" তে সরকারি নিয়ন্ত্রন
ধীরে ধীরে দামিন ই কোহ সাঁওতালদের কঠোর পরিশ্রমে একটি সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিনত হলে, শকুনের দৃষ্টির মতো সরকারের তীক্ষ্ণ নজর দামিন ই কোহতে পড়ে। ধীরে ধীরে সরকার দামিন ই কোহ অঞ্চলকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় নিয়ে আসে এবং জমিদারদের সহজ শর্তে জমির বন্দোবস্ত দিতে থাকে।
এর ফলে দামিন ই কোহতে বহিরাগত জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের প্রবেশ ঘটতে থাকে। সাঁওতালরা তাদের এলাকায় এইসব বহিরাগত লোকজনদের "দিকু" বলতো। জমিদার এই এলাকায় প্রবেশ করে ধীরে ধীরে সাঁওতালদের ওপর খাজনার পরিমান উত্তরোত্তর বাড়াতে থাকেন। এই সুযোগে মহাজনরা সাঁওতালদের চড়া সুদে ঋন দিতে থাকেন এবং তাদের জমি গুলি আত্মসাৎ করে নিতে থাকেন। এর ফলে দিকুদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের মধ্যে ক্রমশ ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে।
দামিন ই কোহ অঞ্চলে যাতে অবস্থার অবনতি না হয়, এবং শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে, সেইজন্য সরকার বারহাইতে বা বারহেটে প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপন করে। অন্যদিকে দীঘিতে একটি থানা স্থাপন করে। এই দীঘি থানার প্রধান দারোগা মহেশলাল দত্ত ছিলেন একজন অত্যাচারী দারোগা। দিকুদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেও সাঁওতালরা কোন সুবিচার পেতেন না।
বারহাইতে ছিলো সাঁওতাল পরগনার একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এখানে সপ্তাহে দুবার হাট বসতো। বহিরাগত ব্যবসায়ীরা এখানে সাঁওতালদের কাছে উৎপাদিত পন্য গুলি কিনতে আসতো। ধীরে ধীরে বারহাইত একটি সমৃদ্ধ বানিজ্য নগরী হয়ে ওঠে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারন
১৮৫৫ খ্রিঃ, ৩০ জুন সাঁওতাল পরগনা এলাকায় দিকু বিরোধী বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিলো। সাঁওতালদের এই বিদ্রোহের পিছনে একাধিক কারন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। যথা -
(১.) ক্রমাগত রাজস্ব বৃদ্ধি :-
দামিন ই কোহ এলাকায় সাঁওতালদের নিষ্কর জমির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইংরেজরা বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করেছিলো। কিন্তু সাঁওতালদের কঠোর পরিশ্রমে যখন এই অঞ্চলটি একটি সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিনত হয়ে উঠলো, তখন কোম্পানি সরকার এই এলাকাটিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় নিয়ে আসে।
জমিদাররা দামিন ই কোহ এলাকায় প্রবেশ করে ধীরে ধীরে সাঁওতালদের ওপর রাজস্বের পরিমান বাড়াতে থাকে। কিভাবে এই রাজস্বের পরিমান বৃদ্ধি করা হয়েছিলো, তা নীচের পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়।
দামিন ই কোহ তে ১৮৩৮ খ্রিঃ বাৎসরিক খাজনা ধার্য করা হয়েছিলো দু হাজার টাকা। ১৮৫১ খ্রিঃ সেটাই বাড়িয়ে করে দেওয়া হয় ৪৩,৯১৮ টাকা। ১৮৫৫ - ৫৬ খ্রিঃ রাজস্বের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা হয়। এর ফলে সাঁওতাল সমাজে ভয়ঙ্কর ক্ষোভের সঞ্চার হয় ।
(২.) মহাজনদের শোষন :-
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সরকার নগদ অর্থে রাজস্ব নিতো। আলোচ্য সময়ে গ্রামীন অর্থনীতিতে মহাজনরা ব্যাঙ্কারের ভূমিকা পালন করতো। তাই যেখানেই ইংরেজ সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন করেছিলো, সেইখানেই মহাজনী কারবার ফুলে ফেঁপে উঠেছিলো। দামিন ই কোহ এলাকাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলো না।
সাঁওতালরা বর্ধিত রাজস্ব মেটানোর জন্য মহাজনদের কাছে ছুটে যায় এবং সেই সুযোগে মহাজনরা সাঁওতালদের অজ্ঞতার ও সরলতার সুযোগ নিয়ে শতকরা ৩৩ টাকা চক্রবৃদ্ধির সুদে টাকা ধার দিতো, যে টাকা আর সাঁওতালরা কোন দিনই শোধ করতে পারতো না।
মহাজনরা সাঁওতালদের টাকা ধার দেবার সময়ে একটি বন্ড পেপারে টিপ ছাপ মেরে নিতো। এই বন্ড পেপারে "কামিয়াতি" ও "হারওয়াহি" র বদলে টাকা ধার দেওয়া হতো।
টাকা ধার দেওয়ার আগে মহাজনদের কিছু সম্পদ বন্ধক দিতে হতো। কিন্তু সাঁওতালদের কাছে সেই অর্থে মহাজনদের কাছে বন্ধক দেওয়ার মতো কিছু ছিলো না। তাই তারা "কামিয়াতি" ও "হারওয়াহি" র বদলে ঋন লাভ করতো।
- কামিয়াতিতে বলা হয়েছিলো - যতদিন না ঋন শোধ হয়, ততদিন সাঁওতালরা মহাজনদের জমিতে বেগার খাটতে অর্থাৎ বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য থাকবে।
- অন্যদিকে হারওয়াহি তে বলা হয়েছিলো - যতদিন না টাকা শোধ হয় সাঁওতালরা বিনা পারিশ্রমিকে মহাজনের জমিতে লাঙ্গল দিতে বাধ্য থাকবে।
এই দুটি প্রথা দ্বারা ধীরে ধীরে মহাজনরা সাঁওতালদের ঋনের ফাঁদে জড়িয়ে তাদের ক্রীতদাসে পরিনত করে ফেলে। ক্রমে সাঁওতালদের ওপর মহাজনদের শোষন মারাত্মক আকার ধারণ করলে সাঁওতাল বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।
(৩.) ব্যবসায়ীদের শোষন ও প্রতারনা :-
দামিন ই কোহ এলাকায় বহিরাগত বাঙালি ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের উৎপাদিত ফসল গুলি কিনতে হাট বসাতো। এখানে ব্যবসায়ীরাও সাঁওতালদের অজ্ঞতা ও সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ঠকাতো।
ব্যবসায়ীরা দুরকম বাটখারা ব্যবহার করে সাঁওতালদের কাছে জিনিস পত্রের লেনদেন করতো -
- কেনারাম - সাধারনত সাঁওতালদের কাছে কোন জিনিসপত্র কেনার জন্য এই বাটখারা ব্যবহার করা হতো। কেনারাম ছিলো বেশি ওজনের বাটখারা।
- বেচারাম - বেচারাম ছিলো হাল্কা ওজনের বাটখারা। ঐ একই পরিমান জিনিস সাঁওতালদের কাছে বিক্রির সময় ব্যবসায়ীরা এই বাটখারার প্রয়োগ করতো।
অনেক সময় বাটখারাতে ঠাকুরের সিঁদুর ঘষে ব্যবসায়ীরা সাঁওতালদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করতো। কিন্তু সাঁওতালরা যখন দিকুদের এই প্রতারনার বিষয় গুলি ধরে ফেলে ফসল বিক্রি না করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে, তখন ব্যবসায়ীরা জোর করে তাদের ফসল গুলি কেড়ে নিয়ে বিক্রি করতে বাধ্য করে। এর ফলে ধীরে ধীরে দিকুদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের ঘৃনা ও ক্ষোভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
(৪.) রেল কর্মচারীদের অত্যাচার :-
সাঁওতাল বিদ্রোহের (১৮৫৫) অল্প কয়েক বছর আগে থেকে (১৮৫৪) ভারতে রেলপথ নির্মানের কাজ শুরু হয়। এইসময় রেলপথ নির্মানের কাজে কঠোর পরিশ্রমী সাঁওতালদের কুলি হিসাবে কাজে লাগানো হয় প্রায় বিনা বেতনে বা নামমাত্র বেতনে। এজন্য সাঁওতালদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিলো।
তাদের এই ক্ষোভকে বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছিলো রেলপথ নির্মানে নিযুক্ত ইংরেজ অফিসার ও কর্মচারীদের নানা রূপ অত্যাচার। অনেক সময় অফিসারদের মনোরঞ্জনের জন্য সাঁওতাল রমনীদের ধরে নিয়ে আসা হতো। এছাড়া, প্রায়ই অফিসারদের উদর পূর্তির জন্য সাঁওতালদের হাঁস, মুরগী, ছাগল ধরে আনা হতো। এজন্য সাঁওতালদের কোন রূপ অর্থও দেওয়া হতো না।
এই সমস্ত কর্মকান্ড সাঁওতালরা দীর্ঘদিন মুখ বুজে সহ্য করলেও, ধীরে ধীরে এগুলি বারুদের স্তুপের মতো দিকুদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের ক্ষোভকে পুঞ্জিভূত করছিলো।
(৫.) প্রশাসনের অসহযোগীতা :-
সাঁওতালদের নিজস্ব উপজাতীয় রাষ্ট্র কাঠামোকে অস্বীকার করে ইংরেজ সরকার সম্পূর্ণ বিদেশী প্রশাসন যন্ত্র সাঁওতালদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলো। এজন্য সাঁওতালদের মনে অসন্তোষ থাকলেও, তারা তা মেনে নিয়েছিলো।
কিন্তু যখন ধীরে ধীরে এই প্রশাসন যন্ত্রের আসল চরিত্র প্রকাশ হয়ে পড়লো, তখন সাঁওতালরা যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে এবং বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।
কথায় বলে, ন্যায় বিচারের পথ বন্ধ হয়ে গেলেই মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সাঁওতালদের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিলো। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের কাছে কোন সুবিচার সাঁওতালরা পায় নি।
- বারহাইতে মূল প্রশাসনিক কেন্দ্র থাকলেও, সেখানকার রাজ কর্মচারী টি সাঁওতালদের অভাব অভিযোগের প্রতিকার ব্যতিত স্থানীয় জমিদারদের কাছে রাজস্বের হিসাব পত্রের দরাদরি নিয়েই অধিক ব্যস্ত থাকতেন।
- দীঘি থানাতেও কোন প্রতিকার পাওয়া যেতো না। সেখানকার দারোগা মহেশলাল দত্ত বাঙালি ও তার স্বজাতিকেই সব সময় সমর্থন করতেন এবং অভিযোগকারী সাঁওতালদের খুব করে শাসিয়ে দিতেন।
- আদালতেও কোন সুবিচার সাঁওতালরা পেতেন না। কারন উকিল, মোক্তার সবাই তাদের বিরুদ্ধে ছিলেন।
এমতাবস্থায়, যেখানে অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে ন্যায় বিচারের সব সম্ভাবনার পথ বন্ধ হয়ে যায়, তখন টিকে থাকার জন্য একটাই বিকল্প পথ খোলা থাকে, সেটা হলো বিদ্রোহ। সাঁওতালরা শেষপর্যন্ত তাই করেছিলো।
বিদ্রোহের সূচনা
১৮৫৫ খ্রিঃ শুরুর দিক থেকেই বিদেশী দিকুদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
(১.) মহাজনের আক্রমণ :-
মহাজনদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের ক্ষোভ ছিলো সবথেকে বেশি। কারন তারা ঋনের ফাঁদে ফেলে সাঁওতালদের পুরোপুরি ক্রীতদাসে পরিনত করেছিলো।
তাই সাঁওতালরা প্রথমে একের পর এক মহাজনদের আক্রমণ শুরু করলে, ভীত মহাজনরা দীঘি থানার দারোগা মহেশলাল দত্ত এবং পাকুরের জমিদারের দ্বারস্থ হয়। পাকুরের জমিদার ছিলেন প্রচন্ড অত্যাচারী। এর পর থানা সহ প্রশাসন যন্ত্রের সহায়তায় জমিদার, মহাজন শ্রেনী একত্রিত হয়ে সাঁওতালদের ওপর তাদের শোষনের মাত্রা আরোও বাড়িয়ে দিলেন।
(২.) সিধু ও কানুর আবির্ভাব :-
এই ঘটনায়, সাঁওতালদের ক্ষোভ আরোও বেড়ে যায়। তারা তাদের শত্রুদের চিনতে পারে। শুধু মহাজন নয়, সকল দিকুই যে তাদের শত্রু তারা তা বুঝতে পারে।
এই সময় সাঁওতাল সমাজে দুজন মহান নেতার আবির্ভাব ঘটে - সিধু ও কানু। এরা দুই ভাই ছিলেন। এই সময় তারা প্রচার করেন পর্বতের দেবতা মারাং বুরু তাদের স্বপ্নে দর্শন দিয়ে ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। তা তখনই সম্ভব হবে, যখন দামিন ই কোহ থেকে দিকুদের বিতাড়ন করা যাবে।
(৩.) বিদ্রোহের বিস্তার :-
সিধু কানু দিকুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে সংগঠিত করবার জন্য কয়েকটি পরিকল্পনা করেন। যেমন -
- তিনি সাঁওতাল গ্রাম গুলিতে "শালগেরো" বা শাল গাছের ডাল পাঠিয়ে তার স্বপ্নাদেশ ও "হুলের" বার্তা পৌঁছে দেন।
- ১৮৫৫ খ্রিঃ ৩০ জুন সিধু কানুর ডাকে ৪০০ টি গ্রাম থেকে ১০,০০০ সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে সমবেত হয়। এই মাঠ থেকে সিধু ও কানু দিকুদের বিরুদ্ধে হুলের অর্থাৎ বিদ্রোহের ডাক দেন।
- এর পরেই সাঁওতালদের বিদ্রোহ সহিংস প্রতিরোধের রূপ নেয়। প্রথমে তারা দীঘি থানার দারোগা মহেশলাল দত্ত কে হত্যা করে। তারপর খাজনা বন্ধ করে দিয়ে জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ীদের আক্রমন ও হত্যা করে তাদের এলাকা থেকে বিতাড়িত করতে থাকে।
- কালক্রমে এই বিদ্রোহ বাংলা, বিহার ও ঊড়িষ্যার সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকা গুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। কামার, কুমোর,তেলি,গোয়ালা প্রভৃতি নিন্মবর্গের অসংখ্য মানুষ এই বিদ্রোহে সামিল হয়।
- বিদ্রোহের মধ্য থেকেই প্রধান নেতৃত্ব হিসাবে উঠে আসেন - সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, ডোমন মাঝি, কালো প্রামাণিক।
বিদ্রোহ দমন
সাঁওতাল বিদ্রোহ ভয়ঙ্কর আকার ধারন করে ব্রিটিশ প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ জানালে, তা সরকারের পক্ষে কখনই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না। কারন সাঁওতাল বিদ্রোহ সফল হলে তার সাফল্যে অন্যান্য জনজাতি গুলি উজ্জিবিত হয়ে উঠবে এবং অচিরেই কোম্পানি প্রশাসন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে এসে পড়বে। সহিংস সাঁওতাল বিদ্রোহকে দমন করতে সরকার তাই নির্বিচার দমন নীতির আশ্রয় নেয়।
- ৫০ হাজার বিদ্রোহীদের মধ্যে ২৫ হাজার বিদ্রোহীকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়।
- সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব এই চার ভাই বীরের মতো যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যান।
- সাঁওতালদের গ্রাম গুলিতে আগুন লাগিয়ে এবং পাগলা হাতি লেলিয়ে দিয়ে বহু সাঁওতালদের হত্যা করা হয়।
ইংরেজ সেনাপতি জর্ডন নিজে স্বীকার করেছিলেন - "আমরা যা করেছিলাম তা যুদ্ধ নয়, গনহত্যা।" এত নির্মম, অমানবিক, বর্বরচিত দমননীতির বিরুদ্ধে কোলকাতার বাঙালি সম্পাদিত কোন সংবাদপত্রই এর সমালোচনা করে নি অথবা সাঁওতাল বিদ্রোহকে সমর্থন করে নি। একমাত্র হরিশচন্দ্রের হিন্দু প্যাট্রিয়ট ছিলো ব্যতিক্রমী সংবাদপত্র, যে সাঁওতাল বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিলো এবং সরকারের ঘৃন্য দমন নীতির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলো।
মনে রাখতে হবে, সাঁওতাল বিদ্রোহ লর্ড ডালহৌসির আমলে (১৮৫৬ খ্রিঃ) দমন করা হয়েছিলো।
সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব
সাঁওতাল বিদ্রোহের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি -
- সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধুমাত্র একটি আদিবাসী বিদ্রোহ ছিলো না, এটি ছিলো নিন্মবর্গের মানুষদের অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
- এই বিদ্রোহে সাঁওতালরা পরাজিত হলেও আত্মসমর্পণ করে নি। এই বিদ্রোহের গুরুত্বকে ব্রিটিশ সরকারও উপেক্ষা করতে পারে নি।
- তাই এই বিদ্রোহের পর সাঁওতালদের পৃথক উপজাতির স্বীকৃতি দিয়ে বাকি জনসমাজ থেকে তাদের আলাদা রাখবার জন্য "সাঁওতাল পরগনা" গঠন করে।
- ভাগলপুর ও বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে সাঁওতাল পরগনার গঠন করা হয়। এখানে খ্রিষ্টান মিশনারি ছাড়া অন্যান্যদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। মিশনারিরা যাতে সহজেই দুর্বিনীত সাঁওতালদের খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করে ব্রিটিশ অনুগত করে তুলতে পারে, সেজনই এই ব্যবস্থা করা হয়। সাঁওতাল সমাজ সমগ্র ব্রিটিশ শাসনকালে আর কখনোও একক ভাবে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে নি। ফলে ইংরেজদের যাবতীয় কূটনৈতিক পরিকল্পনা সফল হয়।
- ঠিক হয়, সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলে কোম্পানির কোন আইন কার্যকর করা হবে না। সাঁওতালদের গ্রাম প্রধান বা গাঁও মাঝিকে মেনে নেওয়া হয়। পুলিশের বদলে গাঁও মাঝিই গ্রামের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখবে, বলা হলো।
- সাঁওতালদের সব দাবি গুলিকেই মেনে নেওয়া হয়। এই সফল বিদ্রোহ তাই ভবিষ্যতের বিদ্রোহ গুলির কাছে অনুপ্রেরণা আর আত্মবিশ্বাসের বার্তা পৌঁছে দেয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য
সাঁওতাল বিদ্রোহের ৪ টি মূল বৈশিষ্ট্যের দিক উল্লেখ করা যায়। যথা -
- সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিলো একটি আদিবাসী বা উপজাতি বিদ্রোহ।
- বহু নিন্মবর্গের মানুষ এই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন।
- এই বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিলো বিদেশী দিকু বিরোধীতা অর্থাৎ জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বিরোধিতা করা।
- সহিংস প্রতিরোধ এই বিদ্রোহের অপর উল্লেখযোগ্য দিক ছিলো।
শব্দগত অর্থ বা পরিভাষা
- দামিন ই কোহ - পাহাড়ের প্রান্তদেশ। সাঁওতালদের বংশানুক্রমিক ভাবে ভোগ করা নিষ্কর জমি।
- দিকু - শত্রু। সাঁওতালরা বহিরাগত মহাজন, জমিদার ও ইংরেজ কর্মচারীদের দিকু বলতো।
- হুল - সাঁওতালি ভাষায় হুল কথার অর্থ হলো বিদ্রোহ।
- কেনারাম - বেশি ওজনের বাটখারা। সাঁওতালদের কাছে কোন জিনিস কেনার জন্য ব্যবসায়ীরা এই বাটখারা ব্যবহার করতো।
- বেচারাম - কম ওজনের বাটখারা। সাঁওতালদের কাছে কোন জিনিস বিক্রির সময় ব্যবসায়ীরা এই বাটখারা ব্যবহার করতো।
- কামিয়াতি - ঋনশোধ না করা পর্যন্ত মহাজনের জমিতে বেগার খাটাকে কামিয়াতি বলা হতো।
- হারওয়াহি - ঋন শোধে ব্যর্থ সাঁওতালদের মহাজনদের জমিতে বেগার খাটা সহ উপরি কিছু কাজও করতে হতো। একে হারওয়াহি বলা হতো।
- শালগেরো - শালগাছের ডাল, যা সাঁওতাল সমাজে প্রতিজ্ঞার প্রতীক ছিলো।
- সিধু কানু ডহর - সিধু কানুর সম্মান রক্ষার্থে নির্মিত জায়গা বা ভূমি।
- মারাং বুরু - সাঁওতালদের পর্বতের দেবতা।
কিছু অতিরিক্ত তথ্য
- সাঁওতাল বিদ্রোহের শ্লোগান - চল চল ভাগনা ডিহি।
- সাঁওতাল বিদ্রোহকে সমর্থন করে - হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা।
- সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন - লর্ড ডালহৌসি।
- সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয় - ১৮৫৫ খ্রিঃ ৩০ জুন।
- সাঁওতাল বিদ্রোহ দমন করা হয় - ১৮৫৬ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি মাসে।
- দীঘি থানার দারোগা ছিলেন - মহেশলাল দত্ত।
- সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন - সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, ডোমন মাঝি, কালো প্রামাণিক।